তাশফী মাহমুদ
এই লেখাটা আজ পত্রিকাতে পড়লাম, খুব ভালো লাগলো তাই সবার সাথে শেয়ার করলাম --
কনট্রাস্ট'-তুলনামূলক বৈপরীত্যটা লৰণীয়। একটু চিন্তা করলে যে কোন বিবেকবান মানুষকেই বিচলিত করবে। রবীন্দ্রপ্রেমিকদের হয়ত আরও একটু বেশি।
গত ৩০ এপ্রিল শনিবারের দৈনিক প্রথম আলোর পেছনের পৃষ্ঠায় ঝলমলে একটি বড় রঙিন ছবি আছে। ছবিটিতে দেখা যায় তেরো-চৌদ্দজন পুরম্নষ মহিলা নৃত্যশিল্পী বিভিন্ন ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে উদ্দাম ছন্দে প্রবলভাবেই নাচছেন।
পেছনে বড় এক গোলবৃত্তে লেখা আছে, 'মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১০'; আর পরিচিতি হিসেবে ছবিটির নিচে লেখা আছে, "বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে গতকাল 'মেরিল প্রথম আলো-২০১০' অনুষ্ঠানে এই সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রের গানে তানজিলের পরিচালনায় নৃত্য পরিবেশন করেন নিপুণ, রোমানা, বিন্দু ও সহশিল্পীরা। " চার কলামে বিস্তৃত এবং আট দশ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যের এই ছবিটির নিচে দুই কলামের একটি খবর আছে, 'শিশু গৃহকর্মীর মৃত্যু, নির্যাতনের অভিযোগ। ' নিজস্ব প্রতিবেদক পরিবেশিত এই খবরের ভেতরে, ইনসেটে এই কথাগুলোকে 'হাইলাইট' করা হয়েছে,_ "গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী আটক। নির্যাতনে হত্যার অভিযোগে মামলা। " খবরটির প্রথম দুটো প্যারাগ্রাফ এমন :
"রাজধানীর সবুজবাগে নির্যাতনে আট বছরের এক গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সুলতানা আখতার তৃষা নামের এই গৃহকর্মীর লাশ পুলিশ গতকাল শুক্রবার ধানম-ির সেন্ট্রাল হাসপাতাল থেকে উদ্ধার করেছে। পুলিশের সন্দেহ, তাকে ধর্ষণও করা হয়ে থাকতে পারে।
এই ঘটনায় গৃহকর্তা সোহেল হাওলাদার ও গৃহকর্ত্রী ফাহমিদা ইসলাম মুক্তাকে পুলিশ আটক করেছে। তবে তাঁরা তৃষাকে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। "
'মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ২০১০'_এর ওপর প্রকা- 'ফলো-আপ'ও করেছে দৈনিক প্রথম আলো ৫ দিন পর; বৃহস্পতিবার ৫ মে'তে তাদের সাপ্তাহিক বিনোদন ক্রোড়পত্র 'আনন্দতে'।
