নামহীন (৫ম পর্ব)
-
-
১১
অনি আর শুভ দুজনের কারোরই মেডিকেল পরীক্ষা খুব একটা ভালো হলোনা।
‘তোর পরের পরীক্ষা কই?’ – শুভকে জিজ্ঞেস করল অনি।
‘টেক্সটাইল আছে, এরপর ডিইউ, সিইউ। ’ – জানালো শুভ। ওর মনটা খারাপ।
রেজাল্ট খারাপ হওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিগুলোতে পরীক্ষাই দিতে পারছেনা সে। আর এখন মেডিকেল টেস্টও খারাপ হল । ‘তবে ভাইয়ার ইচ্ছা আমি ম্যারিনে যাই। ’ – শুভর বড় ভাই নিজেই ম্যারিন পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাবা ডাক্তার বলে বড় ছেলেকেও ডাক্তার বানানোর ইচ্ছে ছিল শুভর বাবার।
কিন্তু শুভর ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ নেই।
‘রাসেলের মত? তুইও চলে যাবি? ভার্সিটিতে পড়েও তো অনেকে অনেক ভালো জায়গায় আছে। ’ – অনির বুকটা হু হু করে উঠলো। রাসেলের সাথেই যোগাযোগ নেই প্রায় ৬মাস। এখন শুভও চলে গেলে অনি একদম একা হয়ে যাবে।
‘না। আমি দেশেই পড়ব, যদি পড়ি। ’ – শুভ বুঝতে পারছে বন্ধুর মনের অবস্থা।
‘ও!’ – শুভর কথা শুনেও আশ্বস্ত হতে পারলনা অনি।
‘দুই বছরের কোর্স।
বের হলেই ভালো চাকরী!’
‘কিন্তু রিস্কও তো অনেক। রাসেল নাকি চিফ ইঞ্জিনিয়ার হবে?’ – অনি এখনো শুভর ডিসিশনটা পছন্দ করছেনা।
‘হ্যা। রাসেল তো ইঞ্জিন সাইডে পড়ছে। আমি পড়াশোনা করব নটিক্যাল সাইডে।
’ – শুভ বোঝাচ্ছে অনিকে।
‘নটিক্যাল সাইডে পড়লে তুই কি হবি?’ – অনি জানতে চাইল।
‘হ্যাঁ। আমি হবো শিপ এর ক্যাপ্টেন। আমি যেমনে বলবো শিপ তেমনে চলবে।
’ – চোখেমুখে গর্বিত ভঙ্গি যেন তার নামেই একটা শিপ আছে যেটার নাম – এম ভি শুভ !
‘দেখিস টাইটানিকের মত ডুবাই টুবাই দিসনা। ‘ – হেসে বলল অনি। ‘তোর ম্যারিনের পরীক্ষা কবে?’
‘হয়ে গেছে!’
‘হয়ে গেছে?’ – অনি তো অবাক! ‘তাইলে?’
‘পরের বছর দিব। এবছর কোথাও ভর্তি হই। যদি এটা ভালো লেগে যায় তো ভালো।
’ – জানালো শুভ।
‘ও। সামনের সপ্তাহে বুয়েট পরীক্ষা। ভয় লাগতেছেরে। না টিকলে যে কি হবে!’ – অনি খুব চিন্তিত।
এমন না যে বুয়েট ছাড়া কোথাও পড়া যাবেনা। কিন্তু এতো কষ্ট করে, এতো টাকা খরচ করে ঢাকা গেল। অন্তত বাবা-মার জন্যে হলেও তার চান্স পাওয়াটা জরুরী।
সবই জানতো শুভ। বলল, ‘আরে চিন্তা করিসনা।
তোর চেয়ে ভাল ছাত্র আছে কিন্তু আমি মনে করিনা বাংলাদেশে তোর চেয়ে এক হাজারটা ভালো স্টুডেন্ট আছে! তুই চান্স পাবি। ’
হেসে ফেলল অনি।
দুদিন পরেই মেডিকেল এর রেজাল্ট দিল। অনি তখন ঢাকায়। অনি, শুভ কেউই চান্স পায়নি।
কিন্তু শ্রাবণী পেয়েছে। শুভর মাধ্যমে তাকে অভিনন্দনও জানালো অনি। কিন্তু বর্ষার কোন খোজ পাচ্ছেনা সে। ফোন বন্ধ ওর। চট্টগ্রাম থেকে আসার পর দেখা করতে যায়নি অনি।
