আদর্শটাকে আপাতত তালাবন্ধ করে রেখেছি
গত বছর বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষের মতামত নেওয়ার উদ্দেশ্যে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) ওয়েব সাইটে দেওয়ার সময় জানানো হয়েছিল, সে বছরেরই শেষ কিংবা ২০১০ সালের শুরু থেকে নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কার্যক্রম শুরু হবে। এত কম সময়ের মধ্যে শিক্ষানীতির ওপর মতামত সংগ্রহ, সেগুলো পর্যালোচনা ও সংসদে আলোচনার পর পাশ করানো- ইত্যাদি অনেক কাজ করে তারপর সেটার বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ থাকলেও সংশ্লিষ্টদের জোরালো উদ্যোগ ও আন্তরিকতা দেখে সেটাকে সম্ভবপর বলেই মনে হয়েছিল। ইতোমধ্যে ২০১০ সালের প্রথম কয়েকটি মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন কার্যক্রম সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে- শিক্ষানীতি কবে বাস্তবায়িত হবে?
শিক্ষানীতি প্রণয়নের ইতিহাস আমাদের দীর্ঘদিনের, কিন্তু বাস্তবায়নের ইতিহাস নেই বললেই চলে। এ সরকার বর্তমান শিক্ষানীতি কমিটি গঠনের সময়ই ঘোষণা দিয়েছিল যে, তারা শুধু শিক্ষানীতি তৈরি করেই বসে থাকবে না; সরকার এটির বাস্তবায়নও নিশ্চিত করবে। পরবর্তী সময়ে এমন কথাও শোনা গিয়েছিল, যেহেতু পূর্বের শিক্ষানীতিগুলোর আলোকে বর্তমান শিক্ষানীতিটি তৈরি হয়েছে, সেহেতু এর অনুমোদন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় না নিয়ে সরকার বরং বাস্তবায়নের দিকেই মনোযোগ দিবে বেশি।
তাছাড়া শিক্ষামন্ত্রী এটাও জানিয়েছিলেন, শিক্ষানীতি অপরিবর্তনীয় (rigid) কোনো বিষয় নয়; বরং সময়ের প্রয়োজনে এর মধ্যে নানা পরিবর্তন আসতে পারে। বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু হলে পরবর্তী সময়ে পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিলে সে অনুসারে পরিবর্তন করা যাবে। এ সমস্ত নীতিনির্ধারণী প্রক্রিয়াকে একজায়গায় আবদ্ধ না রেখে পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর শিক্ষামন্ত্রীর এ অ্যাপ্রোচ অভিনন্দনযোগ্য; কিন্তু বাস্তবায়নের যে সময়সীমা তিনি জানিয়েছিলে সেটা পূরণ না হওয়ায় শিক্ষানীতির ভবিষ্যৎ আমাদেরকে কিছুটা চিন্তিত করে বটে। এই শিক্ষানীতি পূর্বতন নীতিগুলোর ভাগ্যবরণ করতে যাচ্ছে কিনা, সেটা একটা ভাবনা তো আছেই (যদিও সেটা হবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস, কিন্তু বাস্তবায়ন কার্যক্রম শুরু না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি মেলে না); পাশাপাশি এই শিক্ষানীতি প্রণীত হওয়ার পর বেশ কিছু মহল থেকে যে ধরনের আপত্তি এসেছে, সেগুলোর কারণে সরকার কিছুটা পিছিয়ে গেল কিনা, সেটাও চিন্তার বিষয়। এটা ঠিক, শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন নিয়ে তড়িঘড়ি কিংবা দীর্ঘসূত্রিতা- কোনোটাই কাম্য নয়।
গত বছরের শেষ দিক থেকেই যখন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছিল, তখন সেটাকে তড়িঘড়ি বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু ইতোমধ্যে অনেকটা সময় পেরিয়ে যাওয়ায় এখন এটা দীর্ঘসূত্রিতার ফাঁদে পড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের আগে অবশ্য বেশ কিছু কাজ সম্পন্ন করতে হয়। প্রথম কাজটিই হচ্ছে সংসদে শিক্ষানীতিটি পাশ করানো। এ বছরের শুরুতে যে সংসদ অধিবেশন ছিল, শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য সেটাই সম্ভবত উৎকৃষ্ট সময় ছিল।
কিন্তু কী কারণে তা করা হলো না সেটি বোধগম্য নয়। ওয়েবে শিক্ষানীতি উন্মুক্ত করার পর বেশ সময় দিয়েই মানুষজনের মতামত আহ্বান করা হয়েছিল এবং অনেকেই তাঁদের মতামত বা পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সেই মতগুলোকে নিশ্চয়ই পরবর্তী সময়ে পর্যালোচনাও করা হয়েছে। যেহেতু এই শিক্ষানীতিটা পূর্বতন শিক্ষানীতিকে কেন্দ্র করে তৈরি করা, তাই নানাজনের মতামত পর্যালোচনা করে ‘চূড়ান্ত খসড়া’টাকে ‘চূড়ান্ত’ করে ফেলাটা খুব একটা সময়ের কাজ নয়। ভেতরের খবর জানি না, কিন্তু ধারণা করি সেসব কাজের সবই হয়ে গেছে।
