আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১।জাফর আলম ঢেউয়ের মাথায় অদম্য তরুণ, ২,বল বয় থেকে গলফার



১,তীরের দিকে ছুটে আসছে সমুদ্রের ঢেউ, সেই ঢেউয়ের মাথায় দাঁড়িয়ে আছে এক অদম্য তরুণ। অবলীলায় ঢেউয়ের পর ঢেউ পেরিয়ে অনন্ত জলরাশির দিকে ছুটে যাচ্ছে তরুণটি। বিদেশি কোনো স্পোর্টস চ্যানেলে এ রকম দৃশ্য হয়তো দেখা যায়, কিন্তু আমাদের দেশে? হ্যাঁ, সম্ভব। এ রকম একটি দৃশ্য আমাদের চোখের সামনে সম্ভব করে তুলেছেন জাফর। কক্সবাজার শহরের দক্ষিণ বাহারছড়ার ফারুক আহমদ আর গোলবাহারের ছেলে জাফর আলম।

বাড়ির পাশে সমুদ্র, তাই পুকুর বা নদীতে নয়, বঙ্গোপসাগরে সাঁতার কেটে বেড়ে উঠেছেন তিনি। প্রায় ১২ বছর আগের কথা। তখনো সার্ফিং শব্দটির সঙ্গে পরিচয় ঘটেনি; সৈকতে দাঁড়িয়ে জাফর দেখতে পেলেন এক বিদেশি পর্যটক দুই পায়ে কাঠের টুকরোর মতো কী জানি বেঁধে বড় বড় ঢেউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে লাফিয়ে উঠছেন আর নামছেন। মনোমুগ্ধকর সেই দৃশ্য! পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন জাফর। সাঁতার কেটে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।

বিদেশি পর্যটক এই অসম লড়াইয়ের যোদ্ধাকে দেখে অবাক। ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, সার্ফিং শিখবেন কি না। জাফর সানন্দে রাজি। অস্ট্রেলীয় ওই পর্যটক সামান্য কটি টাকার বিনিময়ে সার্ফ বোর্ডটি জাফরকে দিয়ে দেন, শিখিয়ে দেন কিছু কলাকৌশল। এরপর শুরু হয় জাফরের আসল লড়াই।

সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি ক্রীড়াশৈলী আয়ত্ত করার সংগ্রাম। জাফর বললেন, ‘উত্তাল ঢেউয়ে সার্ফ বোর্ডের ওপর দাঁড়িয়ে থাকাটা খুবই কঠিন কাজ। প্রায়ই বোর্ড থেকে ছিটকে পড়তাম। তবু হাল ছাড়িনি। ’ কোনো প্রশিক্ষক নেই, দেশে নেই কোনো পূর্বসূরিও, তাই দীর্ঘ পাঁচ বছর একান্তে সাধনা করে খেলাটি আয়ত্তে আনলেন জাফর।

শুধু নিজে শিখলে তো হবে না, সঙ্গী-সাথি ছাড়া আর যা-ই হোক, খেলাধুলা অসম্ভব। তাই ২০০২ সালে গড়ে তুললেন ‘সার্ফিং বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন। শুরুতে সদস্য হলেন পাঁচজন। দলে মেয়েও ছিলেন একজন। কাঠমিস্ত্রি আবদুস সালামের ষোড়শী কন্যা নাহিদা আকতার।

সার্ফিং বাংলাদেশের সদস্য হয়ে জাফরের উৎসাহ ও সহযোগিতায় ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার সাহস ও সামর্থ্য অর্জন করেছেন বাঙালি ‘অবলা’টিও। ২০০৪ সালে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপ থেকে কক্সবাজার সৈকতে সার্ফিং করতে আসেন ‘সার্ফিং দ্য ন্যাশনস’-এর প্রেসিডেন্ট টম বাউয়ার ও তাঁর তিন সঙ্গী। সৈকতে জাফরের সার্ফিং প্রশিক্ষণ দেখে বিস্মিত হন বাউয়ার। বাংলাদেশি সতীর্থদের জন্য শুভেচ্ছা হিসেবে দিয়ে যান তিনটি সার্ফ বোর্ড। বলেছিলেন, আবার আসবেন তাঁদের এগিয়ে যাওয়া দেখতে।

সেদিন টম বাউয়ারের সঙ্গে পরিচয় না হলে হয়তো সবার অগোচরেই থাকতেন জাফর। অজানা থাকত বাংলাদেশের এক সম্ভাবনার দিগন্ত। শুরুতে পাঁচজন, ২০০৮ সালে ২৫ জন, ২০০৯ সালে ৪০ জন। ধীরে ধীরে সার্ফিং বাংলাদেশের পরিধি বিস্তৃত হতে থাকল। বর্তমানে ১৩০ জনের মধ্যে মেয়ে সার্ফারের সংখ্যা ৩৫ জন।