ফোনে বলেছিল এসেছে। আর এরপর তো পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তাই বলে রেজাল্টটাও জানাবেনা। শেষমেষ উর্মিকেই ফোন দিল।
‘বর্ষার চান্স হয়নি!’ – উর্মির মুখ থেকেই রেজাল্ট শুনলো।
কি বলবে বুঝে উঠতে পারলনা। শুভকে দেখেছে কি সুন্দর মানুষকে সমবেদনা জানায়, সাহস দেয়। অনি কখনো পারেনি। তার এক বন্ধুর মা মারা যাওয়ার খবর পেয়েও সে যাওয়া তো দূর ফোনও দেয়নি। কিন্তু অনেক কষ্ট পাচ্ছিল বন্ধুটার জন্যে।
ফোনে বারবার বর্ষাকে চেয়েও পেল না অনি। সে নাকি খুব কান্নাকাটি করছে। কারো সাথে কথাই বলছেনা।
পরদিন সকালেই বর্ষার সাথে দেখা করতে গেল অনির্বান। ছোট ছোট চোখগুলো ফুলে আছে মেয়েটার।
চোখের নিচে কালি। সারারাতই কান্না করেছে বোঝা যাচ্ছে। চুলও উসকোখুসকো।
‘কি হইছে তোর? দেশে কি পড়ার যায়গার অভাব হইছে?’ – বর্ষার কাছে এসে জিজ্ঞেস করল অনি।
‘এইচএসসির রেজাল্টটাই ডুবাইলো!’ – বর্ষা বলল বিষন্ন কন্ঠে।
‘আরে ব্যাপার না। ’ বর্ষাকে বলল সে। বর্ষা আজ পড়েছে একটা সাদা টপস। সবসময় ওড়না দিয়ে আসলেও আজ আসেনি। তার ফর্সা কোমরের খানিকটা অংশ দেখা যাচ্ছিল।
একবার দেখেই আর তাকায়নি অনি। বুঝতে পারছিল মেয়েটা খুব শকড। বলল, ‘এসব চিন্তা বাদ দে। রুমে গিয়া গোসল কর। যা।
তারপর ভার্সিটির জন্য পড়া শুরু কর। ‘
‘আমি যে অঙ্ক পারিনা। খুব চেয়েছিলাম মেডিকেলটা’
বর্ষাকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি আছিনা। আমি শিখায় দিব তোরে। আমার বুয়েট পরীক্ষা।
আর মাত্র তিনদিন। প্রে করিস। ’
বুয়েট পরীক্ষা পর্যন্ত কারো সাথেই আর কোন যোগাযোগ করেনি অনি। রাতদিন খেটে পড়ছিল। আগের দিন রাতে বাবা এসেছেন।
পড়দিন-ই অনেকের মত অনির্বানের জীবন ঘুরে যাওয়া পরীক্ষা!
১২
‘কেমিস্ট্রিটা অনেক ইজি করে ফেলছে। চান্স পাওয়াটা টাফ হয়ে গেল!’ – বের হয়েই বাবাকে বলেছিল অনি।
রাতে ঘুমাতে যাবে এসময়ই বর্ষার ফোন। ‘তোকে একটা মেসেজ পাঠাতে চাই। তুই ফ্রি হলে বলিস!’
‘এখনই পাঠা।
আমি ফ্রি। ’ – অনি ভাবল হয়ত ওদের সেই মজার মেসেজগুলোর মত হয়তো কিছু। কিন্তু এটার জন্যে অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন কি? বুঝতে পারল মেসেজটা পড়ে। মেসেজটার সারমর্ম ছিল , এতোদিন পরীক্ষা ছিল দেখে কথাবার্তা বলেনি অনি। কিন্তু পরীক্ষার পরও কেন আজ রাতে বর্ষার সাথে গল্প করেনি সে!!!
কথাটা ঠিক।
তবুও অনির প্রচন্ড অভিমান হল। সে তো ব্যস্ত ছিল এতোদিন। আর আজ তো হল থেকে বের হয়ে ফোন দিয়েছিল বর্ষাকে। মেসেজ পাঠানোর পরপরই বর্ষা ফোন দেয়া শুরু করল। কিন্তু অনি প্রতিবার ডিসকানেক্ট করে দেয়।
বর্ষা একের পর এক মেসেজ পাঠাচ্ছে ‘সরি’ বলে। তবুও অনি ফোন ধরেনা।
বর্ষা মেসেজ পাঠালো, ‘তুই ফোন না ধরলে আমি সারারাত বাইরে বসে থাকবো। মশার কামড় খাবো!’
