থেমে যাবো বলে তো পথ চলা শুরু করিনি।
লেখাটি ভাল লাগলো, তাই শেয়ার করলাম। মূল লেখাটা এই লিংকে Click This Link
ধর্মনিরপেক্ষতা একটি রাষ্ট্রীয় দর্শন। ইউরোপের একটি বিশেষ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর উদ্ভব। সেই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে না রেখে শুধু শব্দটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে এর অর্থ ব্যাখ্যার প্রয়াস গ্রহণ করতে অনেককেই দেখা যাচ্ছে।
এমনকি অনেক বিজ্ঞ আলেম-ওলামাও ধর্মনিরপেক্ষ, রাষ্ট্রদর্শনের তাত্পর্য না বুঝেই এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করছেন। এ ধরনের প্রেক্ষিতে যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে এই রাজনৈতিক দর্শনটির উদ্ভব, তা আমাদের সামনে আসা খুবই প্রয়োজন বলে মনে করছি।
বস্তুত ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে নিয়ে ৪০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৮০০ বছর গোটা ইউরোপে রোমান আধিপত্য টিকে ছিল। রোমানরা দাপটের সঙ্গে দেশের পর দেশ জয় করে নিচ্ছিল। সাম্রাজ্য বিস্তারের পাশাপাশি সমাজের মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতি মনোনিবেশ না করার কারণে রোমানরা বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হলেও জনমানুষের ভালোবাসা ও আন্তরিক সমর্থন লাভ করতে পারেনি।
শুরুর দিকে রোমানরা মূলত তাদের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। খ্রিস্টধর্মের মূল কেন্দ্রভূমি ছিল জেরুসালেম। রোমে খ্রিস্টধর্ম সম্প্রসারিত হলে রোমানরা পুরনো ধর্মমত পরিত্যাগ করে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করে। ক্রমেই খ্রিস্টধর্ম রোমের মূল ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মের তিনশ’ বছর অতিবাহিত হওয়ার পর খ্রিস্টধর্ম রোমান সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে।
৩৯৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে খ্রিস্টধর্মকে রোমের সরকারি ধর্মের মর্যাদা দেয়া হয়। খ্রিস্টধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করার ১৭ বছর পর অর্থাত্ ৪১০ খ্রিস্টাব্দে রোম ভেঙে খানখান হয়ে যায়।
কিন্তু এই ভাঙনের সূচনা বলতে গেলে আরও আগেই হয়েছে। কারণ ৩৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজধানী রোমনগর থেকে প্রশাসনিক সুবিধার্থে কনস্টান্টিনোপলে স্থানান্তর করা হয়। আর সে থেকেই ভাঙনের সূত্রপাত হয়।
একদিন তা পূর্ব রোম ও পশ্চিম রোম—এই দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়।
বস্তুত রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে স্থানান্তর করার ফলে মূল রোমের কর্তৃত্ব রোমান গির্জার প্রধান পোপের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। রোমান গির্জার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সেন্ট পিটার, যিনি প্রধান ধর্মযাজক ও ধর্মপ্রচারক হিসেবে সর্বমহলে ব্যাপক স্বীকৃতি লাভ করেছিলেন। তার প্রভাবে রোমান গির্জার প্রাধান্য সর্বমহলে স্বীকৃত হয়। সেন্ট পিটার এর আগে পশ্চিমের টিউটনিক জাতিগুলোকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার জন্য বিভিন্ন মিশন পাঠিয়েছিলেন এবং ব্যাপক প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন।
ফলে যারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, তাদের কাছে রোমান গির্জার প্রাধান্য স্বাভাবিকভাবেই স্বীকৃত ছিল। তাছাড়া পশ্চিমে যেসব গির্জা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, সেগুলো রোমান গির্জার অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। সেসব গির্জা থেকে রোমান গির্জা বার্ষিক আর্থিক সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। তাই পশ্চিমাঞ্চলীয় খ্রিস্টসমাজের কাছে রোমান গির্জার শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকৃত ছিল। তাছাড়া রোমান বিশপকে সেন্ট পিটারের উত্তরাধিকারী মনে করা হতো।
