অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...
** দৃশ্যপট-১ **
অন্তর দরদর করে ঘামছে । আশ্চর্য ! সামান্য একটা কথা বলবে সীমানাকে; ফোনে বললেই ভাল হতো বোধহয়। ১১টার সময় সীমানার একটা ক্লাস শেষ হবে । সীমানাকে অবশ্য আগেই বলেছে দেখা করতে চায়। একটা হেল্প দরকার; ডাহা মিথ্যে কথা ।
অবশ্য মিথ্যেও নয়, সীমানার সাহায্যটা লাগবেই আসলে । নাহলে অন্তর যা বলতে চায় তা পরিপূর্নতা পাবে না ।
পাবলিক লাইব্রেরী হলো দেখা করার স্থান। অন্তর সেখানেই হাঁটাহাঁটি করছে । ইদানীং কম আসা হয় ইউনিভার্সিটি এরিয়াতে ।
বুয়েট থেকে এবছরই মাস্টার্স শেষ করে চাকরী খুঁজতেই বেশী মনোযোগী । এর মাঝেই সীমানার মুখটা বেশী বেশীই ভেসে ওঠে অন্তরের চোখের সামনে। এতদিন কমবেশী প্রতিদিনই দেখা হতো, তাই হয়ত তখন বিশেষ কিছু অনুভূতিগুলো এখনকার মত প্রবল রূপে পরিপূর্ণ মাত্রা পেয়ে ওঠেনি।
এতটাই মগ্ন ছিল যে সীমানা সামনে এসে দাঁড়ানোতে প্রায় চমকে উঠলো অন্তর।
- কি হলো ? চিন্তিত দেখাচ্ছে আপনাকে ? কেমন আছেন ?
সীমানা কলকলিয়ে ওঠে যেন ।
- ওহ ! খেয়াল করি নি আসলে । তোমাকে ,(তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে), মানে আপনাকে নীলাম্বরী শাড়িতে বেশ মানিয়েছে ।
একটু লাল হয়ে যাওয়া চেহারাটা এড়ায় না অন্তরের দৃষ্টিতে। তবে হতচকিত ভাবটা চট করে সামলে নেয় সীমানা ।
- কেন ডেকেছিলেন বলুন তো ? কোন সমস্যা ? আজকের এই আবহাওয়াতেও আপনি তো রীতিমত ঘেমে-নেয়ে একাকার !
- ওহ! একটা ইন্টারভিউ আছে আজ বিকেলে ।
একটা টিভি চ্যানেলে । তাই একটু চিন্তিত । আর একটু ছুটতে ছুটতে এসেছি; পাছে দেরী হয়ে যায় আর আপনাকে শুধু শুধু আমার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
সীমানা হাসে । অন্তর হারানো সাহসটা একটু ফিরে পেয়ে বলে উঠে,
- আবহাওয়াটা আসলেই সুন্দর ।
চলুন না একটু হাঁটি ?
দু'জনে হাঁটছে । সীমানার চোখে প্রশ্ন কিন্তু জিগেষ করছেনা । হঠাত থেমে গেল অন্তর । সীমানা এক কদম এগিয়ে গিয়ে পিছনে ফিরে থাকায় । অসাধারন সেই ভঙ্গিমা! অন্তর কিভাবে কি বলবে বুঝতে পারছেনা ।
- শোনো, তোমাকে আপনি করে বলতে ভাল লাগছেনা আজকে ! একটা কথা অনেক দিন ধরে বলল বলে ভাবছিলাম কিন্তু ... সীমানা, তোমাকে ভাল লাগে অনেক, আসলে অনেক বেশী...বুঝতে পারো ?
সীমানা ভেবে পায়না কি বলবে । ভীষণ লজ্জায় একছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করছে । এভাবে কেউ বলে নাকি !! কিন্তু সীমানা চলে যায়না ; কেঁপে ওঠা পল্লব নামিয়ে ফেলে ; ক্ষীণ গলায় বলে ,
- আরেকটু হাঁটলে কেমন হয় ?
