এক অসাম্প্রদায়িক উজ্জল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশ ও শিকড় সম্পর্কে সুনীল গংগোপধ্যায়ের "সেই সময়" উপন্যাসে গল্প আছে মজার তবে গাজাখুড়ি নয়। রবীঠাকুরের পরিবার কলকাতার সবচেয়ে প্রাচীন ব্রাক্ষ্মণ পরিবার। তাদের পূর্বপুরুষদের বলা হত "পীরালীর বামুন"। কারন তাদের পরিবারের সাথে একজন মুসলমান পরগনাদারের নাম যুক্ত আছে।
যশোরের সেনাপতি খান জাহান আলীর জনৈক হিন্দু কর্মচারীর(নাম জানা যায় নি) গভীর প্রনয় হয়েছিল এক মুসলিম নারীর সাথে।
তাকে বিয়ে করায় কর্মচারীটির জাত যায় এবং সে মুসলীম হতে বাধ্য হয়। কর্মচারীটির জন্ম পশ্চীমবংগের নবদ্বীপের পিরল্যা গ্রামে ছিল বলে পরে তার মুসলামানী নাম হয় পীর আলী। যদিও মুসলমান হবার পর তার খাতা কলমে নাম ছিল মামুদ তাহির। তবু তিনি পীর আলী নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন(কারণ তখনকার দিনে বাংগালীদের নামের সাথে পদবীর বদলে গোত্র ও গ্রামের নাম যুক্ত থাকার রেওয়াজ ছিল। গ্রামের নাম যেহেতু ছিল পিড়ল্যা তাই লোকমুখে বলতে ভলটে হয়ে গেল পীর আলী)।
এই পীর আলীকে খান জাহান আলী ভালবেসে "চেঙ্গুঠিয়া"নামে একটি পরগনা মুসলীম হওয়ার পুরস্কারসরূপ দান করেন। পরগনাদার হিসেবে তিনি বেশ খ্যাতি কুড়ান।
কামদেব ও জয়দেব নামে দুই দেওয়ান কাজ করত তার পরগনায়। তারা একদিন এক ভয়ানক রসিকতা করে বসল পীর আলীর সাথে। রোজার মাস।
রোজাদার পীর আলীর হাতে ছিল একটি গন্ধ লেবু,মাঝে মাঝে তিনি তা শুকছেন এবং সবার সাথে কথা বলছেন। এমন সময় জয়দেব ও কামদেবের মাঝে কেউ ১জন বলল,"উজির সাহেব,আপনার আজকের রোজা তো ভংগ হয়ে গেল। "
পীর আলী বিষয়টি জানতেন না। অবাক পীরকে তখন ব্যাখ্যা দেয়া হল ঘটনার। শাস্ত্রমতে,"ঘ্রাণেন অর্ধ ভোজনম্"মানে গন্ধেই আহার হয়।
তাই রোজা হল না।
চালাক পীর আলী কামদেব ও জয়দেবকে জব্দ করার জন্য এক কৌশল নিলেন। একদিন পীর আলী দরবারে ভু হিন্দুকে নিমন্ত্রন করলেন। কথাবার্তার এক ফাকে ভৃত্তকে ইসারা করলেন। একটু পরই দরবার কক্ষে আনা হল কয়েকটি জলন্ত উনুন।
উনুনের উপর কড়াইতে গরুরমাংস রান্না হচ্ছে। গরুর মাংসের গন্ধ পেয়ে অনেক হিন্দু নাকে কাপড় দিলেন,সভা ছেড়ে পালালেন,কিন্তু পীর আলী চেপে ধরলেন কামদেব আর জয়দেবকে। বললেন"তোমরা পালাচ্ছ কেন?শাস্ত্র মতে তোমাদের ও অর্ধ ভোজন হয়েছে। এবং সে অনুযায়ী তোমাদেরও জাত গ্যাছে। "
ধর্মান্তরিত হবার পরে তাদের নাম হল জামালউদ্দীন ও কামালউদ্দীন।
কিন্তু ধর্মান্তরিত হবার পরও তৎকালীন রক্ষনশীল ও কড়া হিন্দু সমাজের হাত থেকে তাদের আত্মীয় স্বজন কেউ নিস্তার পেল না। তারা মুসলমান হয়ে বাঁচলেও তাদের আত্মীয় স্বজনরা কেউ হল কোনঠাসা কেউ হল একঘরে। তাদেরকে কেউ পুরো বামুন বলত না,বলত পীরালীর বামুন। কামদেব আর জয়দেবের দুই ভাই রতিদেব ও সুখদেব সমাজের অত্যাচার সইতে না পেরে একজন করে গৃহত্যাগ আরেকজন টাকার জোরে সমাজে টিকে থাকলেও পীরালী অপবাদ ঘোচাতে পারল না। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম তারা বয়ে চলল এ অপবাদ।
সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে এই বংশের ই দুই ভাই পন্চানন ও শুকদেব কাজের সন্ধানে আসে স্বগ্রাম ছেড়ে। ঘুরতে ঘুরতে তারা আসে গোবিন্দপুর খাড়িতে। সেখানে ছিল তখন কেবল কয়েকঘর জেলে,মালো কৈবর্তের বাস। পরিধানে পটবস্ত্র,মাথায় শিখা,অতিশয় গৌর বর্ন ও ললাটে চন্দন পরিহিত ব্রাক্ষ্মণ দেখে সেখানকার অধিবাসীরা এসে সাস্টাঙ্গে প্রনাম করতে লাগল। গ্রামে ব্রাক্ষ্মণদের আশ্রয় দেয়া পুন্যের কাজ।
সেখানে তাদের ঠাঁই হয়ে গেল। তখন গ্রামের মানুষ ভক্তিভরে তাদের ডাকতো "ঠাকুর" বলে।
গোবিন্দপুর,সুতানটি ও কলকাতা নামে তিনটি গ্রাম জুড়ে ইংরেজরা তখন কেবল নতুন একটি শহরের পত্তন করেছে । গোবিন্দপুর খাঁড়ি দিয়ে জাহাজ চলাচলের জন্য এটিকে কেটে পশস্ত করা হচ্ছে। গ্রামের লোকদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য সাহেবরা যখন আসে তখন গ্রামের লোকেরা তাদের সাথে কথা বলার সাহস না পেয়ে এগিয়ে দেয় তাদের "ঠাকুর"দের।
সাহেবরা সঠিক উচ্চারণ করতে পারে না,বলে 'টেগোর'। সেই থেকে ঘুচল তাদের বংশীয় অপবাদ ''পীরালীর বামুন" । সেই থেকে পরিচিত হল তারা ঠাকুর নামে। এভাবেই শুরু। পরবর্তীতে ইংরেজদের সাথে যোগাযোগ ও কর্ম দক্ষতার সুবাদে প্রজন্মান্তর ধরে ঠাকুর পরিবার হয়ে গেল কলকাতার শ্রেস্ঠ ধনী।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।