আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিহত লাদেন সাগরে লাশ



আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডো বাহিনী আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের দুর্গম এলাকায় প্রায় এক দশক পালিয়ে থাকার পর রবিবার রাতে নিহত হন যুক্তরাষ্ট্রের এক নম্বর শত্রু লাদেন। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের খুব কাছের শহর অ্যাবোটাবাদে লুকিয়ে ছিলেন তিনি। আল-কায়েদার শীর্ষ নেতাকে হত্যার খবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, সুবিচার নিশ্চিত করা হয়েছে ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার পর মৃতদেহ কবজায় নেয় মার্কিন সেনারা। যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম জানিয়েছে, লাশ সাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছে। আল-কায়েদাপ্রধান নিহত হওয়ার খবর প্রচারিত হওয়ার পরপরই উল্লসিত লোকজন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বাসভবন হোয়াইট হাউস, নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কয়ার ও টুইন টাওয়ারের গ্রাউন্ড জিরো এলাকায় সমবেত হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা উড়িয়ে তারা জয়ধ্বনি করতে থাকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কের টুইন টাওয়ার ও ওয়াশিংটনের পেন্টাগনে সন্ত্রাসী হামলার পর আল-কায়েদা নেতা বিন লাদেনকে ধরার জন্য অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালালে পতন হয় তাঁকে আশ্রয় দেওয়া তালেবান সরকারের। এর পর থেকে পালিয়ে ছিলেন দুর্ধর্ষ এই জঙ্গি নেতা। তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র ইউরোপীয় দেশের সেনাবাহিনীর ধারাবাহিক অভিযানেও কোনো সাফল্য পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব কাঁপানো এই জঙ্গি নেতার মাথার দাম আড়াই কোটি ডলার ঘোষণা করে।

এর পর থেকে ধারণা করা হচ্ছিল, বিন লাদেন আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় উপজাতি নেতাদের আশ্রয়ে রয়েছেন। কিন্তু রবিবার রাতের বিশেষ অভিযানে ইসলামাবাদ থেকে মাত্র ৩৫ মাইল উত্তরের একটি এলাকায় তিনি নিহত হন প্রেসিডেন্ট ওবামা গতকাল হোয়াইট হাউস থেকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ঘোষণায় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী ও সিআইএ কর্মকর্তাদের একটি যৌথ অভিযানে বিন লাদেন নিহত হয়েছেন। মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা জানান, অভিযানের সময় তিনি প্রতিরোধের চেষ্টা করেন এবং মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। ওবামা বলেন, 'দুই দশক ধরে আল-কায়েদার নেতা ও প্রতীক ছিলেন বিন লাদেন। তাঁর মৃত্যু আল-কায়েদার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

তবে আমাদের অভিযান এখানেই শেষ নয়। আল-কায়েদা নিশ্চিতভাবে আমাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ অব্যাহত রাখতে চাইবে। তাই আমরা অবশ্যই দেশ ও বিদেশে সজাগ তপরতা চালিয়ে যাব। ' যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ইসলামাবাদের উত্তরে অ্যাবোটাবাদ শহরে রয়েছে পাকিস্তানের সামরিক একাডেমী ও বড় একটি সামরিক ঘাঁটি ওই ঘাঁটি থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরত্বের একটি বিশাল বাড়িতে ছিলেন আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা নোংরা একটি গলির মাথায় যে বাড়িতে লাদেন থাকতেন, সেখানে টেলিফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, রবিবার রাতে সন্ত্রাসবিরোধী বাহিনীর কমান্ডো অভিযান চলার সময় অস্ত্র হাতে ওসামা বিন লাদেন প্রতিরোধের চেষ্টা চালান কিন্তু সেনাদের গুলি কপালে বিদ্ধ হয়ে তক্ষণা তাঁর মৃত্যু হয়।

গোলাগুলির সময় লাদেনের এক ছেলেও নিহত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বছরের পর বছর ধরে অনুসন্ধান চালানোর পর বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। তাঁর একজন ঘনিষ্ঠ সহচরের ওপর নজরদারি চালিয়ে খুঁজে পাওয়া যায় অ্যাবোটাবাদের আস্তানাটি। কিউবার গুয়ানতানামো বে কারাগারে আটক আল-কায়েদার এক সদস্য বেশ কয়েক বছর আগে ওই সহচরের ছদ্মনাম গোয়েন্দাদের জানিয়েছিলেন। পরে ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়ে চার বছর আগে তাঁর আসল পরিচয় জানা যায়। বিন লাদেনের এই অতি বিশ্বস্ত ব্যক্তি কোথায় আছেন সে ব্যাপারে তথ্য পেতে সময় লাগে আরো দুই বছর।

যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা তাঁকে অনুসরণ করে গত আগস্টে অ্যাবোটাবাদ শহরের বাড়িটির ঠিকানা জানাতে পারেন ঊর্ধ্বতন এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, 'আল কায়েদার ওই সদস্য ও তাঁর ভাইয়ের বাড়িটির খোঁজ পাওয়ার পর আমরা বিস্মিত হয়েছিলাম। বিশাল একটি প্লটের ওই বাড়ির নির্মাণশৈলী বেশ অদ্ভুত। নিরাপত্তার বিভিন্ন আয়োজন রয়েছে সেখানে। বাইরের উঁচু দেয়াল ছাড়াও ভেতরে রয়েছে বেশ কয়েকটি প্রতিরক্ষা বেষ্টনী। এলাকার অন্যসব বাড়ির তুলনায় ওই আস্তানাটি অন্তত আট গুণ বড়।

