আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঢাকা! আহ ঢাকা! তুমি যেন এক বেশ্যা, যাকে কেবল ব্যবহার করা চলে...



চারশ' বছরের পুরনো আমাদের এই প্রিয় শহরটির ভবিষ্যৎ কি? আমার এই শহর, এই 'মনোরম মনোটোনাস' ঢাকা শহর মাঝে মাঝে এর অদ্ভুত আর প্রায় অসম্ভব অস্তিত্ব নিয়ে চেপে বসে আমার বুকের ওপর। এটা কোনো শহর হলো? কোনো পরিকল্পনা নেই, কোনো সুদূর-সুনির্দিষ্ট ভাবনা নেই কারো মধ্যে এই শহর নিয়ে। যে যার ইচ্ছে মতো ব্যবহার করছে একে। কেউই ঢাকাকে ভালোবাসে না- ঢাকা যেন এক বেশ্যা, যাকে কেবল ব্যবহার করা চলে। সারাদেশ থেকে এখানে আসা মানুষগুলো হচ্ছে এর খদ্দের, আর এখানে যারা জমিটমির মালিক, তারা হলো পতিতালয়ের মাসিদের মতো- ওই পুঁজিটুকুর সর্বোচ্চ ব্যবহার করেই ছাড়বে।

আর তাই, বিশাল বিশাল সব অট্টালিকা বিরামহীন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে- পাশাপাশি দুটো অট্টালিকার মাঝখানে কোনো ফাঁকা জায়গা ছাড়াই, কারণ, কেউ এতটুকু ছাড় দিতে রাজি নয়। এভাবে চলতে থাকলে একদিন এই শহরের মানুষগুলো নিঃশ্বাস নেবার সুযোগ পাবে না, হাঁসফাঁস করতে করতে মরে যাবে। আমি ভেবে পাই না, একটি দেশের রাজধানী শহরে এরকম অপরিকল্পিত কার্যকলাপ চলে কিভাবে? একের পর এক অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে- কিন্তু এর বাসিন্দাদের জন্য পানি-গ্যাস-বিদু্যৎ ইত্যাদি নাগরিক সুবিধাদির ব্যবস্থা কি করা হচ্ছে? এ রকম একেকটা বিল্ডিং-এ যতগুলো মানুষ বাস করে- তাদের ময়লা ফেলার জন্য আলাদা করে একটা ডাস্টবিনের ব্যবস্থা করা দরকার, তা কি করা হচ্ছে? না, হচ্ছে না। তাই তো রাস্তাঘাটে নোংরা আবর্জনার ছড়াছড়ি- পুরো শহরটাই যেন এক ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। সুয়ারেজ ব্যবস্থাও তো মনে হয় ভেঙে পড়েছে, মানুষ বাড়ছে- তাদের মলমূত্র ত্যাগ করা তো আর থেমে নেই, সেগুলো প্রোপারলি পাস করার ব্যবস্থা না করেই এইসব অট্টালিকা নির্মাণের অনুমতি সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষ কিভাবে দেয়? শুধু কি তাই? মানুষ বাড়ছে, যানবাহন বাড়ছে- রাস্তাঘাট তো আর বাড়ছে না, বাড়াবার জায়গা-ই বা কোথায়? চারদিকে কেবল এ্যাপার্টমেন্ট আর মার্কেট।

ফল যা হবার তাই হয়েছে- রাস্তায় দুঃসহ যানজট। আচ্ছা, এত যে অ্যাপার্টমেন্ট আর মার্কেট গড়ে উঠেছে, অ্যাপার্টমেন্টগুলো দেদারসে বিক্রি হচ্ছে, মার্কেটগুলোও বেশ সরগরম থাকে প্রায় সারাবছরই- মানুষ এত টাকা পেলো কোথায়? এত অ্যাপার্টমেন্ট বিক্রি হয় কিভাবে? এতগুলো মার্কেট চলে কিভাবে? আমি থাকি মালিবাগে। গুনে দেখেছি, মগবাজার মোড় থেকে মালিবাগ মোড় পর্যন্ত আধা কিলোমিটারের মধ্যে বারোটা মার্কেট- আরো দু-একটা হচ্ছে! এটা কোনো পশ এলাকা নয়, নিতান্তই মধ্যবিত্তদের বসবাস এখানে, এতগুলো মার্কেট তাহলে চলে কিভাবে? শহর জুড়েই এই একই চিত্র। মার্কেট আর মার্কেট। হিসেব মেলে না কিছুতেই।