** দৃশ্যপট-২ **
দু'পক্ষের কারো পরিবারকেই রাজী করানো গেলনা । অন্তর ভেবেছিল অন্তত তার পরিবারকে সম্মত করতে তেমন ঝামেলা হবে না; কিন্ত বড় ভাইয়ের এক কথা তার পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করতে হবে! ওদিকে সীমানার পরিবারও তড়িঘড়ি করে ওকে অন্যত্র বিয়ে দেয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিল। সীমানা আর অন্তর দুজনেই বেশ সীদ্ধান্তহীনতায় ভূগছে; কি করা উচিত এখন তাদের ?
সেদিনের ইন্টারভিউয়ের পর অন্তরের চাকরীটা হয়ে গেছে ।
ছ'মাসের প্রবেশন পিড়িয়ড শেষ হয়ে এখন বেতনটাও খানিকটা বেড়েছে। মেয়ে বলে সীমানা মুখ ফুটে বলতে পারছেনা হয়ত; কিন্তু অন্তরকে এখনই একটা কিছু করতে হবে । ও ফোন করে সীমানাকে; ওপাশে সীমানার ভারাক্রান্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। অন্তর ভাবে, এই মেয়েটাকে অনিশ্চয়তায় রাখার মানে নেই আর ।
- হ্যালো, সীমানা, শোনো , কাল সকাল ঠিক ১০টায় টি.এস.সি -তে আসবে ।
আমার কয়েকজন বন্ধুও আসবে; কাল আমাদের বিয়ে ।
** দৃশ্যপট-৩ **
- এ্যাই শোনো, এই ছবিটা তো ওপাশের দেয়ালে লাগানোর কথা ; তুমি এই দেয়ালে ঠোকাঠুকি করছ কেন ?
কোমরে হাত দিয়ে কপট রাগ প্রকাশ করল সীমানা ।
- জো হুকুম, রানী সাহেবা, এই বান্দা হাজির তোমার আজ্ঞা পালনের জন্য । বলতো এই বুকের জমিনে পেরেক ঠুকে দেই ?
- ধ্যাত ! তুমি না আজকাল বেশী বেশীই...
অন্তর আর সীমানার নতুন, ছোট্ট সংসারের হালচাল আজকাল এরকমই যাচ্ছে । দুটি প্রাণ বারে বারে একে অপরের কথায়, ছোঁয়ায় উষ্ণতা প্রাপ্ত হচ্ছে ।
ফ্রেমে বাঁধানো ওদের যুগল ছবি দিয়ে, সংসারটাও যেন ছবির মত গোছানো হয়ে উঠছে একটু একটু করে ।
** দৃশ্যপট-৪ **
একটা স্কুটারও পাওয়া যাচ্ছে না ! ঢাবিতে গতকাল ছাত্র-আর্মি গোলোযোগের উত্তাপ ছড়াচ্ছে খুব দ্রুত। অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে অন্তর , হসপিটালে যেতে হবে । হসপিটাল যেতে অন্তরের কখনই খুব ভাল লাগেনা । তাই খুব অস্থির লাগছে ।
একটা ক্যাবওয়ালাকে অনেকটা হাতে-পায়ে ধরে , ২০ টাকা বেশী দেয়ার কথা বলে রাজী করানো গেল অবশেষে ।
ছুটতে ছুটতে অপারেশন থিয়েটারের সামনে আসলো অন্তর । ধড়ফড় করছে বুক । ধপ করে বসে পড়ল পেতে রাখা একটা চেয়ারে । জেনী ভাবি এগিয়ে আসলেন ।
ওদের প্রতিবেশী । খুব বেশী বয়স্ক নন ওদের থেকে, অনেক বেশী বন্ধুভাবাপন্ন । অন্তর -কে দিনের বেশীরভাগ সময়ই তো অফিসে থাকতে হয়। যেদিন ভার্সিটিতে ক্লাস থাকে সেদিন তাও সীমানার সময়টা উড়ে চলে যায় কিন্তু অন্যান্য দিন জেনী ভাবি ছাড়া ওর চলেই না যেন।
- টেনশন করোনা ; সব কিছু নরমাল ...কিছুক্ষনের মধ্যেই অপারেশন শেষ হবে।
অভয় বাণী শোনালেন জেনী ভাবি ।
ঠিক ওই সময়ই অপারেশন থিয়েটার থেকে মহিলা ডাক্তার বার হয়ে আসলেন । অন্তর চোখে-মুখে প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল ।
- সব ঠিক আছে ? সীমানা ভাল আছে ?
