মৃত্যুর মিছিলে আরও যোগ হলো ১১ লাশ।
জামায়াতের ডাকা সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে গতকাল পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবির ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটেছে লালমনিরহাটে। এখানে পুলিশের গুলিতে ও ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন তিন শিবির কর্মী। প্রতিশোধ নিতে বাড়ি থেকে ধরে এনে শিবির কর্মীরা কুপিয়ে হত্যা করেছে এক ছাত্রলীগ ও দৌড়ে পালানোর সময় এক যুবলীগ কর্মীকে।
জয়পুরহাটে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছেন দুই শিবির কর্মীসহ তিনজন। লক্ষ্মীপুরে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। সিলেটে শনিবার জামায়াত-শিবিরের হামলায় আহত যুবলীগ নেতা এবং নারায়ণগঞ্জে পুলিশের গুলিতে আহত একজন গতকাল মারা গেছেন। বিভিন্ন স্থানে রাস্তা কেটে, গাছের গুঁড়ি ফেলে, একাধিক স্থানে বেইলি ব্রিজের পাটাতন খুলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। কোথাও রেললাইনের ফিশপ্লেট উপড়ে ফেলা হয়েছে।
সংঘর্ষের ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন শতাধিক। এর মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আহত হয়েছেন তিন শতাধিক ব্যক্তি। বিভিন্ন স্থান থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে অন্তত ১০০ জন। তবে রাজধানীতে হরতাল ছিল ঢিলেঢালা।
নিজস্ব প্রতিবেদক ও জেলা প্রতিনিধিদের খবর- লালমনিরহাট : পাটগ্রামে পুলিশের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে ছাত্রলীগ নেতাসহ নিহত হয়েছেন পাঁচজন। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও নয়জন। আহত হয়েছেন অর্ধশতাধিক। নিহতরা হলেন শিবিরের পাটগ্রাম উপজেলা সভাপতি মনিরুল ইসলাম (২৫) ও পৌর সাধারণ সম্পাদক সাজু এবং কর্মী আবদুর রহিম (২২) এবং উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মিন্টু (৩১) ও এক যুবলীগ কর্মী (পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়নি)। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলার মির্জারকোট বাজারে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের করে জামায়াত-শিবির।
এতে বাধা দেয় পুলিশ। পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল ও গুলি ছোড়ে পিকেটাররা। এ সময় একটি ট্রাকসহ বেশ কয়েকটি যানবাহনে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে তারা। জবাবে পুলিশ রাবার বুলেট, টিয়ার শেল ও গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন শিবির কর্মী আবদুর রহিম।
শিবিরের পাটগ্রাম উপজেলা সভাপতি মনিরুল ও পৌর সাধারণ সম্পাদক সাজুসহ গুলিবিদ্ধ হন ১১ জন। আহত হন শতাধিক। গুলিবিদ্ধ ১১ জনকে পাটগ্রাম হাসপাতালে নিয়ে গেলে মনিরুল ও সাজু সেখানে মারা যান। আশঙ্কাজনক ছয়জনকে রংপুর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দলীয় নেতা-কর্মী নিহতের ঘটনায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে শিবির।
এর প্রতিশোধ নিতে দুপুরে শিবির কর্মীরা বাড়ি থেকে ধরে এনে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা মিন্টুকে। আর পালিয়ে যাওয়ার সময় ধরে এনে কোপানো হয় অজ্ঞাত এক যুবলীগ কর্মীকে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন তিনি। একই সময় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের আটটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয় জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। এদিকে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেল রুটের বাউরা এলাকায় শিবির কর্মীরা রেললাইনের ফিশপ্লেট খুলে ফেলায় ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
