আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শিক্ষানীতি ও মৌলবাদ বিকাশের যোগসূত্র



বাংলাদেশে ক্রমেই বেড়ে চলেছে মৌলবাদী আস্ফালন। আমরা হব তালেবান বাংলা হবে আফগান-এ শ্লোগান কিছুদিন আগেও সবসময়ই ধ্বনিত হত তাদের মিছিলে। এক পর্যায়ে ইসলামী শাসন বাস্তবায়নের নামে দেশব্যাপি তাদের সশস্ত্র মহড়া আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক চাপে জঙ্গিবাদী শীর্ষ নেতাদের বিচারের আওতায় আনা হলেও মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়নি। বরং ডালপালা মেলে নতুন মাত্রায় নতুন রূপে তা বিকশিত হচ্ছে।

সম্প্রতি বর্তমান সরকার প্রণীত পুঁজিবাদী ভাবগতধারা ও বৈষয়িক স্বার্থ বিকাশের লক্ষ্যে এদেশের গণ মানুষ ও ছাত্র সমাজের আকাঙ্ক্ষা বিরোধী শিক্ষানীতি এবং নারীর প্রকৃত মর্যাদা ও অধিকার বিহীন নারী নীতিকে কোরান বিরোধী আখ্যা দিয়ে আরও পশ্চাৎপদ ধারণা সংযোজনের দাবিতে তাদের সহিংস কার্যকলাপে এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে তাদের শিকড় অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। আমিনীর ডাকা হরতালে উপজেলা শহর থেকে শুরু করে বড় বড় শহর এমনকি খোদ রাজধানীতেও কওমী মাদ্রাসা ছাত্রদের ব্যাপক সহিংস অংশগ্রহণ ছিল। যা হোক,এটা এখানকার আলোচনার বিষয়বস্তু নয়। আলোচনার বিষয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় নীতিগুলো বিশেষ করে শিক্ষানীতি কীভাবে মৌলবাদী ভাব ধারাকে বিকাশের সুযোগ দিয়ে শক্তিশালী হতে সহায়তা করছে। আমিনীদের অপব্যাখার কারণে কোরান হাতে মাদ্রাসা ছাত্রদের রাজপথে সহিংস অবস্থান কিংবা বাংলা ভাই-মুফতি হান্নান-শায়খ রহমানদের অপব্যাখ্যার কারণে জঙ্গিবাদের উত্থান-শুধুমাত্র এরকম ধারনা পোষণ করা একেবারেই অনুচিত।

বরং মৌলবাদী-জঙ্গিবাদী কার্যক্রমকে কীভাবে রাষ্ট্রীয় নীতি সহায়তা করছে তাও বিচারের দাবি রাখে। তা না হলে গুটিকয়েক বাংলা ভাই-শায়খ রহমানদের বিচারের মাধ্যমে সাময়িক সমাধান মিললেও এক সময় তা চূড়ান্ত বর্বরতাকেই প্রতিষ্ঠা করবে। একটি গণতান্ত্রিক শিক্ষানীতি এদেশের ছাত্র-শিক্ষক-জনগণের পুরানো দাবি। উপনিবেশিক আমল থেকেই এর গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এদেশের সচেতন পন্ডিত মহল। কিন্তু পরাধীন ভারতবর্ষে,অখন্ড পাকিস্তানে এবং বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশেও এ দাবি বার বার উপেক্ষিত হয়েছে।

শাসন ক্ষমতা বদলের সঙ্গে সঙ্গেই নতুন কথায় পুরানো সুরে শিক্ষার অধিকারকে সংকুচিত করা হয়েছে। শিক্ষা মৌলিক মানবাধিকার হলেও সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষার আর্থিক দায়িত্ব যে সরকারের তা অস্বীকার করা হয়েছে। ফলে প্রতিটি শিক্ষানীতিতেই মৌলিক অধিকার শিক্ষার ভার রাষ্ট্র পুরোপুরি নেয়নি। বরং বিভিন্ন কৌশলে তা এড়িয়ে গিয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণকে বৈধতা দিয়ে প্রতিটি শিক্ষানীতিই একটি অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্যমূলক চরিত্র ধারন করেছে।