এ কারণে তারা রোমান বিশপকেও মেনে চলত।
পরে একসময় টিউটনিকরা রোম জয় করে নেয়। ফলে রোমের ওপর কনস্টান্টিনোপল সরকারের আইনগত যে কর্তৃত্ব ছিল, সেটাও শেষ হয়ে যায়। এই অনুকূল পরিস্থিতিতে রোমের গির্জার প্রধান পোপ শাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পশ্চিমাঞ্চলীয় দেশ ও গির্জাগুলোর সমর্থন রোমান পোপের প্রতি থাকার কারণে তার প্রভাব এত বৃদ্ধি পায় যে, কনস্টান্টিনোপলের শাসকের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কোনো ক্ষমতাই তার ওপর থাকে না।
বস্তুত টিউটনিকদের দ্বারা রোমের পতনের কাল থেকে ম্যাকিয়াভেলির যুগ পর্যন্ত (৩৯৩-১৫২৭ খ্রিস্টাব্দ) এ সময়কে রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে মধ্যযুগ বলে অভিহিত করা হয়। মধ্যযুগকে আবার দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। শুরুভাগ ও শেষভাগ। শুরুভাগে এ যুগের খ্যাতনামা রাষ্ট্র দার্শনিক ছিলেন সেন্ট আম্ব্রোজ, সেন্ট অগাস্টিন, পোপ গ্রেগরি প্রমুখ ধর্মযাজক। এ যুগকে চার্চের স্বর্ণযুগ বলা হয়।
কেননা এ সময় খোদ পোপের মাথায় ছিল রাজমুকুট, চার্চ ছিলেন দিগ্বিজয়ী আর খ্রিস্টধর্মের নিয়মনীতি ছিল সর্বব্যাপী। কিন্তু মধ্যযুগের শেষভাগে চার্চের ক্ষমতা হ্রাস পায়, সম্রাটদের কাছে পোপের মর্যাদা নিষ্প্রভ ও হীন বলে পরিগণিত হতে থাকে। ধর্মে বিশ্বাসের স্থলে যুক্তিবাদ প্রাধান্য লাভ করতে থাকে। এ সময়টা মূলত ছিল চার্চ ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কাল। এ সময় সুষ্ঠু রাষ্ট্রের জন্য একদল দার্শনিক ধর্মের পক্ষে জোরালো বক্তব্য পেশ করেছেন, যেমন—সেন্ট অগাস্টিন, পোপ গ্রেগরি, সেন্ট অ্যাকুনাস, ইগিডাস রোমানা প্রমুখ।
এরা পোপকে করে তুলেছিলেন প্রকৃতির মতো নিত্য আবশ্যিকের দণ্ডমুণ্ডের হর্তাকর্তা।
আরেকদল পোপের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ন করা থেকে নিয়ে ধর্মবিবর্জিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের পক্ষে কথা বলেছেন। যেমন দান্তে, মরিসিলিও উইলিয়াম ও জন প্রমুখ। এরা চেষ্টা করেছেন পোপকে রাষ্ট্রের আজ্ঞাবহ বানাতে। আর রাষ্ট্রকে চিন্তা করেছেন ধর্মহীন এক অবকাঠামোর আঙ্গিকে।
ম্যাকিয়াভেলি বিষয়টিকে সুস্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এই যা।
পাঁচশ’ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসনের জন্য পোপ গেলাসিয়াস তার সমান্তরাল দর্শন বা দুই তরবারি দর্শন পেশ করেন। তিনি চিন্তা করেছেন মানবজীবনের দুটি স্বতন্ত্র লক্ষ্য রয়েছে। একটি হলো পার্থিব জীবনের সুখ, অপরটি আত্মিক উন্নয়ন ও পারলৌকিক প্রশান্তি। রাষ্ট্র মূলত মানুষের পার্থিব জীবনের সুখ-শান্তির জন্য কাজ করে।
আর চার্চ মানুষের আত্মিক উন্নয়ন ও পারলৌকিক প্রশান্তি অর্জনের লক্ষ্যে কাজ করে। এর একটি অপরটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। কোনোটিকে বাদ দিয়ে জীবন পূর্ণ হয় না। তাই এ দুটি ক্ষেত্রের জন্য দুটি কর্তৃপক্ষ থাকতে পারে। সে প্রেক্ষিতেই গেলাসিয়াস দুটি সমান্তরাল শক্তির কল্পনা করেন।
দার্শনিকদের মধ্যে দান্তে (জন্ম ১২৬৫, মৃত্যু ১৩২১ খ্রিস্টাব্দ) ছিলেন এর অন্যতম প্রবক্তা। তিনি বলেন, ‘মানবজীবনের দুটি লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই দুজন পথপ্রদর্শক, দুটি আলোকবর্তিকা। শাশ্বত জীবনের শুভপথ দেখাবেন পোপ ধর্মগ্রন্থের দিব্যজ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে। আর পার্থিব সুখের পথপ্রদর্শক হবেন সম্রাট তার যৌক্তিক ও দার্শনিক পসরা হাতে নিয়ে।
পরবর্তী সময়ে দার্শনিক মারসিলিও (জন্ম ১২৭৪ খ্রিস্টাব্দ, মৃত্যু ১৩৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এসে চার্চের ওপর রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করেন এবং ধর্মকে জীবনের আঙিনা থেকে হটিয়ে কেবল পরলৌকিক মুক্তির পরিমণ্ডলে আবদ্ধ করে ফেলেন।