এই শহরের চরিত্র বুঝতে পারি না। এ কি এক চরিত্রহীন শহরে পরিণত হলো? আবার দেখুন, একদিকে অট্টালিকা, সোডিয়াম বাতি, মার্কেট আর আরেকদিকে ফুটপাতে ছিন্নমূল মানুষের ভিড়, সেখানেই তাদের ধুলোর সংসার। এগুলো কি কারো চোখে পড়ে না? নাকি দেখে দেখে সয়ে গেছে? কেমন নির্বিকার, নিস্পৃহ, নিরাসক্ত; নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই। যেন জীবনটা নিয়ে বড্ড ঝামেলায় পড়ে গেছে তারা, কি থেকে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না, এখানে সুখ নেই তো ওখানে চলো- ভেবে এখানে ওখানে দৌড়াচ্ছে, কিন্তু সুখ আর পাওয়া যাচ্ছে না। এ রকম হবার কথা ছিলো নাকি- এই যে সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে, এই যে সুখ ও সাফল্য নামক অধরা জিনিসগুলোর জন্য সবাই অন্ধ হয়ে দৌড়াচ্ছে- এমন কি হবার কথা ছিলো? জানি না, বুঝি না।

এতসব সুরম্য অট্টালিকা গড়ে উঠেছে, অথচ আমার মাঝে মাঝে মনে হয়- সবকিছু ভেঙে পড়ছে; যেন ফাঁপা একটি কাঠামো দাঁড়িয়ে আছে- ভেতরে সারবস্তু বলতে কিছু নেই। সবকিছুর ভেতরে ক্ষয়ে যাবার ছাপ। আর এই ক্ষয়িষ্ণু শহরে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে আসছে মানুষ- দেশের নানা প্রান্ত থেকে। জীবিকার সন্ধানে, বেঁচে থাকার উপায় খুঁজতে, সাফল্য ও প্রতিষ্ঠা লাভের মোহে- আর পরিণত হচ্ছে একেকটি জড় পদার্থে। এদের চোখেমুখে কেবলই ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ানোর চিহ্ন, হতাশা ও দুশ্চিন্তার ছায়া; একজন মানুষ অন্যজন থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন।

প্রতিবেশীদের সঙ্গেও পারস্পারিক কোনো সম্পর্ক নেই। একই বিল্ডিং-এর দুটো তলার বা পাশাপাশি দুটো অ্যাপার্টমেন্টের লোকজনের মধ্যে কোনো আলাপ-পরিচয় নেই। কেউ কোনো কৌতূহলও দেখায় না প্রতিবেশী সম্বন্ধে। সম্ভবত তা ভদ্রতা-বিরুদ্ধ ব্যাপার বলে মনে করা হয়। ঢাকা হচ্ছে ভুলভাবে গড়ে ওঠা শহর।

সারাদেশ থেকে ছুটে এসেছে মানুষ এই শহরে। তা, কি চাই এখানে? চাকরি, ব্যবসা, প্রতিষ্ঠা, সাফল্য। আর? আর উঠতে চাই উঁচুতে, অনেক উঁচুতে, এত উঁচুতে যেন সবাইকে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখতে হয়, আঙুল তুলে বলতে হয়- ওই যে অমুক, দ্যাখো কত ওপরে উঠেছে; যেন এইসব অপগণ্ড অপকৃষ্ট মুর্খ মানুষগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা যায়। তা, অতো ওপরে উঠতে গেলে তো তোমাকে ভালো মানুষের মতো থাকলে চলবে না। তাহলে কি করতে হবে? তোমারই মতো যারা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে চাচ্ছে- সময় সুযোগ বুঝে তাদের ল্যাং মারো।

