নাজমুল ইসলাম মকবুল
আপিল শুনানিতে ৫ আলেমের বক্তব্য : ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে কোরআন ও ইসলাম নিষিদ্ধ হয়ে যাবে
ফতোয়া নিয়ে আপিল শুনানিতে ৫ বিশিষ্ট আলেম বলেছেন, পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াসের ওপর ভিত্তি করে ফতোয়ার বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফতোয়া নিষিদ্ধ করে রায় দেয়ার অর্থই হচ্ছে কোরআন ও ইসলামকে নিষিদ্ধ করা। ফতোয়া নিষিদ্ধ করে হাইকোর্টের দেয়া বিতর্কিত রায় ও ভ্রান্ত রায় আপিল বিভাগেও বহাল থাকলে দেশের ৯০ ভাগ মানুষ কোনো অবস্থায় তা সহ্য করবে না। তারা বলেন, পরিপূর্ণ জীবনবিধান হিসেবে ইসলাম ধর্মের অনুসারি মুসলমানদের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কর্মকাণ্ডই ফতোয়ার ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বের ক্রমবর্ধমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জিজ্ঞাসাও বাড়ছে।
প্রাত্যহিক জীবনপ্রবাহ সম্পর্কে এ জিজ্ঞাসার জবাবই হচ্ছে ফতোয়া। কাজেই ফতোয়া নিষিদ্ধ করা তো দূরের কথা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকারও কারও নেই। ফতোয়ার অপপ্রয়োগ সম্পর্কে তারা বলেন, আইনের অপপ্রয়োগ আমাদের জন্য একটি জাতীয় দুর্যোগ।
বাংলাদেশে এমন কোনো আইন নেই যার অপপ্রয়োগ বা অপব্যবহার নেই। গ্রাম্য সালিশের সিদ্ধান্তকে ফতোয়া হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামী বিধানকে পরিকল্পিতভাবে বিতর্কিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হকের নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের ৬ বিচারপতির বেঞ্চে গতকাল ফতোয়া অবৈধ ঘোষণা করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে অংশ নেন পাঁচ আলেম। তারা হলেন গোপালগঞ্জের গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল এবং সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের মহাসচিব মুফতি মাওলানা রুহুল আমিন, চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রধান মুফতি মাওলানা মোহাম্মদ কিফায়াত উল্লাহ, ঢাকার গেন্ডারিয়ার নেসারিয়া আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মাওলানা কফিল উদ্দিন সরকার, বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের শিক্ষা সচিব মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের গবেষণা বিভাগের উপ-পরিচালক মুফতি আবদুল্লাহ আল মারুফ। আপিল বিভাগের নির্দেশে ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাদের মনোনীত করে।
শুনানিতে ফতোয়ার ব্যাপারে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি উল্লেখ করে মুফতি মাওলানা রুহুল আমিন বলেন, কোরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ফতোয়া দেয়া হয়। এটি পবিত্র কোরআন ও হাদিসের আলোকেই এসেছে।
মহান আল্লাহতায়ালার দেয়া বিধানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ফতোয়া নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কারও নেই। আমাদের দেশে গ্রাম্য সালিশে যেসব সিদ্ধান্ত হয়, সেগুলো দিয়ে থাকেন গ্রাম্য মাতব্বররা। সেগুলোকে ফতোয়া হিসেবে অপপ্রচার চালানো হয়। ফতোয়া দেয়ার একমাত্র স্বীকৃত ব্যক্তি হলেন মুফতিরা। যারা সঠিক জ্ঞানের অধিকারী।
