আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গৃহত্যাগী জোছনা



'কী রানার মা আজকে কী রানবা’ জগলু মাষ্টার ঘরে ঢুকতে ঢকতে তার অমায়িক হাসিটি হাসলেন। ‘আজকে সজনে ’ রানার মার উত্তর। সজনে কুটছে দরজার সামনে বসে। ছোট মেয়ে রিনি উদম গায়ে বড় একটা সজনে নিয়ে এক মনে মাটিতে দাগ কাটছে। ‘সজনে ডাল দিয়ে রান্না করলে বুঝলে ভাত খাওয়া যায় তিন থাল।

সাথে ভর্তা ভাজি থাকলে আর কাথাই নাই’ জগলু মাষ্টার হাত কচলাতে লাগলো। এই হাত কচলানোয় এক ধরনের খস খস আওয়াজ হয় যাতে আয়েস আর পরিতৃপ্তির পরিস্কার ভঙ্গিটি ফুটে ওঠে। হাসানপুর হাই স্কুল থেকে তিন বৎসর হলো রিটায়ার করেছেন। দীর্ঘ ২০ বৎসর হেডমাষ্টারি করার পর তার বর্তমান কাজ হলো পাড়ার এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরে বেড়ানো। মহিলাদের হেঁসেল পাড়ে বসে আলাপ জমানো।

জগলু মাষ্টারের পরিবারের কেউ তার এ পাড়া বেড়ানোটা পছন্দ করে না। পাড়ার আর যে কটা বাড়িতে তার যাতায়াত আছে তার মধ্যে হোসেন মিয়ার এই বাড়িতে তার নিয়মিত পদধুলি পড়ে। দুই বেলা বান্ধা টাইম। হয় সকাল এগারটা-বারটায় নয় তো সন্ধ্যা ছয়টা সাতটা। এই সময় হোসেন মিয়ার সাথে টিভি দেখতে দেখতে আলাপ চলে।

হোসনে মিয়া উপজেলা কার্যালয়ে পিয়ন পদে চাকরী করে। জগলু মাষ্টারের আগমনে সে খুব আপ্লুত হয়। মাষ্টারকে সে খুবই পছন্দ করে। তার পছন্দ করার দুইটা কারণ আছে। প্রথম কারণ হলো সে নিজে রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে পছন্দ করে আর মাষ্টার তার সাথে প্রায়ই একমত পোষণ করে।

দ্বিতীয় কারণটি হলো কর বেকরে তার থেকে টাকা পয়সা ধার পাওয়া যায়। ‘কী কর হোসেন মিয়া। অন্ধকারে বসে কী খুটখাট করতেছ?’ হোসনে মিয়া ঘরের একটু কোণের দিকে বসে দার ভাঙ্গা ডাঁটে কচি গুঁজছে। শিম গাছর মাচাটা কেটে নামাতে হবে। এবার শীতে বেশ শিম ধরেছিলো।

খেয়েদেয়ে বিক্রি করে ভাল টাকা পাওয়া গেছে। আজ পয়লা মে। সরকারী ছুটি। এই সুযোগে বাগানের যত্ন নেয়া। ‘বসেন মাষ্টার সাব, বাগানের মাচাটা ঠিক করতে হবে শীত তো গেছে কবে, বাগানের মাচাটা অমনেই পড়ে আছে' হোসেন মিয়া কচি গুঁজতে গুঁজতে দাঁত দিয়ে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বলে।

জগলু মাষ্টার টেবিলের পার্শ্ব চেয়ারটা টেনে বসল। অপর পাশে খাটের উপর বসে হোসনে মিয়ার বড় ছেলে পড়ছে। ‘কর কর তোমর তো বয়স আছে, তবে হোসেন মিয়া তুমি এবার যে শিম দিয়েছ তা বাজার থেকে শিং মাছ আর আলু দিয়ে তানিয়ার মা রান্না করছিলো। ওহ্ যা টেষ্ট তোমারে বলছি’ জগলু মাষ্টার মুখ দিয়ে স্বাদ নেয়ার একটা ভঙ্গি করে। জগলু মাষ্টাকে পছন্দ করার নানান কারণের মধ্যে অন্যতম একটা কারন হলো সবকিছুতেই মাষ্টার ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।

কোন লুকোচুরি নেই। ঈর্ষার ব্যাপার নেই। কোন তরকারি কীভাবে রান্না করতে হবে কোন ঋতুতে কী ভাল এই নিয়ে যখন রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করেন তখন হোসেন মিয়াও সাথে যোগ দেয়। এই সময় জগলূ মাষ্টারের হাসির সাথে যে দুটো দাঁত পড়ে গেছে ওই ফাঁক দিয়ে কিছু থুতু রেরিয়ে পড়ে। দুই হাতের খস খস আওয়াজ বাড়ে।

