বাংলা আমার দেশ
ইসলাম ধর্মের মাহাত্ম্য হলো, এটা প্রত্যেক মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রদান করে। এই স্বাধীনতা কেবল ধর্ম-বিশ্বাস লালন-পালন করার স্বাধীনতা নয় বরং ধর্ম না করার বা ধর্ম বর্জন করার স্বাধীনতাও এই ধর্মীয় স্বাধীনতার অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ ্ তা’লা বলেছেন, কুলিল হাক্কু মির রাব্বিকুম ফামান শা’ ফালইউমিন ওয়ামান শা’ ফাল ইয়াক্ফুর, অর্থাৎ ‘তুমি বল, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক’ (সূরা কাহাফ্ : ২৯ আয়াত)। সত্য ও সুন্দর আপন সত্তায় এত আকর্ষণীয় হয়ে থাকে যার কারণে মানুষ নিজে নিজেই এর দিকে আকৃষ্ট হয়। বলপ্রয়োগ বা রাষ্ট্রশক্তি নিয়োগ করে সত্যকে সত্য আর সুন্দরকে সুন্দর ঘোষণা করানো অজ্ঞতার পরিচায়ক।
ফার্সিতে বলা হয়, আফতাব আমাদ্ দালিলে আফতাব। অর্থাৎ সূর্যোদয়ই সূর্যের অস্তিত্বের প্রমাণ। এই নিয়ে গায়ের জোর খাটানোর বা বিতণ্ডার অবকাশ নেই। সূর্যোদয় সত্ত্বেও কেউ যদি সূর্যের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাকে বোকা বলা যেতে পারে কিন্তু তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কিছুই নেই। ঠিক তেমনি কে আল্লাহকে মানলো বা মানলো না, কে ধর্ম করলো বা করলো না এটা নিয়ে এ জগতে বিচার বসানোর কোন শিক্ষা ইসলাম ধর্মে নেই।
বরং এর বিচার পরকালে আল্লাহ ্ নিজে করবেন বলে তাঁর শেষ শরীয়ত গ্রন্থ আল কুরআনে বার বার জানিয়েছেন। এ স্বাধীনতা কাজে লাগিয়ে সমাজে আস্তিকও থাকবে, নাস্তিকও থাকবে। মুসলমানও থাকবে হিন্দুও থাকবে এবং অন্যান্য মতাবলম্বীরাও থাকবে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র পরিচালনা করার ইসলামী শিক্ষা কি, আর ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসঙ্গে ইসলাম কি বলে সংক্ষেপে তা আমার সীমাবদ্ধ জ্ঞানে উপস্থাপন করছি।
ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি।
এর অর্থ ধর্মহীনতা বা ধর্ম বিমুখতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রনায়করা নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে কোন্ ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্র-যন্ত্র কোন ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমানএই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা'লা ঘোষণা করেছেন, ইন্নাল্লাহা ইয়ামুরুকুম আন তুয়াদ্দুল আমানাতি ইলা আহলিহা।
ওয়া ইযা হাকামতুম বায়নান নাসি আন তাহকুমু বিল আদল্। ইন্নাল্লাহা নেঈম্মা ইয়াইযুকুম বিহি। ইন্নাল্লাহা কানা সামিয়াম বাসিরা। অর্থাৎ, নিশ্চয় আল্লাহ্ তা'লা তোমাদেরকে আমানতসমূহ (অর্থাৎ দায়িত্বাবলীকে) এর উপযুক্ত ও যোগ্য প্রাপকের হাতে তুলে দেয়ার আদেশ দিচ্ছেন। আর যখন তোমরা মানুষের মাঝে শাসন কাজ পরিচালনা কর তখন তোমরা পূর্ণ ন্যায়-পরায়ণতা (অনংড়ষঁঃব ঔঁংঃরপব)-এর সাথে শাসন পরিচালনা করবে।
আল্লাহ্ যা উপদেশ দিচ্ছেন তা কত উত্তম। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা (সূরা নিসা ঃ ৫৮ আয়াত)।
আলোচ্য আয়াতে একদিকে সর্বাধিক উপযুক্ত প্রাপকের হাতে দায়িত্ব প্রদানের জন্য বলা হয়েছে। অপরদিকে নির্বাচিত হবার পর শাসন কাজ পরিচালনার মূল নীতি শেখানো হয়েছে। এখানে শাসক ব্যক্তিকে ধর্ম পরিত্যাগ করতে বলা হয় নি।
বরং তাঁকে বলা হয়েছে প্রকৃতপক্ষে যদি ধার্মিক হয়ে থাকো তবে ন্যায় বিচার করবে। আর বলা বাহুল্য, পূর্ণ নিরপেক্ষতা ছাড়া পক্ষপাতহীন ন্যায় বিচার সম্ভব নয়।
