আজ আমাদের সার্ধশত ২৫শে বৈশাখ। রবীন্দ্র নাথকে স্মরণ করছি বিনম্র শ্রদ্ধায়। কবি নিজেও জন্মদিন নিয়ে কিঞ্চিৎ আগ্রহী ছিলেন। তার প্রমান ছড়িয়ে আছে জন্মদিন নিয়ে তাঁর বেশ কিছু কবিতাসহ নানা রচনায়।
সরকারীভাবে এই উৎসব চলছে যৌথ প্রয়াসে।
সাথে আছি আমরা আম জনতা।
এই দেড়শ' বছরের মধ্যে বাঙালী পাঠকসমাজ রবীন্দ্রনাথের রচনাবলী পাঠের সুযোগ পেয়েছে ১৩৫ বছর (১৫ বছর বাদ দিয়ে,যদিও লেখালেখি আরো আগেই শুরু হয়েছে)।
বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন তিনি। অনেক জায়গায় তিনি পথিকৃৎ। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে কবিতা, গান আর ছোটগল্প শীর্ষ আসনের হকদার।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও তাঁর আসন প্রথম সারিতেই। রবীন্দ্রনাথের আরেকটি বড়ো আসন পাওনা তাঁর প্রবন্ধাবলীর। সেগুলো রবীন্দ্রনাথের বিচিত্র ভাবনারাশিকে ধারণ করে আছে। চিন্তাবিদ রবীন্দ্রনাথ আমাদের সমাজে এখনো প্রকৃত অর্থে অনালোচিত। আলোচনা যা হয় সেটা খন্ডিত।
রবীন্দ্র নাথের সমাজ ভাবনা, শিক্ষা ভাবনা, কৃষিভাবনা এই সব ভাগে ভাগে আলোচনা হয়, সামগ্রিকভাবে নয়।
বাঙালীর নবজাগরণের সূচনালগ্নের সারথীদের একজন রবীন্দ্রনাথ। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প বিপ্লব পৃথিবীর সমাজ কাঠামোর খোল নলচে বদলে দেয়। ভূমি ভিত্তিক অভিজাততন্ত্র আর তাদের হতভাগ্য প্রজাকূলকে নিয়ে যে দুই শ্রেণীবিশিষ্ট সমাজ ছিলো সেটাকে তিনচার ভাগ করে ফেলে শিল্প বিপ্লব। ভূমি ভিত্তিক অভিজাতরা কোনঠাসা হয়ে যায়।
সেই জায়গা দখল করে নব্য পূঁজিপতিরা। প্রজাকূলের নিম্নবর্গ শ্রমিক হয়ে যায়। বঞ্চনা বহাল থাকে। তবে সাপ্তাহিক বেতন কিঞ্চিৎ নিশ্চয়তার বাতাস বয়ে আনে। গড়ে ওঠে নতুন শ্রেণী-মধ্যবিত্ত।
উচ্চ পদের চাকরী, ছোট মাঝারী ব্যবসা হয়ে ওঠে এদের পেশা। বৃটিশ ভারতের রাজধানী কলিকাতায়ও সেই সমাজ কাঠামো চেপে বসে। গড়ে ওঠে শিক্ষিত ( বৃটিশ অর্থে) বাঙালী মধ্য বিত্ত সমাজ।
সুকান্ত কথিত ক্ষুধার রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদ ঝলসানো রুটি মনে হলেও পেটে ভাত পড়লে চাঁদের রূপ চোখে পড়তে শুরু করে। রোমান্টিকতা আকুলি বিকুলি শুরু করে।
শুধু খেয়ে পরে চলে না। মন আরো কিছু চায়।
সেই চাওয়ার উত্তর হলো সংস্কৃতি চর্চা। আমাদের অঞ্চলে বংশ পরম্পরায় টিকে থাকা অভিজাত শ্রেণীর জন্য ছিলো ধ্রুপদী সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য ইত্যাদি। সাথে নানা পার্বন,উৎসব।
ব্রাত্যজনের জন্য ছিলো জারী,সারি,ভাটিয়ালী,মুর্শিদী,বাউল গান। গ্রামীন মেলা। পালাপার্বন। ছিলো যাত্রা, লাঠি খেলা ইত্যাদি। জমিদারের পেয়াদা বরকন্দাজ রূপে ছোট যে মধ্যবিত্ত ছিলো তারা জমিদারের পায়ের কাছে বসে গাছেরটাও খেতো আবার পালাপার্বনে জমিদারের হয়ে হম্বিতম্বি করার সময় তলারটাও কুড়াতো।
শিল্প বিপ্লব যে বড়ো সাইজের মধ্যবিত্ত শ্রেণী বানালো তাদের এই সবে চলছিলো না। তাদের জন্য ভিন্ন সংস্কৃতির দরকার হয়ে পড়ে। প্রথমত তারা আগের অভিজাতদের ধ্রুপদী জগতে হাত পাতে। ব্রাত্যজনের কাছে যেতে তাদের খুব বাধছিলো। (সে জন্যই লালন হাসনদের প্রকৃত তথাকথিত সুধীজনের দরবারে কল্কে পেতে এই যুগ পর্যন্ত সবর করতে হয়েছে)।
