আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা, তাই মাছি বসে আছে



আসমানি ভিউ বনাম পোকায়িত জীবন শহরের চারপাশে কিছু টাওয়ার চোখে পড়ে। বেশ উঁচুতে। নিচের গাড়ি, বাড়ি, মানুষকে পোকা মনে হয়। টাওয়ারগুলোর সাইজ বিভিন্ন। খুব উঁচু, মাঝারি, ছোটও আছে।

তবে প্রত্যেকের ভিউ একটাই- যাকে আসমানি ভিউ কিংবা খোদাতাআলার ভিউ বলা যায়। টাওয়ারগুলোতে নানা সাইজের কুঠুরি আছে। আয়েশে থাকার জন্য বেশ বিলাসী কায়দায় তৈরী কুঠুরি। জানালায় দূরবীন তাক করা, চোখ লাগালেই দূরে দেখা যায় মানুষের পোকায়িত জীবন। আবার আরামে বিছানায় গা ডুবিয়ে গড়াগড়ি খাওয়ার সময় দেয়ালে টাঙ্গানো মনিটরে মাঝে মাঝে চোখ ঘোরালেও চলে।

বিভিন্ন উদ্দেশ্যে নানা দেশের জনতা রীতিমত লাইন ধরাধরি করে, এই টাওয়ারগুলোতে থাকার জন্য। কেউ আসে গবেষণার উদ্দেশ্যে, কেউ ভ্রমণ পিপাসু, আবা্র অনেকে আসে পরিবার সমেত আনন্দ বিনোদনের জন্য। সবার জন্যই রয়েছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা। সরকার এ ব্যাপারে কোনো কুণ্ঠা বো্ধ করে না। বিদেশী সংস্থাগুলোও টাওয়ার নিয়ে সজাগ, এবং উদার।

প্রতিবছর সরকার এ খাতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ভিক্ষা পায়। অতিউলঙ্গ তাহারা শহরের কোণায় কোণায়, রাস্তার পাশে; বিশেষত বাসস্ট্যান্ডগুলোতে গোপন ক্যামেরা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। এই ক্যামেরাগুলো প্রতিমূহুর্তের situation পাঠিয়ে দেয় টাওয়ারগুলোর মনিটরে। সবধরণের বাসের ভেতর, লেগুনা আর চ্যাম্পিয়নের অভ্যন্তরেও্ লাগিযে দেয়া হয়েছে গোপন ক্যামেরা। এমনকি শহরের প্রত্যেক ঘরে-যেখানে লোডশেডিং নিয়মিত-সেখানেও রেহাই নেই।

শহরের প্রত্যেক গলিঘুপছি, পথঘাট সমস্তই এখন টাওয়ারের চারদেয়ালে ঠাঁই নিয়েছে। শহরবাসি এ ব্যাপারে কিছু জানে কিনা কিংবা জানলেও তারা মোটামোটি গোছের নির্বিকার কিনা- এ ব্যাপারে তেমন কিছুই জানা যায় না। সরকারও এ বিষয়ে অন্যমনস্ক ভানাক্রান্ত। লোকজনের মুখ দেখেও কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্ত তৈরী হয় না। এরা কিছু অদ্ভুত আচরণে আক্রান্ত।

উঠো টাওয়ার, উঠো আকাশের দিকে শহরের তীব্র যানজট, মানুষের হুড়োহুড়ি, বিদ্যুৎ সংকট ইত্যাদিতে মানুষ যখন নিজেদের জন্তু জানোয়ার ভাবা শুরু করেছে, ঠিক তখন শহরবাসীদের মধ্যে যারা জ্ঞানী তারা চিন্তাভাবনা করলো, কিভাবে এই নেতিবাচক দশাকে ইতিবাচক পথে হাঁটানো যায়। তারা সরকারকে চিঠি পাঠালো, ফ্যাক্স করলো; আবার অনেক অতি উৎসাহী মোবাইল ফোনে ক্রমাগত বিরক্ত করতে থাকলো। সরকার তার গন্ডারশরীর নিয়ে তেমন উৎফুল্ল হতে পারছিলো না। কিন্তু জ্ঞানীদের কেউ কেউ বিদেশী দাতাসংস্থাগুলোর লেজ ধরে মোচড়ামোচড়ি করাতে তারা সরকারকে বেশ জোরেই গুঁতিয়ে দিলো। প্রথম দিকে সরকার গন্ডারীয় আচরণ বজায় রাখলেও পরে মুলো দেখে সামলাতে পারলো না; জিভ বেরিয়ে আসলো এবং দ্রুততার সাথে মাঠে নেমে পড়লো।

নানান বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তাবনা সামনে আসলো। খারিজ হলো। বিদেশীসংস্থাগুলো দু'পাশে মাথা নাড়লো, সরকার না করে দিলো। তারা যখন অনুমতি দিলো সরকার নাচুনি বুড়ির মতই ঢোলের বাড়ি অনুসরণ করলো। একের পর এক শহরেরে নানাপ্রান্তে গজিয়ে উঠলো টাওয়ার।

লোকজন এটা নিয়ে কিছুদিন খুব আলাপ-সংলাপ করলো। তারপর স্বভাবতই ভুলে গেলো। মাঝেমাঝে মনকোণে উদয় হলে্ও তারা আর এ বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দিতে চাইলো না। আর কত। হয়তো এ টাওয়ারগুলো- ক) নয়া অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসা, অথবা খ) হাওয়া খাওয়ার বড়োলোকি ব্যবস্থা, অথবা গ) সরকারী নিরাপত্তা বেষ্টনী ইত্যাদি প্রত্যেকেই তাদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভুলে গেলো টাওয়ার কাহিনী।