এখানে কেউ তোমার সহযোগী নয়, সবাই তোমার প্রতিযোগী- এই কথাটি মনে রেখে চলবে; এখানে কোনো ফেয়ার ডিলিংস-এর সুযোগ নেই, সবই ফাউল গেম। অতএব ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে প্রতিযোগী কমাও, পথও পরিষ্কার কর। মনটা যে কেমন কেমন করে! আরে দূর, এইসব মধ্যবিত্তসুলভ স্যঁতস্যাঁতে আবেগ ছাড়ো- ল্যাং না মারলে পথ পরিষ্কার হবে কিভাবে? আর খবরদার, ল্যাং মেরে আবার পেছনে ফিরে দেখতে যেও না যে, লোকটার কি হলো- ঠ্যাং ভাঙলো, মাথা ফাটলো, নাকি মরেই গেলো! গেলে গেছে, অযোগ্য বলেই টিকে থাকতে পারেনি। অতএব তুমি মর্মপীড়া থেকে অবলীলায় মুক্ত থাকতে পারো। যোগ্যতার বলেই তুমি এগিয়ে যাচ্ছো, এগোতে গিয়ে একটু-আধটু ল্যাং মারতে হচ্ছে, কনুই মারতে হচ্ছে, ধাক্কা দিতে হচ্ছে; পেছন থেকে তোমার মধ্যবিত্ত মা-বাবা-শিক্ষক-বই-পুস্তক-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিখে আসা মূল্যবোধ নামক ফালতু জিনিসটা তোমাকে টেনে ধরার চেষ্টা করছে বলে ওদিকে না তাকিয়েই তোমাকে মাঝে মাঝে পিছ-লাথি মারতে হচ্ছে- তাতে আবার তোমারই ফেলে আসা স্বজনরা আঘাত পাচ্ছে।

পাক, তুমি তো আর দেখছো না! এসবই করতে হয়, নইলে ওঠা যায় না। অতএব, গ্যালো- মূল্যবোধ গ্যালো, সহানুভূতি গ্যালো, শিক্ষা-দীক্ষা-রুচি-আদর্শ সব গ্যালো। রইলো কেবল ওপরে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় কূটকৌশল। কেউ রইলো না আর আপনজন-স্বজন হয়ে, সহযোগী হয়ে- সবাই হয় প্রতিযোগী, না হয় এগিয়ে যাবার পথে বাধাবিপত্তি, যাদেরকে যে-কোনো মূল্যে ঝেড়ে ফেলতেই হবে। মানবিক সম্পর্কের চর্চা আর রইলো না।

কিছুই রইলো না আসলে। মানুষ বন্দি হলো নিজেরই সৃষ্ট কারাগারে। এই তো শহুরে মানুষ। কেউ ও রকম ওপরে উঠে গেছে, কেউ উঠতে শুরু করেছে, কেউ উঠতে চাইছে- আর তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে সে প্রস্তুত। চুরি-চামারি-লুটপাট-হত্যা-জখম-সন্ত্রাস সব।

আর এই শহর কেবলই তাদের ডেকে বলছে- পেছনে ফিরে দেখো না; সততা, আদর্শ, সত্যবাদিতা, মূল্যবোধ এগুলো সব অকেজো আভিধানিক শব্দ, এসব ছাড়ো। ছেড়ে সবাই ছোট হয়ে যাও, খুব ছোট, তাতে নানারকম ফাঁকফোকর গলে সাফল্যের দুর্গম দুর্গে ঢুকে যেতে সুবিধে হবে তোমার। পারলে বামন মানব হয়ে যাও- আর সবাই তাই-ই হচ্ছে। বামন মানবে ভরে গেছে এই শহর। এমন ভুলভাবে গড়ে ওঠা শহরের ভবিষ্যৎ কি?



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.