তিনি বলতেন, যাজকদের মূল কাজ হলো পরকালের উন্নত জীবনের নিশ্চয়তার আশ্বাস। আর রাষ্ট্রের কাজ হলো উন্নত জীবন সংগঠন এবং তা শুধু ইহকালে নয়, পরকালেও।
এভাবেই মারসিলিও পোপ-পাদ্রীদের সম্রাটের সমান্তরাল মর্যাদার আসন থেকে নামিয়ে এনে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের অধীন করেছেন। আদিকাল থেকে রাষ্ট্রের ওপর ধর্মের যে প্রভাব চলে আসছিল এবং ধর্মের বিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় নিয়মনীতি প্রবর্তনের যে প্রথা চলে আসছিল, মারসিলিও এ দুটিকে একই সঙ্গে উত্খাত করতে চেয়েছেন। ইতোপূর্বে এমন দুঃসাহস আর কেউ দেখাননি।
এভাবে মারসিলিও ঐতিহ্যবাহী সমান্তরাল নীতি ও ‘দুই তরবারি’ দর্শনের মূলে কুঠারাঘাত করেন এবং ধর্মের সর্বব্যাপী বৈশিষ্ট্যকে অস্বীকার করেন। তিনি চার্চের যে সার্বভৌম একক কর্তৃত্ব ছিল, তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন। তার এই দর্শনের ফলে চার্চ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি বিভাগের পর্যায়ে অবনমিত হয়ে যায়। জীবনের সর্বক্ষেত্রে ধর্মের যে সুর অনুরণিত ছিল তা পরকালের মুক্তির সীমিত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। আর এক্ষেত্রেও চার্চের কর্মকাণ্ড রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন ও তার আজ্ঞাবহ হয়ে পড়ে।
বস্তুত মারসিলিও রাষ্ট্র ও চার্চের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্বকে ইউরোপের অশান্তি ও বিশৃঙ্খলার মূল কারণ বলে ধরে নিয়েছিলেন। এবং তিনি মনে করতেন, চার্চ ও রাষ্ট্র সমকক্ষ ও সমান কর্তৃত্বের অধিকারী হলে এই দ্বন্দ্ব ও বিশৃঙ্খলা কিছুতেই নিরসন করা সম্ভব হবে না। এজন্য তিনি চার্চকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণাধীন আনার প্রয়াস গ্রহণ করেছেন।
ম্যাকিয়াভেলি ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ইতালির ফ্লোরেন্স নগরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র দর্শনের জনক মনে করা হয়।
তিনি মূলত ছিলেন ধর্মে অবিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের কোনো পারলৌকিক লক্ষ্য নেই। মানুষের জীবনের পরিপূর্ণতা লাভের ক্ষেত্র হলো এই পৃথিবী। জীবনের পরিপূর্ণতা অর্জন করতে হলে এই পৃথিবীতেই তা অর্জন করতে হবে। খ্যাতি, ক্ষমতা ও মহত্ত্ব প্রভৃতি গুণ মানুষকে অমরত্ব দান করে।
তাই রাষ্ট্রীয় জীবনে কোনো ঐশ্বরিক বিধানের প্রয়োজন নেই। এজন্য রাষ্ট্রের সংহতি বজায় রাখার প্রয়োজনে শাসকদের নীতি-নৈতিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ থাকারও কোনো প্রয়োজন নেই।
বস্তুত তার সময়ে গোটা ইউরোপ ছিল বিশৃঙ্খলার শিকার। গ্রিকের নগররাষ্ট্রের মতো ইতালিজুড়ে ছিল বেশকিছু ক্ষুদ্র রাষ্ট্র। ভেনিস ও ফ্লোরেন্সের মতো কতগুলো ছিল প্রজাতন্ত্রীধর্মী নগররাষ্ট্র।
তবে অধিকাংশই ছিল একনায়কতন্ত্রী শাসনব্যবস্থার অধীন। এগুলোর মধ্যে সর্বক্ষণ রাজনৈতিক কোন্দল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা লেগেই থাকত। বৈদেশিক শক্তিগুলো এ অঞ্চলের প্রতি তীক্ষষ্ট শিকারির দৃষ্টি মেলে রাখত। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশী জার্মানি, স্পেন, ফ্রান্সের মতো শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো সদা সম্প্রসারণের মনোভাব নিয়ে পর রাষ্ট্র দখলের পাঁয়তারায় লিপ্ত থাকত। ষোল শতকের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলে কয়েকশ’ নগররাষ্ট্র মিলে পাঁচটি বৃহত্ রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যথা—নেপল্স, ভ্যাটিকান রাজ্য, মিলান, ভেনিস ও ফ্লোরেন্স।
