দক্ষিণের জানলাটা খোলা..আলো আসে আলো যায়।
সাত বছর পর আজ এই বাসা ছেড়ে যাছ্ছি। সত্যি বলতে কি ছেড়ে যাছ্ছি না ছেড়ে যেতে হছ্ছে। এত বড় বাসায় থাকাটা এখন আমার জন্য বিলাসিকতা,সেই আর্থিক সঙ্গতিও নেই আমার এখন। এই বাসায় যখন এসেছিলাম তখন আমরা ছিলাম ৩ জন আর আজ বাসাটা ছেড়ে যাছ্ছি আমি একা।
মালামাল প্যাকিং শেষ,গাড়িতে ওঠানোও প্রায় শেষ পর্যায়ে। শেষ বারের মত ঘরগুলো ঘুরে দেখছিলাম আমি।
স্মৃতিগুলো কেন যে এত নির্দয় হয়,একে একে চোখের পাতায় ভর করে সময়ের ডানায় চড়ে। সাত বছরের পুরনো সময় অথচ মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। স্মৃতির এ্যালবামে ভিড় করে একের পর এক সুখের প্রতিচ্ছবি।
সারাঘরময় রাকিব আর রাফসানের ছুটাছুটি আর হৈ-হুল্লোড়। একটা মিনিট তারা চুপ করে থাকতে পারতো না। উৎসবের দিনগুলোতে নিজ হাতে আমার প্রিয় খাবারগুলো রান্না করতো রাকিব,ছুটি দিনগুলোতে হুট করে ঘুরতে বের হয়ে যাওয়া-একদিন নয়তো দুদিনের জন্য। কতটা আনন্দে মোড়া ছিল এক একটা দিন। প্রিয় মুর্হূতগুলো কিংবা অলস বিকেলে একসাথে গুনগুন করে গান গাওয়া,বিশেষ উপলক্ষে ছোটখাট পারিবারিক উৎসবের হাসিমুখ,কেমন করে এই স্মৃতিগুলো ভুলে যাব!
দক্ষিণের বারান্দাটা রাকিবের খুব প্রিয় ছিল,অবেলার অবসরে কিংবা বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে বসতাম দুজনে,অতীতের স্মৃতি রোমন্থন আর ভবিষ্যতের সুখস্বপ্ন থাকতো আমাদের দুচোখে।
একটুকরো আকাশ দেখতে দেখতে কোনদিন উদাস হয়ে বলতাম রাকিব তোমাকে ছেড়ে কোনদিন যদি আমি হারিয়ে যাই,কেমন হবে?ও হেসে নির্মলেন্দু গুনের ছন্দে বলতো-‘"তুই কেমন করে যাবি,পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া,আমাকেই তুই পাবি,তবুও তুই বলিস যদি যাই,দেখবি তোর সমুখে পথ নাই। ‘"
রাফসান অদ্ভূত সুন্দর ছবি আঁকতো,ওর আঁকা ছবিগুলো যত্ন করে তুলে রাখতাম আমি। আজ ক্যানভাসগুলো নিঃসঙ্গ আর রং গুলো অভিভাবকহীন। কতশত স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে আমাদের। এভাবেই আনন্দ-ভালবাসায় কেটে যাছ্ছিল এক একটা দিন,বয়স বাড়ছিল জীবনের।
স্মৃতির ঝাঁপিতে সুন্দর মুর্হূত আর প্রাপ্তি জমা হছ্ছিল একের পর এক। চারপাশের পৃথিবী সুন্দর থেকে সুন্দরতর হছ্ছিল।
কিন্তু একদিন!!দিনটা ছিল আর দশটা রুটিন ধরা দিনের মতই। সকালের নাস্তা শেষে ওরা দুজন প্রতিদিনকার মত বাসা থেকে বের হয়ে গেল। রাফসানকে স্কুলে নামিয়ে গুলসানে ওর অফিসে যাবে রাকিব।
ঘর গুছাছ্ছিলাম আমি,ঘড়ি তখন ঠিক নয়টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। ফোনটা এল তখনই,আমি পাগলের মত ছুটে গেলাম ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের মর্গে। আমার সামনে নিথর পড়ে ছিল আমার প্রিয় সন্তানের লাশ!ওর নিষ্পাপ মুখের বদলে সেখানে ছিল.........কি একটা দিন ছিল সেটা।
সন্তানের হারিয়েও মনকে শক্ত করলাম রাকিবকে যে বাঁচাতে হবে। আইসিইউতে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা রাকিবকে বাঁচানোর জন্য শুরু করলাম নতুন এক যু্দ্ধ।
সকাল-সন্ধ্যা ছুটাছুটি,হাসপাতাল-ডাক্তার-অপারেশন-ওষুধ এর বাইরে কোন শব্দ ছিল না আমার পৃথিবীতে। মধ্যবিত্তের সব সঞ্চয় উজাড় করে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করলাম। আইসিইউর ওপাশে হয়তো ও আপ্রাণ মৃত্যুর সাথে লড়াই করত আর এপাশে আমি বাস্তবতার সাথে লড়াই করতাম। রাকিব সবসময় বলতো-হারতে যদি হয় বীরের মত লড়াই করে হারা উচিত,সেই কথাকে সাহস করে সর্বশক্তি নিয়ে মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়তাম আমি। আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল আত্মীয়-বন্ধু-স্বজন আর নাম না জানা আরো অনেকে।
আমরা এক হয়ে চেষ্টা করেছিলাম ওকে বাঁচাতে।
এখনোও বিশ্বাস হয় না এমন দিনও এসেছিল আমার জীবনে!এ্প্রিল ২৮,২০১০। নিথর হয়ে গেল ওর হৃদপিন্ড,আর রং হারালো আমার পরনের শাড়ি। মৃত্যূর কাছে আর একবার হেরে গেলাম আমি। তারপরের দিনগুলোতে আমি কোথায় ছিলাম,কেমন ছিলাম জানি না।
বেঁচে থাকার অবলম্বনগুলোকে হারিয়ে কি যেন এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম আমি। আমার সকাল-দুপুর-রাত কিংবা স্বপ্ন-বাস্তবতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আমার জগৎ থমকে ছিল কিন্তু সময় যেন দ্রুত কেটে যাছ্ছিল। দুমাস পর ঘরে ফিরে বেঁচে থাকাটা যেন আরো নিষ্ঠুর হয়ে উঠলো। জীবিত মানুষের স্মৃতির মাঝে বেঁচে থাকা যায় কিন্তু মৃত মানুষের ছায়ার মাঝে বেঁচে থাকাটা যে কত কষ্টের….!মনে হত ওরা আগের মত খুনসুটিতে মেতে আছে,পুরো ঘরজুড়ে ওদের আনাগোনা।
একসময় আর পারছিলাম না আমি,প্রিয়জন হারানোর কষ্ট যে অনেক বেশি অসহনীয়।
আম্মা,মাল সব উঠে গেছে,চলেন। কেয়ারটেকারের ডাকে সম্বিত ফেরে নির্ঝরের,ঘোরলাগা পায়ে ধীরে বের হয়ে আসে সে। পিছনে ফেলে আসে স্ব্প্ন-কবিতা-গানের মৃত শরীর আর দুজোড়া মায়াবী করুণ চোখের ছায়া…..।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।