নাজমুল ইসলাম মকবুল
ফাইনালে ভারত
ভারতের বিপক্ষে জয়ের পাল্লাটা ভারী পাকিস্তানের দিকেই। কিন্তু বিশ্বকাপের ইতিহাস আফ্রিদি-রাজ্জাকদের পক্ষে নেই। প্রতিবারই ভারতের কাছে পরাস্ত হতে হয়েছে তাদের। চলতি এ আসরেও ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারলেন না পাকিস্তানিরা। পঞ্চমবারের মতো পরাজয়ের গ্লানি নিয়েই মাঠ ছাড়তে হলো আফ্রিদি বাহিনীকে।
সেই সঙ্গে স্বাগতিক ভারত তৃতীয়বারের মতো বিশ্বকাপের স্বপ্নের ফাইনালে পৌঁছে গেল। আগামী ২ এপ্রিল তারা মুম্বাইতে অনুষ্ঠিতব্য ফাইনালে আরেক স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ময়দানি লড়াইয়ে মাঠে নামবে। গতকাল মোহালিতে পাওয়া জয়টা মোটেও সহজ ছিল না ভারতের জন্য। ঘামঝরানো জয় নিয়েই মাঠ ছাড়তে হয় তাদের। তবে পাক-ভারত যে টান টান উত্তেজনাপূর্ণ এবং উপভোগ্য একটি ম্যাচ প্রত্যাশা করেছিল সবাই ঠিক তেমন একটি ম্যাচই উপহার দিয়েছেন তারা।
পুরো ম্যাচজুড়েই উভয় দলের সমর্থকরা স্নায়ুচাপে ভুগেছেন। একতরফা ম্যাচ হয়নি। ফাইনালের আগে আরেকটি ফাইনাল দেখলো ক্রিকেটবিশ্ব।
এর আগে টস জিতে আগে ব্যাট করতে নেমে শচীনের ৮৫ রানের ওপর ভর করে ২৬১ রানের টার্গেট ছুড়ে দেয় স্বাগতিকরা। পাকিস্তানি পেসার ওয়াহাব রিয়াজের আগুনঝরা বোলিংয়ের সামনে এদিন দলের আর কোনো ব্যাটসম্যান নিজের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি।
রিয়াজ ক্যারিয়ার সেরা বল করে তুলে নেন ৫ উইকেট। ২৬১ রানের টার্গেটে মাঠে নেমে ভারতীয় স্পিনারদের ঘূর্ণি বলে নিজেদের আর খুঁজে পায়নি পাক ব্যাটসম্যানরা। দলীয় স্কোর বোর্ডে ২৩১ রান জমা করতেই সবক’টি উইকেট হারাতে হয় তাদের। দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৫৬ রান করেন মিসবাহ উল হক।
টস জিতে আগে ব্যাট করতে নামে ভারতীয় শিবির।
দুই ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগ এবং শচীন টেন্ডুলকার পাক বোলারদের ওপর তাাসরে এখনও সেভাবে রানের দেখা না পাওয়া এই ওপেনার কাল পাকিস্তানের বিপক্ষে কিছু একটা করে দেখাবেন—এমন প্রত্যাশা ছিল সমর্থকদের। কিন্তু না। পারলেন না শেবাগ। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের সামনেও নিজেকে সেবাবে প্রমাণ করতে পারলেন না। সহসাই ফিরে গেলেন সাজঘরে।
৩৮ রান করেই বিদায় নিতে হয় তাকে। রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস শোয়েব আখতারের বদলে দলে জায়গা পাওয়া পেসার ওয়াহাব রিয়াজ দলীয় ৪৮ রানে ফিরিয়ে দেন শেবাগকে। সবেমাত্র বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তার আগে সাজঘরে ফিরে যাওয়ায় কিছুটা চাপে পড়ে স্বাগতিক শিবির। ধোনি বাহিনী মাত্র ৩৯ বল খেলে দলীয় অর্ধশত রান পূর্ণ করেন।