স্মীত হেসে ডাক্তার বলেন,
- আপনিতো ভাগ্যবান, যান ভেতরে যেতে পারেন আপনি এখন, তবে শুধু আপনি যান প্রথমে...
এটার অপেক্ষাই করছিল অন্তর, ছুটে ভেতরে গেল ।
সীমানাকে অনেক ক্লান্ত দেখাচ্ছে ।
কিনতু অনেক পবিত্র ! ভীষণরকম মায়াবতী মনে হচ্ছে ওকে এখন। পাশে থেকে নার্স তোয়ালে মুড়ানো একটা ছোট্ট প্রাণ আলগোছে হাতে তুলে দিল অন্তরের হাতে। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটেনা অন্তরের । সীমানার দিকে তাকাতেই একটা স্বর্গীয় হাসির দেখা পেল । অন্তরের চোখে পানি ।
সীমানাকে যতটুকু ভালবেসেছিল অন্তর, তার সবটুকু কড়ায়গন্ডায় শোধ করে দিল যেন সীমানা আজ । অন্তরের হাতে ধরা তোয়ালে পেঁচানো, ছোট্ট শরীরটা অন্তরের নিজের সত্ত্বা আর সীমানার ভালবাসার মাধুর্যময় প্রকাশ । পৃথিবীতে যে নতুন শিশুটি জন্ম নিল, সে আর কেউ নয় তাদেরই কন্যা-শিশু !! যে অন্তরকে একসময় বাবা বলে ডাকবে, সীমানাকে মা । মেয়েকে সীমানার পাশে শুইয়ে দিয়ে, সীমানার কপালে আলতো চুমু দিল অন্তর ।
** দৃশ্যপট-৫ **
কন্যা সন্তানের কান্না-হাসির ভাষা বুঝতে বুঝতে অন্তর-সীমানার দিবা-রাত্রি কাটে এখন।
মেয়ের নাম কি রাখা হবে তাই নিয়ে ওদের দু'টিতে বেশ খুনসুটি হয়ে যাচ্ছিল ক'দিন আগে। অন্তর হসপিটালের সেই মুহুর্তটুকু ভুলতে পারেনি এখনও। ওর এক কথা, মেয়েকে সে প্রাপ্তি বলে ডাকবে। উদাত্ত কণ্ঠে, সীমানার দিকে দু'হাত প্রসারিত করে অন্তর বলে,
হে, নারী
ভালবাসা তোমার
যেন অভূতপূর্ব;
অধম আমি,
তোমাতে বিলীণ
হয়ে চিরঋণী,
এ তোমার নয়কো
প্রতিদান জানি,
স্বর্গীয় 'প্রাপ্তি' আমার
অবনত শিরে
তা মানি।
** দৃশ্যপট-৬ **
- তুমি যে কি বল না ! এই সবের দরকার নাই কোন ।
তুমি এমনিতেই ব্যস্ত থাকো সারাদিন । এখন মেয়েটাকে নিয়ে সময় কাটে , সামনেও কাটবে, তোমাকে তো খুঁজেই পাওয়া যায় না ...
অন্তরের খুব শখ হয়েছে মেয়ে কে মিডিয়া লাইনে আনবে । নিজে তো টিভি চ্যানেলে আছেই, তাই পরিচিতি অনেক । আজকাল এইটুকু ছেলে-মেয়েরা মডেলিং করে সুপার স্টার । আর ওদের মেয়েটা এত কিউট !!! সারাক্ষণ ওই ছোট্ট মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে ।
প্রাপ্তির বয়স এখন মোটে সাত মাস পার হয়েছে । সব কিছু চোখ বড় বড় করে দেখে। টিভিতে খবর হলে কিভাবে জানি বুঝে যায়, চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে । আবার যখন টিভি এ্যাডগুলো চলে, তখন তার খুশি আর ধরে না চেহারায়।
তাই অন্তরের শখ মেয়েকে ও টিভি পর্দায় দেখতে চায় ; আর সীমানার যত আপত্তি এখানেই।
(২য় পর্ব আসছে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।