বাংলাদেশ কে ভালোবাসি
আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির একটি বড় অংশ নিঃসন্দেহে চলচ্চিত্র ! আমাদের প্রিয় ভূখন্ডে এই শিল্পটির সূচনা , পথচলা , উৎকর্ষতা এবং মুখ থুবড়ে পড়া এবং এই মুখ থুবড়ে পড়ার পেছনে আমাদের করনীয় কিংবা আমাদের সচেতনতা অথবা যুক্তিযুক্ত সমালোচনার অভাব কি দায়ী নয় ??? চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্প যেখানে দর্শকরাই প্রাণ ! একটু পেছন থেকেই আসতে চাই !
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল সেই সময়কার প্রাদেশিক পরিষদে শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আইন পরিষদের অধিবেশনের শেষ দিনে একটি বিল উপস্থাপন করেন .'Sir, I beg to move that the East Pakistan film development corporation bill, 1957 be taken into consideration .....' ! অল্প কিছু সংশোধনীর পর 'পূর্বপাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা' নামে বিলটি বিনা বাঁধায় পাশ হয় । যদিও তার আগেই ১৯৫৬ সালের ৩রা আগষ্ট মুক্তি পায় প্রথম সবাক চলচ্চিত্র “মুখ ও মুখোশ “ । যার শুভ উদ্ভোদন করেন তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ! ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল ঢাকার সদরঘাট এলাকার রূপমহল সিনেমা হলে !
চলচ্চিত্রকর ইঙ্গমার বার্গম্যান বলেছিলেন, 'Film as dream, film as music. No art passes our conscience in the way film does, and goes directly to our feelings, deep down into the dark rooms of our souls.'
আর আমার ভাষায় চলচ্চিত্র এমন একটি শিল্প যেখানে জীবনবোধ আর আমাদের জীবনের গল্পগুলো ফুটে উঠবে গতিময়তার মাঝেই ! নিঃসন্দেহে বিনোদন ই এর মুখ্য উদ্দেশ্য ! আর শিল্পের চেয়ে বড় বিনোদন হতেই পারেনা !
১৯৫৭ সালের সেই আইনগত ভিত্তি কিংবা ” মুখ ও মুখোশ “ দিয়ে আমাদের পদচারণা!
একটি দেশের চলচ্চিত্র সে দেশের মাটির গন্ধ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ায় ! পাশের দেশের চলচ্চিত্র শিল্প তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম আয়ের উৎস ! সেখানে আমরা কতটা পিছিয়ে ? এর জন্য একান্ত ব্যক্তিগতভাবে আমি দায়ী করবো আমাদের কেই , দর্শকদেরকেই ! এখন ২০১৩ সাল ! ১৯৫৬ সালে যাত্রা শুরু হবার পর চলচ্চিত্র কি একই রকম ছিল ? মোটেই না , বিশ্বের আর সব দেশের মত আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ও এগিয়েছে যুগের ফ্যাশনের সাথে তাল মিলিয়েই ! কিন্তু কোথায় যেন মুখ থুবড়ে পড়েছে আর আমরা দেশপ্রেমিক বাংলাদেশীরাও সেখানে ফেলেই চলে এলাম !