সহিংস ঘটনার কারণে পাটগ্রামে বেলা ১২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করেছে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রফিকুল হক। অন্যদিকে শিবির কর্মীদের গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জেলা জামায়াত। জয়পুরহাট : আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০ জন গুলিবিদ্ধসহ আহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। বিকালে জামায়াত-শিবির কর্মীরা পুরানাপুল বাজারে হামলা চালিয়ে কয়েকটি দোকান ভাঙচুর ও কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে।
এ ঘটনার আধঘণ্টা পর পুলিশ, বিজিবি, র্যাব এক হয়ে হালট্রি গ্রামে গেলে জামায়াত-শিবির কর্মীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গুলি চালালে ঘটনাস্থলে নিহত হন শামীম (২৪) নামের এক শিবির কর্মী। হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান গুলিবিদ্ধ শিবির কর্মী ইনসান (২২) ও ভ্যানচালক ফিরোজ। দলীয় কর্মী নিহতের প্রতিবাদে বাইপাস সড়কে একটি আলুবোঝাই ট্রাক ও দুটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দিয়েছে শিবির। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সোমবার ভোর ৬টা পর্যন্ত শহরে ১৪৪ ধারা জারি করেছে জেলা প্রশাসন।
গুলিবিদ্ধদের মধ্যে গৃহিণী রাজিয়া ও যুবক শাকিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। লক্ষ্মীপুর : রায়পুর-পানপাড়া সড়কের লুধুয়া বাজারে সন্ধ্যায় জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিরাজ হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় মাসুদ নামের এক যুবলীগ কর্মীকে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে তারা। তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। সূত্র জানায়, সহযোগী মাসুদ ও বাহারকে নিয়ে মিরাজ মোটরসাইকেলে মিরগঞ্জ থেকে রায়পুর শহরে আসছিলেন।
লুধুয়া বাজারে পেঁৗছলে দুর্বৃত্তরা গতি রোধ করে তাদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় বাহার দৌড়ে পালিয়ে গেলেও মিরাজ ও মাসুদকে উপর্যুপরি কুপিয়ে জখম করা হয়। এ সময় ঘটনাস্থলেই নিহত হন মিরাজ। সিলেট : জামায়াত-শিবিরের হামলায় খুন হয়েছেন কানাইঘাট পৌর যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম (৩০)। তিনি দলইমাটি গ্রামের মোতাহির আলীর ছেলে।
শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে কানাইঘাটের সুরমা সেতু-সংলগ্ন নয়াতালুক এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে জামায়াত-শিবির কর্মীরা পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক নজরুল ইসলামকে কুপিয়ে হত্যা করে বলে জানা গেছে। হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রাতেই দলইমাটি গ্রামের জামায়াত কর্মী হারুন মিয়ার বাড়িতে আগুন দেয় আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের বিক্ষুব্ধ নেতা-কর্মীরা। ছাত্রদল ও শিবিরের চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। সিদ্ধিরগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) : শনিবার সন্ধ্যায় যানবাহন ভাঙচুরের সময় পুলিশের গুলিতে আহত যুবক রাসেল (২৬) গতকাল সকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা গেছেন।
স্থানীয়রা তাকে পরিবহন শ্রমিক দাবি করলেও পুলিশ বলছে নিহত রাসেল শিবির কর্মী ছিলেন। বাগেরহাট : শহরতলির দশানীর পচাদীঘির পাড় এলাকায় রাতে জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে আহত হয়েছেন বাগেরহাট মডেল থানার ওসিসহ চার পুলিশ সদস্য। সংঘর্ষে এসকেন্দার (২২) নামে একজন গুলিবিদ্ধসহ তাদের ছয়জন আহত হয়েছে বলে দাবি জামায়াতের। পুলিশের হাতে আটক দুজনকে ছাড়িয়ে নিতে জামায়াত-শিবির কর্মীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে পুলিশের ওপর হমলা চালায়। এ সময় দায়ের কোপে মডেল থানার ওসি মো. লিয়াকত এবং পুলিশ সদস্য আবদুল হামিদ ( ২৬), তানজির (২৫) ও ভিক্টর (২২) আহত হন।