এদিকে নিজেকে আরও পরিণত করে তুলেছেন জাফর। ২০০৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সার্ফিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে বিভিন্ন দেশের ১৩০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অধিকার করে চমকে দিয়েছেন সবাইকে। আর ২০১০ সালে ১৭০ জন প্রতিযোগীর মধ্যে তাঁর স্থান তৃতীয়। এবার তাঁর দৃষ্টি নিবদ্ধ প্রথম স্থানটির দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জাফরের সাফল্যের সঙ্গে তাঁর দেশটির কথাও জানছে সবাই।

বাংলাদেশ নিয়ে কৌতূহলী হয়ে উঠছেন পর্যটকেরা। জাফর বলেন, ‘সার্ফিং বাংলাদেশ’ লেখা টি-শার্ট পরে আমেরিকায় ঘোরাফেরা করার সময় অনেকেই জিজ্ঞেস করেছেন, বাংলাদেশে সার্ফিং হয়? ওখানে সাগর আছে? আমেরিকার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সার্ফার জাফরের সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, যেখানে পর্যটকদের প্রতি ছিল বাংলাদেশ ভ্রমণের উদার আমন্ত্রণ। জাফর বাংলাদেশে সার্ফিংয়ের অমিত সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমেরিকার হাওয়াই, ইন্দোনেশিয়ার বালি এবং শ্রীলঙ্কার অর্গম বে-তে সার্ফিং করেছি। কিন্তু আমাদের কক্সবাজারের সঙ্গে এর কোনোটিরই তুলনা হয় না। যেমন, হাওয়াইতে পানির নিচে প্রচুর প্রবাল পাথর, শরীর কেটে যায়।

ঢেউ বড় হলেও সব জায়গাতে ঢেউ ওঠে না। অন্য সৈকতগুলোতেও নানা সমস্যা। কিন্তু কক্সবাজার সৈকত বালুতে ভরা। এ সমুদ্রে ঢেউয়ের আকৃতি যেমন বড়, তেমনি তার তীব্রতাও বেশি। কক্সবাজারের এ সুযোগ-সুবিধার কথা বিদেশে প্রচার করা গেলে এই খাত থেকে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।

’ ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, জানতে চাইলে জাফর বললেন, ‘কক্সবাজারে একটি সার্ফিং একাডেমি করার ব্যাপারে সরকারি-বেসরকারি সাহায্য পাওয়া গেলে যেমন অনেক তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব, তেমনি অবকাঠামোগত সুবিধা পেয়ে বিদেশি পর্যটকেরাও ভিড় করবেন এখানে। এখনই সার্ফিং করতে অনেকে আসছেন, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনো নির্দেশিকা নেই, যোগাযোগ করার কোনো ঠিকানা নেই। ’ ১৯৮২ সালের ১৯ মার্চ জন্ম জাফরের। দারিদ্র্যের কারণে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। সার্ফিং বোর্ডে চেপে নিজের সেই সীমাবদ্ধতাকে পেরিয়ে যেতে চান তিনি।

বিশাল সমুদ্রে ঢেউয়ের মাথায় দাঁড়ানো জাফর হতে পারেন বাংলাদেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। এই অদম্য তরুণকে দেখে কবিতার সেই পঙিক্তগুলোই গুঞ্জরিত হয় মনে—‘সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে/ আমরা বাঙালি বাস করি সেই বাঞ্ছিত ভূমি বঙ্গে/ বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি/ আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই নাগেরি মাথায় নাচি’। ২,« অপরাজেয় তারুণ্যসিদ্দিকুর রহমান গলফ মানচিত্রে বাংলাদেশ» ধামালকোট জায়গাটা ঢাকার খানিকটা বাইরে। কুর্মিটোলা থেকে মাইলখানেক দূরে। ধামালকোটের সিদ্দিক নামের এক কিশোরের কথা শুনুন।

নব্বইয়ের দশকের শুরুর ঘটনা। কোনো এক ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে কিশোর সিদ্দিক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ঢুঁ মারছে এলাকার লোহালক্কর আর ঝালাইয়ের দোকানগুলোতে। কী খোঁজে ছেলেটা? লোহার রড! কিশোর সিদ্দিক লোহার রড খুঁজছিল কেন? বিস্তারিত না জেনে আপনি হয়তো সিদ্দিককে ওই কতিপয় দামালের দলেই ফেলতে যাচ্ছেন! উত্তর যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে বলি, থামুন, এত বড় ভুল করবেন না! এবং জেনে নিন ধামালকোটের ওই কিশোর সিদ্দিক এখন বাংলাদেশের ক্রীড়াজগতের উজ্জ্বল তারকা—সিদ্দিকুর রহমান, গলফ কোর্টে যাঁর দৌর্দণ্ড প্রতাপ। আর সেই ঝাঁ ঝাঁ রোদের দুপুরে তিনি লোহার রড খুঁজছিলেন একটা অস্ত্র বানানোর আশায়। অস্ত্রের নাম—গলফ ক্লাব! সোজা কথায় গলফ খেলার ব্যাট।