আমরা কখনই বুঝতে চাই নি এটা শুধুমাত্র বিনোদন নয় , কারো জন্য ব্যবসাই শুধু নয় , এটা হতে পারে আমাদের নিজস্বতার আরেকটি শক্তিশালী প্রতীক ! আমি নিজেও পাত্তা দিতাম না ! মুভি দেখতে মন চাইলে লেটেষ্ট কোন হিন্দি কিংবা হলিউড আর মন চাইলে কলকাতা ভিত্তিক কিছু আর্ট ফিল্ম , যেটা দেখে আরাম পাওয়া যায় ! খুব খারাপ লাগছিল যে কারণে এই পোষ্টের অবতারণা ! ফেসবুকে এক ভারতীয় বন্ধুর সাথে নান বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো , আমাদের ইতিহাস , আমাদের সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম , আমাদের প্রিয় ক্রিকেট দল এই জিনিসগুলো নিয়ে বেশ ভালো ভাবেই রাজস্থানী ঐ বন্ধুকে তর্কে হারিয়ে দিচ্ছিলাম প্রায় ! চলচ্চিত্র কথাটা উঠতেই আমি থমকে গেলাম , এই সময় টায় আমার হাতে কি পর্যাপ্ত কিছু আছে তর্ক করার মত , আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে ?? জীবনে প্রথমবার অনুভব করলাম “আমাদের চলচ্চিত্র !!! ” । কিছুক্ষণ চুপ থেকে চোরাবালির কথা বললাম , আমার ছোট্ট অভিজ্ঞতার ভান্ডার থেকে হূমায়ুন আহমেদের কিছু ছবির কাহিনী আর নির্মান নিয়ে কথা বললাম আর বললাম আমাদের দীর্ঘশ্বাস সালমান শাহ্ এর গল্প ! খুবই অপ্রতুল এবং বিপরীত ধারার , যেখানে এগুলোই হতে পারতো মূল ধারার !
ঐ বন্ধুর সাথে আমার আলাপচারিতা এগিয়ে নিতে অপ্রস্তুত লাগছিল ! ভাবছিলাম ছোটবেলার কথা, যখন প্রতি শুক্রবার হলেও একটি করে সিনেমা আমি দেখতাম , কেমন লাগতো সেসব ?
অবচেতন মন উত্তর দিলো ... ভালোই তো ছিল , দেখে হাসতাম , কাঁদতাম আবার মাঝে মাঝে দেশ নিয়ে আবেগী হয়ে উঠতাম ! একজন সালমান শাহ্ মারা যাবার পর আমার ফুফু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছিল ! প্রশ্ন জাগলো ৯৬ সালের আগের চলচ্চিত্রের ধারাটা কেমন ছিল , কিংবা কোথায় থমকে গেল আর এখনকার অবস্থা ! একটা সময় মনে হলো এই শিল্পটা নিয়ে আমাদের অনীহাই এর ভরাডুবির প্রধান কারণ !
তারপর নেট ঘেটে আর ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ এবং একই সাথে ৭০ দশকের বাংলা ছবি দেখা কয়জনের সাথে আলাপ করলাম ! ১৯৫৭ সালের পর আমাদের চলচ্চিত্র আসলেই শিল্প ছিল ! ৬০ কিংবা ৭০ দশকের সিনেমা গুলো ও সেই প্রজন্ম ভালোভাবে নিয়েছে , আমি নিজে খুব কম দেখেছি তাই সেই সময়কার কোন নামকরা অভিনেতার কথা বলতে চাচ্ছিনা ! ৮০’র দশকের পর ও আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প ভালোই পাল্লা দিচ্ছিলো পাশের দেশের সিনেমার সাথে !
৯০ এর শুরু কিংবা মাঝামাঝি সময়টার ছবিই সম্ভবত আমি সবচেয়ে বেশী দেখেছি ! একটা সিনেমা তৈরীর পেছনে একজন প্রযোজকের অর্থ থাকে ! তাই উনি ব্যাবসায়ীক দিক টা দেখবেন ই ! দর্শক ভালো ছবি দেখবেন , নিজের টাকা খরচ করে কেউ অখাদ্য দেখবেনা !
একটা সময় বাণিজ্যিক আর শৈল্পিক এই দুই ধারার ধারণাই আমাদের পতনের মূল কারণ ! প্রকৃত অর্থে ভালো ছবি কথাটাই যথেষ্ট ,ব্যবসা এবং শিল্প দুটাই রক্ষা করার জন্য ! একটি ভালো ছবির পেছনে থাকে কাহিনী , চিত্রনাট্য , দক্ষ পরিচালক এবং অভিনেতা এবং অভিনেত্রী !
