শফিক হাসান
খবরটা কৌতুককর, কোনো সন্দেহ নেই। হবিগঞ্জে বিএনপির ২৫ জন নেতা একত্রে পদত্যাগ করেছেন! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা বিশাল খবর বটে! ঘটনার নায়করা নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বাংলাদেশ হচ্ছে সেই দেশ যে দেশে কেউই পদত্যাগ করতে চায় না। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে পিয়নের কাজ করা মানুষটারও পদত্যাগ খুবই অপছন্দের শব্দ। বরং পদকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চায় সবাই।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের সাথে সাথে পদদখলেরও মহোৎসব শুরু হয়। তাই তো রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অফিসে ছুটে যান, পদটাকে শক্তভাবে বাঁধতে। নিশিরাতে সাধারণত তস্কর সম্প্রদায় কাজকর্ম করতে পছন্দ করে। অন্য সম্প্রদায় একই পথ অবলম্বন করলে প্রশ্ন্ ওঠাই স্বাভাবিক। অফিস টাইমের বাইরে এতো তাড়াহুড়া কেনÑপ্রশ্ন করা হলে, ভিসি মহোদয়ের রেডিমেড বাণী পেতে দেরি হয় নাÑ‘এটা সার্বক্ষণিক পদ!’ রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিদের জবাব এমনই হবে, এতে কিছু বলার নেই।
সবার পদই যেন সার্বক্ষণিক। বাংলাদেশের বর্তমানে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল পালাক্রমে ক্ষমতায় যায়। গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী এ-দুটি দল একে অপরের প্রতি সবসময়ই বিরুদ্ধ মনোভাবাপন্ন। কেউই অন্যের ছায়াও মাড়াতে পারে না। কি আওয়ামী লীগ, কি বিএনপি।
উপরন্তু সদা তৎপর একে অপরকে খাদে ফেলার জন্য। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, অন্য দল জিগির তুলবেÑএই সরকার ব্যর্থ, অবিলম্বে পদ্যত্যাগ করতে হবে। জনগণ তাদের প্রত্যাখ্যান করেছে। পদত্যাগ না করলে অমুক দিন হরতাল!
জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করতে বিরোধীদল একের পর এক হরতাল করতেই থাকে। শুধু হরতাল নয়, যত রকমভাবে যা কিছু করা দরকার, কোনো কিছু করতেই পিছপা হয় না তারা।
এমনকি যদি বিদেশি প্রভুদের কাছে নালিশ জানাতে হয় তাও নির্দ্বিধায় করেন তারা। বানরের পিঠা ভাগ করার গল্পটা সবারই জানা। নিজে ভোগ করতে পারবে না তাই অন্যকেও দেবে নাÑএই মনোবাসনা থেকে ঠিকই বানরকে পিঠা ভাগ করতে দিতে চায়। তাতে আখেরে দুই পক্ষের কেউই লাভবান হয় না। বরং উল্টো হাসির বস্তুতে পরিণত করে নিজেদের।
শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার এই দুই নেত্রীর দুষ্ট সতিন সদৃশ ঝগড়াঝাটি যতটা দেশের মানুষের কৌতুকের বিষয়, তারচেয়ে অনেক বেশি বিরক্তির। দুজনের ঝগড়া এবং লোভের আগুনে পুড়তে হয় সাধারণ মানুষকেই। তাদের তো কিছুই হয় না। একজন পদত্যাগ করো পদত্যাগ করো বলে তারস্বরে চেঁচাবেন আর অন্যজন ঠিকই নিজ গদিতে হাওয়া লাগিয়ে বেড়াবেন আর আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পথ পরিষ্কার করতে নানারকম ফন্দি-ফিকির করবেন। ৪০ বছর বয়সী বাংলাদেশে এ পর্যন্ত কারোরই স্বেচ্ছায় পদত্যাগের ইতিহাস নেই।
এই যখন দুই দলের প্রধানের অবস্থা, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পদত্যাগ প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয় বৈকি। কেন পদত্যাগ করবে তারা, আমাদের ঐতিহ্যে তো পদত্যাগ শব্দটা নেই! রাজনীতির অভিধানে পদ আঁকড়ানোর ব্যাপার আছে কিন্তু কোথায় পদত্যাগ!
অবশ্য পদত্যাগকারী সেই ২৫ জন বিরল রেকর্ড করেছেন, কোনো সন্দেহ নেই। করেছেন না বলে রেকর্ড করতে বাধ্য হয়েছেন বলা যায়। হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়েছে। কিন্তু সেই কমিটিতে দলের যোগ্য ও ত্যাগী নেতারা স্থান পাননি! যাদের নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করা হয়, বিভিন্ন সময়ে ইট-পাটকেলটা ঠিকভাবে এগিয়ে দেন যে কর্মীরা দলে তাদের শ্রম ও মেধার মূল্যায়ন হবে না কেন? বঞ্চিত নেতাদের এই দুর্দশা সহচররা কীভাবে সইবেন! সুতরাং তারাও একযোগে পদত্যাগ করেছেন।
পদত্যাগ করেও কি শান্তি আছে! দলে যারা বড় পদ পেয়েছেন, তারা তো জেগে জেগে ঘুমান। যেন কিচ্ছুটি বোঝেন না! যেমন জেলা বিএনপির নতুন কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক বলেন, ‘সমস্যা থাকলে কেন্দ্রকে জানানো যেতে পারে অথবা অথবা নিজেদের মধ্যে কথা বলে সমাধানে আসা যায়। কিন্তু কী কারণে তারা একযোগে পদত্যাগ করলেন, তা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। ’ ১৫১ সদস্যবিশিষ্ট জেলা বিএনপির এই ২৫ জন নেতা পদত্যাগ করেছেন বলেই তো সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। তাও কমিটি গঠনের মাত্র তিনদিনের মধ্যে।
গত ৩০ এপ্রিল তারা পদত্যাগপত্র দলের কেন্দ্রীয় মহাসচিব বরাবর পাঠিয়েছেন। এই যুগান্তকারী পদক্ষেপে নিজ দলের নেতাকর্মীর পাশাপাশি নেত্রীকেও একটা মেসেজ দিতে পেরেছেন, দ্যাখো, কীভাবে পদত্যাগ করতে হয়!
সূত্র : প্রথম আলো, ৫ মে ২০১১
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।