আমি সততা ও স্বচ্ছতায় বিশ্বাস করি।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাবুল। লোকে ডাকে কানা বাবুল। বাঁশির সুরে গাঁথা এই জীবন। তার সুরের মাধুরী দুলিয়ে মাতিয়ে তুলে মানুষের মন।
বাবার হাত ধরে এক’কদম দু’কদম করে এগুতে থাকে তার পথচলা। বাঁশিতে সুর তুলেই মাসের পর মাস পেরিয়ে চলছে বাবুলের জীবন। এভাবেই গত দু’বছরে বাবুল হয়ে উঠেছে পাকাপোক্ত এক বাশোরিয়া। ক্রমেই সে কানা বাবুল থেকে হয়ে উঠেছে এক সুরেলা বাবুল। শিশুশিল্পী বাবুলই এখন তার একমাত্র পরিচয়।
শুনে হয়তো যে কেউ বিস্মিত হতে পারেন, কেউবা গল্প মনে করতে পারেন। ১৪ বছরের শিশু বাবুল তংলার জীবনচলার কথা বলছি। হ্যাঁ, বাবুল জন্মগতভাবেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। তার দু’টি চোখে যেন জীবনযুদ্ধে পরাজয়ের গ্লানি তাকে বারবার অশ্র“ঝড়িত করে। সমাজের অন্যসব শিশুদের মতো তারও যেমন রয়েছে একটি সুন্দর জীবন গড়ার স্বপ্ন, তেমনি রয়েছে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার এক উদ্যমী শক্তি।
তার সমবয়সী অন্য শিশুদের সাথে পাল্লা দিতে চাইলেও সে পেরে উঠছে না তার দৃষ্টিহীনতার কারণে। তাই পিছিয়ে পড়া শিশুদের সাথেই দীর্ঘ এক যুগ কেটেছে বাবুলের।
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ৭নং কুলাউড়া ইউনিয়নের গাজীপুর চা-বাগানের বাসিন্দা এই শিশুশিল্পী বাবুলের বাবা রাখাল তংলা দিন মজুরের কাজ করেন। মা লক্ষী তংলা চা-বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন। ৫ বছর বয়সের ছোট বোন মনি তংলার এখন স্কুলে যাওয়ার সময়।
৪ সদস্যের পরিবারে নিত্য দারিদ্রতা যেন লেগেই আছে। অভাবের তাড়নায় প্রায়ই বাবুলের মনে কষ্ট হয়। একদিকে যেমন দৃষ্টিহীনতা অন্যদিকে বাবুলের নিষ্কর্ম জীবন তাকে যন্ত্রণা দেয় প্রতিনিয়ত।
গত দু’বছর আগে নিজের অভাগা জীবনে দিন বদলের চেষ্টায় হঠাৎ করেই বাবুল হাতে বাঁশি তুলে নেয়। নিজে নিজেই সুর তুলতে থাকে বাঁশিতে।
তার নরম হাতের ছোঁয়ায় আর কোমলমতি ঠোঁটের টানে ভেসে আসে মনোমুগ্ধকর এক সুমধুর সুর। অনেক দূর হতে মানুষকে কাছে টেনে আনে তার বাঁশির সুর। অথচ বাবুলের পরিবারের সদস্যসহ কেউই কোনদিন ভাবেনি যে দৃষ্টিহীন বাবুলের জীবনে শিল্পীর ছোঁয়া আসতে পারে। মাত্র দু’বছরেই বাবুল দেশাত্ববোধক, বাউল, ভাটিয়ালী, মুর্শিদী, হিন্দীসহ বিভিন্ন গানের সুর তুলে ফেলেছে তার বাঁশিতে। এখন শুধু বাঁশির সুরেই বাবুল দৈনিক ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা রোজগার করছে।
প্রতিদিন সকালে বাবার হাত ধরে বাঁশি নিয়ে ঘর থেকে বের হয় বাবুল। তার মায়াবী বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে মানুষ ২/১ টাকা করে যা দেয় তাতে দৈনিক ৩/৪শ টাকা হয়ে যায়।
ট্রেনে-বাসে চলাচল করেই তারা মাসের পর মাস ঘুরে বেড়ায় মৌলভীবাজারের ৭ টি উপজেলায়। তবে ট্রেনেই বেশি চলাচল করে তারা। এক ষ্টেশন থেকে আরেক ষ্টেশনে যেতে যে সময় লাগে তাতে ট্রেনের ভেতরে কিছু রোজগার হয়।
আবার ষ্টেশনে ট্রেন আসতে দেরি হলে প্ল্যাটফর্মে কিংবা আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়ায় তারা। ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্ত হয়ে গেলে আবার ষ্টেশনেই বিশ্রাম নেয়।
স¤প্রতি বাবুল আর তার বাবা শ্রীমঙ্গল রেল ষ্টেশনে আসলে ফের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে চলে আসে শহরের দিকে। বাবুল বাঁশি বাজিয়ে বাজিয়ে শহরের চৌমূহনা চত্তরে আসতেই বাঁশির সুরে মুগ্ধ জনতার ভীড় জমে যায়। দূর থেকে মনে হয় যেন কোন এক শিল্পী বাঁশি বাজাচ্ছে।
কিন্তু কাছে এসে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী এই শিশুশিল্পী বাবুলকে দেখে সকলেই অবাক হয়ে ওঠেন। বাবুলের বাবা রাখাল তংলা এ প্রতিবেদককে জানান, পরিবারে ২ সন্তান আর স্ত্রী নিয়ে খুব খারাপ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। বছর খানেক ধরে বাবুল বাঁশি বাজিয়ে রোজগার করছে। তবে বাবুল একা চলতে পারে না তাই বাবাকে সঙ্গে থাকতে হয়। এতে করে দৈনিক ৩/৪শ টাকা রোজগার হয়।
বাবুলের শিশুমনে শিল্পীর ছোঁয়াকে জাগিয়ে তুলতে এবং মফস্বল থেকে শহরাঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে তার বাবার প্রয়াসের কোন কমতি নেই। তিনি আরো বলেন, “অনেক বড়লোকেরা অনেক বড় বড় আশা দিয়ে চলে যান, কিন্তু কিছুই হয় না। আমার রোজগারের কথা বাদ, আমার বাবুলের যদি একটা ভাল দিক হয়ে যায় তাহলে আমার আর কোন চিন্তা নাই। ”
একজন দৃষ্টিহীন শিশুশিল্পীকে সমাজ, দেশ ও দেশের মানুষের কাছে পরিচিত করে তুলতে বাবুলের বাবার যেমন উৎসাহ ও প্রচেষ্টার কোন শেষ নেই। তেমনি এই দৃষ্টিহীনের প্রতিভার বিকাশের জন্য প্রয়োজন সমাজ-সংস্কৃতি ও স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক সহযোগীতা।
তবেই বাবুলের বাবার আশা পূরন হবে। আর দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বাবুল হবে প্রতিষ্ঠিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।