১ম পর্ব
২য় পর্ব
৩য় পর্ব
-
-
৭
‘অনি, বাবা ভালো আছিস?’ – মার কন্ঠ শোনা গেল ফোনের ওপাশ থেকে।
‘আছি মা। তোমরা কেমন আছ?’ – জানতে চাইল অনি।
-ভাল আছি।
‘রিপা ঠিকমত পড়ছে তো?’ – ছোটবোনটা এবছর জুনিয়র স্কলারশীপ দেবে।
‘তুই এ কথা বল। নে, ধর’ – রিপার হাতে ফোনটা দিল মা।
‘হ্যালো দাদা, জানো শাহরুখ এর নতুন একটা মুভি বের হবে। ’ – ফোনটা কানে নিয়েই রিপার প্রথম কথা।
‘শুধু শাহরুখ আর শাহরুখ, না?? পড়া কেমন চলছে? ’
-ভালো।
‘দাদী কেমন আছে? বাংলা চ্যানেল দেখতে দিসতো?’ – জানতে চাইল অনির্বান। রিপার সাথে সবসময় তার দাদীর টিভি নিয়ে ঝগরা লেগেই থাকে।
-ওফ। দাদী তো শুধু কিসব দেখে! অসহ্য!
‘হাহা। আচ্ছা ভালো করে পড়।
বৃত্তি পেতে হবে কিন্তু। ’ – অনির্বান বলল।
‘আরে পাবো পাবো। নাও মার সাথে কথা বল। ’ ফোনটা এবার মার হাতে দিলো রিপা।
‘মা, আমার একটা ভাইয়ার হেল্প লাগবে। আমি যে কোচিং এ পড়ি ওখানে বুয়েটের ভাইয়া আছে। ’ – পরীক্ষাগুলোতে খুব একটা ভালো করতে পারছেনা অনি। কোচিং এর অন্য ছেলেদের দেখাদেখি সেও পড়তে চাইছে।
‘ও।
কতো টাকা লাগবে?’ – মার স্বরে একটু যেন আশংকা।
‘৫ হাজার,মা। দুমাস পরলেই হবে মা। ’ – ভাল জায়গায় চান্স পাওয়ার জন্যে অনির বাবা কষ্ট করে ছেলেকে ঢাকা পাঠিয়েছেন। এমনিতেই প্রচুর খরচ হয়।
অনি একটু ভয়েই ছিল রাজি হয় কিনা। এতো টাকা!
মা বলল, ‘আমি তোর বাবাকে বলব। তুই চিন্তা করিস না। ঠিকমত পড়। ’
‘আচ্ছা মা।
’
‘ঠিকমত খাবি। পানি ফুটায়ে খাবি। ’ – মা রা সবসময়ই একটু বেশি বেশি চিন্তা করেন।
‘তোর মামার বাসায় যাস?’- মা জানতে চাইল।
‘না মা।
সময় পাইনা। ‘ – মিথ্যেই বলল সে। অনির আপন মামা থাকেন কাছেই। কিন্তু যেতে ইচ্ছে করেনা ওখানে। মামারা অনেক বড়লোক।
মামী কেমন করে জানি কথা বলেন। অবশ্য মামাতো ভাইবোন দুইটা অনেক ভালো।
‘পারলে যাস। ’
‘আচ্ছা রাখি,মা’ – অনি জানে মা এখন কিছুক্ষন কান্নাকাটি করবে। ফোনটা রেখে দিল সে।
ভাইয়ার বেতনের জন্যে হয়ত আগামী একমাস বাসায় কোন মাছ-মাংস আনা হবেনা। শুধু রিপাকে হয়ত একদুইদিন দেয়া হবে। এসব ভেবে নিজের অজান্তেই অনির চোখটা ভিজে এসেছে। আবেগকে এখনো দূরে ঠেলে রাখতে শিখেনি অনির্বান। তবুও মনে মনে প্রতিজ্ঞা-ই করে সে যে করে হোক চান্স পেতে হবে।
অনির কাছ থেকে বহুদুরে শুভ ফোনের রিং শুনে ধরমরিয়ে বিছানায় উঠে বসল। পরিচিত একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। নাম্বারটাতে দুদিন আগে সে একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে। ওইদিন সারারাত ভেবেছে উত্তর পাবে। পায়নি।
এখন তাই সে খুশি হবে নাকি বুঝতে পারলনা।
‘দোস্ত,শ্রাবণী মেসেজ দিছে’ – মেসেজ পড়েই অনিকে ফোন দিল শুভ। সবকথা বলল বন্ধুকে।
‘তাইলে তুই ওর সাথে দেখা কর। ’ – পরামর্শ দিল অনির্বান।
-দেখা তো ডেইলি হয়।
‘আরে গাধা, সে দেখা না। বাইরে কোথাও। ‘ - বন্ধুর অবস্থা দেখে হাসি পাচ্ছে অনির। স্কুলে থাকতে মেয়েরাই শুভর সাথে কথা বলতে আসত।
কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতে পরে শুভ কি করবে কিছু বুঝতে পারছেনা।
‘কিন্তু, ও কি আসবে?’ – শুভর চোখের শংকা পরিস্কার বুঝতে পারছে অনি।
‘আচ্ছা, একটা কথা বল। ‘ - অনি জানতে চাইল। ‘তুই শ্রাবণীরে পছন্দ করিস?’