মূলত গোটা মধ্যযুগের রাজনৈতিক চিন্তার মৌলিক নীতি ছিল ধর্মভিত্তিক এবং ঐশ্বরিক বিধিবিধানের অনুগত। ক্ষমতাসীনরা মূলত বিবেচিত হতেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবনের সবকিছুই ছিল ধর্মনীতির অধীন, খ্রিস্টীয় চার্চের নিয়ন্ত্রণাধীন। সবকিছুই ধর্মতত্ত্বের আলোকে চার্চের ক্রোড়ে লালিত হতো। কিন্তু যুক্তিবাদের প্রভাবে ধর্মের এই আধিপত্য সমূলে উত্পাটনের জন্য যারা কাজ করেছেন, ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন তাদের অন্যতম।
মারসিলিও এবং ম্যাকিয়াভেলি উভয়েই চার্চকে ইতালির ঐক্যের পথে বড় বাধা মনে করেছেন। এজন্য তারা চার্চকে খুবই ঘৃণার চোখে দেখতেন। তবে এক্ষেত্রে ম্যাকিয়াভেলি ছিলেন মারসিলিওর চেয়েও অগ্রগামী। এজন্য তিনি চার্চকে সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয় এবং তার নীতিমালাকে জাগতিক জীবনের জন্য অর্থহীন বলে ঘোষণা করেন।
এই পর্যালোচনায় একথা একেবারেই দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট হয়ে যায় যে, সব ধর্মের প্রতি উদার মানসিকতা পোষণের চেতনা থেকে ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শনের উদ্ভব হয়নি, কিংবা সবাইকে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার চেতনা থেকেও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শনের সূচনা হয়নি।
বরং রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে ধর্মকে উত্খাত করা এবং মানুষের জীবনকে যুক্তিবাদের আলোকে পরিচালিত করে ধর্মীয় নীতি-নৈতিকতার বন্ধন মুক্ত করাই মূলত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রদর্শন উদ্ভাবনের পেছনে মূল চেতনা হিসাবে কাজ করেছে।
আমরা একথা অস্বীকার করছি না যে, খ্রিস্টধর্ম ছিল সাময়িক কালের ধর্ম। যে কারণে আবহমান কালের মানুষের প্রয়োজনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অগ্রসর হওয়ার মতো পর্যাপ্ত উপাদান তাতে বিদ্যমান ছিল না। অথচ খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা এটাকে বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নিয়ে অসাধ্যকে সাধন করার চেষ্টা করেছেন। তাছাড়া সাময়িক কালের জন্য প্রদত্ত একটি ধর্মকে কিয়ামত পর্যন্ত অনাগত মানুষের ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত রাখার হীন কৌশল অবলম্বন করে একদিকে যেমন তারা ঐশ্বরিক অভিপ্রায়ের সঙ্গে প্রতারণামূলক আচরণ করেছেন, অপরদিকে যে ধর্মে সর্বকালের মানুষের প্রয়োজন পূরণের উপাদান বিদ্যমান নেই, তাকে সর্বকালের মানুষের জন্য চাপিয়ে দিয়ে নিজেরাই গ্যাঁরাকলে আটকে গেছেন।
কেননা ক্রমপ্রসারমাণ বিশ্বের মানুষের প্রয়োজন পূরণ এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্ম ব্যর্থ বলে প্রতিভাত হয়েছে। এতে মানুষ ধর্ম বর্জন করে যুক্তিবাদের আশ্রয় নিয়েছে।
খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারীদের সামনে ছিল এক মহা সঙ্কট—কোন ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে তারা ইহজাগতিক ও পার্থিব বিষয়ের কর্মপন্থা নির্ধারণ করবে? এসব কারণে ধর্মকে বাদ দিয়ে যুক্তির দর্শনকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রসংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে জীবন চলার পথ রচনা করে নিতে তারা বাধ্য হয়। এজন্য ধর্মনিরপেক্ষতার দর্শন ছিল ইউরোপের জন্য এক মহা আশীর্বাদ।
কিন্তু ইসলামী দুনিয়ায় ও মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় এ দর্শন চাপিয়ে দেয়ার কোনো যুক্তি নেই।
কেননা ইসলামের আগমনই হয়েছে বিশ্বজনীন ধর্ম হিসেবে এবং কিয়ামত পর্যন্ত মানুষের জন্য মহান আল্লাহতাআলা এ ধর্মকে মনোনীত করেছেন। সুতরাং কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্বমানুষের জীবনের গতিপথ ও সমস্যার সমাধান এতে নিহিত আছে। তাছাড়া ইসলাম বৈরাগ্যবাদী কোনো ধর্ম নয়, জীবন-জগতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়ানো এক ধর্ম। জীবন-জগতে ইলাহি নেজাম বাস্তবায়নের মাঝ দিয়েই পরকালীন সফলতার পথ তৈরি করতে হয়। জীবনের কোনো অধ্যায়কে ধর্মবিবর্জিত করে পরিচালনার কোনো সুযোগ ইসলামে নেই।