বেশ কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে। বগুড়া : বেলা সাড়ে ১১টায় শাজাহানপুরের মাঝিড়া বন্দরে হরতাল চলাকালে দুর্বৃত্তরা সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মুক্তিযোদ্ধা হযরত আলীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম করে। এদিকে শহরের খান্দার সড়কে বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ ও অগি্নসংযোগ এবং শহরতলির খামারকান্দিতে পাথরবাহী দুটি ট্রাকে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগি্নসংযোগ করেছে। রংপুর : পীরগাছা উপজেলায় প্রহরীদের বেঁধে রেখে ২৫২ ফুট রেললাইন ও রেলসেতুর পাটাতন উপড়ে ফেলেছে জামায়াত-শিবির কর্মীরা। ভোরে পীরগাছা রেলস্টেশন থেকে ছয় কিলোমিটার দূরে কুকড়া রেলসেতুতে এ নাশকতা ঘটানো হয়।
পরিস্থিতি দেখতে গিয়ে লাইনচ্যুত হয় একটি টহল ট্রেন। এর পর থেকে লালমনিরহাট ও রংপুরের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। পীরগাছা স্টেশনের চৌকিদার হীরালাল রায় জানান, শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে শতাধিক জামায়াত-শিবির কর্মী এসে তাদের বেঁধে ফেলে। পরে তারা রেললাইন ও সেতুর পাটাতন উপড়ে ফেলে চলে যায়। বিকালে রংপুর প্রেসক্লাব কমপ্লেঙ্ মর্কেটের দ্বিতীয় তলায় সুন্দরবন কুরিয়ার সার্ভিসের ভিডি (টাকা লেনদেন) শাখার ভেতরে ঢুকে পেট্রল ঢেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
পাবনা : ঢাকা থেকে সনি পরিবহন নামে একটি কোচ বিকল্প সড়কে পাবনা শহরে আসার পথে আটঘড়িয়া-চাটমোহর সড়কের সঞ্জয়পুর নামক স্থানে জামায়াত-শিবির কর্মীদের নাশকতার মুখে পড়ে। বাসটিতে ভাঙচুর শেষে আগুন দেয় তারা। এতে বাসটি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কুমিল্লা : স্থানীয় সূত্র জানায়, ভোররাতে ১০-১৫ জন মুখোশধারী মনোহরগঞ্জ-লক্ষ্মণপুর সড়কের লৎসর সীমানায় প্রায় পাঁচ ফুট রাস্তা ও উভয় পাশের গাছ কেটে ফেলে। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
নগরীর চকবাজার এলাকায় ৮-১০টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ : শিবগঞ্জের পাইলিং মোড়ে শনিবার রাতে একটি বিআরটিসি বাস পুড়িয়ে দিয়েছে জামায়াত-শিবির। সিরাজগঞ্জ : জেলা যুবদলের সভাপতি আবু সাঈদ সুইটসহ তিন নেতার গ্রেফতারের প্রতিবাদে ও জামায়াতের দেশব্যাপী হরতাল চলাকালে খোকশাবাড়ীতে পুলিশের ওপর ককটেল হামলা চালিয়েছে পিকেটাররা। নারায়ণগঞ্জ : শহরের উকিলপাড়া এলাকায় শিবিরের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় শিবির বেশ কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়।
দিনাজপুর : শিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য ও দিনাজপুর শহর শাখার সভাপতি মতিউর রহমানসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হরতালের সমর্থনে মিছিল শেষে তারা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে রাস্তা অবরোধের চেষ্টা করে শিবির। কুষ্টিয়া : ভেড়ামারার সাতবাড়িয়া হিসনা ব্রিজের কাছে সকালে একটি খড়বোঝাই ট্রলিতে আগুন ধরানোর সময় জাসদ ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা দুই শিবির কর্মীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করে। পরে ভ্রাম্যমাণ আদালত এক বছর করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন তাদের। চট্টগ্রাম : নগরীসহ কয়েকটি এলাকায় ককটেলের বিস্ফোরণ ও গাড়ি ভাঙচুর করে জামায়াত-শিবির কর্মীরা।
পাঁচলাইশ থানার বেবি সুপার মার্কেট এলাকায় একটি গাড়িতে আগুন দেওয়ার চেষ্টা করে তারা। বিভিন্ন স্থানে চালানো হয়েছে ককটেল হামলা। রাজশাহী : হরতালের সমর্থনে বেলা ১২টার দিকে মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্ট থেকে বের হওয়ার আগেই জাপার ব্যানার কেড়ে নেয় পুলিশ। এ সময় বাধা উপেক্ষা করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে ফাঁকা গুলি ছুড়ে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এতে জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুদ্দিন রেন্টু গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দলটির পক্ষে দাবি করা হয়েছে।
পরে আর কোনো কর্মসূচিতেই দেখা যায়নি তাদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।