আমাদের চলচ্চিত্রে বর্তমানে একটা ও নেই ! যে ছবি দেখলে বুঝার উপায় থাকবেনা কেউ অভিনয় করছে , সেটাই দর্শক অনুভব করবে ! হঠাৎ করেই আমাদের চলচ্চিত্রে মানসম্পন্ন অভিনেতা –অভিনেত্রীর একটা ঘাটতি দেখা দেয় ! মন্দা একটা পরিবেশ তৈরী হয় ! তখনই মূলত বাণিজ্যিক আর আর্ট ফিল্ম এই ধারার সুচনা হয় ! একটা সময় মনে করা শুরু হয় অশ্লীল কিছুই মনে হয় দর্শক বেশী খাবে , “যৌবন একটা লাল টমেটো “ টাইপ সংলাপ আমাদের রুগ্ন শিল্প টাকে শুধু ধর্ষণ ই করেছে , কিন্তু শারীরিক আবেদনের ব্যাপার টাকেও যে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা যায় সেটা আমাদের চলচ্চিত্র বোদ্ধারা আজ ও বুঝতে পারেনি ! আর সেই পতনই এখনো হচ্ছে ! অশ্লীলতার ধারাটা কমে এসেছে মনে হয় কিন্তু যুগের সাথে তাল মিলানো কিংবা একটি ভালো শিল্প উপহার দেয়া আর হচ্ছেনা ! ভালো পরিচালকরা এক সময় সিনেমা থেকে দূরে সরে গেলেন , ভালো কোন আর্টিষ্ট আসা বন্ধ হয়ে গেল ! যা আছে তা দিয়েই চলতে লাগলো ! নিচের ছবি গুলো দেখলেই অনুভব করতে পারবেন একটা সময়ের সুস্থ প্রতিযোগীতা আর তারপর লম্বা একটা শূন্যতা ! শেষ আধুনিক মুখ সালমান , শাবনূর , মৌসুমী আর ভিলেনে প্রিয় হুমায়ূন ফরিদী ! তারপর সময়ের দর্শক জয় করার মত কেউ ই নেই !!!!
পরিতাপের বিষয় হচ্ছে শক্তিমান অভিনেতা রাজিব এর ছবি আমি গুগল খুজেও পাই নি ! রাজিব লিখে সার্চ দিলে পেজের পর পেজ থাবা বাবা কিংবা প্রভার রাজীব ! ভিলেন রাজিব , অভিনেতা রাজিব , চলচ্চিত্রের রাজিব , রাজীব কিংবা ইংরেজীতে রাজিব লিখেও আমি পাই নি ! এসব তো আমাদের দায়িত্বহীনতার ফসলই !
এই একটা ব্যাপারে পাশের দেশের বিদেশী বন্ধুর কাছে হেরে গিয়ে মনে হচ্ছিলো, যখন থমকে গেল , যখন আমাদের চলচ্চিত্র থেকে দর্শকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করলো তখন কেন সিরিয়াস কিছু হলো না ? যেই দর্শক টা মাসে একবার হলেও হলে গিয়ে সিনেমা দেখে আসতো সে কেন ক্রমাগত বাজে সিনেমা দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে সিনেমা হলে ভাংচুর করলোনা , কেন সবাই এক্ত্রিত হয়ে কিছু চাইলোনা !
আমাদের চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলতে গেলে সালমান শাহ্ আসবেনই ! একটা মানুষের মৃত্যু কিভাবে একটা পুরো ইন্ডাস্ট্রিকে ধসিয়ে দিতে পারে সেটা আর চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়ার কিছু নেই !