এই 'আনন্দ' ক্রোড়পত্রের প্রথম পাতায় আরও বড় এক রঙিন ছবি, পাঁচ কলামের এবং দৈর্ঘ্যে-১২ ইঞ্চি। ছবিতে দেখা যায় দুই পৌঢ় মহিলা, রোজিনা এবং অঞ্জনা এবং দুই সুঠাম দেহধারী পুরম্নষ, ফেরদৌস এবং রিয়াজ বিচিত্র পোশাক পরে আরও উদ্দাম অঙ্গ ভঙ্গিতেই নাচছেন। এই রঙিন ছবিটির পাশের খবরটির শিরোনাম 'কত তারা জ্বলে!' চারপাতার এই ক্রোড়পত্রের ভেতরের দুই পাতায় আছে আরও ২৫টি রঙিন ছবি এবং শেষ, মানে চতুর্থ পাতায় আরও ১৪টি, বিভিন্ন সাইজের, নৃত্যশিল্পী গাইয়েদের' এবং অতিথিদের বিভিন্ন মুডের।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, অনুষ্ঠানের উপস্থাপক জাহিদ হাসান, রাশেদা কে চৌধুরী, ফিরোজা বেগম, রোকেয়া আফজাল রহমান, রাবেয়া খাতুন হাস্যোজ্জ্বল মুসত্মাফা মনোয়ার, মুর্তজা রশীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, 'দু'জনে দু'জনার জিনাত হাকিম ও আজিজুল হাকিম', সাবেক সেনাপ্রধান হারম্নন-উর-রশীদ বীর প্রতীক ও সারা বেগম কবরী, মেজর জেনারেল সফিউলস্নাহ বীরউত্তম, মেজর জেনারেল আমীন আহম্মেদ চৌধুরী বীর বিক্রম। তিশা ও মুসত্মফা সরয়ার ফারম্নকীরও একটি আলাদা ছবি আছে।
তো এই তিশার আরও একটি ছবি আছে, তিনি 'হারম্নন-উর-রশীদ বীর প্রতীকের' হাত থেকে পুরস্কার নিচ্ছেন। এক তিশার দু'দুটো ছবি! কিন্তু গৃহকমর্ী ৮ বছর বয়সী তৃষার আর কোন খবর পরে এই প্রথম আলোতে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। এই তৃষার কোন ছবিও দৈনিক প্রথম আলো ছাপেনি। সাদাকালো একটি ছবিও নয়।
॥ দুই ॥
'স্কয়ার টয়লেট্রিজ'-এবং প্রথম আলোর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে কত লাখ, কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে, জানার আমার খুব আগ্রহ।
একে তো বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্র, ভাড়া বাবদই বোধ হয় সাত আট লাখ টাকা; তারপর নৃত্য পটীয়সীদের জন্য পোশাক আশাক, তাদের জন্য সম্মানী, তাদের আনা নেয়ার খরচ, তারপর খানাপিনা।
এই যে এত 'বিশিষ্ট'জনকে এই অনুষ্ঠানটিতে জড়ো করা হলো, তাঁরা যে অনুষ্ঠানটিকে আলোকিত করলেন, স্কয়ার টয়লেট্রিজ' সামগ্রীকে মর্যাদা ও সম্মান দিলেন; তাঁদের কেউই কি গৃহকমর্ী তৃষার মতো একটি শিশুর পাশে এক মুহূর্তের জন্য কস্মিনকালেও দাঁড়িয়েছেন? একটি কথাও কোনদিন বলেছেন? কিন্তু প্রতিদিনই তো এমন ঘটনা ঘটছে, প্রতিদিনই তো এমন নিষ্ঠুর নির্যাতনের খবর ছাপা হচ্ছে। এ সব বিশিষ্ট 'মশাল,' এ সব বিশিষ্ট 'তারকা' এই শিশুগুলোকে নিয়ে এতসব পত্রিকায় রচিত এতসব খবর শুধু এক মিনিট, শুধু এক মিনিট, সময় নিয়ে কি পড়ে দেখেছেন?