যার প্রভাবে এক দিকে যেমন মানবিক মূল্যবোধ-সামাজিক দায়বোধ বর্জিত যন্ত্র মানব তৈরি হচ্ছে অপর দিকে ব্যাপক মাত্রায় মৌলবাদী ধ্যান ধারনার স্ফীতি ঘটছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণের ফলে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কার্যক্রম মাত্র ৪৬ ভাগ সরকারি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে ইবতেদায়ি মাদ্রাসা,কিন্ডার গার্টেন,এনজিও,ইংলিশ মিডিয়াম সহ ১১ ধারার বিদ্যালয় হচ্ছে বাকি ৫৪ ভাগ বিদ্যালয়। প্রায় ১৬ হাজার গ্রামে কোন বিদ্যালয়ই নেই। আর সারা দেশে আঠারো হাজার ৭৯৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩১৭টি সরকারি।

অর্থাৎ মাত্র ১.৬৯ ভাগ সরকারি বিদ্যালয়ের মাধ্যমে মাধ্যমিক শিক্ষা পরিচালিত হয়। আবার এই বিদ্যালয় গুলোর বেশির ভাগই জেলা এবং উপজেলা শহরে অবস্থিত। গ্রামাঞ্চলে কোন সরকারি বিদ্যালয় নেই। বাকি ৯৮.৩১ ভাগ বিদ্যালয় বেসরকারি যার ব্যয় ভার বেশি হওয়ায় অধিকাংশ মানুষের পক্ষেই শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়না। তাই দরিদ্র সীমার নীচে বসবাসকারী ৪০ ভাগ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর এদেশে প্রায় বিনা বেতনে ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার একটা প্রবণতা ব্যাপক মাত্রায় লক্ষ্য করা যায়।

ফলে একদিকে মুনাফা লোটার জন্য শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো যেমন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে অপর দিকে ধর্মান্ধতার বিকাশের স্বার্থে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে কওমী মাদ্রাসা সহ বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা। বর্তমান শিক্ষানীতিতে একটি নতুন বিষয় যুক্ত হয়েছে-প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার এ সময়টাতে একটি শিশুর মনো-দৈহিক যে কাঠামো গড়ে ওঠে তা-ই পরবর্তী জীবনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে। এমন স্পর্শকাতর সময়ে শিশুদের মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডায় ধর্মীয় শিক্ষা দানের কথা বলা হয়েছে। ফলে শিশুটি একজন সামাজিক মানুষ হয়ে গড়ে উঠার আগে হয়ে উঠবে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের মানুষ।

মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে,দ্বীন ও ইসলামের ঐতিহ্যের প্রচার ও প্রসারের জন্য অনুকরণীয় চরিত্র গঠন এবং ইসলাম ধর্মের বিভিন্ন দিক,ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান,সংস্কার সম্পর্কে জনগোষ্ঠীকে সচেতন করা ও ধর্ম অনুমোদিত পথে জীবন-যাপনের জন্য তাঁদেরকে উদ্বুদ্ধ করার উপযোগী করে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলা। ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা অধ্যায়েও বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে এরকমই অভিমত দেয়া হয়েছে। উচ্চ শিক্ষা প্রসঙ্গে পূর্বের শিক্ষানীতি গুলোর সুরেই বর্তমান শিক্ষানীতির বক্তব্য হচ্ছে-বাংলাদেশে বর্তমানে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে ভর্তি ফি ও বেতন খুবই সামান্য। তাই এ শিক্ষানীতি প্রনয়ণকারীদের সুপারিশে সামান্য বেতন-ফি পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর বছর বাড়ানো হচ্ছে ভর্তি ও বেতন ফি। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে লেগেছে বিভাগ ভেদে ৮হাজার থেকে ১২ হাজার টাকা,জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪ হাজার৪০০ থেকে ১৬ হাজার ৪০০ টাকা,নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ২২হাজার টাকা।