ইসলামে মসজিদ যেমন পরিচালিত হয় ঐশী বিধানের ভিত্তিতে, রাষ্ট্রও তেমনি পরিচালিত হয় ঐশী নেজামের ভিত্তিতে। এ দুইয়ের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয় না। তাছাড়া রাষ্ট্রসংক্রান্ত বিধানের ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ততার যে সঙ্কট খ্রিস্টধর্মে ছিল তাও ইসলামে নেই। কারণ ইসলামের সামগ্রিক বিধানে রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রের জন্য পর্যাপ্ত বিধান বিদ্যমান রয়েছে; ইসলামের মূলধারা ও মূলভাষ্য হারিয়েও যায়নি, বিকৃতও হয়নি। এসব কারণে রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলামী জীবনব্যবস্থা থেকে আলাদা করে ভাবার কোনো অবকাশ নেই, বরং নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা ও জীবনব্যবস্থা নিয়েই ইসলাম পূর্ণাঙ্গ।
তাই যদি কেউ রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন মনে করে তাহলে ইসলামের প্রতি তার বিশ্বাস হবে অপূর্ণাঙ্গ। এটাকে পূর্ণাঙ্গ ইমান বলা যাবে না। এ কারণে কোনো মুসলমানের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে বিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই।
অবশ্য আমাদের দেশে অনেকেই ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন এভাবে যে, প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে আপন আপন ধর্ম পালন করবে। এটি মূলত ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের ওপর চাপানোর কৌশল হিসেবে বলা হয়।
বস্তুত ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনে ব্যক্তিপর্যায়ে যেসব আমল-আচার পালন করা হয় তাতে বাধা দেয়া হয় না। তবে রাষ্ট্রে ধর্মের অংশগ্রহণকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়, যা ধর্মনিরপেক্ষ দর্শনের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা অনুধাবন করেছি। ইসলামের যে বিধিবিধানের সম্পর্কে রাষ্ট্রের সঙ্গে সেগুলো বাস্তবায়নের কোনো পথ খোলা থাকে না। এমনকি তা বাস্তবায়নের জন্য কোনো উদ্যোগ গ্রহণের পথও খোলা থাকে না। উপরন্তু রাষ্ট্র যদি ইসলামবিরোধী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে রাজনৈতিকভাবে তা প্রতিরোধেরও কোনো অবকাশ থাকে না।
তাই এই প্রচারণা দ্বারা আমরা যেন বিভ্রান্ত না হই। একবার যে রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতা চেপে বসে সে রাষ্ট্রে ধর্মের অনুকূলে আওয়াজ ওঠানোর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। এই তো তুরস্ক যা একদিন মুসলিম সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার সুবাদে সেখানে পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, কোনো প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীর স্ত্রী যদি স্কার্ফ পরিধান করে তাহলে তাকে আর ধর্মনিরপেক্ষ মনে করা হয় না। তার পদপ্রার্থিতা ধর্মনিরপেক্ষতার আইনে অবৈধ হয়ে যায়। অবশ্য বিষয়টি এক দিনে হয়ে যায়, তা নয়।
ধর্মনিরপেক্ষতার লাগাম একবার লাগাতে পারলে ক্রমান্বয়ে সেই পর্যায় পর্যন্ত সহজেই নিয়ে নেয়া যায়। বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর অনেক দেশেই গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সমান্তরাল রাখা হয়েছে। এগুলো মূলত রাষ্ট্রীয় দর্শনের নামে মানুষকে ইসলামী মূল্যবোধ থেকে হঠানোর ইয়াহুদি খ্রিস্টান চক্রের ষড়যন্ত্র। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা হয়তো না বুঝেই বিষয়টি গলাধঃকরণ করেছেন, কিংবা গলাধঃকরণ করেছেন কোনো স্বার্থের টানে—আল্লাহই ভালো জানেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।