মুফতি মিজানুর রহমান সাঈদ বলেন, ইসলামী বিধি-বিধান সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের পাঁচশ’ আয়াত রয়েছে। ইসলামী বিধানের মূল ভিত্তি হচ্ছে পবিত্র কোরআন, হাদিস, ইজমা ও কিয়াস। আর ফতোয়া হচ্ছে ইসলামী বিধানেরই অংশ। কাজেই ফতোয়া নিষিদ্ধ করার অর্থই হচ্ছে পবিত্র কোরআন ও ইসলামকে নিষিদ্ধ করা। হাইকোর্ট ফতোয়াকে নিষিদ্ধ করে কোরআনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
হাইকোর্টের বিচারপতিরা এখতিয়ারবহির্ভূত কাজ করে শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি। ফতোয়ার সংজ্ঞা ও ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, পৃথিবী যত এগিয়ে যাবে মুসলামনদের মধ্যে তত নানা প্রশ্নের উদ্রেক হবে। একজন মুসলমান ইসলামী বিধান ও দৈনন্দিন জীবনে চলার পথের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জানতে চাইবেন, এটাই স্বাভাবিক। এসব জিজ্ঞাসার জবাব দেয়াই হচ্ছে ফতোয়া। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে মুসলমানরা ধর্ম-কর্ম সম্পর্কে কিছুই জানতে পারবেন না।
কেউ আর তাদের জিজ্ঞাসার জবাবও দেবেন না। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে ফরজে কেফায়া আদায় হবে না। ফরজে কেফায়া না হলে সমগ্র মানুষ গুনাহগার হবেন। ফতোয়ার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ধরুন কোনো একজন মুসলমান বিচারপতি মারা গেলেন। তার জানাজায় ইমাম সাহেব চার তাকবিরের স্থলে ভুল করে তিন তাকবির দিয়ে জানাজা শেষ করলেন।
মানুষের পক্ষে এ ধরনের ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক বলেই এর প্রতিকারও রয়েছে। জানাজায় ইমামের ভুল হওয়ার বিষয়টি সবাই বুঝতে পারলেন। তখন সবাই ইমাম সাহেবের কাছে জানতে চাইলেন, নতুন করে নামাজ পড়তে হবে— নাকি এ জানাজাতেই লাশ দাফন করা যাবে। তখন ইমাম সাহেব বললেন, এই প্রশ্নের জবাব দিলে তা ফতোয়া হয়ে যাবে। ফতোয়া নিষিদ্ধ।
কাজেই ফতোয়া দিয়ে আমি জেলে যেতে চাই না। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। মুফতি মিজান আরও বলেন, পেটে ব্যথা ও সর্দি-কাশি কিংবা জ্বর হলে আমরা ডাক্তার না দেখিয়েই ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে খাই। অনেক সময় ভালো হয়। কখনও কখনও ভালো হয় না।
বরং ওষুধে উল্টো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। রেজিস্টার্ড চিকিত্সকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া ওষুধ বিক্রি ও কেনা উচিত নয়। এটা জেনেও আমরা ডাক্তার না দেখিয়েই ওষুধ কিনে খাই। এজন্য ডাক্তারি পেশাটাকেই নিষিদ্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব আজ পর্যন্ত কেউ করেননি। ফতোয়া প্রত্যেক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত মুফতির কোরআন হাদিসভিত্তিক এবং আমাদের সংবিধানে স্বীকৃত অধিকার।
এ অধিকার কেড়ে নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। মুফতি বোর্ড করে মুফতি ও আলেমদের সরকারের আজ্ঞাবহ করারও কোনো যৌক্তিকতা নেই। মুফতি বোর্ড করা হলে এ নিয়ে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। সরকার চাইবে মুফতি বোর্ড দিয়ে একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত আদায় করতে। যেটা মুসলমানরা মানবেন না।
