আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অবহেলায় ডাক্তারদের কর্মজীবন গড়াগড়ি খায় ছাদঘর ও মেঝেতে!



একটি কক্ষের সামনে ভিড় করে আছেন কিছু লোক। হঠাৎ তাঁদের কয়েকজন ছুটলেন এক তরুণের পেছনে। উঠে গেলেন সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে। এঁরা কারা জিজ্ঞেস করতেই অধিদপ্তরের একজন নারী কর্মী (চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী) বলেন, 'সবার সামনে আলাউদ্দিন, এইখানের কর্মচারী_আর পেছনের সবাই ডাক্তার। ' তাঁরা কোথায় গেলেন জানতে চাইলে ওই কর্মী বলেন, 'যাইয়া দেহেন, কই যায়।

' সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই দেখা যায় খোলা ছাদ। খাঁ খাঁ রোদে পুড়ছে পানির ট্যাংক, ভাঙাচোরা পরিত্যক্ত আসবাবপত্র। কেমন ভয়ের আবহ। কিন্তু যাঁরা এইমাত্র উঠলেন, তাঁরা কোথায়? সিঁড়ি বেয়ে নামার মুখেই দেখা যায়, আরেকজন উঠছেন। ঘটনা খুলে বলতেই ওই ভদ্রলোক নিজেকে একজন ডাক্তার পরিচয় দিয়ে বললেন, 'চলেন আমার সঙ্গে।

দেখবেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে আমাদের চাকরিজীবন কোথায়, ক্যামনে আটকে আছে। ' ওই ডাক্তারের সঙ্গে ছাদের পানির ট্যাংক ও আসবাবপত্র পেরিয়ে আরেক নির্জন প্রান্তে গিয়ে দেখা যায় দুই দরজার একটি চিলেকোঠা। একটি দরজায় ফাঁক গলে ভেতরে চোখ রাখতেই দেখা যায় ছুটে আসা সেই মুখগুলো। একজন ফাইল খুঁজছেন, সম্ভবত কর্মচারী আলাউদ্দিন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নথি সংরক্ষণের এ ব্যবস্থা উদ্বেগের সঙ্গে দেখছেন ডাক্তাররা।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে একজন ডাক্তার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'দেখেন, আমাদের এসিআর ফাইলের কী দুর্দশা! একটি ফাইল খুঁজে পেতে নানা রকম হয়রানি হতে হয়। অনেকেই দু-তিন দিন ঘুরেও ফাইল বের করতে পারে না। এ ছাড়া এত গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো অরক্ষিত ও অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছে। কারো ফাইল পাওয়া না গেলে তার চাকরির সব সুবিধাই ঝুঁকির মুখে পড়ে। ' বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা কয়েকজন চিকিৎসক- কর্মচারী জানান, আগে এসিআর শাখায় ফাইল খুঁজতে প্রতিটির জন্য ৫০০ টাকা আদায় করা হতো প্রকাশ্যেই।

এখন এ ক্ষেত্রে অনেক রাখঢাক করা হয়। আর টাকার অঙ্ক আদায় হয় ইচ্ছামতো, যার কাছ থেকে যা পারা যায়। গত সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে গিয়ে দেখা যায় এমনই দৃশ্য। দেশের পুরো স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ হয় ছয় তলা ভবনের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে। সেই সঙ্গে দেশের হাজারো সরকারি ডাক্তারের 'চাকরিজীবন'ও এই ছয় তলা ভবনের নথিপত্রের ওপর নির্ভর করে।

তবে এই মহার্ঘ্য নথিই কিছু গড়াগড়ি খায় টেবিলের তলায়, কিছু মেঝের ধুলা-ময়লায়! অযত্নে পড়ে থাকে চিলেকোঠায়। গত সোমবার দেখা যায়, ভবনের ছয় তলায় 'এসিআর শাখা'র সামনে বেশ কিছু নারী-পুরুষের ভিড়। কারো হাতে ব্যাগ, কারো হাতে ফাইলপত্র। ৬০৪ নম্বর কক্ষে রীতিমতো মানুষের ঠাসাঠাসি। তাকে রাখা ফাইল হাতড়ে বেড়াচ্ছেন দু-তিন কর্মী।

পাশের ৬০৩ নম্বর কক্ষের দরজা খোলা। কক্ষভর্তি ফাইল। তাকে ঠাঁই না হওয়ায় অনেক ফাইল পড়ে আছে টেবিলের তলায় এবং মেঝেতে। কিছু স্তূপ দেওয়া, আবার কিছু ছড়ানো-ছিটানো অবহেলায়-অযত্নে। ফাইলগুলোর বেশির ভাগের ওপরই ধুলা-ময়লার আবরণ।