টাওয়ার উঠলো। সাদা আর নীল রঙা উঁচু, মাঝারি, নিচু টাওয়ার। রাতে লোডশেডিং এ সারা শহর অন্ধকার হলেও টাওয়ারগুলো জ্বলজ্বল করতে থাকে। শহরবাসী অনেকেই এই নয়া আধুনিকতাকে নিজেদের প্রাপ্তি বলে মনে করতে শুরু করে। তোমাদের শরীরি ভাষায় ক্রীড়ারত বিনোদন, তথ্য-উপাত্ত এবং কলা 'টাওয়ার শুধুমাত্র গবেষকদের জন্য'‌‌-শুরুতে এই অনুমোদন দেয়া হয় সরকারেরে পক্ষ থেকে।

নানা দেশের গবেষকরা টাওয়ারগুলোতে বসবাস আরম্ভ করে। তারা দিনের পর দিন টাওয়ারগুলোতে অবস্থান করতে থাকে। দূরবীন এবং মনিটর মারফত যে উপাদানগুলো তারা দৈনিক পেতে থাকে তা তাদেরকে সন্তুষ্ট করতে পারে না। তারা আরো তথ্য উপাত্তের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। ফলে তারা নিয়োগ দেয় দেশীয় মাঠকর্মীদের।

এই স্থানীয় মাঠকর্মীরা লোকজনের সাথে কথা বলা, তাদের অন্দরমহলে ঢুকে পড়া জাতীয় কাজগুলো করতে থাকে। মাস শেষে এই মাঠকর্মীদের মজুরি স্বরূপ লেপটপ প্রদান করে বিদায় করে দেয়া হয়। এবং আরো বহু লেপটপ প্রার্থীদের মধ্য থেকে নিয়োগ দেয়া হয় নয়া মাঠকর্মীদের। খুব দ্রুতই এ শহর গবেষকদের সুনজরে চলে আসে। মানুষের বিচিত্র আচরণ-বিশেষত রাস্তাকেন্দ্রীক তাদের জীবনযাত্রা, তাদের দৈনন্দিন হুড়োহুড়ি, লুটোপুটি গবেষকদের উত্তেজিত করে তোলে।

এমনকি তারা তাদের সঙ্গী/নিদের সাথে সহবাস করতেও ভুলে যায়। গবেষকরা যখন এমন নানা তথ্যে উপাত্তে বিগলিত, তখন পৃখিবীর জ্ঞানীগুণীরা এই শহরেরে dramatic elements গুলোর গন্ধ পেযে যান। বাসে ওঠার সময় মানুষের শরীরীভাষা। তাদের অঙ্গভঙ্গি। পরস্পর কামড়াকামড়ি।

মুখভঙ্গি, তাদেরকে মুগ্ধ করে। বাসের চারদেয়ালের ভেতর যাত্রীদের পারস্পরিক শব্দ বিনিময়, হাতাহাতি, নির্বিকার ঘামযুক্ত মুখ- ইত্যাদি দেখে তারা "এতদিন কোথায় ছিলাম" জাতীয় আক্ষেপে পারলে কেঁদে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে তারা সরকারকে চাপাচাপি শুরু করেন যাতে অন্তত লোডশেডিং এর সময় গৃহবাসীদের দশা তারা দেখতে কিংবা শুনতে পারেন। সরকার নারাজ হয়, আবার এই নারাজি মুখ থুবড়েও পড়ে। তাই dramatic elements-এর সরবরাহ আরো বহুমাত্রিক হয়ে ওঠে।

গবেষকদেরও দাঁত বেরিয়ে আসে গবেষনায় নতুনমাত্রা য়োগের আনন্দে। আরেকদল লোক এ সময় মনযোগী হয় এ শহরের প্রতি। এরা ভ্রমণপিপাসু মানুষ। টাওয়ার কি? এবং এ টাওয়ারের সুযোগ সুবিধা কোন্ পর্যায়ের-জেনে তারা আপ্লুত হয়; তারাও সরকারেরে কাছে আবেদন জানায়। ফলে সরকার নানাজাতের টাওয়ার তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

বিদেশী সংস্থাগুলো এ ব্যাপারে হাত বাড়িয়ে দেয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, এ ঘটনার পর হিমালয় অঞ্চল থেকে ভ্রমণপিপাসুদের চোখ চলে গেছে টাওয়ারগুলোর চুড়ায়। বিনোদনপ্রিয় লোকজন যখন এ শহরের ইতিবৃত্ত জানতে পারে তাদের স্নায়ুতে গভীর সুখ জাগরিত হয়। এ শ্রেণীর লোকেরা চাঁদে ঘুরতে যায়, চাঁদে জমি কিনে রাথে, আরব আমিরাতে দ্বীপ দখল করে। এরা তাদের লম্বা জিভে টাওয়ারকে জড়িয়ে ধরতে তাই দেরি করে না্।

পরিবার পরিজন নিয়ে তারা টাওয়ার এ এসে ওঠে। শহরেরে মানুয়ের মহাবিচিত্র আচরণে তারা অভূতপূর্ব বিনোদনের রসদ খুঁজে পায়। হাসতে হাসতে এরা গড়িয়ে পড়ে। আবার একই স্তরের আবেগে এরা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে। এবং শহরের চারপাশে কিছু টাওয়ার চোখে পড়ে।

বেশ উঁচুতে। কলোনী: ৩ ২০১১

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.