এরপর মাঠে আসা গৌতম গাম্ভিরকে সঙ্গে নিয়ে দলকে এগিয়ে নিতে থাকেন লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার। তবে এদিন শচীনকে ‘লাকি ব্যাটসম্যান’-এর উপাধিটা দেয়াই যায়। কারণ, চারবার তিনি পাকিস্তানের দুর্বল ফিল্ডিংয়ের কারণে ক্যাচ তুলেও বেঁচে যান। প্রথমবার ব্যক্তিগত ২৭ রানে আফ্রিদির ঘূর্ণি বলে মিসবাহ উল হকের তালুবন্দি হয়েছিলেন শচীন। কিন্তু মিসবাহ ক্যাচটি হাতে রাখতে ব্যর্থ হন।
এরপর ৪৫ ও ৮২ রানে আরও দু’বার লাইফ পেয়ে যান লিটল মাস্টার। এক ম্যাচে চারবার লাইফ পেয়েও নিজের শততম ‘সেঞ্চুরি’ পূর্ণ করতে না পারার আক্ষেপটা তার থেকেই যেতে পারে। ৮৫ রানে তাকে থামিয়ে দেন পাক স্পিনার সাইদ আজমল। ১১৫ বলে ১১টি চার দিয়ে নিজের ইনিংস সাজান শচীন। শচীন মাঠ ছাড়ার আগে সাজঘরে ফিরে যেতে হয় গাম্ভির (২৭), কোহেলি (৯) ও যুবরাজ সিংকে (০)।
গাম্ভিরকে মোহাম্মদ হাফিজ বিদায় করলেও যুবরাজ এবং কোহেলির গুরুত্বপূর্ণ দুটি উইকেট উপড়ে ফেলেন পেসার ওয়াহাব রিয়াজ। শোয়েব আখতারের পরিবর্তে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে মাঠে নেমেই জ্বলে উঠলেন এ পেসার। কাল মোহালিতে রিয়াজ আরও একবার নিজেকে প্রমাণ করেন। প্রতিপক্ষ ভারতের ৫ উইকেট গুঁড়িয়ে দেন তিনি। তার আক্রমণাত্মক বোলিংয়ের কারণেই স্বাগতিকদের ২৬০ রানে বেঁধে ফেলে পাকিস্তান।
অথচ শচীন দলীয় ১৮৭ রানে প্যাভেলিয়নের পথ ধরার পরও ধোনি ছিলেন উইকেটে। তখনও স্বাগতিকদের রান ২৮০ ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু রিয়াজের গতির সামনে মোহালিতে নিজেদের খেই হারিয়ে ফেলেন ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের কারণে শেষ পর্যন্ত তারা ৯ উইকেটে ২৬০ রান জমা করে নিজেদের স্কোরবোর্ডে। শচীন ছাড়া দলের আর কেউ তেমন রান জমা করতে পারেননি নিজেদের নামের পাশে।
সুরেশ রায়না ছিলেন ৩৬ রানে অপরাজিত। পাকিস্তানি টিম ম্যানেজমেন্ট শোয়েবকে মাঠে না নামিয়ে রিয়াজের হাতে বল তুলে দিয়েছিলেন হাই ভোল্টেজ এ ম্যাচে। টিম ম্যানেজমেন্ট কমিটির আস্থার প্রতিদান দিতে ভুল করেননি পাঞ্জাবের এ ক্রিকেটার। মোহালির পাঞ্জাব ক্রিকেট স্টেডিয়ামে এদিন আগুন ঝরালেন রিয়াজ। যেখানে দলের প্রতিষ্ঠিত পেসার ওমর গুল, আবদুর রাজ্জাকরা ব্যর্থতার পরিচয় দেন, সেখানে ২৬ বছর বয়সী এ পেসার আতঙ্ক হয়ে দেখা দেন প্রতিপক্ষ শিবিরে।
ক্যারিয়ার সেরা বোলিং করে ৪৬ রানের খরচায় তুলে নেন ৫ উইকেট। এর আগে তার সেরা বোলিং ফিগার ছিল ২২ রানে ৩ উইকেট। রিয়াজের সঙ্গে দুই উইকেট পান সাঈদ আজমল।
জয়ের জন্য পাকিস্তানের সামনে লক্ষ্য ২৬১ রান। টার্গেট আহামরি তেমন কিছু নয়।
কিন্তু প্রতিপক্ষ ভারতের মাটিতে ম্যাচ। তাই হোম অ্যাডভান্টেজের দিক দিয়ে পাকিস্তান কিছুটা পিছিয়ে থাকবে। দর্শক সমর্থন পুরোটাই ছিল ধোনি-শচীনদের পক্ষে। তবে মর্যাদার এ লড়াইয়ে সবকিছু দু’পায়ে মাড়িয়ে নিজেদের অভিষ্ট লক্ষ্য ‘জয়ের’ জন্যই মাঠে নামে আফ্রিদি বাহিনী। শুরুটা করেছিলেন কামরান আকমল এবং মোহাম্মদ হাফিজ।