টেবিলের পাশে পড়ে থাকা ফাইলগুলোর কোনো কোনোটির ওপরে লেখা 'বার্ষিক/বিশেষ গোপনীয় অনুবেদন'। অনেকের মাঝে এমনভাবেই পড়ে থাকতে দেখা যায় ডা. রোজিনা সুলতানার (কোড ৪৩০৯৯) ওই ফাইল। কাছেই পড়ে আছে আরেক ডাক্তার নওরোজের (কোড নম্বর ৩৬০৫০) ফাইল। ৬০৪ নম্বর কক্ষের তাক উপচে পড়া ফাইলের চিত্রও একই রকম। পাঁচ তলার করিডর।

সারি সারি চেয়ারে বসে আছেন বিভিন্ন কাজে আসা চিকিৎসক বা স্বাস্থ্যকর্মীরা। কেউ দিব্যি ঘুমাচ্ছেন, কেউ ঝিমুচ্ছেন। কেউবা বসে আছেন অসহায় ভঙ্গিতে। মাদারীপুর থেকে আসা অবসরে যাওয়া এক স্বাস্থ্যকর্মী বলেন, '২০০৯ সালে পেনশনে গেছি, টাকাপয়সা ঠিকই পাইছি, তবে এখন নতুন সিলেকশন গ্রেডের টাকার অনুমোদনপত্র নিতে আইছি। দুই দিন ধইর‌্যা এখানে ঘুরি।

কাগজটা এখনো হাতে পাইনি। ' মহাপরিচালকের দপ্তরের বাইরে ভিড় নেই। সামনের করিডরে কেউ পায়চারি করলেই দায়িত্বরত কর্মচারীরা তাকে দ্রুত সরিয়ে দেন। দরজা ঠেলে ঢুকতেই দেখা যায় মহাপরিচালকের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা, জনসংযোগ কর্মকর্তা আর গেস্টরুমে লোকে ঠাসাঠাসি। কেউ গায়ে গায়ে বসে, কেউবা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দর্শনার্থীদের বেশির ভাগই বিভিন্ন এলাকার চিকিৎসক। তাঁরা বদলি সমস্যা বা ওএসডি সুবিধা বিষয়ে মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। প্রতিদিনই এই শ্রেণীর চিকিৎসকদের এমন ভিড় লেগে থাকে এ দপ্তরে। ভবনের নিচে চায়ের দোকানের সামনেও ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মীদের ভিড়। দেশের উত্তরাঞ্চল থেকে আসা একজন স্বাস্থ্যকর্মী নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, 'স্বাস্থ্য সহকারী পদ থেকে সহকারী পরিদর্শক পদে পদোন্নতির জন্য তালিকায় নাম ছিল।

স্থানীয় কর্মচারী নেতাদের টাকাও দেওয়া হয়েছিল। কাজ হয়নি। শুনেছি, মন্ত্রী-এমপি বা সরকারদলীয় প্রভাবশালী অনেক নেতার তদবিরের মাধ্যমে কারো কারো পদোন্নতি মিলেছে। কিন্তু আমার তেমন কেউ না থাকায় কোনো গতি হলো না। এখন নিজেই এসেছি মহাপরিচালকের সঙ্গে দেখা করতে।

দেখা করতে পারব কি না জানি না। ' একই স্থানে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন ঠিকাদার। এক ঠিকাদার সম্প্রতি একটি পণ্যের সরবরাহ কাজ না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে উচ্চ গলায়ই বলতে থাকেন, 'আমরা কাম পামু ক্যামনে, বেশির ভাগ লাইন ডাইরেক্টরই বেনামে নিজেরা ঠিকাদারি কাম বাগিয়ে নেয়। ' আরেকজন বলেন, 'এই ভবনে যত প্রকল্প, ডাইরেক্টরদের তত কপাল খোলে। ' 'লোকাল চায়না' : মূল ভবনের পাশে একই অধিদপ্তরের আইইডিসিআরের পরিচালক ড. মাহমুদুর রহমানের কক্ষ।

একজন কর্মচারী ঢুকলেন এক ঠিকাদারকে নিয়ে। হাতে প্লাস্টিকের ছোট দুটি বাঙ্। গবেষণাকাজের নমুনা সংরক্ষণের কাজে ব্যবহারের জন্য বাঙ্ সরবরাহের অনুমোদন পেয়েছেন ওই ঠিকাদার। দরপত্রে ওই ঠিকাদার উল্লেখ করেছেন তাঁর সরবরাহ করা মালগুলো চীনের তৈরি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এখন আপত্তি জানিয়েছে।