ইসলাম ধর্মের এই অমোঘ শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর পবিত্র জীবনে। মক্কার নির্যাতিত অবস্থা থেকে মুক্তি চেয়ে ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশায় তিনি মদীনায় হিজরত করেন। মদীনায় পৌঁছানোর পর মদীনার ইহুদী ও অন্যান্য ধর্ম গোষ্ঠী ও গোত্রের সাথে তিনি একটি ‘সন্ধি’ করেন।
এই সন্ধি ‘মদীনা সনদ’ নামে বিখ্যাত। ‘মদীনা সনদের’ প্রতিটি ছত্রে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মদীনা রাষ্ট্রের সকল নাগরিককে এক জাতিভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে কয়েকটি ধারার উল্লেখ করাই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। মদীনা সনদের যে ধারা বিন্যাস প্যারিস বিশ্বাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হামিদুল্লাহ্ তাঁর লিখিত ঞযব ঋরৎংঃ ডৎরঃঃবহ ঈড়হংঃরঃঁঃরড়হ ড়ভ ঃযব ডড়ৎষফ-এ ব্যবহার করেছিলেন এখানেও তাই অবলম্ব^ন করছি।
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
১. এটি আল্লাহর নবী মোহাম্মদ (সাঃ)- এর ঘোষণাপত্র যা কুরাইশদের অর্ন্তভুক্ত মুসলমান ও মু’মিনদের এবং ইয়াসরিববাসী ও তাঁদের অধীনস্থ হয়ে যারা সম্মিলিতভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করবে তাঁদের জন্য প্রযোজ্য।
২. সমগ্র মানবজাতি থেকে পৃথক এরা এক স্বতন্ত্র উম্মাহ্।
৩. হিজরতকারী কুরাইশরা তাঁদের পূর্ববর্তী অবস্থায় বহাল থাকবে, তাঁদের পারস্পরিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের পূর্ববর্র্তী নীতি অক্ষুণœ থাকবে। তারা নিজেদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায় করবে যেন মু’মিনদের মাঝে পারস্পরিক সুবিচার ও ন্যায়নীতি বজায় থাকে।
৪. বানু আওফ গোত্রও তাদের পূর্ববর্তী অবস্থায় বহাল থাকবে, তাদের পারস্পরিক ক্ষতিপূরণ প্রদানের পূর্ববর্তী নীতি অক্ষুণœ থাকবে।
প্রত্যেক দল তাদের নিজেদের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তিপণ আদায় করবে যাতে মু’মিনদের মাঝে পারস্পরিক সুবিচার ও ন্যায়নীতি বজায় থাকবে।
এরপর এ সনদে একে একে বিভিন্ন গোত্রের নাম উল্লেখ করে তাদের সামাজিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়। এরপরে ২৫ নম্বর ধারায় ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি বিরল উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে বলা হয় :
২৫. বনু আওফ গোত্রের ইহুদীরা মু’মিনদের সাথে একই উম্মতভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইহুদীদের জন্য ইহুদীদের ধর্ম, মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ধর্ম।
একই কথা এদের মিত্রদের এবং এদের নিজেদের জন্য প্রযোজ্য। তবে যে অত্যাচার করবে এবং অপরাধ করবে সে কেবল নিজেকে এবং নিজ পরিবারকেই বিপদগ্রস্ত করবে।
কি চমৎকার শিক্ষা! বিশ্বনবী, মহানবী (সাঃ) প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, যে যে ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জাগতিক অবস্থান সমান। এ কারণেই সম্ভবত মহানবী (সাঃ) মদিনাকে ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বা ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করেন নি। যে কাজ মহানবী (সাঃ) করেন নি সে কাজ সম্পাদন করে কেউ কি ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারব?