এসব 'তারকা', এসব 'লিডিং লাইটস' থাকছেন নির্বিকার। প্রথম আলো এ্যাসিড সন্ত্রাসীদের বিরম্নদ্ধে বড় একটি জনমত সৃষ্টি করেছে। কিন্তু শিশু গৃহদাসীদের জন্য একটু 'রহম' চেয়ে প্রথম আলোর সম্পাদককে চিঠি লিখে প্রাপ্তি স্বীকারমূলক এক লাইনের একটি চিঠি পাইনি।
আমাদের পত্রিকাগুলো সরকারের কোন অনুষ্ঠানে কত লাখ কত কোটি টাকা খরচ হয়েছে তার বিবরণ ছাপে। তো দৈনিক প্রথম আলো এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে স্কয়ার টয়লেট্রিজ-এর কাছে পত্রিকাটির চার, চারটি পাতা বিক্রি করে কত লাখ টাকা আয় অর্জন করল তাও তো আমাদের জানা দরকার।
দেশে শিশু গৃহকমর্ী নির্যাতন একটি মহামারীর আকার ধারণ করেছে। গত পনেরো বছরের আমার কলাম লেখকের জীবনে আমি অনত্মত দশটি কলাম লিখেছি বিভিন্ন পত্রিকায়। কিন্তু কোথাও এতটুকু দাগ কাটতে পেরেছি বলে মনে হয় না।
দশ বছর আগে আমি যখন কাকরাইলে থাকতাম, তখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওসিসিতে (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) চিকিৎসাধীন নির্যাতিত শিশুদের দেখতে যেতাম। তখন একজন লোক আলোড়িত হয়েছিলেন, মধ্য বয়সী সাধারণ একজন মানুষ, একজন হার্ডওয়্যার ব্যবসায়ী; মফিজুল ইসলাম তাঁর নাম। তাঁর দোকানটি ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমার দৰিণ দিকে। থাকতেন রথখোলায়।
আমার একটি লেখা পড়ে জনকণ্ঠ অফিস থেকে আমার টেলিফোন নম্বর জোগাড় করে টেলিফোন করলেন এই ভদ্রলোক।
এক রোজার ঈদের আগে ওসিসিতে তখন চিকিৎসাধীন শিশুগুলোর সংখ্যা জেনে নিয়ে তাদের প্রত্যেকের জন্য কিছু কাপড়চোপড় কিনলেন; কিছু জুস প্যাক, কিছু চকোলেট এবং আরও কিছু খাবারসহ আমাকে নিয়ে তাদের দেখতে গেলেন তিনি। পরে আরও একবার, আরেক ঈদের আগে তিনি এমনটি করলেন। তৃতীয়বার আর সম্ভব হলো না। কারণ ওসিসির লোকজন আমাদের জানাল, মহিলা ও শিশু অধিদফতরটি আমাদের এমন আগ্রহ পছন্দ করছে না। ইতোমধ্যে জামায়াত-জাতীয়তাবাদী জোট ৰমতায় এসে গেছে; তাদের দাপট প্রতাপও চলছে।
ডাক্তার বিপুল এবং ডাক্তার নুরম্নন্নাহার নামের যে দুই চিকিৎসক আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আমাদের সাহায্য সহযোগিতা দিতেন খাতির যত্নও করতেন; দেখলাম সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে গেল। তারপর মফিজুল ইসলাম সাহেবের সাথেও আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। অনেক বছর কোন খোঁজখবর নেই। নিউইয়র্ক জাতিসংঘে এখন আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি ড. আবদুল মোমেন ৭/৮ বছর আগে যখন বোস্টন থেকে ঢাকায় আসেন তখন আমাকেও তিনি দেখতে এসেছিলেন আমার উত্তরার বাসায়। তখনও সামনে একটি ঈদ।
আমি ঢাকা মেডিক্যালের ওসিসিতে যাব বলতেই তিনিও বললেন তিনিও যাবেন আমার সাথে। পথে একটি স্টোর থেকে তিনিও কিছু জুসপ্যাক, চকোলেট এবং আন্দাজ করে ১০/১২ জন শিশুর জন্য কিছু ফ্রগ শার্ট জামাকাপড় নিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু এই একজন সাধারণ মানুষ, মফিজুল ইসলাম এবং তখন একজন অধ্যাপক ড. মোমেন যেভাবে বিচলিত হয়ে অজানা, অচেনা কতগুলো শিশুর প্রতি তাদের দরদ অনুভূতি প্রকাশ করলেন, তার বিন্দুমাত্রও কি মেরিল প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে উপস্থিত 'বিশিষ্ট' জনরা কোনদিন দেখিয়েছেন? ড. ফখরম্নদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাশেদা কে চৌধুরী তো মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়েরই উপদেষ্টা ছিলেন। এই শিশু শ্রমিকদের রৰায় তাদের কল্যাণে তিনি কি বিশেষ কোন ভূমিকা রেখেছেন, আমার জানতে খুব ইচ্ছে হয়।