অনি এবার ধরলো ফোনটা। ‘বাব্বা, এতো রাগ!’ – বর্ষা বলল।
সেদিন তারা অনেক রাত পর্যন্ত গল্প করেছিল।
প্রত্যেকটা সম্পর্কের একটা সীমানা থাকে যাকে আমরা বলি ‘স্যাচুরেশন পয়েন্ট’। পশ্চিমা দেশগুলোতে কোন সম্পর্ক এই পয়েন্টে চলে আসলে ততক্ষনাৎ ভেঙ্গে যায়। তাদের যেমন বিয়ের আগেই সন্তান হয় তেমনি সামান্য কুকুরের নাম জেমি হবে নাকি টমি এজন্যে ডিভোর্সও হয়। আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই সম্পর্কের বেড়াজালে আটকা।
সম্পর্কগুলো অনেকটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বিয়ের ১৫ বছর পরও অনেক স্ত্রী জানেননা স্বামী কোন পদে চাকরী করেন। তাই এই পয়েন্ট এর গুরুত্ব সাধারণ সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রে নগণ্য।
কিন্তু একটা ছেলে এবং একটা মেয়ের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা যে দেশেই হোক না কেন অনেকটা ‘প্রফেশনাল’ সম্পর্কের মত। দুজনেই একটা দূরত্ব বজায় রেখে চলে।
বন্ধুত্বের মধ্যেও একটা অদৃশ্য সীমানা যেন থেকে যায়। স্যাচুরেশন পয়েন্ট অতিক্রম করলে সম্পর্কটা আর বন্ধুত্ব থাকেনা।
অনির্বান আর বর্ষা তাদের সম্পর্কের স্যাচুরেশন পয়েন্টে পৌছে গেছে আগেই। তাদের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটা আর এক পা আগালেই পড়ে যাবে অন্য একটি গভীর অচেনা সম্পর্কের চক্রে।
শুভর আশংকাকে সত্যি প্রমাণিত করে সে পথে বর্ষা-ই প্রথম পদক্ষেপটা নেয়।
বুয়েট পরীক্ষার পরের দিনই অনি চট্টগ্রামে চলে যায়। বাসায় রাতে কথা বলার উপায় ছিলনা। কিন্তু কথা না বলে ওরা থাকবে কি করে! সারারাত ধরে চলত মেসেজ আদান প্রদান।
রাত একটা বেজে তেইশ মিনিট। ফুফাত ভাইয়ের পিসিতে মাত্র একটা হিন্দী ছবি দেখা শেষ করল অনি।
বর্ষা কে কথাটা বলতে যাবে তখনই মেসেজটা আসল।
‘তুমি কি আমাকে ভালোবাসো?’
কথাটা দুজনেই জানত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে যে ব্যাপারটা সামনে না আসাই ভালো ছিল হঠাত তার মুখোমুখি হয়ে অনি হকচকিয়ে গেল। তারওপর হঠাত ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’!! সে কি বলবে বুঝতে পারল না। তার চোখের সামনে চশমা পরা মেয়েটার চেহারা ভেসে উঠল।
যন্ত্রের মত সে লিখল,
‘সেটা আমি কি করে জানব? আমার মনকে জিজ্ঞেস কর। ’
বর্ষার উত্তর, ‘তোমার মনকে আমি কি করে জিজ্ঞেস করব? সেটাতো তোমাকেই করতে হবে, তাইনা?’
অনি লিখল, ‘আমার মন তো আমার কাছে নেই!’
এখনো ঘোরের মধ্যে আছে দুজন। অনি ভাবছে বর্ষার কথা। ওদের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক তৈরী হচ্ছিল যেটা সৃষ্টির আদি হতে ছিলো, আছে এবং থাকবে। কিন্তু আমাদের সমাজ সে সম্পর্কের বৈধতা দিতে যেন কিছুটা কৃপণ।
কিন্তু নিষিদ্ধের প্রতি মানুষের আগ্রহ চিরন্তন।
অনি ছোটবেলা থেকেই বেশ যুক্তিবাদী। কিন্তু আজ সে যুক্তি দিয়ে নয় বিচার করছে তার আবেগ দিয়ে। সে ভুলে গেল শুভর সাবধান বাণীর কথা। তার চোখে এখন স্বপ্ন।
বর্ষার উত্তরের অপেক্ষা না করেই অনি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি ভালোবাসো আমাকে??’
বর্ষার চোখে পানি। বর্ষা ভুলে যেতে চাইল নিষ্ঠুর সমাজের কথা। তার মনে হল অনির্বান পাশে থাকলে সে লড়তে পারবে সবার সাথে।
সে লিখল, ‘শ্বাস নিতে পারছিনা। প্রচন্ড ভালোবাসি তোমাকে! ’
কিন্তু হায়! হঠাত যেন ঘোর কেটে গেল বর্ষার।
এ কি করছে সে! স্বার্থপর এর মতো শুধু নিজের কথা ভাবছে! বাবা-মার কথা একবারও সে চিন্তা করল না। সামান্য আবেগকে লাগাম পরাতে পারলনা। ভুলে গেছে তার নাম ‘বর্ষা দেওয়ান’! সে একজন আদিবাসী!! কিন্তু অনি বাঙ্গালী! তাদের সমাজে এ অসম প্রেম মেনে নেবেনা। সে বুকে পাথর রেখে লিখল,
‘কিন্তু আমরা বাবা-মাকে কষ্ট দেবোনা। কেমন?’
অনি হতভম্ব হয়ে গেল।
সে তো সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিল বর্ষাকে। প্রচন্ড অপমানে আর কষ্টে অনি ফোন বন্ধ করে রাখল।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।