দেশের তরে
মাইনুদ্দিন:
কথায় কথায় তর্ক করা কোন ভাল গুণ নয়। আবার অন্যকে নিজের মতের প্রতি কনভিন্স করার যোগ্যতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। সভার মধ্যে সবচেয়ে ভাল চিন্তাটা যদি এমন কারো মাথায় আসে যে ব্যাপারটা কাউকে বোঝাতে পারে না তবে সেটা অবশ্যই দুঃখজনক। ঝগড়াটে অথবা কূটতার্কিক মানুষকে আমরা খুবই অপছন্দ করি, কিন্তু যে শিক্ষক যত ভাল যুক্তি দিয়ে সহজ করে বোঝাতে পারেন তিনি আমাদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় হন। অনেকেই নিজে খুব ভাল বোঝেন কিন্তু অন্যদের বোঝাতে পারেন না।
অন্যকে বোঝাতে পারার এবং নিজের মতের প্রতি কথার মাধ্যমে কনভিন্স করার যোগ্যতাকেই বলে বাগ্মীতা। এ যোগ্যতা প্রায় সব মহাপুরুষের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামার জনপ্রিয়তার জন্য কৃতিত্ব দেয়া হয় তার বাগ্মীতাকে। কেউ কেউ বন্ধুদের মধ্যে আড্ডায় খুব ভাল কথা বলতে পারেন কিন্তু মঞ্চে উঠলে নার্ভাস হয়ে পড়েন। কর্মজীবনে এ দুর্বলতাটা অনেক মানুষকেই খুব ভোগায়।
একজন মানুষের বাগ্মী হয়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে ভাল সময় ছাত্রজীবন এবং উৎকৃষ্ট উপায় বিতর্ক। প্রায় সব ভাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই এখন বিতর্ক ক্লাব থাকে এবং নিয়মিত বিতর্কের চর্চা হয়। এ সংস্কৃতি এ দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য খুবই ইতিবাচক। একজন বিতার্কিক হওয়ার জন্য প্রথমে অবশ্যই মঞ্চের প্রতি ভয় কাটিয়ে উঠতে হবে। ভয় কাটিয়ে উঠতে পারে না বলেই অনেকের আর বিতার্কিক হয়ে ওঠা হয় না।
সাহস করে শুরু করা এবং কিছুদিন চর্চা করাই একজনের জড়তা কাটিয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট। এটুকুর জন্য প্রয়োজন ন্যূনতম আত্মবিশ্বাস। পাছে লোকে কিছু বলে ধরণের মানসিকতা নিয়ে বিতর্ক কেন, কোন ক্ষেত্রেই মানুষ ভাল করতে পারে না। নিয়মিত চর্চা বিতার্কিক হওয়ার আবশ্যকীয় শর্ত। এজন্য সবচেয়ে ভাল জায়গা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্লাবগুলো।
এগুলোতেই এখন পর্যন্ত নিয়মিত বিতর্কসভা হয়। সনাতনী এবং সংসদীয় বিতর্কের নিয়মকানুন রপ্ত করা এবং নিয়ম রক্ষা করে তত্ত্ব ও তথ্যের ভিত্তিতে যুক্তি প্রয়োগ করার যোগ্যতা শুধুমাত্র বিতর্ক শিক্ষার কোর্স করে অর্জন সম্ভব নয়। অনেক দিন বিতর্ক করার পরও কেউ কেউ সংসদীয় বিতর্কের পয়েন্টসমূহ নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন। ভাল বিতর্ক দেখা খুব কার্যকর। ডি.ইউ.ডি.এস. (ঢাকা ই্্উনিভার্সিটি ডিবেটিং সোসাইটি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ, অন্যান্য পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়মিত বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করে।
এসব প্রয়োজন (বিশেষত ২য় পর্ব/কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ফাইনাল পর্ব পর্যন্ত) মানসম্মত বিতর্ক দেখার ভাল সুযোগ থাকে। ভাল বিতার্কিকদের জ্ঞানগর্ভ কথামালা দর্শককেও জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে। বিতার্কিক হওয়ার জন্য যে কথা সবাই বলেন তা হলো অনেক বেশি জানতে হবে। কী জানতে হবে সেটা সিলেবাস ধরিয়ে দিয়ে বোঝানোর চেয়ে একজন বিতার্কিকের বাস্তব বিতর্ক অঙ্গন থেকে বুঝে নেয়াই গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক বিজ্ঞান এবং সাধারণ বিজ্ঞানের প্রাথমিক তত্ত্বগুলো জানা না থাকলে ভাল বিতর্ক করা কঠিন।