॥ তিন ॥
শিশু গৃহশ্রমিকদের আমি 'শিশু গৃহদাসী' হিসেবেই দেখি।
গত দশ বছরে বিভিন্ন পত্রিকায় এই শিশু গৃহদাসীদের ওপর যত খবর আমার চোখে পড়েছে, আমি ক্লিপিং করে সেগুলো সংরৰণেরও চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু এখন যে আর পারছি না! একা মানুষ, আর কত করব? নিষ্ঠুর নির্যাতন তো দিন দিন বাড়ছেই। আর যে সামাল দিতে পারছি না।
এমন অত্যাচার নির্যাতনের এক একটি খবর আমি পড়ি আর আমার মনে তখনই কতগুলো প্রশ্ন জাগে। আচ্ছা, এই শিশুটির এবং তার বাবা মায়েরও তো বিভিন্ন লেভেলে কয়েকজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছেন।
আছেন, ওয়ার্ড কমিশনার বা ওয়ার্ড কাউন্সিলর; আছেন মেয়র বা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। তারপর আছেন জাতীয় সংসদ সদস্য। পত্রিকার খবরটিতে আমি খুঁজি শিশুটির ঐ এলাকার জনপ্রতিনিধি এই আক্রানত্ম নিযর্াতিত শিশুটির রৰায় বা অন্যায়ের প্রতিকারে কিছু বলেছেন কিনা বা কোন ভূমিকা রাখছেন কিনা। কিন্তু গত দশ বছরে এমন একটি উদাহরণও দেখিনি। তাহলে অবশ্যই প্রশ্ন করতে হয় এই ৰেত্রে কি তাদের কোনই দায়িত্ব নেই? তাহলে তাদের 'কাম'টাই বা কি?'
তারপর আমাদের দুটো বড় রাজনৈতিক দল আছে, তাদের শাখা-প্রশাখা শহর গ্রামের ওয়ার্ড পর্যনত্ম বিসত্মৃত।
আছে বড় দু'টো ছাত্র সংগঠন। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলও আছে। কিন্তুু এতসব সংগঠনের কেউ কি সামান্যতম উদ্যোগ নিয়েছে এই মহামারীটি ঠেকাতে?
আমি অনেক বছর ধরেই আশা করে আসছি_ কলেজ ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা এই একটি ৰেত্রে নন্দিত একটি ভূমিকা রাখতে পারে। শিশুটির দরিদ্র বাবা-মা-ভাইবোনদের জন্য কিছু টাকা তুলতে পারে; শিশুটির বাবা-মাকে মানসিক শক্তি জোগাতে পারে; অত্যাচারী গৃহস্বামী গৃহকত্রর্ীর বিরম্নদ্ধে দায়ের করা মামলাটি 'মনিটর' করতে পারে। আইন বিষয়ের ছাত্রছাত্রীরা 'কেস স্টাডি' হিসেবে ঘটনার শুরম্ন থেকে শেষ পর্যনত্ম পর্যবেৰণ করতে পারে।
তাতে লেখাপড়ার পাশাপাশি সমাজসেবাও হয়।
এমন কয়েকটি ৰেত্রে 'মনিটর' করে আমি দেখেছি, মামলা চালানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য কোন বাবা-মায়েরই থাকে না। আর্থিক সামর্থর্্য যদি এতটুকুও থাকবে, তাহলে মাত্র আট বছরের তৃষাকে তার বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজন, আর একজনের বাড়িতে কাজ করতে পাঠাবেই বা কেন? আরও লৰ্য করেছি, নিহত বা গৃহকত্রর্ীর খুনত্মির আঘাতে ৰতবিৰত শিশুটির বাবা-মা বা আত্মীয়স্বজনদের অতি অল্প কিছু টাকা দিয়েই কিনে ফেলা যায়। তাই তো প্রতিবছর এতসব হৃদয়বিদারক ঘটনা কিন্তু কোন গৃহকত্রর্ী বা গৃহস্বামীর কোন শাসত্মি হওয়ার উদাহরণ পত্র পত্রিকায় দেখিনি। উকিল নিয়োগ, থানা কোর্টে দৌড়াদৌড়ি,_অনেক টাকার ধাক্কা।
স্বচ্ছল মানুষদের কয়জনের পৰেইবা তা সম্ভব?