এখন বাকি কাজটুকু করার পালা।
শিক্ষানীতি নিয়ে এই দীর্ঘসূত্রিতার আরো নানা কারণ থাকতে পারে, সব কারণ হয়তো আমাদের পক্ষে জানা বা আন্দাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু শিক্ষানীতি তৈরি ও বাস্তবায়নের সিদ্ধান্তের সাথে যারা জড়িত, অর্থাৎ শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি, শিক্ষামন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা উপদেষ্টা ও শিক্ষা-বিষয়ক সংসদীয় কমিটিসহ অন্যরা যদি এই প্রক্রিয়াটাকে দ্রুততর করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে আগামী বাজেট অধিবেশনের পর সংসদের যে শীতকালীন অধিবেশ অনুষ্ঠিত হবে, সেখানে এটি বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা মাধ্যমে পাশ করানোটা কঠিন হবে বলে মনে হয় না। সংসদে এখন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ, তারা চাইলে শিক্ষানীতিটাকে পাশ করিয়ে দিতে পারে। কিন্তু যেহেতু এটা দেশের একটা নীতির ব্যাপার এবং এই নীতির ওপর দেশের সার্বিক ভবিষ্যৎও অনেকটা নির্ভর করে, সেহেতু শিক্ষানীতি সম্পর্কে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার পরই এটাকে চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করা উচিত হবে।
শিক্ষামন্ত্রীর মনোভাবে অবশ্য সবার মতামত নিয়েই এটাকে চূড়ান্ত করার মানসিকতার দেখা মেলে, তবে এক্ষেত্রে বিরোধী দলেরও কর্তব্য আছে। শিক্ষানীতির ওপর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করে, এর বাস্তবায়নের সুবিধা-অসুবিধাগুলো বের করে এবং সে অনুযায়ী গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথনির্দেশ করে তাঁরা সেই দায়িত্বশীলতার প্রমাণ দিবেন বলে আশা করি। এই শিক্ষানীতির মূল অ্যাপ্রোচ ইতিবাচক, যদিও সেখানকার নানা সুপারিশ নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন মত রয়েছে। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। আর যে যে বিষয়ে দ্বিমত বা ভিন্নমত রয়েছে, সেগুলো বরং আলোচনায় বেশি বেশি উঠে আসা দরকার।
তাতে বিষয়গুলো বাস্তবায়নের সময় সরকার ভিন্নমতের দৃষ্টিভঙ্গিগুলো মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, সরকার সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখলে এ বছরের শেষ দিকে অর্থাৎ সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে শিক্ষানীতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। সংসদ সেটি পাশ করলে সাথে সাথেই বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা যাবে; না হলে হয়তো আবার সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠাতে হবে এবং কমিটির মতামতের পর হয়তো বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। জানি না সরকার এ ব্যাপারে কী চিন্তা করছে কিন্তু সব মিলিয়ে শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের পথে আরো বেশ খানিকটা পথ এগুতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। সরকার যদি এসব বিষয় মাথায় রেখে সেভাবেই পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ করে, তাহলে হয়তো আগামী বছরের শুরু থেকেই শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের কাজ শুরু করা যাবে।
স্বাধীনতার পর এতোগুলো বছর পার হয়ে গেলো, আমারা এখন পর্যন্ত একটা শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করতে পারলাম না- এই ব্যর্থতার দায়ভার আর বেশিদিন বহন করা উচিত হবে না।
২.