কারণ পণ্যের গায়ে নির্মাণকারী দেশের কোনো নাম-চিহ্ন নেই। ঠিকাদার বলছিলেন, বাঙ্গুলো যাতে বাতিল না করা হয়_কর্তৃপক্ষ চাইলে তিনি বাঙ্রে গায়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি 'মেইড ইন চায়না' স্টিকার লাগিয়ে দেবেন। ঠিকাদারের কথা শুনে হাসিমুখেই ধমক দিয়ে ওই ঠিকাদারকে কক্ষ থেকে বের করে দিলেন ড. মাহমুদুর রহমান। কালের কণ্ঠের প্রতিবেদককে তিনি বলেন, 'আমার কাছ থেকে কখনোই এমন কাণ্ড হবে না। অন্য কেউ অনুমোদন করলেও আমি বাতিল করে দিব।

' অটিড বন্ধ : ভবনের অর্থ শাখার অডিট বিভাগের কক্ষে ফাইলের স্তূপ। ফাইলের ফাঁকে কাজ করেন দুজন কর্মকর্তা। এখানকার কাজ কী জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা জানান, আপাতত মাঠপর্যায়ের কাজের চাপ কম। কিন্তু অফিসে কাজ আছে। সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে একটি টিম মাঠপর্যায়ে অডিটে যায়।

এরপর আর যাওয়া যায়নি। এ অডিট বিভাগের কাজ কেবল সারা দেশের উপজেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রের বরাদ্দ দেওয়া অর্থ ব্যয়ের বিভাগীয় অডিট করা। কিন্তু গত ডিসেম্বরে সারা দেশের সব উপজেলার কাজ করা যায়নি। মাত্র গোটা ৪০ উপজেলার কাজ করা হয়েছে। একই সূত্রে জানা যায়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের (অর্থ) অধীনে একজন উপরিচালক, দুজন সহকারী পরিচালক, একজন অডিট সুপার, ছয়জন অডিটর ও তিনজন অফিস কর্মীর ওপর সারা দেশের উপজেলা পর্যায়ের অডিটের ভার।

এর মধ্যে একমাত্র অডিট সুপারসহ চারজন অডিটরের পদ শূন্য পড়ে আছে। ফলে মাঠের কাজে নামার উপায় নেই। তাই আপাতত অডিট বন্ধ। সরকারি হাসপাতালগুলোর মতোই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভবনের প্রতি তলায় টয়লেটের দুরবস্থা। ভাঙাচোরা উপকরণ।

সঙ্গে ময়লা, দুর্গন্ধ। অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা) ডা. মো. আবুল মনসুর খান বলেন, 'শুধু টয়লেট নয়, এখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্ভোগ পদে পদে। সংকুচিত একেকটি কক্ষে ঠাসাঠাসি করে বসেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। একেক শাখা একেক জায়গায়। ক্যান্টিনের জায়গা নেই।

গাড়ির পার্কিংয়ের জায়গা নেই। পুরো চত্বরে এলোমেলো করে গাড়ি রাখতে হচ্ছে। নিজেরাই যেখানে ঠিকমতো বসতে পারি না, সেখানে বাইরে থেকে আসা চিকিৎসক-কর্মচারীদের নির্বিঘ্নে সেবা দেওয়া কতটা সম্ভব!' তিনি আরো বলেন, অনেক চেষ্টা করেও পরিবেশ পুরোপুরি ভালো রাখা যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের এ হাল বড়ই দুঃখজনক। তবে প্রস্তাবিত নতুন ভবনটি নির্মাণ করা গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে।

জাতীয় পতাকা 'ওড়ে না' : এসবের বাইরে আরেক জাতীয় মর্যাদার প্রশ্ন তুলে ধরলেন খোদ ওই অধিদপ্তরেরই একাধিক কর্মকর্তা। ভবনের বাইরে এসে পতাকার স্ট্যান্ড দেখিয়ে একজন বললেন, 'এই দপ্তরে শেষ কবে জাতীয় পতাকা উড়তে দেখেছি, তা মনে পড়ে না। ' স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. খন্দকার মো. শিফায়েতুল্লাহ বলেন, 'অগোছালো সব কিছু গুছিয়ে আনার কাজ চলছে। ইতিমধ্যেই ভবনে সিসিটিভি ব্যবস্থা চালু করার কাজ শুরু হয়েছে। অনিয়ম-দুর্নীতি কমানোর জন্য যা যা করা দরকার, সবই করা হবে।

কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যার যার দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন না করলে সবারই শাস্তি ভোগ করতে হবে। ' মহাপরিচালক আরো বলেন, 'এসিআর শাখায় আগে অনিয়ম- অনৈতিক অর্থ আদায়ের ব্যাপার ছিল। এখন তা নেই। ব্যবস্থাপনাগত আধুনিক পদ্ধতি চালু হবে শিগগিরই। সব চলবে কম্পিউটারে।

ফলে ফাইল খুঁজতে হয়রানির সুযোগ থাকবে না। সংরক্ষণেও কোনো সমস্যা হবে না। ' সুত্র : কালের কন্ঠ

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।