ফেনী সদর হাসপাতালের এক নম্বর ওয়ার্ডের ১২ নম্বর বিছানায় শিশু হাসিনার কঙ্কালসার দেহটি পড়ে আছে। গায়ের প্রতি ইঞ্চিতে জখমের চিহ্ন। পা থেকে গলা পর্যন্ত নানা স্থানে দগদগে ঘা। শরীরের বিভিন্ন স্থানে পচন ধরেছে। সাংবাদিকতার স্বাভাবিক নিয়ম মানলে এমন ছবি ছাপানো যায় না।
গৃহকর্ত্রীর হাতে নির্যাতিত ১১ বছরের এই গৃহকর্মীর ছবি দেখলে যে কেউ মানসিকভাবে আঘাত পাবেন।
হাসিনার ভাই মো. ইউসুফ ফেনী সদর হাসপাতালে সাংবাদিকদের জানান, হাসিনা ঢাকা সেনানিবাসের জনৈক মেজর শাহেদের (ডাকনাম শিবলু) বাসায় কাজ করত। মেজরের স্ত্রীর নাম নিপা। কিন্তু ইউসুফ বা হাসিনা ওই সেনা কর্মকর্তার বাসার ঠিকানা বলতে পারেনি। মূলত মেজরের স্ত্রীই হাসিনাকে নির্যাতন করতেন বলে দাবি করেছেন তিনি।
ইউসুফ জানান, মেজরের স্ত্রী গত ২৬ মার্চ রাতে গাড়ি করে নিয়ে হাসিনাকে ঢাকার রাজারবাগে তার আরেক গৃহকর্মী বোন নাছিমার মালিকের বাসার সামনে ফেলে যান। সকালে ওই বাসার আশপাশের লোকজন মেয়েটিকে রাস্তায় পেয়ে জটলা করে। জটলা দেখে বাসার মালিক ও নাছিমাও সেখানে যান। তাঁরা হাসিনাকে চিনতে পেরে বাসায় নিয়ে যান। পরে ইউসুফকে খবর দিয়ে এনে হাসিনাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
ইটভাটার শ্রমিক ইউসুফ বৈবাহিক সূত্রে ফেনীর বক্তার মুন্সী এলাকায় বসবাস করেন। গত ২৭ মার্চ তিনি হাসিনাকে ফেনী সদর হাসপাতালে ভর্তি করান। তবে তাঁদের মূল বাড়ি লক্ষ্মীপুরে।
গত কয়েক দিন সাংবাদিকেরা হাসিনার কাছে তার ওপর নির্যাতনের বিষয়ে জানতে চাইলেও সে ভয়ে মুখ খোলেনি। কারণ, গৃহকর্ত্রী তাকে কোরআন মাথায় দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়েছেন, নির্যাতনের কথা কাউকে বলা যাবে না।
তবে সবার অনুরোধে মুখ খোলে হাসিনা।
হাসিনা জানায়, গৃহকর্ত্রী নিপা তার চোখে মরিচ লাগিয়ে দিতেন। কথায় কথায় বেত দিয়ে মারতেন। যেখানে জখম ছিল, সেখানে বেশি মারতেন। না খেয়ে অনেক রাত বাসার বাইরে বারান্দায় কেটেছে তার।
সকালে গৃহকর্তা নাশতা করে বের হয়ে যেতেন। এর পর কাজের খুঁত ধরে চলত অমানুষিক নির্যাতন। চিৎকার করলে মুখে কাপড় গুঁজে দেওয়া হতো।
হাসিনা জানায়, ওই বাসায় তার সমবয়সী পারভিন নামের আরেকটি গৃহকর্মী আছে। তাকেও নির্যাতন করা হচ্ছে।
ফেনী সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক এস এম ইব্রাহিম ও আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) হাসিনা আক্তার জানান, শিশুটির শরীরের বিভিন্নস্থানের পচন সারতে সময় লাগবে। হাসপাতাল ও সমাজকল্যাণ বিভাগ থেকে হাসিনার ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে বলে জানান তত্ত্বাবধায়ক।