এত টাকা খরচ করে শিক্ষা গ্রহণের সামর্থ্য এ দেশের বেশির ভাগ পরিবারেরই নেই। তাই মা’র হাতের বালা,বাবার হালের গরু-চাষের জমি বিক্রি করে যখন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে তখন তাদের দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে ইসলামী ছাত্র শিবির সহ বিভিন্ন মৌলবাদী ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের নিজেদের দলে টেনে নেয়। অপর দিকে চাঁদাবাজি,টেন্ডারবাজি,চুরি-ছিনতাইয়ের ভাগ,হলের সিট ইত্যাদি বৈষয়িক উপকরণ দিয়ে নিজেদের দল ভারি করে ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতাহীন ছাত্র সংগঠনগুলো। এ ভাবেই উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাড়ছে উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর আধিপত্য। পাকিস্তান আমলে সামরিক শাসক আইয়ূব খান কর্তৃক গঠিত শরীফ কমিশনের শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছিল,সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারনা রহিয়াছে তাহা শ্রীঘ্রই ত্যাগ করিতে হইবে।

যেমন দাম তেমন জিনিস-এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন,শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনি এড়ানো দুষ্কর। বাধ্যতা মূলক প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব বুঝাতে গিয়ে আইয়ূব খান বলেছিলেন,ধর্ম বিশ্বাসের অভাবে মানুষের সব সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। আইয়ূব খানের বাধ্যতামূলক ধর্মীয় শিক্ষা পাকিস্তান রাষ্ট্রের সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। বরং ১৯৭১ সালে মানবতা বিরোধী গণহত্যাকে ধর্মের দোহাই দিয়েই বৈধ বলা হয়েছিল। পরবর্তীকালে শিক্ষার সংকোচন নীতি ও সাম্প্রদায়িকরণের ফলাফল আজ সুস্পষ্ট।

কিছুদিন আগে পাঞ্জাবের গভর্নর সালমান তাসিরকে হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিবাদীরা। এরপর হত্যা করা হয় মন্ত্রী শাহবাজ ভাট্টিকে। সালমান তাসিরের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী বলেছিলেন,আজ যা হল আগামী পাঁচ বছরে তার হয়তো কোন অভিঘাত হবে না। কিন্তু ২৫ বছর পর হবে। এখন আমরা যা দেখছি তা ৩০ বছর আগে রোপিত বৃক্ষের ফল।

শিক্ষার অধিকার থেকে জনসাধারণকে বঞ্চিত করার কৌশল পাকিস্তানি শাসকরা যেমন নিয়েছিল,ধর্মীয় উগ্রতা বিকাশের সুযোগ যেমন তারা দিয়েছিল আজও তারই ধারাবাহিকতা বজায় রয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশেও। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারিকরণের কৌশল যে শ্রেণী বৈষম্যকে আরও প্রকট করে মৌলবাদী-জঙ্গবাদী ধারাকে বিকাশের সুযোগ করে দিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। পুঁজিবাদী অর্থনীতির শোষণ মূলক কাঠামোকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এ শিক্ষানীতি প্রনয়ণ করে যারা ভাবছেন যে এ শিক্ষানীতি সমাজকে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে তাদের ধারনা সঠিক নয়। কারণ এ শিক্ষানীতি প্রগতির নয় প্রতিক্রিয়াশীলদের শক্তিশালী করার হাতিয়ার। তাই এ অগণতান্ত্রিক,বৈষম্য মূলক,সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতিকে অবিলম্বে বাতিল করে বেসরকারিকরণ-বাণিজ্যিকীকরণ বিরোধী গণতান্ত্রিক,অসাম্প্রদায়িক,একই ধারার বিজ্ঞান মনস্ক শিক্ষানীতি প্রণয়ন করুন।

দেশটাকে নষ্টদের হাতে তুলে দেবার অধিকার নিশ্চয় আপনাদের নেই।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.