মুফতি মোহাম্মদ কিফায়াত উল্লাহ বলেন, এদেশে ফতোয়াকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। মুফতিরা বিচারক নন। তারা যোগ্যতা অনুসারে মতামত দেন। সেটা মানা না মানা বিচারপ্রার্থীর নিজস্ব বিষয়। তিনি ফতোয়াকে ইসলামের অংশ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ঈমান, আকিদা ও ধর্মের সব ক্ষেত্রের সঙ্গে ফতোয়া অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে মুসলমানরা ঈমান হারাবে। কোনো মুসলিম দেশে ফতোয়া নিষিদ্ধ হতে পারে না। তবে ফতোয়ার বিষয়ে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফতোয়ার নামে কেউ কাউকে শাস্তি দিতে পারেন না। ফতোয়ার নামে নির্যাতন আইনের দৃষ্টিতে অবৈধ।
এটা সাধারণত গ্রাম্য সালিশে হয়ে থাকে। আর দিয়ে থাকেন গ্রামের মাতব্বর বা মুরুব্বিরা। এর সঙ্গে ফতোয়ার কোনো সম্পর্ক নেই।
মাওলানা কফিল উদ্দিন বলেন, মুসলিম আইনের উত্স হচ্ছে কোরআন ও সুন্নাহ। ফতোয়ার উত্সও একই।
তিনি ফতোয়ার ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে আরও বলেন, আল্লাহ নিজেও ফতোয়ার বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন। বিভিন্ন সময়ে রাসূল (সা.) নিজেও ফতোয়া দিয়েছেন। মহানবী (সা.)-এর ইন্তেকালের পর ১৪৯ জন সাহাবি ফতোয়ার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ফতোয়া নিষিদ্ধ করা কোরআনের জন্য মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। ফতোয়া নিষিদ্ধ করা হলে মুসলমানদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়বে।
মুফতি আবদুল্লাহ আল মারুফ বলেন, ফতোয়া হচ্ছে শরিয়াতের বিধি-বিধানের অংশ। ফতোয়া ছাড়া মানুষ ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝতে পারবে না। কাজেই কোনোভাবেই ফতোয়া নিষিদ্ধ করা যাবে না। ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে ইসলামের প্রচার ও প্রসার নিষিদ্ধ হয়ে পড়বে। বর্তমানে দ্বীনের যে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে, সেটাও আর দেয়া যাবে না।
ফতোয়া নিষিদ্ধ হলে এদেশের সিংহভাগ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে উঠবে। ফতোয়ার অপপ্রয়োগ বন্ধ করতে হলে একটি নীতিমালা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ইসলামের অনুসারি ও আলেম-ওলামাকে জঙ্গি বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। আলেমদের বর্তমানে জঙ্গি বানানো হচ্ছে। এটা নিশ্চয় অন্যায়।
মুফতি আবদুল্লাহ এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার এক পর্যায়ে আদালত তাকে বলেন, আপনি উত্তেজিত অবস্থায় রয়েছেন। আপনার পয়েন্ট আমরা বুঝতে পেরেছি। আপনি এবার বসে পড়ুন। তার বক্তব্যের পর আদালত শুনানি মুলতবি করেন।
দুই অ্যামিকাস কিউরির বক্তব্য : এদিকে সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এম হাসান আরিফ এবং প্রবীণ আইনজীবী এবিএম নুরুল ইসলাম ফতোয়ার পক্ষে মত দিয়ে গতকাল তাদের বক্তব্য পেশ করেছেন।
হাসান আরিফ ফতোয়াকে বৈধ বলে উল্লেখ করে বলেন, ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে ফতোয়া দেয়া যেতে পারে। তবে এর মাধ্যমে যদি কোনো অপরাধমূলক কাজ হয়, সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি বলেন, ফতোয়ার নামে গ্রাম-গঞ্জে যা হচ্ছে, তা চলতে দেয়া হলে সমাজে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। এছাড়া সাংবিধানিকভাবেই হাইকোর্ট কোনো বিষয়ে সুয়োমোটো রুল জারি করতে পারেন বলে তিনি মন্তব্য করেন। এবিএম নুরুল ইসলাম বলেন, ফতোয়া হচ্ছে অভিমত।
এটি দেয়া প্রত্যেক মানুষের মৌলিক অধিকার। তিনি বিচারপতিদের উদ্দেশে বলেন, বিচারপতিরা যে রায় বা আদেশ দেন সেটাও এক ধরনের ফতোয়া।
সুত্র: আমার দেশ
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।