এগারো বছর আগে, ২০০০ সালে, নিউ মার্কেটের পাশে মিরপুর রোডে এক শীতের সকালে একটি লোককে একটি শিশুর লাশ একটি ডাস্টবিনে ফেলে যেতে দেখেন একটু দূরের এক চা'দোকানদার। নীলুফা নামের আট দশ বছর বয়সী এই গৃহদাসীটি মেরে, ফেলে দিতে এসে ধরা পড়ে যায় বাংলাদেশের প্রথম সারির (এখন মরহুম) এক কবি'র ভাই। দৈনিক ভোরের কাগজ এই খবরটি শিশু নীলুফার ছবিসহ ছেপে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
মেয়ের মৃতু্যর খবর শুনে বিধবা মা ছুটে এসেছিলেন ময়মনসিংহের গ্রাম থেকে। কিন্তু শিশুটির লাশ বাড়ি নিয়ে গিয়ে দাফন করার মতো শ'খানেক টাকাও তার ছিল না।
এই মার একটি কথা এখনও, এতবছর পরও আমার চোখ দুটো ভিজিয়ে দেয়, 'লাশ নেয়ার টাকাই যদি আমার থাকবে তাহলে আমি এই শিশুটিকে পেটেভাতে কাজ করার জন্য এত দূরে পাটাই কেন?' পরে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম শিশু নীলুফা এবং তার মাকে তাদের গাড়িতে করে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
কিন্তু মামলাটির কি হলো তা আর জানিনি। এই নির্মম হত্যাকা-টির ওপর দৈনিক ভোরের কাগজ বা অন্য কোন পত্রিকা বা কোন টিভি চ্যানেল আর কোন খবর প্রকাশ করেনি। করেনি, কারণ 'তারকা' তিশার মতো গৃহদাসী নীলুফা বা তৃষা 'গস্ন্যামারাস' কিছু তো নয়। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত কাবুলীওয়ালা গল্প অবলম্বনে ৫০ বছর আগে তখন সিংহ পরিচালিত কাবুলীওয়ালা ছবিটির ছোট ছয় বছর বয়সী মিনির মতো তারা যে নাচতেও পারেনি কোনদিন; নাচ শেখার সুযোগই পায়নি তারা কোনদিন।
॥ চার ॥
আমাদের জাতীয় সংসদ সদস্য, ওয়ার্ড কমিশনার, মেয়র সাহেবদের এমন সব 'তুচ্ছ' বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই। আগ্রহ নেই আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু, শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শারমিন চৌধুরীও। আগ্রহ নেই তাদের মন্ত্রণালয়ের সচিবদের, আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং পুলিশ কমিশনার বেনজির আহমদের। কিন্তু গভীর আগ্রহ দেখেছি, শেখ হাসিনার আগের সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমের মধ্যে। এমন ঘটনা পত্রিকায় দেখলে তিনি নিগৃহীত শিশুটিকে দেখতে ছুটে যেতেন।
কিন্তু তারপর এতজন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এসেছেন কত বিচিত্রভাবে তাঁরা তাঁদের দাপট প্রতাপ দেখিয়েছেন, কিন্তু এতটুকু দয়ামায়া এই লোকগুলো, এই মহিলাগুলো দেখাননি অবর্ণনীয় নিষ্ঠুরতার শিকার এই শিশুগুলোর প্রতি। সুস্বাস্থ্যের অধিকারী আমাদের শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর পাশে শিশু তৃষার লাশটি কেমন একটি 'কনট্রাস্ট' হবে।