এটি নিছক একটি ঘোষণাই ছিল না।
বরং মহানবী (সাঃ) মদীনার শাসনকাজ পরিচালনাকালে এর সুষ্ঠ বাস্তবায়নও করেছিলেন। একবার মহানবী (সাঃ)- এর শ্রেষ্ঠত্বের বিষয় নিয়ে একজন মুসলমান ও একজন ইহুদীর মাঝে বাক-বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে বিতণ্ডা তিক্ততার স্তরে উপনীত হলে সেই ইহুদী মহানবী (সাঃ)-এর কাছে বিচারপ্রার্থী হয়। মহানবী (সাঃ) নিরপেক্ষ শাসক হিসেবে রায় দিয়ে বলেন, ‘লা তুফায্যিলুনি আলা মুসা’ অর্থাৎ তোমরা আমাকে মুসার ওপর শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করো না (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া লে ইবনে কাসীর, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-২৩৭)। এর অর্থ হচ্ছে, আধ্যাত্মিক জগতে কে শ্রেষ্ঠ আর কে শ্রেষ্ঠ না এটা মানুষের সিদ্ধান্তের বিষয় নয়।
অতএব এ নিয়ে সামাজিক অশাান্তি সৃষ্টি করতে যেও না। একই ধরনের একটি ঘটনা ঘটে এক মুসলমান এবং এমন একজন মানুষের মাঝে যে হযরত ইউনুস (আঃ)-এর ভক্ত ছিল। এই ব্যক্তি অন্য কাউকে হযরত ইউনুসের চেয়ে বড় মানতে রাজি ছিল না। মুসলমান ভুলবশত বিতণ্ডাকালে তার মনে আঘাত দিয়ে ফেলে। নালিশ যায় বিশ্ব নবীর (সাঃ) দরবারে।
পূর্ণ ন্যায় বিচারক ছিলেন আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ)। তিনি অমুসলমান ব্যক্তির পক্ষে রায় প্রদান করে বলেন, ‘লা তুফায্যিলুনি আলা ইউনুস ইবনে মাত্তা’ অর্থাৎ তোমরা ইউনুস বিন মাত্তার ওপর আমাকে শ্রেষ্ঠত্ব দিতে যেও না (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া লে ইবনে কাসীর, ১ম খন্ড, পৃষ্ঠা-১৭১)। অর্থাৎ কে বড় নবী আর কে ছোট নবী, কে আল্লাহর দৃষ্টিতে অধিক প্রিয় বা নিগৃহীত- এ বিষয়ে রাষ্ট্র নীরব থাকবে আর সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখবে। এসব আধ্যাত্মিক বিষয়ের মীমাংসা হবে পরকালে আল্লাহর দরবারে, ইহকালে নয়।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ইসলামের শিক্ষানুযায়ী দ্ব্যর্থহীনভাবে সাব্যস্ত।
কুরআন শরীফে মহান আল্লাহ তা’লা বলেছেন ‘ওয়ালাও শা’ রাব্বুকা লা’আমানা মান ফিল আরযি কুল্লুহুম জামিয়া আফা আনতা তুকরিহুন নাসা হাত্তা ইয়াকুনু মুমিনিন। ’ অর্থাৎ, তোমার প্রতিপালক-প্রভু চাইলে জগতের সবাই ঈমান আনতো। তুমি কি তবে মানুষকে মুমিন-বিশ্বাসী হওয়ার জন্য বলপ্রয়োগ করতে পার? (সূরা ইউনুস: ৯৯ আয়াত)। আল্লাহ তা’লা ঘোষণা দিয়ে বলছেন, তিনি চাইলে সবাই ঈমান আনতে পারতো কিন্তু এমনটি তিনি করেন নি বরং সত্য গ্রহণ বা বর্জনের ক্ষেত্রে সবাইকে স্বাধীনতা প্রদান করেছেন। যে ক্ষেত্রে স্বয়ং খোদা এমন করেন নি তাঁর প্রতিনিধি বিশ্ব নবী (সাঃ) কীভাবে মানুষকে ঈমান আনতে বাধ্য করতে পারেন! এই হচ্ছে ধর্ম বিষয়ে ইসলাম প্রদত্ত স্বাধীনতা।
অতএব এসব স্বর্ণ শিক্ষা আমাদেরকে মনে রাখতে হবে এবং বর্তমান প্রচলিত নোংরা, মিথ্যা রাজনীতি বা কূটনীতির সাথে সত্য ও পবিত্র ধর্মের সংমিশ্রণ ঘটানোর অপচেষ্টা রুখতে হবে।
পরিশেষে বলবো, ধর্ম নিরপেক্ষতা এমন একটি চশমা যা পরিধান করলে শাসকদের চোখে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ কেবল একজন মানুষ হিসেবেই ধরা দেয়। তখন সে খোদার এক সম্মানিত সৃষ্টি হিসেবে মনে হয়, যার প্রতি ন্যায় বিচার ও সদাচরণ করা শাসকদের পবিত্র দায়িত্ব। এই শিক্ষা আমরা মহান আল্লাহর ব্যবহার থেকেও গ্রহণ করতে পারি। তিনি যেমন মুসলমান-অমুসলমান, আস্তিক-নাস্তিক, পূণ্যবান-পাপী নির্বিশেষে সবার প্রতি অনুগ্রহ করেন, তাদের সৎকর্মের প্রতিদান দেন, সবাইকে সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত করেন, সবাইকে তাঁর করুণার বৃষ্টি বর্ষণ করেন, সকলকে যেমন সমান ইন্দ্রিয় এবং দৈহিক ও মানসিক শক্তি প্রদান করেন, ঠিক তেমনি জাগতিক সরকার বা রাষ্ট্রনায়কদেরও এই গুণটি অবলম্বন করা উচিত।
তবেই রাষ্ট্র ও দেশ হবে সুখি, সমৃদ্ধ ও নিরাপদ। মহান আল্লাহ আমাদের শাসকদেরকে নিরপেক্ষভাবে দেশ ও দশের সেবা করার সৌভাগ্য দিন। (আমীন)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।