মুন রিভার ...
দ্বিতীয় পর্বের পরে...
পরদিন ঘুম ভাঙ্গে অনেক দেরিতে। সর্বনাশ! যথারীতি আমার আ্যডভার্টাইজিং ক্লাস মিস। অবশ্য কোর্স কো-অর্ডিনেটর জুলিয়ান আমাদের আ্যডভার্টাইজিং ক্লাশ নেয়, কেনো যেনো আমাকে খুব পছন্দও করে। ভাবতেই সর্বনাশ শব্দটা বাতাসে উবে গিয়ে আমার সারা শরীরে একটা আরামদায়ক আলস্য এনে দেয়।
আমি রাতের কেনা বেনসন ধরিয়ে দুপুরে বের হই হোস্টেলের সামনের ফুড কোর্টে, সকালের নাস্তার খোঁজে ।
সিঙ্গাপুর এ ফুড কোর্ট শব্দটা খুব প্রচলিত। একসাথে অনেক দেশের খাবার বিশাল একটা খাবারের দোকানে ছোটো ছোট স্টলে বিক্রি হয়। সাব কন্টিনেন্টাল, মালয়, চাইনিজ, জাপানিস, ভিয়েতনামিজ, সিঙ্গাপুরিয়ান-বেশ সরগরম থাকে সবসময়। বেলা বাড়তেই কোলাহোল বেড়ে যায় আরও, আর সাঝঁ নামতেই আরো থেকে বারো... সিঙ্গাপুরের মানুষ বিয়ার খেতে পারে জম্পেশ। কার্লসবার্গ, হেনিকেন, সিঙ্গা- পেট মোটা এক একটা বোতল।
আমি নাস্তা সেরে হোস্টেলে ফিরে আসি। ভিতরের মাঠে আমার পাশের রুমের সাউথ ইন্ডিয়ান মেটদের সাথে ক্রিকেট খেলি। ওরা খুব শান্ত আর ভদ্র। পুরাই পাগলু ছিলো আমার রুমমেটগুলো। রুম নাম্বার আই-০৮ এর বাসিন্দা- রা ছিলো জেনুইনলি পাগলা, হোস্টেল এর ভিতর সবচেয়ে মারকুটে।
বেশিরভাগ ছিলো পাঞ্জাবি, একজন ছিলো নেপালি আর আমরা পাচঁজন ছিলাম বাংলাদেশি। মজার ব্যাপার হোলো রাজা,সানি- (এইদুটো নামই স্মৃতি হাতরে বের করতে পারলাম!) সহ বাকি সবাই আমাকে খুব ভালোবাসতো। আমার উদাস মুখে দিনে এক মানুষ, আর রাতে আরেক মানুষ হয়ে যাওয়ার ডাঃ জেকিল আর মিঃ হাইড খেলার কারনেই বোধহয় আমাকে বন্ধু মনে করতো, খানিক সমীহ-ও করতো বোধহয়!
ওদের কারো কারো কথা হঠাৎ মনে পড়ে যায় আমার!
সেদিন সন্ধায় আমি আবার যাই ফুড কোর্টে। কার্লসবার্গ এর প্রেমে পড়ি এবার। রাত বাড়তেই মদীর চোখে হাটা ধরি সিগার হাতে ।
কিন্তু আমার চোখ খুঁজে বেড়ায় একজন কে! কে?
ইস্ট কোস্ট, আই লাভ ইউ ট্রুলি...
ঘুড়তে ঘুড়তে আমি অসাধারণ একটা জায়গার সন্ধান পেয়ে যাই। হোস্টেল থেকে হাঁটা পথ ধরে মিনিট দশেক পরেই একটা আন্ডারপাস । আন্ডারপাস থেকে বের হতেই,কি আশ্চর্য! সমুদ্র সৈকত। কি যে সুন্দর! একপাশে ফাস্ট ফুড এর দোকান, পাব, বার, তারপাশে ছোট্টো হাঁটাপথ আর একপাশে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। সবুজ ঘাস, গাছ আর আড্ডা দেয়ার বিশাল জায়গা- কি নেই সেখানে! ঘাসের উপর বসে আমি ঘোর লাগা চোখে সেই রাতটা ভোরের কাছে নিয়ে যাই।
সুর্যের অপার্থিব আলো গায়ে মেখে হোস্টেলে ফিরে আসি।
তোমার কি আর দুঃখ পেলে চলে ? মেদুর আকাশ, বৃক্ষ সবুজ তোমার কথা বলে...
সিঙ্গাপুরের পরবর্তী দেড় বছরে আমার বেশির ভাগ রাতই কাটে এই ইস্ট কোস্টে, সমুদ্রের ধারে।
আমি, লিয়েন আর ইস্ট কোস্ট।
আমার খুব ইচ্ছে করে আর একবার, শুধু একবার ইস্ট কোস্টের সেই সমুদ্রের ধারে একটা রাত কাটাতে। আমার দেখতে ইচ্ছে করে বিষাদ আর স্মৃতির তীব্রতা আমাকে কতখানি গ্রাস করে নিতে পারে! আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে ইস্ট কোস্টের বাতাস আর ঢেউ-র কাছে, অকৃতিম বন্ধুতা মনে আছে কিনা!