আমার আরও একটি প্রশ্ন আছে। এই ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষজন কি আগেও এমন নিষ্ঠুর ছিল? নাকি বিভিন্নমুখী চাপে মানুষজনের মধ্যে নিষ্ঠুরতা দিন দিন বাড়ছেই? কিছু মহিলার মধ্যে গৃহশ্রমিক শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুরতাটা স্বভাবজাতই মনে হয়। আমার পরিচিতদের মধ্যেও এমন কয়েকটি উদাহরণ আমি জানি।
রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং রবীন্দ্র চর্চার প্রসার বিসত্মার ঘটছে। কিন্তু একই সঙ্গে নিষ্ঠুরতাটাও তো বাড়ছে। তা কেন? তাহলে কি বলতে হবে রবীন্দ্র চর্চা মানুষের মনে কোন প্রভাব ফেলতে পারছে না।
সংশিস্নষ্ট সকলকে দুটো বিষয় বিশেষভাবে ভাবতে অনুরোধ করি। শিশুরা শিশু বলেই তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয়; শিশু বলেই তাদের অধিকার তারা রৰা করতে পারে না।
তাদের ওপর আক্রমণ তারা প্রতিহত করতে পারে না। তাই তাদের জন্য অভিভাবকের দরকার হয়।
আনত্মর্জাতিকভাবে তাদের অধিকার সংরৰণ করার জন্য সৃষ্ট সংগঠনটির নাম 'ইউনিসেফ,_ ইউনাইটেড নেশনস ইন্টারন্যাশনাল চিলড্রেনস ইমার্জেন্সি ফান্ড'। শুধু বয়স বিবেচনায় এমন আর কোন আনত্মর্জাতিক সংগঠন নেই দুনিয়াতে। যেমন প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘের কোন অঙ্গ সংগঠন নেই।
কিন্তু শিশুদের অধিকার, শিৰা, স্বাস্থ্য, খাবারদাবার ইত্যাদি বিষয়ে বিশেষ দৃষ্টি দেয়ার দরকার আছে বলেই শুধু শিশুদের জন্যই এই সংগঠনটি। শিশুরা অন্য যে কোন শ্রেণীর তুলনায় বেশি 'ভালনারেবল। ' তাই তাদের বিষয়গুলোকে বিশেষ গুরম্নত্ব দিতে হয়, আনত্মর্জাতিকভাবে তা স্বীকৃত। জাতীয়ভাবেও তাই তো একটি আলাদা মন্ত্রণালয় আছে শিশুদের জন্য, দুনিয়ার অনেক দেশে। আছে বাংলাদেশেও।
তবে শিশু গৃহদাসী, গৃহশ্রমিকদের রৰায় এই মন্ত্রণালয়টি বা তার মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীর চোখে পড়ার মতো কোন ভূমিকা দেখি না। দেখি না কারণ, আবারও বলি এসব শিশুর মধ্যে যে কোন 'গস্নামার' নেই;
ভূমিকা দেখিনা এনজিও নিয়ে বাণিজ্য করে, বা বাণিজ্য করে না, এমন কোন প্রতিষ্ঠানেরও। অথচ শিশু অধিকার নিয়ে কত এনজিও 'কাজ' করছে!! কিন্তু এমন কোন এনজিও কি কোন অত্যাচারী নির্যাতনকারী নিষ্ঠুর গৃহকর্তা বা গৃহকত্রর্ীর গ্রেফতারের পর ফৌজদারি মামলার চূড়ানত্ম রায় পর্যনত্ম 'মনিটর' করে নির্যাতনকারীর সাজা নিশ্চিত করতে পেরেছে?
অনেককেই বলতে শুনি, কাজের মেয়েটিকে আমরা কত আদর যত্ন করি; কিন্তু তারপরও সে ঠিকমতো কাজ করে না, কথা শোনে না, থাকতে চায় না। এদের কয়েকজনকে আমি জিজ্ঞাস করেছি, ঠিকমতো কাজটি কি, কাজটি কত ভারি, কাজটি প্রতিদিন কত ঘণ্টার, তার থাকার জায়গাটি ঘরের কোথায়, তার খাবারগুলো কেমন? যত ছোট শিশুই হোক, আমাদের কাজের ছেলেমেয়েগুলো তো ঘুম থেকে ওঠে খুব ভোরে সকলেরই আগে; আর ঘুমাতেও যায় সকলের পরে গভীর রাতে। গরম্ন-ছাগল, কুকুর-বিড়ালকেও কি এত ভোরে উঠতে হয়? এত গভীর রাতে ঘুমাতে যেতে হয়?