‘হ্যাঁ’ – স্বীকার করে নিল শুভ।
‘তাইলে ওরে বল তোর সাথে দেখা করতে। যদি না আসে বুঝবি ওই মেয়ে তোর জন্যে না!’
‘কিন্তু…..’ এখনো দ্বিধানিত শুভ।
-আবার কয় কিন্তু। যা ভাগ। রাখলাম।
আমার আর্ম ফোর্সড মেডিকেল এ যেতে হবে।
-আচ্ছা রাখ । আমি পরে ফোন দিব।
অনি বুঝতে পারছিল শুভর খুব একটা পড়ালেখা হচ্ছেনা। তাই এই ঘটনার যত তাড়াতাড়ি সমাধান হয় ততই ভালো।
রেডী হয়ে বের হল সে। সে এখন যাবে বর্ষার সাথে ভর্তিপরীক্ষার ফর্ম তুলতে।
৮
‘আর্মড ফোর্স এ কিভাবে যাব? আমিতো চিনিনা’ – অনির্বান বলল বর্ষাকে।
মেয়েটা আজ একটা সাদা রঙের জামা পড়েছে। ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলল, লেগুনাগুলা মনে হয় যায়।
‘চল। ’ অনির্বান সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তার কোচিং এর উলটা দিকেই লেগুনাস্ট্যান্ড।
লেগুনাতে উঠেই যে ঝামেলাটায় পড়ল প্রথম সেটা হচ্ছে পা রাখা নিয়ে। এতো ছোটো জায়গায় এতোগুলো মানুষ গাদাগাদি করে বসে কি করে সেটাই একটা রহস্য।
বর্ষা বসেছে অনির ঠিক বিপরীত দিকের সীটে। বর্ষার মুখে চুল এসে পড়েছে। একহাতে ব্যাগ আর একহাতে রডে ধরে থাকায় চুলগুলো সরাতে পারছেনা। লেগুনার হঠাত ঝাকুনিতে বর্ষার ওড়নাটা একটু অদ্ভুদভাবে একপাশে সরে গেল। বর্ষা এটা খেয়ালই করেনি।
অনি লজ্জায় আর বর্ষার দিকে তাকাতেই পারছেনা। কিন্তু দেখল পাশে বসা লোকটা একটু পরপর তাকাচ্ছে বর্ষার দিকে। অনির প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু কিছু বলতেও পারছেনা। ও জানেনা কিছু বললে বর্ষা এটা কিভাবে নেবে! নামার পর শুধু একটা কথা বলেছিল অনি বর্ষাকে, ‘ওড়নায় পিন লাগাসনি কেন?’ তারপর সোজা হেটে গেছে সামনে।
অনেকদিন পর অনি জানতে পেরেছে তার কথায় বর্ষা খুব খুশি হয়েছিল।
তিনটা ফর্ম কিনে ফিরে আসল ওরা। একটা শুভর জন্যে। অনির যদিও ডাক্তার হওয়ার ইচ্ছে নাই তবুও বাবার কথা রাখতে কিনেছে সে। বাবা বলেন, ‘ডাক্তার হয়ে মানুষের সেবা করতে পারবি।
না পড়িস অন্তত পরীক্ষাটা দে। ‘
অনি ইঞ্জিনিয়ার হতে চাওয়াতেও বাবার কোনো আপত্তি নেই। অনি বাবাকে বলেছে, ইঞ্জিনিয়ার হলেও তো সেবা করা যাবে। তবে সেটা হবে পরোক্ষ সেবা। বাবা অবশ্য সবসময় বলেন, ‘যা-ই করো সৎ থাকবে।
ভুলে যেওনা দেশের কথা। ‘ অনি স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন নিয়ে খেলে।
বর্ষাকে তার হোস্টেল পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসল অনি। তেজগাঁও কলেজের সামনে যাওয়ার সময় মনে হয় সবকটি চোখ যেন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে! যদিও আসলে সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত।
রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে বর্ষা ফোন দিল অনিকে। অনেকক্ষন রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছেনা। বর্ষা প্রথমে বিরক্ত হলো। কিন্তু পরে তার চিন্তা হতে লাগল। কি হলো ছেলেটার? ফোন ধরছেনা কেন! বর্ষাকে রুমের সামনে সিড়িতে বসে থাকতে দেখে উর্মি জিজ্ঞেস করল, ‘কিরে কি হলো?’
‘দেখনা, অনিটা ফোন ধরছেনা।
‘ – উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল বর্ষা।
‘হয়ত ঘুমাচ্ছে। ’ – উর্মি যুক্তি দেখায়।
‘ওর তো কালকে একটা পরীক্ষা, এখন তো ঘুমানোর কথা না। ’ তখনই বর্ষার ফোনটা বেজে উঠল।
অনি ফোন দিয়েছে। সাথে সাথে রিসিভ করে বলল, ‘তুই ফোন ধরিস না কেন?’
