আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুগো শ্যাভেজের অন্তর্ধান ও ভেনিজুয়েলার রাজনীতির ভবিষ্যৎ

I want to make me as a blog writter. আনলাকি থার্টিনের দুর্ভাবনায় ছিল ভেনিজুয়েলাবাসী। দুঃসংবাদ দিয়েই বছর শুরু হয় তাদের। কারণ ভেনিজুয়েলার মহান নেতা শ্যাভেজ ২০১১ সালের জুন মাস থেকেই দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন। কিন্তু তার এত অসুস্থতার কথা কাউকে জানতে দেয়া হয়নি। তবে ১৮ মাসে চারবার শ্যাভেজের শরীরে অস্ত্রোপাচারের পর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জাতিকে জানানো প্রয়োজন মনে করেছিল কারাকাস।

৩ জানুয়ারী তথ্যমন্ত্রী আর্নেস্তো ভিলেগাস জানিয়েছিলের , ৫৮ বছর বয়সী বিপ্লবী নেতার ফুসফুসে মারাতœক সংক্রমণ। শাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তার। তখনও তিনি কিউবার রাজধানী হাভানার কিমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর শ্যাভেজের শাসনালিতে ছয় ঘন্টার অস্ত্রোপাচারে অনাকাঙ্খিত ভাবে ব্যাপক রক্তক্ষরণ হয়েছিল। তারপর তিনি দীর্ঘদিন কিউবার হাসপাতালে ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকার পর গত ১৮ ফেব্রুয়ারী দেশে ফিরেছিলেন।

দেশে ফিরে ভেনিজুয়েলার সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন এবং তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছিল । দেশে ফেরার পর অনেকেই মনে করেছিলের শ্যাভেজ দেশের মাটিতে শেষ নিঃশাস টুকু ত্যাগ এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে নির্বাচনে জয়ী করার জন্য কারাকাসের মাটিতে এসেছেন। আর ৫ মার্চ সেই ধারণা বাস্তবে পরিণত হলো ভেনিজুয়েলার গরিবের ইমেজ ও ল্যাতিন আমেরিকার মহান নেতা হুগো শ্যাভেজের মৃত্যুর সংবাদে। ভেনিজুয়েলার বিপ্লবী নেতা শ্যাভেজ দেশটির অক্টোবর ২০১২ সালের নির্বাচনে ক্যান্সার আক্রান্ত শরীর নিয়েও তিনি বিপুল ভোটে বিরোধীদের হারিয়ে পুনরায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত ১০ জানুয়ারী চতুর্থ মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবার কথা ছিলো হুগো শ্যাভেজের।

কিন্তু কিউবায় ক্যান্সারের অপারেশনের কারণে তাঁর এই সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতাটুকু পালন করা তখন সম্ভব ছিলনা। তবে তার শপথ গ্রহন না করার কারণে দেশটিতে আইনগত ভাবে কোন সঙ্কট সৃষ্টি হয়নি। কারণ দেশটির সুপ্রিমকোট শ্যাভেজের শপথ গ্রহন স্থগিত রাখাকে বৈধ বলে রায় দিয়েছিল। এমনকি শ্যাভেজ পরে যে কোন সময় শপথ নিতে পারবেন বলে রায় দিয়েছিল দেশটির সুপ্রিমকোট। কিন্তু এতটা ভালবাসা থাকা সত্তেও এই মহান নেতার আর শপথ নেয়া হলো না।

দুরারোগ্য মরণব্যাধি ক্যান্সার ভেনিজুয়েলাবাসীদের মাঝ থেকে তাদের নেতাকে কেড়ে নিল এবং বিনিময়ে দিয়েছে অসামান্য কষ্ট আর চোখের জল। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর শ্যাভেজ চতুর্থবারের মত গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। শ্যাভেজ ১৯৫৪ সালে এক শ্রমিক শ্রেনীর পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন। তিনি ছিলেন তার স্কুল শিক্ষক পিতার দ্বিতীয় সন্তান। তরুন বয়সে শ্যাভেজ রাজনীতি নয়, বরং বেজবল স্টার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

তিনি ১৭ বছর বয়সে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ভেনিজুয়েলার স্বাধীনতার বীর সিমন বলিভারের রিভুলুশনারি বলিভারিয়ান মুভমেন্ট নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন এবং সৈন্যদের সংগঠিত করতে শুরু করেন। ১৯৯২ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কার্লোস আন্দ্রেস পেরেসের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অসন্তোষের সুযোগে শ্যাভেজ অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং দুই বছর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়। ১৯৯৪ সালে প্রেসিডেন্ট রাফায়েল ক্যালডেরা ক্ষমা করে দেয়ার পর শ্যাভেজ কারাগার থেকে মুক্তি পান।

