আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাযাবরনামা ... দ্বিতীয় পর্ব !

মুন রিভার ...
যে দিন চলে যায়, যে রাত টা ঘুমায়, ফিরে আসে না ... দিনটা ছিলো কোনো এক সোমবার। ঘূর্নিপাকে অনেক দিন ঘুরে ঘুরে নিজেকে আবিষ্কার করলাম চাঙ্গি এয়ারপোর্টে। দারুন ঝকঝকে, সুন্দর। কার্পেটের নরম মখমলে পা ডুবিয়ে রাজ্যের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুরছি আর মনে মনে বলছি, ‘ ওহে, এবার কি অপেক্ষা করছে তোমার জন্য! এবার কোন জলে ঝাঁপ দেবে তুমি?’ তখনও জানতাম না সিঙ্গাপুরে আমার জন্য অপেক্ষা করছে এক অদ্ভুত বিষাদ মাখা তীব্র আনন্দ! শুরুটা হলো খুব অদ্ভুত ভাবে। বিখ্যাত সেরাংগন এর এক ছোট্ট হোটেলের ততোধিক ছোট্ট রুমে।

দরজা বন্ধ করে মনে হলো, কবরের অন্ধকার নেমে এলো যেন! রাতে রুটি খেলাম, ২ ডলার দিয়ে কিনে। কিচ্ছু চিনি না, জানি না। কিন্তু ঘুড়ে বেরাচ্ছি রাতের সিঙ্গাপুর- এ। তারপর ক্লান্ত আর অদেখা ভবিতব্য ভাবতে ভাবতে ঘুমের একদম অতলে তলিয়ে যাওয়া প্রথম রাতের ঘুম। ঘুম ভেঙ্গে দেখি সকাল ৭টা।

যাক, আমিও সকাল সকাল উঠতে পারি তাহলে। নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিলাম। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে রওনা দিলাম স্কুল খুঁজে বের করতে। আমি এডমিশন নিয়েছিলাম ইনফরমেটিক্স ইন্সটিটউট এর ম্যাস কমিউনিকেশন-এ। প্ল্যান ছিলো ডিপ্লোমা কমপ্লিট করে অ্যাডভান্স ডিপ্লোমায় এ ভর্তি হবো।

প্ল্যান ছিলো উড়াল দিবো, উড়াল... কেউ খুঁজে পাবে না আমাকে। ভেবেছিলাম বোহেমিয়ান হয়ে যাবো সমস্ত পিছুটান ফেলে... হোটেল থেকে বের হতে দেখি চারিদিক আধাঁর। কি কান্ড! সাত সকালে সিঙ্গাপুরে রাতের আকাশ! আমি অবাক হতে হতে দেখি নিয়ন আলো, ব্যস্ত মানুষ, গোছানো পরিপাটি রাস্তা, ছুটে চলা ট্যাক্সি। উঠে পড়ি এক ট্যাক্সি ক্যাব-এ। গন্তব্য জুরং ইস্ট।

‘ তুমি তো অনেক দেরি করে ফেলেছো, মিস্টার। আজ আর কাগজপত্র প্রসেসিং হবে না। আজ তো অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। ' মানে! আমি আকাশ থেকে পড়ি। সকাল বাজে আটটা।

অফিস শেষ! সিঙ্গাপুরে কি সব আমার মত আউলা হয়ে চলে নাকি! আমি জিজ্ঞেস করি সাত সকালে অফিস বন্ধের কারণ! অফিসের সুন্দরী মহিলা অবাক হয়ে বলে, আমাদের অফিস তো সন্ধে সাতটাতেই বন্ধ হয়ে যায়। তুমি আধা ঘন্টা দেরি করে ফেলেছো! ঘুম থেকে উঠা পিঠ চাপড়ানোর কথা মনে পড়ে। এতক্ষনে আমার মাথায় ঢুকে সিঙ্গাপুরের আকাশ আধাঁর নামায় সন্ধে হলেই, সাত সকালে নয়। আমার ঘুম ভেঙ্গেছিলো আসলে সন্ধ্যা ৭টায়। ফিরে আসি তব্দা খাওয়া হাবলু হয়ে ছোট্ট হোটেল এর আধাঁরপুরী -তে।

মনে মনে এক চোট হাসি নিজের বোকামীর জন্য। সিঙ্গাপুর জীবন শুরু হলো অদ্ভুত ভাবে , তখনও ভাবিনি সিঙ্গাপুর আমার জন্য তার সমস্ত বর্নিলতা সাজিয়ে বসে আছে। কাটং হোস্টেল, তানজুং কাটং রোড উঠে আসি ইন্ট্যারন্যাশনাল স্টুডেন্ট হোস্টেলে। স্বার্থক নামকরণ। স্টুডেন্ট নেই কোন দেশের! ভিয়েতনাম, চিন, জাপান, কোরিয়া মংগোলিয়া- এপাশে আমার দেশ, ইনডিয়া, নেপাল, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা , ওদিকে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা হয়ে নেই কে! যেনো এক মিলনমেলা।