‘যাও তো রানার মা মাষ্টার সাবের জন্য এককাপ চা বানায় নিয়ে আস। আমার জন্য দুধ চা বানাইয়ো। ’ হোসেন মিয়া বলল। ‘কী দুধ চা তোমরা খাও মিয়া, রঙ চা খাও ঠিক মতো রঙ চা বানাইতে পারলে ধুর কীসের দুধ চা। আমার এক চাচী, ওই মজীবরের মা চিনেছ তো এমন চা বানাই তো একবার খাইলে সারা জীবন মনে রাখতো।

সেই আমলে কয়জনে আর চা খেতো। ছিলো তলুকদারের মেয়ে। চায়ের অভ্যাসটা সাথে করে নিয়ে এসেছিলো। ’ ‘যাও তাড়াতাড়ি যাও, একটা কথা বললে এতো দিরি হয় কেন?’ রুষ্ট হয় হোসেন মিয়া। ‘আরে যাবে যাবে হাতের কাজ সারতে দাও, রঙ চায় আদা দিয়ো রানার মা, কী বলো রানার মার রঙ চায়ের সাথে কী দুধ চায়ের তুলনা চলে?’ জগলু মাষ্টার রানার মার দিকে তাকায়।

রানার মা বুকের উপরের কাপড়টুকু টেনে দেয়। ব্লাউজের ঠেলে তার ভাড়ি স্তন দুটো যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। রানার মা শরীর বাড়াবাড়ি রকমের ভাল। এই বয়সে গ্রামদেশে মেয়েদের শরীরে কিছু থাকে না। রানার মার এই বিপুল শরীর আর ভাড়ি নিতম্ব গ্রামের সবাই চোখ দিয়ে চেটেচেটে এক আধটু খায় কেবল হোসনে মিয়া ছাড়া।

কীভাবে যে এমন একটা বউ পেল? হোসেন মিয়া লম্বায় পাঁচ ফিটের বেশি হবে কি হবে না কিন্তু রানার মা সাড়ে পাঁচ। টানটান ব্লাউজের হাতায় যেটুকু বাহু নগ্ন থাকে তাতে পুরুষদের চোখ সরানো দায়। রানার মা চায়ের পাতিল, ম্যাচ, কেরসিনের কুপি নিয়ে পাকঘরের দিকে গেল। ছোট মেয়ে রিনি এতক্ষণ পাশে বসে মায়ের সজনে কুটা দেখছিলো। মায়ের পিছে পিছে সেও দধু, চিনি আর একখন্ড আদা নিয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায়।

‘কালকের সংসদ অধিবেশন কেমন দেখলা হোসেন মিয়া?’ ‘কালকে তো বিরোধী দল ঠিক মতো একটা প্রশ্নরও উত্তর দিতে পারে নাই। ’ ‘ঘাগু রাজনীতি বিদ ক্যামনে পারব। ছাত্র জীবন থেকে রাজনীতি করে আসতেছে। একবার দাড়াইলে টানা দুই ঘন্টা কোন ব্যাপার না’ ‘তবে যাই কন মাষ্টার সাব এইবার ক্যাবিনেট মন্ত্রিগুলা পড়ছে বাঘা বাঘা’ হোসেন মিয়া দা রেখে গা ঘাম মুছতে মুছতে চকিতে গিয়ে বসল। যদিও চাকুরী করে পিয়নের চিন্তাভাবনা তার খুব উচ্চ মার্গের।

মন্ত্রি, এমপি, বাঘা বাঘা ছাত্র-রাজনীতিকদের মহোময় চরিত্র্র তার প্রায় তার গল্পের বিষয়বস্তু। বিভিন্ন ঐতিহাসকি ঘটনা প্রায় বলতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু তার এইসব অতি উচ্চমানের চিন্তভাবনার শরিক এই গ্রামে পাওয়াভার এক মাষ্টার সাব ছাড়া। জগলু মাষ্টার বড় ছেলে রানার দিকে ফিরলো, ‘কী পড়াশোনা কেমন চলতেছে? পড় পড় খালি নকল না করলেই হলো, পইড়া দশবারে ম্যাট্রিক পাশ করলেও অসুবিধা নাই। ’ জগলু মাষ্টার নামের এই লোকটাকে বড় ছেলেটার বেশ ভাল লাগে।

ইংরেজীতে একটু দুর্বল। প্রিটেস্টে সবগুলো বিষয়ে পাশ করেছে কেবল ইংরেজী ছাড়া। মাষ্টারের কথায় সে সাহস পায়। আর এই কারণে মাষ্টার সাব আসলে তার ভেতরেও একটা খুশি খুশি ভাব ছড়িয়ে পড়ে। ‘বুঝেছ হোসেন মিয়া আমার এক ছাত্র ছিল সাত বারে ম্যাট্রিক পাশ করেছে-এমন মনের জোড়।