সাধারণ জ্ঞান বলতে আমরা যা বুঝি তাতে একজন বিতার্কিকের ন্যূনতম ধারণা থাকতে হবে। এজন্য বিসিএসের প্রস্তুতির মতো সাধারণ জ্ঞানের বই মুখস্থ করা কখনোই ভাল পদ্ধতি নয়। দৈনন্দিন জীবনে শেখার যেকোন সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। আগ্রহ থাকলে এ ব্যাপারটা অবচেতনভাবেই ঘটে। ইদানীং কালের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে সংবাদপত্রে যে যত মনযোগী জ্ঞানের প্রশ্নে সে তত এগিয়ে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো তথ্যপ্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার। শুধু বিতর্ক নয়, যেকোন ক্ষেত্রে ক্যারিয়ার গঠনে তথ্যপ্রযুক্তির যথার্থ ব্যবহার করতে পারলে অনেক সম্ভাবনাই হাতে ধরা দেয়। দলগত বিতর্কের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে অবস্থান ও কৌশল নির্ধারণ। সংসদীয় বিতর্কে সংজ্ঞায়ন প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অনেকসময় তথ্য এবং যুক্তি সাজাতে গিয়ে বিতার্কিকরা এ দিকটায় অবহেলা করেন যা দলগত বিতর্কের জন্য সত্যিকার অর্থে আত্মহত্যার শামিল, একটি শক্তিশালী অবস্থানে না দাঁড়াতে পারলে, ভাল কৌশল নির্ধারণ করতে না পারলে বিতার্কিকের অনেক শক্তিশালী যুক্তিই বৃথা হয়ে যায়।
সংজ্ঞায়ন, অবস্থান নিরূপণ ও কৌশল নির্ধারণের জন্য বিষয়ের বহুমাত্রিক এবং স্বচ্ছ বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সাধারণত দুই দলের প্রথম বক্তাদের বক্তব্যে বিতর্কের কেন্দ্রীয় ইস্যুটা ধরা পড়ে যায়। পরবর্তী বিতার্কিকরা সে ইস্যুটা ধরে পুরে বিতর্ক চালিয়ে নিতে পারলে বিতর্ক সুন্দর হয়। অন্যথায় যুক্তিগুলো বিভিন্ন লক্ষ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে, যুক্তির সংঘর্ষ কম হয় এবং বিতর্কের সৌন্দর্য হারিয়ে যায়। নিয়মিত চর্চার ক্ষেত্রে একজন বিতার্কিকের উচিত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিতর্কের এসব খুঁটিনাটি কৌশল সচেতনভাবে লক্ষ করা এবং উত্তরোত্তর উন্নতির চেষ্টা করা।
উচ্চারণের কথা বলাই বাহুল্য। অঙ্গভঙ্গি ভাল বিতার্কিকের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। একটি বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজে নিজে অঙ্গভঙ্গির মুদ্রাদোষ এবং অন্যান্য বের করা সহজ। এছাড়া এ ব্যাপারে অন্যদের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন। অনেক বড় মনের অধিকারী হওয়া প্রয়োজন।
বিতর্কের মঞ্চে সারাক্ষণ নিজেকে নির্ভুল প্রমাণ করার প্রচেষ্টা থাকলেও প্রতিযোগিতার বাইরে নিজের ভুলগুলো উপলব্ধি করা এবং শুধরে নেয়ার জন্য প্রয়োজন অনেক বড় একটা মন। এছাড়া আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার একজন বিতার্কিকের অযোগ্যতা এবং মানসিক সঙ্কীর্ণতার পরিচয়। উপসংহারে একটি উল্টো কথা লিখতে চাই। জীবনের প্রয়োজনে যুক্তিকে বিসর্জন দেয়ার যোগ্যতা একজন মানুষের থাকা উচিত। জীবনের বাস্তবতায় মানুষের পারস্পরিকতার হিসেবকে কখনো কখনো যুক্তির ঊর্ধ্বে বিবেচনা করতে হয়।
বির্তক যেন কাউকে যুক্তিসর্বস্ব করে না ফেলে। বিতর্কের চর্চা এড়িয়ে কেউ যেন যুক্তি নির্ভরতাকে অসম্মান না করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।