সামনেই ফুড কোর্ট। খুঁজে পেতে পেয়ে যাই সাব কন্টিনেন্ট এর খাবার। ভিতরে খেলার জায়গা, মাঠ, জিম, টিভি রুম আর সুবিশাল কিচেন। তবে সবচেয়ে অবাক হয়ে যাই হোস্টেল থেকে এক রাতে বাংলাদেশি বন্ধুদের সাথে বের হয়ে। হোস্টেল এর খুব কাছে দারুন এক সমুদ্র সৈকত।

নাম ইস্ট কোস্ট। প্রথম দিন যেয়েই মুগ্ধ হয়ে যাই। সমুদ্রের ধার ঘেঁষে পাব, ম্যাকগোনাল্ড, কে এফ সি, বার। পাবগুলোতে চলছে লাইভ ব্যান্ড পারফরমেন্স। আমাকে আর পায় কে! ঢুকে পড়ি এক পাবে।

বসে পড়ি হ্যানিকেন হাতে। দারুন কাটে সে রাত। ফিরে আসি ভোর রাতে। হোস্টেলে ততদিন বন্ধু হয়ে যায় তুহিন, মিঠু সহ আরো অনেকে। ছুটে যাই পরদিন, তারপরের দিন...প্রতিদিন, ইস্ট কোস্টে! আমার জীবনে এভাবে জড়িয়ে পরে দূর সুদুরের এক সমুদ্র সৈকত- ইস্ট কোস্ট এর নাম, গন্ধ, বাতাস আর বুক পাঁজরে হাহাকার ছড়িয়ে দেয়া ঢেউ!... তারপর একরাত, স্বপ্ন সমান সমুদ্র ভাবায়!... ততদিনে আমি ক্লাস করি অনিয়মিত আর নিয়ম করে বিয়ার খাই সন্ধ্যা হতেই , ছুটে যাই ইস্ট কোস্টে।

সমুদ্র বাতাস আর লাইভ মিউজিক আমাকে পুরোপুরি মোহাবিষ্ট করে ফেলেছে। কোথায় কোথায় চলে যাই , কি কি করি কোনো হিসেব নেই। আমার অবশ্য জীবনটাই বেহিসেবি ত্রিকোনোমিতি। আমি ঘুড়ে বেড়াই, মদির চোখে কাকে যেনো খুঁজে বেড়াই, নিজেই বুঝি না... একরাতে। ফিরে আসছি ইস্ট কোস্ট থেকে হোস্টেলে।

রুমে ঢুকতে যাবো, শুনি কে যেনো খুব মনোযোগ দিয়ে গাইছে- মাইকেল লার্ন্স টু রক এর সামডে! আমি অবাক হয়ে এগিয়ে যাই। চুপচাপ পাশে দাড়িয়ে থেকে শুনি। নাইলন স্ট্রিং এর গিটার নিয়ে একটু টুংটাং করার চেষ্টা করি। মনে পড়ে যায়, আমি আর কখনো সুর শব্দে ফিরে আসবো না এই পণ করেছিলাম নিজের কাছেই। শেষ হতেই হাত বাড়িয়ে পরিচিত হই।

জানতে পারি ওর নাম লিয়েন। সেই রাতে আমি স্বপ্নে দেখি সমুদ্রের বাতাস হঠাৎ প্রবল বেগে আমার চোখের কালো হয়ে ঢুকে পড়ছে চোখে। অবারিত সবুজে মিশে যাচ্ছি আমি। আর কি অবাক করা ব্যপার! আমি দেখতে পাই শৈশব-কৈশোর এর সেই কড়ই গাছ , হেঁটে বেড়ানো সেই বহুচেনা পথ, আর প্রিয় মুখগুলোকে। সেদিন বুঝিনি, সে রাতে আমি আমার জীবনের একটা লম্বা সময় বয়ে বেড়ানো ভুল স্বপ্ন দেখেছিলাম।

ক্রমশঃ (অফটপিক- আমার খুব প্রিয় ছোটো ভাই চিত্রকর মুরাদ এর ছবিটা দিলাম যাযাবরনামার সাথে। বুঝতে পারছি না পুরো ছবিটা এলো কিনা ! মুরাদকে অনেক ধন্যবাদ। ) ভালো হোক সবার, জেগে থাকা রাতগুলো রাগী জোনাকি থেকে মুক্ত থাকুক!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।