ভারতীয় বোলারদের ওপর রীতিমতো চাপ প্রয়োগ করে খেলতে শুরু করেন তারা। রানের চাকাও এগিয়ে নিতে থাকেন ‘সুপারসনিক’ গতিতে। কিন্তু আচমকা এ জুটিকে গুঁড়িয়ে দেন পেসার জহির খান। দলীয় ৪৪ রানে দুর্দান্তভাবে ছুটে চলা কামরান আকমলকে যুবরাজের তালুবন্দি করে সাজঘরে ফেরত পাঠান। এরপর পাক শিবিরে ভাঙনের বান হয়ে দেখা দেন যুবরাজ নিজেই।
ব্যাটে রান না পেলেও পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য দুই ব্যাটসম্যান আসাদ শফিক (৩০) এবং ইউনিস খানকে (১৩) ফিরিয়ে দিয়ে দলকে ব্রেক থ্রু এনে দেন। তার ঘূর্ণি বলের কারণেই মাত্র ১০৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে ব্যাকফুটে চলে যায় আফ্রিদি-কামরানরা। তবে পঞ্চম উইকেট জুটিতে মিসবাহ উল হক এবং ওমর আকমল দলকে এগিয়ে নিচ্ছিলেন সাবধানী ব্যাটিং কৌশলে। দলের স্কোরবোর্ডে ৩৬ রান জমাও করেছিলেন। ওমর আকমল সবেমাত্র হাত খুলে চার-ছক্কা হাঁকানো শুরু করেছেন।
স্বাগতিক শিবিরের জন্য বিপদ বনে যাওয়ার আগেই ওমরকে বোল্ড আউট করে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেন হরভজন সিং। মাত্র ৮ রান পর আবদুর রাজ্জাকের বেল ফেলে দিয়ে পাক শিবিরকে হতাশার চাদরে মুড়ে দেন মুনাফ প্যাটেল। আনন্দের বন্যা বয়ে যায় স্বাগতিক শিবিরে। ৯ বলে ৩ রান করে ফিরে যান রাজ্জাক। পাক ক্রিকেটাররা যে ব্যাট হাতে মাঠে নেমে স্নায়ুচাপে ভুগেছেন, সেটা তাদের স্কোর লাইন দেখেই বোঝা যায়।
এরপর মিসবাহ উল হকের সঙ্গে দলের হাল ধরতে মাঠে নামেন অধিনায়ক আফ্রিদি নিজেই। তিনি ব্যাট হাতে মাঠে নামার পর সমর্থকরা কিছুটা বিশ্বাস ফিরে পায়। কিন্তু ভারতীয় বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ের সামনে সেভাবে রান এগিয়ে নিয়ে যেতে পারছিলেন না তিনি। অবশেষে তিনিও ফিরে গেলেন। হরভজনের ঘূর্ণি বলের শিকার হয়ে।
ফুল টস বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে মিড উইকেটে শেবাগের হাতে ক্যাচ তুলে দেন আফ্রিদি। সঙ্গে সঙ্গেই সব আশা শেষ হয়ে যায় পাকদের। উল্লাসে ফেটে পড়ে ভারতের সমর্থকরা। আফ্রিদি ১৭ বলে খেলেন ১৯ রানের ইনিংস। ১৫ রান পরেই ফিরে যেতে হয় ওয়াহাব রিয়াজকে।
একে একে দলের পাঁচ ব্যাটসম্যান বিদায় নিলেও মিসবাহ ছিলেন অবিচল। অবশ্য ইনিংসের শেষ ওভারের চতুর্থ বলে মিসবাহর উইকেট তুলে নিয়ে জহির খান ভারতের জয় নিশ্চিত করেন। মিসবাহ করেন ৫৬ রান। পাকিস্তান সবকটি উইকেট হারিয়ে ২৩১ রান করে। ভারত জয় পায় ২৯ রানের।
জহির খান, অশিষ নেহরা, মুনাফ প্যাটেল, হরভজন সিং এবং যুবরাজ সিং দুটি করে উইকেট তুলে নেন।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।