তারপর হয়তো তাকে আদর করেন? কিন্তু বর্ষার রাতে যখন মেঘ ডাকে, শিশুটি ভয়ে যখন ঘরের এক কোণে একা কাঁপতে থাকে তখন শিশুটি তো দৌড়ে মায়ের বুকে আশ্রয় নিতে চাইবে।
তখন কি তাকে, এই শিশুটিকে আপনার বুকে আশ্রয় দেবেন? কিন্তু সে যদি তার মায়ের সঙ্গে থাকত তখন তো মায়ের বুকেই থাকত। আপনার পর্বত প্রমাণ আদর স্নেহও ঐ শিশুটির মায়ের বুকের নিরাপত্তার সমান নয়।
। পাঁচ ॥
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর দিন এই লেখাটি লিখছি। আমার ধারণা, যাঁরা রবীন্দ্রনাথকে ভালবাসেন, তাঁর গান সাহিত্যকে ভালবাসেন, তাঁদের সকলেরই মনটা নরম, কোমল।
আজকের এই পবিত্র দিনটিতে সকল রবীন্দ্রনাথ প্রেমিককে একটি বিশেষ আবেদন এই ছিন্নমূল, নিরীহ অসহায়, অত্যাচারিত নির্যাতিত মা-বাবার আদর স্নেহবঞ্চিত, ভাইবোনদের ছোটখাটো খুনসুটি থেকে দূরে, এই শিশুগুলোর রৰায়ও একটু ভূমিকা রাখুন। একেবারে অসহায় না হলে এই শিশুগুলোকে, এই এত অল্প বয়সে, অনেকৰেত্রে শুধুমাত্র পেটেভাতে, শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য, বাবা-মা, ভাইবোন খেলার সাথীদের চাইতে এত দূরে, নরম শরীরে দিনরাত কাজ করতে তাদের বাবা-মা পাঠাবে কেন?
শিশুটি যে ঘরে কাজ করে সেখানে, তার চারপাশে শুধু 'প্রিডেটর'। পারলে তাকে খেয়েই ফেলে। তার গায়ে যখন গরম পানি ঢেলে দেয়া হয়, তাকে যখন কোন ছোট একটি বাথরম্নমে দিনের পর দিন আটকে রাখা হয়, তাকে দিনের পর দিন অভুক্ত রাখা হয়, তখন তাকে একটু আদর, একটু স্নেহ দেয়ার জন্য, একটু সহানুভূতি জানানোর জন্য, একটি প্রাণীও নেই। তার বাবা-মা বেঁচে আছে কিনা, সে জানে না, বেচে থাকলে কোথায় আছে, সে তা জানে না।
মাসে একবারও হয়ত সে তার বাবা-মার দেখা পায় না। হয়ত সেই ঘরের অন্য শিশুগুলোও এই শিশুটিকে মা-বাবার দেখাদেখি মারধর করে থাকে। শিশুটি তার ওপর নিষ্ঠুরতার কথাগুলোও বাইরের কাউকে জানাতে পারে না। শিশুটি হয়ত কাঁদতেও পারে না; তাকে কাঁদতেও দেয়া হয় না।
রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা পথশিশুদের জন্য একটি প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ করছেন বলে পত্রিকায় পড়েছি।
কিন্তু গৃহশ্রমিকগুলো একেবারেই অরৰিত আমাদের সমাজে।
আমার আগের এক লেখায় জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ এবং তাঁর ভাই ড. জাফর ইকবালের কাছে এই বিষয়ে একটি আবেদন রেখেছিলাম। ড. জাফর ইকবাল শিশুদের খুবই ভালবাসেন, শিশুরাও তাঁকে। কিন্তু আমার ঐ লেখাটি ঐ আবেদনটি তাদের চোখে পড়েনি। আজ তাঁদের দু'জনকে এই একই আবেদনটি আবার করছি।
তাঁরা এ ধরনের কোন ঘটনার খবর জানলে, তারা মৃত বা জীবন্মৃত শিশুটিকে দেখতে থানা বা হাসপাতালে যেতে পারেন, শিশুটির বাবা মাকে সানত্ম্বনা বা সাহস দিতে পারেন। তাদের জনপ্রিয়তার কারণে তারা এমন কিছু করলে সাধারণ মানুষজন এবং সিনেমা টিভি এবং খেলাধুলার 'এস্পার'রাও এগিয়ে আসবেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।