১৯৯৮ সালে তিনি ভেনিজুয়েলার গরিবদের মধ্যে তেলসম্পদের সুবিধা বন্টন করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় এসেই তিনি তার সোস্যালিস্ট এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালান। নব্য উদারপন্থীদের বিরাষ্ট্রীকরণ কর্মসূচী বাতিল করে তিনি প্রধান প্রধান শিল্প কারখানা গুলো রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন। ১৪ বছরের শাসনামলে তিনি তেল থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে আমুল পরিবর্তন নিয়ে এসেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম তেলের আধার ভেনিজুয়েলায় তিনি ২০০১ সালে এক নতুন আইন চালু করেছিলেন যার বলে বিদেশী তেল কোম্পানিগুলোর গায়ে প্রবল আঘাত হানা হয়।

পূর্বে পশ্চিমাদের তেল কোম্পানি এক্সন, বিপি, শেল ও শেভরন ভেনিজুয়েলা থেকে আহরিত তেলের বিক্রয়লব্ধ অর্থের ৮৪ ভাগ পেত। শ্যাভেজ সেটা করেন ৭০ ভাগ। সরকারকে আগে রয়ালিটি দেয়া হত মাত্র ১ শতাংশ। এখন দিতে বাধ্য করা হল ১৬ শতাংশের বেশি। এভাবে আদায়কৃত বিপুল অর্থ দারিদ্র ও নিরক্ষরতা বিমোচনে ব্যয় করা হলো।

গত ১২ বছরে ভেনিজুয়েলা সামাজিক খাতে প্রভুত সাফল্য অর্জন করেছে। ঋণের নামে আইএমএফের শোষণ মোকাবেলায় তিনি পেট্রো ডলার কাজে লাগিয়েছিলেন। কিউবা বিপ্লবে অর্থ সহায়তা দিয়েছেন। ল্যাতিন আমেরিকার মিত্রদেশগুলোর কাছে তিনি কম মূল্যে তেল সরবরাহ করেছেন। ইরানের সঙ্গে মেত্রী করেছেন।

লিবিয়ার লৌহ মানব গাদ্দাফিকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই পাশ্চাত্য ও তাদের মিডিয়ার বিরাগভাজন হয়েছিলেন শ্যাভেজ। পশ্চিমারা তাকে বিতর্কিত, স্বৈরাচারী, একনায়ক প্রভৃতি বিশ্লেষনে হেয় করার চেষ্টা করেছে। কেননা তিনি সর্বদা মার্কিনসহ তার মিত্রদের সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ছিল বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর। তিনি জাতিসংঘে দেয়া বক্তৃতায় তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশকে ‘শয়তান’হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন।

শ্যাভেজ ভেনিজুয়েলায় গরিবদের ইমেজ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সেই শ্যাভেজ কারাকাসের জনগনের মাঝে আর নেই। তার অসুস্থতার কারণে অনেকেই শঙ্কিত ছিলেন যে, ভেনিজুয়েলার ক্যান্সার আক্রান্ত প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ কি শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের হাল ধরতে পারবেন? অবশেষে ভেনিজুয়েলাবাসীর শংকা বাস্তবে রুপায়িত হলো। কেননা মৃত্যুর সঙ্গে পুরোদস্তর লড়াই করে চলে গেলেন ভেনিজুয়েলাবাসীর মহান নেতা শ্যাভেজ। এদিকে শ্যাভেজের দল পিএসইউডি এবং ভেনিজুয়েলাবাসী শ্যাভেজের অসুস্থতার এই অমোঘ সত্যটি পূর্বেই মেনে নিয়েছিলেন এবং তার জন্য তারা শ্যাভেজ-উত্তর পরিস্থিতি বরণ করে নিতে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

দেশটির সংবিধান অনুসারে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। বিশ্লেষকরা মনে করছেন শ্যাভেজের মৃত্যুর ফলে দেশটির রাজনীতিতে এক ধরনের বিরুপ প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। পরবর্তী নির্বাচনই ঠিক করে দেবে দেশটির ভবিষ্যত। তাই সকলের আগ্রহ এখন দেশটির পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হবেন।

