আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সরস্বতী; বিদ্যার দেবী, নাকি একটি নদী?

একজন সুখী মানুষ

আমরা যারা বিশেষ করে হিন্দুদের ঘরে জন্ম নিয়েছি, তারা সবাই সরস্বতীকে জানি একজন বিদ্যার দেবী হিসাবে। এখনো স্কুল, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যার দেবী কে মহা ধুমধামে পূঁজার্চনা করা হয়। সেই জন্য আমাদের নিকটের মুসলিম বন্ধুবান্ধব রা যে জানে না, তা নয়। তাই এখানে সরস্বতী দেবতা, না একটি নদী এর বিস্তারিত আলোচনা করা হলোঃ ঋগ্বেদে দুই ধরনের সরস্বতীর উল্লেখ আছে। একটি ত্রিলোক্য ব্যাপিনী সূর্যাগ্নি, অন্যটি নদী।

সরস্‌ ধাতু তদুত্তরে অস্থর্থে বতু এবং স্ত্রী লিঙ্গে ঈপ্‌ প্রত্যয় যোগে নিষ্পন্ন হয়েছে সরস্বতী-এ মত স্বামী নির্মলানন্দের। আলোকময়ী বলে সর্বশুক্লা। শংকরনাথ ভট্টাচার্যের মতে, সরস+বতী=সরস্বতী অর্থ জ্যোতিময়ী। ঋগ্বদে এবং যর্জুবেদে অনেকবার ইড়া, ভারতী, সরস্বতীকে একসঙ্গে দেখা যায়। বেদের মন্ত্রগুলো পর্যালোচনায় প্রতীতী জন্মে যে, সরস্বতী মূলত সূর্যাগ্নি।

দেবীভাগবতে সরস্বতী জ্যোতিরুপা। ভৃগুপনিষদে জ্যোতির্ময়ী সরস্বতী ও জলময়ী সরস্বতীর সমীকরণ করা হয়েছে। এই উপনিষদে জলে জ্যোতি প্রতিষ্ঠিত, জ্যোতিতে জল প্রতিষ্ঠিত। কবি বিহারীলাল চক্রবতী সারদামঙ্গল কাব্যে জ্যোতিময়ী সরস্বতীর আবির্ভাব বর্ণনা করেছেন। রামায়ন রচয়িতা বাল্মীকি যখন ক্রৌঞ্চ হননের শোকে বিহবল হয়ে পড়েছিলেন, সে সময় জ্যোতিময়ী সরস্বতী তার ললাটে বিদ্যুৎ রেখার মত প্রকাশিত হয়েছিলেন।

ঋগ্বেদে ইন্দ্রের সঙ্গে সরস্বতীর সম্পর্ক যেমন ঘনিষ্ঠ তেমনি ঘনিষ্ঠ মরুদ ও অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে। সরস্বতী কখনো ইন্দ্রের পত্নী আবার কখনো শত্রু, কখনোবা ইন্দ্রের চিকিৎসক। শুক্ল যজুর্বেদে তিনি চিকিৎসক রুপে রুদ্র অশ্বিদ্বয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ততা। সরস্বতীর রোগ নিরাময় শক্তির কথা প্রবর্তী সময়েও জনশ্রুতিতে ছিল। ‘কথা সরিৎসাগর’-এ সোমদেব (একাদশ শতক) জানিয়েছেন, পাটলিপুত্রের নারীরা রুগ্ন ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য সরস্বতীর ঔষধ ব্যবহার করতেন।

নিরুক্তকার যাস্কের মতে, সরস্বতী শব্দের অর্থ যাতে জল আছে। সৃ ধাতু নিস্পন্ন করে সর শব্দের অর্থ জল। অর্থাৎ যাতে জল আছে তাই সরস্বতী। নদী সরস্বতী আর্যভূমির অন্যতম নদীরুপে ঋগ্বেদে বহুবার কীতির্ত ও স্তোত হয়েছে। ঋগ্বেদে সরস্বতী সিন্দু ও তার পাঁচটি উপন্দী নিয়ে সপ্তসিন্ধুর বারংবার উল্লেখ আর্যভূমিতে এদের অপরিসীম গুরুত্ব প্রমাণ করে।

শুধু বৈদিক যুগে নয় পরবর্তীকালে মহাভারত, পুরাণ, কাব্যে পূতসলিলা সরস্বতীর মহিমা বর্ণিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল ছিল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে, এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রসবণ থেকে এই নদীর উৎপত্তি তা ছিল প্লক্ষ্ণাবৃক্ষের নিকটে-তাই একে বলা হতো প্লক্ষ্ণাবতরণ। এতি হিন্দুদের তীর্থস্থান। ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, পক্ষান্তরে সরস্বতী নদী ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়।

এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি। সরস্বতী ও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হতো। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত স্বারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হতো। মহাভারত লিখিত হওয়ার আগেই রাজপুতনার মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এগুলো হলো চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ।

রাজস্থানের মরুভূমির বালুকার মধ্যে চলুর গ্রামের নিকটে সরস্বতী অদৃশ্য হয়ে ভবানীপুরে দৃশ্য হয়। আবার বলিচ্ছপুর নামকস্থানে অদৃশ্য হয়ে বরখের নামক স্থানে দৃশ্য হয়। ২ তান্ডমহাব্রাহ্মণে সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিসাবে প্লক্ষ্ণপ্রস্রবণ ও বিনাশস্থল হিসেবে বিনশনের নামোল্লেখ আছে। ভারতের বর্তমান উদয়পুর, মেবাড় ও রাজপুতনার পশ্চিম প্রান্তে মরু অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভূটানের মরুভূমিতে সরস্বতীর বিলোপ স্থানই বিনশন। লাট্যায়ণের শ্রৌতসূত্র মতে, ‘সরস্বতী নামক নদী পশ্চিম মুখে প্রবাহিদত, তার প্রথম ও শেষভাগ সকলের প্রত্যক্ষ গোচর, মধ্যভাগ ভূমিতে নিমগ্ন হয়ে প্রবাহিত, সে অংশ কেউ দেখতে পায় না, তাকেই বিনশন বলা হয়’।

অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজো কচ্ছ ও দ্বারকার নিকটে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে’। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে। আচার্য যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে ‘খ্রিস্টের দেড়হাজার বছরেরও পূর্বে’। নদী সরস্বতীর মহিমা ভারতবাসীর মনে এত রেখাপাত করেছিল যে পরবর্তীকালে গঙ্গা সরস্বতীর স্থান দখল করলেও তারা তাকে ভুলতে পারেনি। প্রয়োগে অন্তঃসলিলারুপে গুপ্তভাবে গঙ্গা যমুনার সঙ্গে সরস্বতী সঙ্গম, পশ্চিমবঙ্গে হুগলী জেলার ত্রিবেণীতে গঙ্গার স্রোত ধারা থেকে সরস্বতীর মুক্তি হিন্দুদের প্রিয় ও পবিত্র বিশ্বাস।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.