খসড়া শিক্ষানীতির ওপর মতামত পাঠানোর সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ড. এমাজউদ্দীন আহমদসহ অনেক বিদগ্ধ ব্যক্তি তাঁদের মতামত পাঠিয়েছেন এবং শিক্ষামন্ত্রী সেটাকে স্বাগত জানিয়েছেন। বিষয়টাকে নানাভাবেই দেখা যেতে পারে। নির্ধারিত সময়সীমা পার হয়ে যাওয়ার পর মতামত গ্রহণ করা উচিত কিনা সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। আবার এটাকে ইতিবাচকভাবেও দেখা যেতে পারে যে, শিক্ষানীতি অপরিবর্তনীয় কোনো বিষয় নয়, চাইলে যে কোনো সময় মতামত দেয়া সম্ভব এবং সরকারের সেটা গ্রহণ করার মানসিকতা রয়েছে।
সেক্ষেত্রে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ থাকবে, যদি সময় থাকে, তাহলে এখনো মানুষজনের মতামত গ্রহণ করা হোক। অনেকে সে সময় নানা কারণে মতামত দিতে পারেন নি। সেক্ষেত্রে তারা মতামত দেয়ার আরেকটি সুযোগ পাবেন। বিশিষ্টজনরা যেহেতু সময়সীমা পার হওয়ার পরও মতামত দিতে পেরেছেন, সময় ও সুযোগ থাকলে সাধারণ মানুষদেরও এই সুযোগটি দেয়া যেতে পারে।
পাশাপাশি এখন পর্যন্ত যে যে মতামত এসেছে সেগুলোও জনগণের সাথে শেয়ার করতে পারলে ভালো হয়।
শিক্ষানীতি নিয়ে পরস্পরের চিন্তাভাবনাগুলো বিনিময় করার কোনো আনুষ্ঠানিক বা নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম নেই। যেহেতু সবার মতামত এক জায়গায় অর্থাৎ শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির কাছে জড়ো হয়েছে, তাই সেগুলোও যদি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়, তাহলে একজন সহজেই অন্যের মতামতের সাথে নিজের মতামতটি মিলিয়ে নিতে পারবেন, প্রয়োজনে আরও নতুন কোনো মত থাকলে সেটিও দিতে পারবেন। মতামত নেয়ার সুযোগটি একেবারে বন্ধ করে না দিয়ে সেটি সারাবছর চলমান রাখতে পারলে আরো ভালো হয়। যেহেতু পরবর্তী সময়ে শিক্ষানীতিকে আপডেট করার বিধান রাখা হয়েছে, তাই সব মতামত এখনি গ্রহণ না করতে পারলেও পরবর্তী সময়ের জন্য সেগুলোকে বিবেচনা করা যেতে পারে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট জায়গায় ইমেইল বা ডাকে মতামত পাঠানো ছাড়াও অনেকে পত্রপত্রিকা, টকশো কিংবা ব্লগে তাদের মতামত দিয়েছেন, যেগুলো সংখ্যায় খুব একটা কম হবে না।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ মতামতও সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত মতামতগুলোর পাশাপাশি এগুলো সংগ্রহ করা ও সে অনুসারে মূল্যায়ন করা হলে শেষ পর্যন্ত লাভ-ই হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।