নিকোলাস মাদুরো না অন্য কেউ? এক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, গত বছর ৮ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে হুগো শ্যাভেজ প্রথমবারের মত বলেছিলেন, কোন অনাকাঙ্খিত পরিবেশ সৃষ্টি হলে এবং তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তিনি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। তাই এটা সুস্পষ্ট যে, নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে ক্ষমতাসীন ইউনাইটেড সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রার্থী হবেন বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। আবার বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, বর্তমান পার্লামেন্টের স্পিকার দিউসদাদো কেবেলো প্রেসিডেন্ট প্রার্থীও হতে পারেন। কেননা তিনি মাদুরোর প্রতিদ্বন্দ্বি। অন্যদিকে বিরোধী ডেমোক্র্যাটিক ইউনিটি (এমইউডি) অ্যালায়েন্সের প্রার্থী গত নির্বাচনে ৪৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন।

কারাকাসের গভর্নর হেনরিক ক্যাপরিলস ছিলেন শ্যাভেজের প্রতিদ্বন্দ্বি। শ্যাভেজ অন্তর্ধানের মধ্যে দিয়ে দেশটিতে পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হবে। তাই দেশটির সামনের নির্বাচনে হেনরিক ক্যাপরিসলসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনাও কম নয়। কেননা এক জড়িপে দেখা যায় যে, ক্যাপরিলস শ্যাভেজের অনুসারী অন্য যে কোন প্রার্থীর চেয়ে জনপ্রিয়। অবশ্য প্রেসিডেন্টের উত্তরসূরী হিসেবে নিকোলাস মাদুরো আগামীর নির্বাচনে শ্যাভেজের ইমেজের কারণে তার সহজে জয়লাভ করারও সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে শ্যাভেজের পরবর্তী নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যিনিই দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, তাকে কঠিন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। কেননা যদিও এই সাহসী নেতার মৃত্যুতে পশ্চিমা বিশ্বের নেতার শোকাহত হয়েছেন কিন্তু তার মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে দেশটিতে তাদের প্রভাব বিস্তারের সুযোগ সৃষ্টি হলো। কারণ শ্যাভেজের উপস্থিতিতে ল্যাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে তাদের কূটকৌশল তেমন কাজে আসেনি। যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে দেশটির সাথে গঠনমূলক সম্পর্ক সৃষ্টির কথা বলেছে। মাদুরো ছাড়া অন্যকোন উদারপন্থী নেতা ক্ষমতায় আসলে দেশটিতে পশ্চিমারা প্রভাব বিস্তার করতে পারবে বলে মনে করে বিশ্লেষকরা।

তবে ভেনিজুয়োর মানুষ শ্যাভেজের মৃত্যুর পরও পশ্চিমা বিরোধী স্লোগান অটুট রেখেছে। এছাড়া দেশটির অর্থনীতির গতি এখন শ্লোথ হোয়ে পড়েছে। মুদ্রাস্ফিতি এখন ১৮ শতাংশ, সম্ভবত ভবিষ্যতে আরো বাড়তে পারে। তবে নিকোলাস মাদুরো যদি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন, তার প্রধান কাজ হবে দলের মধ্যকার সংঘাত বন্ধ করা। যদিও শ্যাভেজ তার ব্যক্তিত্বের জন্য সহজেই অন্তর্কোন্দল সামাল দিতে পারতেন।

কিন্তু শ্যাভেজ পরবর্তী সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করাও খুব সহজ হবে না। কারণ কট্টর বামপন্থী হিসেবে অনেকেই মাদুরোর আস্থাভাজন হতে পারবে না। তবে যাই হোক দুরারোগ্য কান্সার যদিও নিবেদিত প্রাণ শ্যাভেজকে ভেনিজুয়েলাবাসীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে কিন্তু শ্যাভেজের মতাদর্শ বা তার ভিত্তিতে তৈরি সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামো এক নিমিষেই চুড়মার হবার নয়। কেননা দরিদ্র সংখ্যাধিক্যরা তাদের নায়ককে স্বরণ রাখবে চিরকাল। শুধু ভেনিজুয়েলা বা ল্যাতিন আমেরিকা নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তরের নির্যাতিত মানুষের মনেও শ্যাভেজ থাকবেন চিরকাল অম্লান।

কেননা এই সাহসী মানুষটিই মার্কিন অভিযানে আফগান শিশুর লাশের ছবি দেখিয়ে বলেছিলেন, সন্ত্রাস দিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়া যায় না। যা বিশ্বের অন্য কোন নেতা দ্ব্যর্থ কন্ঠে বলার সাহস পাননি। তাই অনেকেই মনে করেন,বলিভারিয়ান মুভমেন্টের বর্ধিত কলেবরকে তার মৃত্যুর পর হয়তো বলা হবে শ্যাভিজম। আর এই শ্যাভিজমকে ঘিরেই হয়তো আবর্তিত হবে ভেনিজুয়েলার রাজনীতি। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.