ওপাশ থেকে ঘুমজড়ানো কন্ঠে অনি বলল, ‘ঘুমাচ্ছিলাম!!’
বর্ষার হঠাৎ করে প্রচন্ড রাগ হলো। সে ফোনটা কেটে দিল। তারপর নিজের রুম এ গিয়ে বিছানায় মেডিকেল গাইডটা নিয়ে বসল।
অনি আবার ফোন দিয়েছে।
পাশেই ফোন, কিন্তু ধরছেনা বর্ষা। উর্মি বলল, ‘কি হলো? ফোন ধরিস না কেন?’
‘ঘুমাচ্ছিল শয়তানটা’ – বর্ষার কন্ঠে রাগ না অভিমান বোঝা যাছেনা।
‘আরে পাগল, ধরতো’ – ফোনটা বর্ষার হাতে তুলে দেয় উর্মি।
হ্যালো – ফোনটা নিয়ে বাইরে চলে আসল বর্ষা। শোয়ার আগে সিড়িতে বসে অনির সাথে গল্প করতে ওর ভালো লাগে।
আর আজ কিনা না বলেই শুয়ে পড়ল!
‘এত রাগছিস কেন?’ – অনি বলল ওপাশ থেকে।
বর্ষা চুপ করে আছে।
অনি আবার বলল, ‘আমার প্রচন্ড মাথা ধরেছে!’
‘কেন?’ – এবার আর চুপ থাকতে পারলনা বর্ষা।
‘জানিনা। এজন্যেই ঘুমাচ্ছিলাম।
অনেকক্ষন ফোন বাজছে দেখে মনির এসে তুলে দিলো। ’
মনির অনির মেসে থাকে। এসেছে নোয়াখালি থাকে। তৌহিদ যখন ছিল তখন দুজনে যে কিসব ভাষায় কথা বলত! অনি একদিন মনিরকে বলে, ‘মনির বলতো, “পানি” ’। মনির বলে, “আনি।
” অনি হেসে বলে, ‘এবার বল “পেপে”। পে-এ-এ-পে। বল বল। ’ সবাইতো হেসেই খুন।
এদিকে বর্ষার রাগ কিছুটা কমে এসেছে।
বলে, ‘তুই আমাকে বলে ঘুমাইতি!’
‘সরি। ’ অনি হাসে।
‘তোর না কাল পরীক্ষা?’
‘হ্যা রে’ – অনির্বান চিন্তিত। ‘তুই আমাকে ডেকে দিতে পারবি?’
‘কয়টায়?’ – বর্ষার প্রশ্ন।
‘ভোরের দিকে।
এই ধর চারটা। পারবি?’
‘আমি তো চারটা পর্যন্ত জেগেই থাকি। ’ - মিথ্যা বলল বর্ষা। দুইটার বেশি সে জাগতেই পারেনা। কেন মিথ্যা বলল সে নিজেও জানেনা।
অনি জানে সেটা। ‘vibration দিয়ে রাখিস। ’
‘ওকে। ডেকে দিস। ঘুমাই।
রাখলাম। ’
‘শোন শোন। vibration দিয়ে রাখিস। ’ – বর্ষা মনে করিয়ে দিল।
‘আচ্ছা।
’ - অনি ফোনটা রেখে দিল।
তিনটার পর বর্ষার প্রচন্ড ঘুম পেতে থাকে। কিন্তু তাকে জেগে থাকতেই হবে। সে বাইরে এসে হাটাহাটি শুরু করল। রাতের নিস্তব্ধতায় সে অনির কথা ভাবতে শুরু করল।
আচ্ছা, ছেলেটা কি খাওয়া দাওয়া করেনা! এতো শুকনা কেন? স্কুলের কথা মনে পড়ল বর্ষার। মাহবুব স্যার এর কাছে যখন পড়ত, অনি বর্ষার সাথে কথাই বলত না। অথচ এখন ওরা কতো ভালো বন্ধু! বর্ষা আপন মনে হাসে। ছেলেটার প্রতি তার হঠাৎ চরম মমত্ববোধ জেগে উঠছে।
চারটার দিকে সে ফোন দিল অনিকে।
তৃতীয় বার রিং পরার পর ধরল অনি।
‘এই ওঠ। ’
‘তুই আমার জন্যে এতক্ষন জেগে ছিলি!!’ – ঘুমের মাঝেও অনি বিস্মিত হয়ে গেল।
‘আরে ধুর। তোর জন্যে কেন জাগব? আমারও কাল পরীক্ষা।
পড়ছিলাম!!’ বর্ষা বলল। ‘ওঠ ওঠ। ’
‘উঠতেসি বাবা’ – হাই তুলতে তুলতে বলল অনির্বান।
‘হাত মুখ ধুয়েনে। রাখলাম।
’ – বর্ষা ফোনটা রেখে দিল। খুব খুশি লাগছে ওর। ছেলে-মেয়ে দুটো জানেইনা কি এক নামহীন বন্ধনে দুজন আবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।