তারপর দিনই লিয়েন আর সাথে আমার আবার দেখা হয়......
বন্ধুত্ব শুরু হয় আমাদের।
গিটার, হঠাৎ হঠাৎ দেখা হওয়া, হাই-হ্যালো এর ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকে মুগ্ধতা। আমি নিয়ম করে ক্লাস ফাঁকি দেই, বোহেমিয়ান ঘুরে বেড়াই, এক আধদিন বই নিয়ে বসে চোখ বুলাই আর ভাবি ,বাহ! সাবজেক্ট-টা মজা তো! তারপর পৃষ্টায় আঁকিবুঁকি করে ফুড কোর্টে চলে যাই। ততদিনে লিয়েন এর সাথে ফোন নাম্বার বিনিময় হয়ে গেছে! টেক্সট করি, ওর গিটার নিয়ে আসতে বলি। আড্ডা জমে ওঠে আমাদের, একদিন-দু'দিন। এভাবে এগিয়ে যেতে থাকে আমার সিঙ্গাপুর জীবন, আমাদের সিঙ্গাপুর জীবন।
অবসরে একদিন সেরাঙ্গন ঘুড়তে যাই। শনিবারে যেয়ে একদম হতবাক হয়ে যাই, খুশীও হই খুব। যেদিকে তাকাই বাংলাদেশী। চানাচুর বিক্রি হচ্ছে এক জায়গায়। কিনে ফেলি ২ ডলার দিয়ে।
খুব আরাম করে সেদিন চানাচুর খেয়েছিলাম, এখনও মনে আছে আমার।
ফিরে এসে দেখি আমার বিখ্যাত আই- ০৮ এ নতুন ছেলে এসেছে একজন। পরিচয় হতে জানায় ওর নাম তুহিন। বাংলাদেশী, চিটাগাং বাড়ি। ভালো লেগে যায়।
ক্রমে ক্রমে তুহিন হয়ে ওঠে আমার খুব কাছের ছোট ভাই, খুব ভালো বন্ধু।
আমাদের হোস্টেল ছিলো আক্ষরিক অর্থেই অদ্ভুত। প্রতি বৃহষ্পতিবার রাতে প্রজেক্টরে সিনেমা দেখানো হতো আবার একই সাথে প্রায় প্রতি উইক এন্ড এ কথা নেই বার্তা নেই, হুটহাট দুই দেশের পোলাপান এর মাথা গরম, মারামারি ...প্যাঁ পোঁ... মিনিট পাচেঁক এর ভিতর পুলিশ এর গাড়ি। সিঙ্গাপুরীয়ান পুলিশ করিৎকর্মা। রাস্তায় একটু পর পর টহল দেয়, আর অন্য দেশ থেকে আসা স্টুডেন্ট বা টুরিস্ট, যে কোনো প্রয়োজনে এগিয়ে আসতে কার্পণ্য করে না এতটুকু।
যাই হোক, কাটং হোস্টেল-এ পুলিশ ছিলো খুব সাধারন ব্যাপার। সবচেয়ে বেশি মারামারি করতো পাঞ্জাবি আর নেপালিরা। একবার তো ভয়ঙ্কর মারামারি শেষে সবাইকে নিয়ে লক আপ এ পুরলো। আমার রুম নিমিষেই মানুষ শুন্য। কারণ আমার রুমমেট সব কয়টা জেলে! আমি এক রাতে রুমে ঢুকে সব শুনে তাজ্জব!
ঐ মেয়েটা আমার মতই একা, আমার মত খোঁজে কি মেঘটাকে...
সিঙ্গাপুর ঘুড়ি, কখনো একা একা, কখোনো বন্ধুদের সাথে।
পায়া লেবার এম আর টি স্টেশন থেকে জুরং ইস্ট স্টেশন। মাঝে আল জুনায়েদ, চায়না টাউন, লিটিল ইন্ডিয়া, সেরাঙ্গন, মুস্তাফা সেন্টার আরও কোথায় কোথায় চলে যাই যখন তখন! লিয়েন এর সাথে আডডা দেই গভীর রাত পর্যন্ত হোস্টেলের রাস্তার পাশেই ঘোস্ট হাউস এর বাইরের অংশে!( তখনও ভিতরের দিকে যেতে সাহস পেতাম না। এটা ছিলোএকটা পরিত্যাক্ত বাড়ি। সামনে বিশাল মাঠ। দিনের বেলায় দেখতে শান্ত, রাতে খানিক গা ছমছমে।
নামটা আমারই দেয়া। মজার ব্যাপার এই নামটা পরে পুরো হোস্টেল এ জনপ্রিয়তা পায়। ঘোস্ট হাউস নিয়ে পরে হয়তো লিখবো আরো। ) মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে চলে যাই ইস্ট কোস্টের সমুদ্রের ধারে। লিয়েন আমাকে গেয়ে শোনায় সি সি আর এর হু স্টপ দ্য রেইন, আমি ওকে শোনাই অঞ্জন এর ২৪৪১১৩৯।
ওর খুব ভালো লেগে যায় গানটা।
আমি তখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ...
ক্রমশঃ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।