খবর পেয়ে ফেনীর পুলিশ সুপার ইমাম হোসেন গত শনিবার হাসিনাকে হাসপাতালে দেখতে যান। তবে এখন পর্যন্ত কোনো মামলা হয়নি।
হাসিনাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ১২ নম্বর ইউনিয়নের পুকুরদিয়া গ্রামে।
বাবার নাম মো. হানিফ, মা শিরিন আক্তার। এক ভাই ও ছয় বোনের মধ্যে হাসিনা ষষ্ঠ। দেড় বছর আগে তাদের মা মারা যান। বাবা আরেকটি বিয়ে করে বসতভিটে বিক্রি করে নতুন স্ত্রীর বাড়ি চলে গেছেন। বড় ভাই মো. ইউসুফ ফেনীর মোল্লার তাকিয়া এলাকায় বিয়ে করে শ্বশুরবাড়িতে থাকেন।
মা বেঁচে থাকতে বড় দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। তৃতীয় বোন নাছিমা ঢাকায় একটি বাসায় কাজ করে। চতুর্থ হাসিনা। তার ছোট বোন মণি নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী নিপার বাবার চট্টগ্রামের বাসায় কাজ করে। সবচেয়ে ছোট বোনটিকে জন্মের পর দত্তক দেওয়া হয়।
হাসিনা প্রথমে নিপার বাবা মোশাররফ হোসেনের চট্টগ্রামের ফেয়ার হেলথ মেডিকেল হাসপাতালের তৃতীয় তলার বাসায় কাজ করত। পরে তাকে নিপার ঢাকা সেনানিবাসের বাসায় পাঠানো হয়।
হাসিনা প্রথম আলোকে জানায়, গৃহকর্ত্রীর স্বামী তাকে মারধর করত না; তবে বাধাও দিত না। হাসিনা ঢাকার ওই বাসায় প্রায় ছয় মাস কাজ করেছে।
গত রাতে চট্টগ্রামে বসবাসরত গৃহকর্ত্রী নিপার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাঁরা মেয়ের বাসার ঠিকানা জানেন না বলে জানান।
নিপার বক্তব্য নেওয়ার জন্য তাঁর ফোন নম্বর চাইলে মা বলেন, নিপার মোবাইল নম্বর জানেন না। টিঅ্যান্ডটি নম্বর চাইলে বলেন, ‘ও এখন বাসায় নেই। আমি ওর সঙ্গে কথা বলে জানাব। ’ তিনি দাবি করেন, হাসিনাকে রাতে ফেলে আসা হয়নি। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে দরজার তালা খুলে সে পালিয়ে গেছে।
ছয় মাস আগে ঢাকায় আসা হাসিনা সেনানিবাস থেকে রাজারবাগের ওই বাসায় একা যেতে পেরেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ও সব চিনে। বাসা থেকে যাওয়ার পর সকাল নয়টার দিকে হাসিনার চাচাকে তিনি ফোনে বিষয়টি জানিয়েছেন বলেও দাবি করেন। নির্যাতনের অভিযোগের বিষয়ে নিপার মা বলেন, ‘এমন তো হওয়ার কথা না। ’
ফেনী সদর হাসপাতালে হাসিনার জন্য রক্তের প্রয়োজন হলে ফেনী কারিগরি মহাবিদ্যালয়ের ছাত্ররা উদ্যোগী হয়ে এ পর্যন্ত দুই ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। শিক্ষার্থী সাইফুল জানান, লাগলে তাঁরা আরও রক্তের ব্যবস্থা করবেন।
সূত্র : প্রথম আলো
আমরা কি দিন দিন পশু হয়ে যাচ্ছি!!! এই অন্যায়ের বিচার করার কি কেউ নেই
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।