এখনকার পোলাপান তো বিশ্বাস করবে না। ‘তো ওই ছেলের চাকরী কীভাবে হইছে শোন। সরকরী চাকুরীর ইন্টাভিউ দিতে গেছে। বুঝইতো সরকারী চাকুরী মানে টাকা পয়সার কারবার। নিয়োগ কমিটি সচিব আগে থেকেই টাকা পয়সা খাইয়া একজনরে সবকিছু ঠিকঠাক।

সভাপতি আবার ঘাগু মানুষ কাউকে গুনে না। ছেলের সিভি দেখে বলল তোমার জন্ম তারিখ কত? ১০ই মে ১৯৭৯ স্যার ম্যাট্রিক পাশ করেছো কত সালে? ২০০৪ এতো বছর কেন? ছেলে কাচুমাচু করে বলল, স্যার সাত বারে ম্যাট্রিক পাশ দিছি। ইন্টাভিউ বোর্ডের সবাই বলল ‘স্যার এই ছেলে দিয়ে কিছু হবে না। এই ছেলে কিছু জানে না। ’ সচিবের কথা সবার আগে শোনা যায়।

‘চুপ করেন আপনারা। যে ছেলের জন্য আপনারা সুপারিশ করেছেন ওই তো নিজের জন্ম তারিখটাই বলতে পারলো না। নকল করে পাশ করেছে মনে হয়। আজকাল তো বস্তায় বস্তায় নকল উদ্ধার করছে ম্যাজিস্ট্ররা। এই ছেলে সাত বার ম্যাট্রিক পাশ করেছে মানে কিছু শিখে বের হয়েছে।

তাছাড়া এলএমএসএসের চাকুরী। অক্সফোর্ড ইউনিভাসিটিতে তো অভিসন্দর্ভ পড়তে যাচ্ছে না। যাও আগামী মাসে এসে তোমার নিয়োগপত্র নিয়ে যেও। ’ ‘সভাপতি জাঁদরেল মানুষ কেউ টু শব্দটাও করতে পারে নাই। ছেলেটা পরে আমার কাছে দুই কেজি মিষ্টি নিয়ে এসে এইসব বলেছে বলছে।

শিখনের মাইর নাই। ’ জগুল মাষ্টার রানার পিঠ চাপড়ে দেয়। হোসেন মিয়া উঠোনের মাচা কাটতে শুরু করেছে। জগলু মাষ্টার পাশে দাঁড়িয়ে আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। আজকে আর অন্য বাড়িতে যাওয়া হবে না।

হোসেন মিয়ার অফিস না থাকায় আড্ডা অনেকণ চলবে। আর একবার চা হবে। এর মধ্যে হোসেন মিয়া তার পাইলট সিগারেট অফার করবে। মাষ্টার সাব তাতে চোখ বন্ধ করে সুখ সুখ ভাব নিয়ে টান দিবেন। বাড়িতে তার সিগারেট খাওযা নিষেধ।

কেবল এই বাড়িতেই হোসেন মিয়ার উপস্থিতিতে তার সিগারেট খাওয়া হয়। ***** রবিবার প্রচুর কাজ থাকে। হোসেন মিয়া তার সাইকেল নিয়ে অফিস থকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছয়টা। এ সময় সে এককাপ চা খায়। রানার মাকে চা বানাতে পাঠালো।

‘রিনি ছোট মগটা নিয়ে আয় তো’ পাকঘর থেকে চেচালো হোসেন মিয়ার বউ। ঘর থেকে পাকঘর দেখা যায়। পিড়িতে শুকনো পাতা চুলায় ঠেলে দিচ্ছে । শাড়ি প্রায় হাঁটু অবদি উঠে গেছে। রিনি চায়ের মগ দিয়ে ছুটে এলো বাবার কাছে।

পাঁচ বছরের মেয়ের সাথে খেলতে হসেন মিয়ার এতো ভাল লাগে। এই বয়সের শিশুরা কি আদরের হয়। মেয়েকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে চুমো চুমোয় ভরিয়ে দিলো। হোসেন মিয়ার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে রিনির নরম গালে একটু কষ্ট হচ্ছিলো। ‘রিনি বললো ‘বাবা আমি তোমাকে একটা থাপ্পর দেই?’ হোসেন মিয়া অবাক হলো মেয়ের কথায়।

‘কেন মা?’ ‘আজ সকালে যখন মাষ্টার চাচু মাকে বিছানায় চুমো দিচ্ছিলো মা চাচুর গালে একটা থাপ্পর দিয়েছে। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।