নতুন ধনীদের পেটে আবার ধ্রুপদী ঘি বদহজম হচ্ছিলো। সত্যজিত রায়ের চলচ্চিত্র ''জলসাঘর'', শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস ''সংসপ্তক'' আর হূমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক নাটক ''অয়োময়''-এ নব্য ধনীদের সাংস্কৃতিক সঙ্কট ফুটে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালী মধ্যবিত্ত সমাজের সাংস্কৃতিক কাঠামোটা কেমন হবে তা প্রায় একা হাতে ঠিক করেছেন। তিনি চেয়েছেন অভিজাত শ্রেণীর সাংস্কৃতিক উচ্চ রুচিটা মধ্যবিত্ত গ্রহণ করুক। সাথে যুক্ত করেছেন নানা কিছু।
তিনি চেয়েছেন, ১৭৯৫ সালে লেভেদেফ যে প্রসেনিয়াম থিয়েটার চালু করেছেন সেটাও মধ্যবিত্তের নাগালে আসুক। সে জন্য নাটক লিখেছেন। অভিনয়ও করেছেন নাটকে। ছবি এঁকেছেন। ভোলেননি মধ্যবিত্ত ঘরের শিশুদেরও।
ছবি এঁকেছেন। মধ্য বিত্তের তরুণ তরুণীদের ভালোবাসার ধরণও যে ভিন্ন হবে সেটাও ভেবেছেন। সে জন্য ৭২ বছর বয়সেও লিখতে ভোলেননি দুর্দান্ত আধুনিক প্রেমের উপন্যাস ''শেষের কবিতা''।
শিক্ষার বিষয়েও রবীন্দ্রনাথ বাঙালীর স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিলেন। ইংরেজের শিক্ষার প্রভাবে বাঙালী নকল বৃটিশ হয়ে উঠুক রবীন্দ্রনাথ তা চাননি।
গড়ে তুলেছেন ভিন্ন ধারার শান্তি নিকেতন। আদর্শ হিসাবে নিয়েছিলেন বৈদিক ধারার গুরুমুখী শিক্ষার আদর্শ। অবশ্যই সেটায় রাবীন্দ্রিক স্বাতন্ত্র্য মিশিয়ে দিতে ভোলেননি। যেমনটা সৈয়দ আমীর আলী, স্যার সৈয়দ আহমদ প্রমুখ চেয়েছিলেন, ভারতীয় মুসলমানরা ইংরেজী শিক্ষায় আলোকিত হবে, কিন্তু মুসলিম সংস্কৃতি হারিয়ে ফেলবে না। বাঙালী মুসলমানদের জন্য সেই বার্তাই বয়েছেন নবাব আবদুল লতিফরা।
রবীন্দ্রনাথ শুধু অভিজাতদের সংস্কৃতি আর পাশ্চাত্যের নতুন জিনিস ভারতীয় স্বাতন্ত্র্য মেখে গ্রহণ করেই থামেননি। আমাদের লোক সাহিত্যের ভান্ডারে যে মনিমুক্তা আছে তাও ছেঁকে তুলেছেন মধ্যবিত্তের জন্য। কাঙাল হরিনাথই যদিও লালনকে শিক্ষিত সমাজের সামনে প্রথম তুলে ধরেছিলেন, কলিকাতার বিদ্ব্যত সমাজে লালনের প্রথম পরিচয় তুলে ধরেন রবীন্দ্রনাথই। হাসন রাজাকেও কলিকাতায় প্রথম তুলে ধরেছেন রবীন্দ্রনাথই।
চলচ্চিত্র যখন এলো রবীন্দ্রনাথ তাকে স্বাগত: জানালেন।
তুলে দিলেন মধ্যবিত্তের পাতে। রেডিওকেও ঋদ্ধ করলেন গান দিয়ে।
রবীন্দ্র নাথের গান ধ্রুপদী ব্যাকরণ ভেঙে ভিন্ন সুরে এলো, ভিন্ন বাণীতেও। যেটা অভিজাতদের মতো নয়, নয় ব্রাত্যজনের লোকগানের মতোও। একান্তই মধ্যবিত্তসুলভ।
কবিতা, গল্প,উপন্যাস, প্রবন্ধ প্রভৃতি নিয়ে বই লিখলেন শিক্ষিত
মধ্যবিত্তের পাঠের জন্য।
মধ্যবিত্তের স্বতন্ত্র মেরুদন্ডও গড়তে চাইলেন জাতীয় চেতনা আর আত্মমর্যাদায় মুড়ে। পাশ্চাত্যে গেছেন। পাশ্চাত্য সংগীত বা সংস্কৃতির নির্যাস নিয়েছেন কিন্তু তা পরিবেশন করেছেন আমাদের মতো করে। 'তোমার হল শুরু আমার হল সারা' কিংবা 'পুরনো সেই দিনের কথা' শুনলে কে বলবে এটা পাশ্চাত্যের সুর ? অথচ এখন আমরা ব্যান্ডের গান শুনলেই বুঝি এটা পাশ্চাত্যের সুরের নকল।
রুচির মানও বাড়াতে চেয়েছেন। সুরুচির প্রতীক পুরো রবীন্দ্র রচনা। সবার খুব প্রিয় গল্প হৈমন্তীর কথাই ভাবুন। অপু যখন জানলো হৈমর চিঠি পোস্ট করার আগে তার বাবা সেটা গোপনে পড়েন। তখন হৈমকে অপু বললো হৈম যেন তার চিঠি অপুকে দেয় পোস্ট করতে।
বাকীটা শুনুন রবীন্দ্র জবানে-
''হৈম বিস্মিত হইয়া কহিল, কেন ?
আমি লজ্জায় জবাব দিতে পারিলাম না। ''
এটা যে নিম্ন রুচির কাজ, এটা যে মুখে আনাও রুচিকর নয় রবীন্দ্র নাথ সেটাই ফুটিয়ে তুলেছেন। রুচির এই উচ্চ মান রবীন্দ্রনাথ সর্বদা বজায় রেখেছেন।
সব মিলে দেড়শ' বছর পরও রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক।
কবিকে আবারো শ্রদ্ধা।
শুভ জন্মদিন, কবি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।