সেখানে কারা থাকে সে ব্যাপারে ধারণা নেই স্থানীয় লেকজনের গত আগস্ট থেকে বিশাল বাড়িটি সিআইএর নিয়মিত পর্যবেক্ষণের মধ্যে ছিল। স্যাটেলাইটের ছবি এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে গত সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা বাড়িটিতে বিন লাদেনের অবস্থানের বিষয়ে মোটামুটি নিশ্চিত হন। আল-কায়েদার শীর্ষ নেতাকে নিরাপদে লুকিয়ে রাখার উদ্দেশ্যেই ২০০৫ সালে অ্যাবোটাবাদ শহরে ওই বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। এর চারপাশ ঘিরে থাকা প্রায় ১৪ ফুট উঁচু দেয়ালের ওপরে ছিল নিরাপত্তাবেষ্টনী ও সিসি ক্যামেরা। তিনতলার মূল ভবনটিতে গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য টেলিফোন অথবা ইন্টারনেট সংযোগ ছিল না।

বাসিন্দারা বাড়ির বর্জ্য বাইরে না ফেলে তা পুড়িয়ে ফেলত। তবে এত কিছুর পরও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাদের চোখ এড়ানো যায়নি বিন লাদেনের অবস্থান সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার পর গত মার্চে বিষয়টি প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে জানানো হয়। তিনি ১৪ মার্চ ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। পরবর্তী ছয় সপ্তাহের মধ্যে এ ধরনের আরো চারটি বৈঠকে অভিযানের খুঁটিনাটি চূড়ান্ত করা হয়। গত শুক্রবার অভিযানের অনুমোদন দেন ওবামা।

সর্বশেষ রবিবার যুক্তরাষ্ট্রের সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে হোয়াইট হাউসে এক বৈঠকে পরিকল্পনা শেষবারের মতো খতিয়ে দেখা হয়। এই পুরো প্রক্রিয়ার কোনো কিছুই পাকিস্তান সরকারকে জানানো হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা ওই বাড়ি সম্পর্কে অন্য কোনো দেশ এমনকি পাকিস্তানকেও কোনো তথ্য জানাইনি। ' জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে অভিযান চালাতে সক্ষম যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর বিশেষ কমান্ডো ইউনিট 'সিল'-এর কয়েকজন সদস্য সিআইএর সহায়তা নিয়ে রবিবার রাতের মিশনে অংশ নেন। এ সম্পর্কে সরকারিভাবে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, অভিযানে বিন লাদেন ও তাঁর এক ছেলে, ওই সহচর ও তাঁর ভাই এবং এক নারী নিহত হয়েছেন। ওই নারীকে জঙ্গিরা মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। মাত্র ৪৫ মিনিটের অভিযানে আল-কায়েদার শীর্ষ নেতাকে হত্যার পর লাশ হেলিকপ্টারে তুলে নিয়ে আফগানিস্তানে চলে যায় কমান্ডোরা। সেখানে ডিএনএ পরীক্ষা এবং মুখের কাঠামো বিশ্লেষণ করে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর খবর পাঠানো হয় বারাক ওবামার কাছে। অভিযানের প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় লোকজন জানায়, রাত সাড়ে ১০টার দিকে প্রচণ্ড শব্দে দু-তিনটি হেলিকপ্টার বিন লাদেনের বাড়ির বাইরে অবতরণ করে।

কমান্ডোরা দ্রুত হেলিকপ্টার থেকে নেমে পশতু ভাষায় স্থানীয়দের বাড়ির লাইট অফ করে ভেতরে থাকার নির্দেশ দেয়। এর কিছু সময় পর দেয়ালঘেরা বাড়ি থেকে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। আগুন জ্বলতে দেখা যায় কয়েকটি কক্ষ থেকে অভিযান শেষে যুক্তরাষ্ট্রের কমান্ডোরা চলে যাওয়ার পর ঘটনাস্থলে যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। স্থানীয় লোকজন জানায়, গোলাগুলির সময় একটি হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এক সেনা কর্মকর্তা বলেন, অভিযান শেষে ফেরার পথে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয় লাদেনকে হত্যার আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বলেন, 'অভিযানে কমান্ডোদের কেউ হতাহত হয়নি।

বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর ব্যাপারে সবাই সতর্ক ছিল। ' নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানান, বিন লাদেনের কবর ভবিষ্যতে যাতে সন্ত্রাসীদের তীর্থভূমিতে পরিণত না হয়, সে জন্য লাশ সমুদ্রগর্ভে দাফন করা হয়েছে। ইসলামী রীতি মেনেই লাশ দাফন করা হয়। আল-কায়েদার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরির বিষয়ে গতকাল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বিভিন্ন গুঞ্জন চললেও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। আল-কায়েদার পক্ষ থেকেও ঘটনা সম্পর্কে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।

তবে পাকিস্তানে আল-কায়েদার সমর্থক তেহরিক-ই-তালেবান (টিটিপি) মুখপাত্র এহসান উল্লাহ এহসান এক বিবৃতিতে বলেছেন, 'লাদেন হত্যার বদলা হিসেবে প্রেসিডেন্ট জারদারি এবং সামরিক বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালানো হবে। ' পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে গতকাল বিকেলে বিন লাদেনের নিহত হওয়ার তথ্য স্বীকার করা হয়েছে। সূত্র : স্কাইনিউজ, নিউ ইয়র্ক টাইমস, দ্য টেলিগ্রাফ, গার্ডিয়ান, এপি, এএফপি, বিবিসি, জিনিউজ, এনডিটিভি, ডন অনলাইন।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.