শুরুর পথটা এমন বৈরীই ছিল। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। বাবা স্বাধীনতার পরপরই মাদারীপুর থেকে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছিলেন দুই ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে। কিন্তু অভাব যেন কপালে লেখা রইল অমোচনীয় কালি দিয়ে। তারপরও আফজাল হোসেন চাইতেন ছেলেরা তাঁর পড়াশোনা করুক, হোক মানুষের মতো মানুষ।

কিন্তু ধামালকোটের হালচাল দেখে শঙ্কায় দিন কাটত তাঁর। একদিন সেই শঙ্কার ঘরে বাসা বাঁধল আশা। পাশের বাড়ির এক ছেলে বলল, ‘চাচা, সিদ্দিকদের গলফ ক্লাবে নিয়ে যাই। বল কুড়িয়ে কিছু টাকা পাবে। ’ সেই হলো শুরু।

কেউ জানল না, বলবয় হিসেবে কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবের মাঠে পা রাখা কিশোর সিদ্দিক একদিন গলফের নায়ক হতে যাচ্ছে। সিদ্দিকুর রহমানও কি তা জানতেন? রাতে স্বপ্নও কি দেখতেন না একটু-আধটু? ‘আসলে ওই সময় স্যারদের খেলা দেখেই গলফের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। ’ স্বপ্নের ডানায় আরও পালক যোগ হলো একদিন। যেদিন বলবয় থেকে ‘ক্যাডি’ হলেন সিদ্দিক। ক্যাডি মানে গলফারদের ক্লাবভর্তি ব্যাগ বহন, প্রয়োজনে টুকটাক সহযোগিতা করা।

ক্যাডি হওয়ার পর গলফটা আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ মিলল। মাথায় কেবল একটাই পোকা—গলফ। ছুটলেন ওই ঝালাইয়ের দোকানে। সেখানেই পেয়ে গেলেন ক্লাব! লোহার রড দিয়ে বানানো সেই ক্লাব দিয়ে স্বপ্নযাত্রার শুরু। দুপুরে স্কুল থেকে ফেরার পর ভাতের হাঁড়ি শূন্য, ততোধিক শূন্যদৃষ্টি মা মনোয়ারা বেগমের।

এ ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তবে ওই শূন্য থেকেই শিখরে ওঠার মন্ত্রণা খুঁজতেন সিদ্দিকুর। ছুটে যেতেন মাঠে। পরিশ্রমের ত্রুটি ছিল না মোটেও। ফলাফল—অবধারিতভাবেই সাফল্য।

এই দশকের শুরুর দিকে দেশে প্রতিযোগিতামূলক গলফ শুরুর উদ্যোগ নিলেন গলফ ফেডারেশনের কর্মকর্তারা। সেখানে নাম লেখা হলো সিদ্দিকুর রহমানেরও। শুরুর দিকে তাঁর উচ্চতা-শক্তি নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অনেকেই। সেই সন্দেহ মিথ্যে প্রমাণ হলো, যখন একে একে ১২টি অপেশাদার গলফ টুর্নামেন্টে শিরোপা বগলদাবা করলেন সিদ্দিকুর। বাংলাদেশে জিতলেন পাঁচটি, দুটি করে জিতলেন পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে আর একটি ভারতের মাটিতে।

এই সাফল্য তাঁকে নিয়ে গেল পেশাদারদের মাঠে। সেখানেও সাফল্য। ২০০৮-২০০৯ সালে সিদ্দিকুর জিতলেন ভারত ও বাংলাদেশে ভারতীয় সার্কিটের চারটি শিরোপা। আর ২০১০-এ সুযোগ মিলল এশিয়ান ট্যুরে অংশ নেওয়ার, প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে। কয়েকটা ট্যুর শেষে এল ব্রুনাই ওপেন।

আগস্টের ১ তারিখ, বাংলাদেশের গলফ ইতিহাসে বাঁধাই করে রাখার মতো একটা দিন, সেদিন ব্রুনাই ওপেন জিতলেন সিদ্দিকুর রহমান! বার্তা সংস্থা এএফপিতে লেখা হলো, ‘এই একজন সিদ্দিকুর রহমানের কারণে গলফ-বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের নামটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ’ ব্রুনাই ওপেন জেতার পর এশিয়ান গলফারদের র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ নম্বরে উঠে গেলেন সিদ্দিকুর। খেলে এসেছেন সুইজারল্যান্ডে, মালয়েশিয়ায়। এখন এশিয়ার গলফারদের মধ্যে তাঁর অবস্থান আরও ওপরে—৬! আর এখন পর্যন্ত তাঁর প্রাইজমানি দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৬৭৩ ডলারে! ১৯৮৪ সালের ২০ নভেম্বরে জন্ম নেওয়া এই তারকা এতেই তুষ্ট নন। সামনে এখন একটাই নিশানা—মেজর টুর্নামেন্ট।

বিশ্বের বাঘা বাঘা গলফারের সঙ্গে জোর লড়াই করেই মেজর টুর্নামেন্টে নাম লেখাতে হবে। সিদ্দিকুর এটা জানেন, জানেন গোটা বাংলাদেশ এখন তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকে। তাই হাসিমাখা মুখে বলেন, ‘আরও অনেক কিছু জেতার বাকি। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.