আমার ধারণা ঐ সালমান পর্যন্তই থমকে গেছে আমাদের সিনেমার উৎকর্ষতা ! যুগের সাথে এগিয়ে চলে নিজস্বতা ধরে রাখাটা আর হয়ে উঠেনি ! তারপর যা হয়েছে সবই হাস্যকর , যেখানে নায়কের কান্না দেখলে দর্শকের হাসি পায় , হাসির দৃশ্য দেখলে মেজাজ খারাপ হয় ! কেউ একজন বলেছিলেন “সালমান শাহ্ বাঙ্গালী নায়কদের পেন্ট পরা শিখিয়েছেন ” ! সালমান গেলেন আর সবাই পেন্ট কিভাবে পরতে হয় তা ভুলে গেল , এটাই বাস্তবতা ! খালি প্রযুক্তির ব্যবহার করলেই যুগের সাথে তাল মেলানো হয় না ! কেন আমরা কি কখনো হলিউডের মুভিতে দুর্দান্ত একশ্যান সিনে প্রযুক্তির ব্যবহার দেখে হেসেছি ?? না হাসিনি কেননা সেখানে কিছুটা হলেও রুচির ছাপ ছিল , অবিশ্বাস্য জিনিসটাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করা হয়েছে ! আর আমরা কেন অনন্ত জলিলের সিনেমার ইফেক্ট দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাই ? এই সব তো সে কমেডি মুভি বানায় নাই , তাও কেন দর্শক হাসার জন্য দেখতে যাবে ! রুচিবোধের অভাব টাই রয়ে গেছে সালমান মৃত্যু পরের যুগ থেকে ! আগে সেটা ঠিক করতে হবে তারপর আসবে প্রযুক্তি ! আমাদের চলচ্চিত্র যখন মুখ থুবড়ে পড়ে তখন প্রযুক্তির ব্যবহার টা মূল কারণ ছিলনা , মূল কারণ ছিল রুচিবোধের অভাব টা !
এই লিঙ্কের বিডিওটা কেউ যদি পুরো টা দেখতে পারেন তাহলে বুঝতে হবে আপনি অনেক ধৈর্যশীল একজন মানুষ ! দুঃখিত অনন্ত জলিল আমি আপনার এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাতে পারছিনা কেননা এই জিনিস দেখার পরেও আপনার এটার মান নিয়ে যেহেতু কোন প্রশ্ন জাগেনি সেক্ষেত্রে আপনার মানসিক সুস্থতা আমার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ ! এর চেয়ে আমার কাছে ৮০ , ৯০ এর দশকের ইফেক্ট বিহীন গান গুলো এখতে এখনো ভালোলাগে ! মৃত শিল্পটাকে আর বলাতকার না করে অনন্ত জলিলের প্রতি অনুরোধ থাকবে কাউন্সেলিং করে তারপর আসার জন্য , ওনার উচ্চারণ আর রুচির কাউন্সেলিং সবার আগে দরকার !
সাকিব খান হতে পারতেন সত্যিকারের নায়ক ! হয় নিজের অজান্তে না হয় ভুল ব্যবহারে উনি বাংলা সিনেমার হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন ! বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ওনার অর্থহীন অহংকার আর কিছু কিছু ক্ষেত্রে ওনার মানহীন অভিনয় ওনাকে অনেক বড় একটা শ্রেণীর কাছে হাসির পাত্রে পরিণত করেছে !
খুব খুব আশাবাদী আরেফিন শুভ আর রেদোয়ান রনিদের নিয়ে ! হয়তো আরেফিন শুভরাই আবার সালমান যুগ ফিরিয়ে নিয়ে আসবেন ! সাধুবাদ জানাতে হয় জয়া আহসানের চলচ্চিত্রে মনোযোগী হয়ে উঠাকেও ! একই সাথে জরুরী সাকিব খান আর অনন্ত জলিলদের মানসিক চিকিৎসা !
বলে রাখা উচিৎ ব্যক্তিগতভাবে আমি চলচ্চিত্র সমালোচনা করার যোগ্য নই ! নিতান্তই একজন সাধারণ দর্শক এবং একই সাথে একজন বাংলাদেশী হিসেবে আমার এই পোষ্ট এর অবতারনা !
এই লেখাটি খুব আবেগের বশে লিখা , বিদেশীর কাছে তর্কে দেশের কিছু নিয়ে হেরে গিয়ে! ইতিহাস ভিত্তিক তথ্যগুলো পেয়েছি প্রথম আলো ব্লগের এই লিখাটি থেকে !
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।