আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনের যাঁতাকলে জন্মই আজ ভুলতে বসেছি আর জন্মদিন সেতো এক বিলাসবহুল স্বপ্নের নাম



মাটির পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে আজ ১৪ই মার্চ, ১৯৮২ সালের এমনই এক আগুনঝরা দিবসে সময়ের বুক চিরে দীর্ণ করেছিলাম আমার মায়ের শরম। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে জানান দিয়েছিলাম পৃথিবীকে আমি বিজয়ী। আমার দাদাজান আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে জানিয়ে দিয়েছিলেন তার মেঝ ছেলের সন্তান জন্মের শুভক্ষন। আমার বাবা হয়তো খুশীতে বাড়ীর সাবার সাথে কোলাকুলী করছিলেন আর খোদা তা'য়ালার শুকরিয়া আদায় করছিলেন। আর মা।

আমার মা, আমি জানিনা , কখনো জিজ্ঞেসও করিনি তার অনুভুতি। তবে বুঝতে পারি, আমিতো তারই সন্তান, তারই ভ্রুণ থেকে তারই সুরক্ষিত সুতাপে সূদীর্ঘ দশটি মাস তিলে তিলে সমস্ত প্রচেষ্টার মায়াময় তিতিক্ষায় জন্ম নেয়া সন্তান। আমি আমার মায়ের আবেগ, ভালোবাসা ও অনুভূতির সবটুকুই বুঝতে পারি। ভূমিষ্ট আমার কান্না শুনে সেদিন নিশ্চয় আমার মা বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি ও তার সন্তান দুজনেই বিজয়ী। নিশ্চয় আমার মা নিরবে কেঁদেছেন বিজয়ীনির সুখের হাসি।

মা, মাগো আমি তোমার সেই সন্তান যার আজ ২৯ তম জন্ম জন্মদিন। কত বড় হয়েছে দেখো তোমার ছেলে। মা ও বাপে করলা বন্দি খুশীর মাঝারে কিছু স্মৃতি মনে পড়ে, কিছু পড়েনা। মনের জানালায় উঁকি দেয়া হাজার স্মৃতি সময়ে সময়ে মনে করিয়া দেয় বাবা মাকে কত কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়েছি। তবে সময়ের স্রোতে আমি যখন বড় হয়ে উঠছিলাম ঋজু দেবদারুর মতো বাবা-মায়ের আদরে কখনো বুঝিনি অনেক কিছুই আবার হয়তো বুঝিনি কোন কিছুই।

মা- বাবাকে বহু আব্দারে আব্দারে জ্বালাতন করেছি অহর্নিশি। মা আমাকে গোসল করানোর সময় কোথাও একটু ব্যাথা পেলে বিকেলে বাবাকে নালিশ করতাম। বলতাম মা আমাকে কানে, পিঠে ব্যাথা দিয়েছেন। বাবা ভিক্সের ডিব্বা থেকে ভিক্স নিয়ে মালিশ করে দিতেন সযতনে। আর ভান করতেন তিনিই সবচেয়ে বেশী বুঝেছেন আমার কষ্টটা।

আর হালকা করে বকে দিতেন মাকে। দুষ্টুমী করলে আম্মাই শাসন করতেন বেশী। তার প্রিয় বেত ছিলো পাটের শুকনো কাঠি। মা কত হাজার পাট কাঠি যে ভেঙ্গেছেন আমার পিঠে তারও কোন শেষ নেই। আব্বা স্কুল থেকে ফিরে আবার আদর করে দিতেন।

ঈদে আমার পছন্দ আর আমার জামা কাপড় খুব গুরুত্বপূর্ন ছিলো। সবার চেয়ে সুন্দর আর ভালো হওয়া চাই, দিতেই হবে এবং পেতামও। মা টুকিটাকি করে সংসারের খরচ থেকে বাঁচানো টাকা আমার জন্য খরচ করতেন। আর বাবা স্কুলের সামান্য বেতনের চাকরী করে খুব কষ্ট করে সংসার চালাতেন যা তখন বুঝতাম না। তবুও আমার চাওয়া যেনো না পাওয়াতে পরিনত হয়না সেদিকে ছিলো তার প্রানান্তকর প্রচেষ্টা।

পুরনো হওয়ার আগেই নতুন স্কুলব্যাগ, শার্ট, স্যান্ডেল পেয়ে যেতাম। দিন এভাবেই বহমান স্রোতের মতোই চলছিলো, আজ মনে হয় সেইসব দিনই ভালো ছিলো। ক্লাস সিক্সে উঠার সাথে সাথেই সিলেটের সনামধন্য এক স্কুলে ভর্তি হতে হলো। সময়ের নিয়ত খেলায় যখন আমি বাবা-মায়ের ছায়ার বাইরে শহরে যাচ্ছি তখন টের পাই যেন এক ঝড় আমার হৃদয়টাকে উলট পালট করে দিচ্ছে। অনুধাবন করেছিলাম আমার মায়ের আঁচলের ভালোবাসা আর পিতার স্নেহের টান।

লালে ধলায় হইলাম বন্দি পিন্জিরার ভিতরে পিঞ্জিরায় সামাইয়া ময়না ছটফট ছটফট করে শহরের অজানা আলোবাতাস কেমন যেনো কঠিন ঠেকতো আমার কাছে। বাড়ীর জন্য মন খুব টানতো। মাঝে মাঝে বাড়ি যখন যেতাম, মা আমায় চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিতেন। ভালো খাবারগুলো আলগা করে রেখে দিতেন তার ছেলের জন্য। আবার যখন ফিরে আসতাম শহরের নিয়ম শৃংখলার কারাগারে তখন খুব নস্টালজিক হয়ে পরতাম।

বাড়ী থেকে ফেরার পথে দেখতাম আমার মায়ের চোখে অঝোর বরষা। বুকের ভিতর মনের ক্ষ্টকে চেপে রেখে বিদায় নিতাম আবার আসবো কথা দিয়ে। শহরের রকমারি আলো ঝলমল সময়গুলো আমাকে ভিষন বেদনায় নীল করে দিতো কখনো কখনো। ছটফট করতাম যন্ত্রণায়। মা-বাবার থেকে দূরে থাকার এ যন্ত্রণায়।

নিরবে, নিভৃতে কত যে কেঁদেছি, ভিজিয়েছি বালিশের তুলো। পরদিন হয়তো আবার সবকিছু ভুলে সময়ের সাথে ভেসে গিয়েছি। এভাবেই এক ধরনের মানসিক পীঁড়ার মধ্যে বেড়ে উঠা। আমার পরীক্ষার সময়গুলোতে আম্মা নফল রোজা রাখতেন। তাই হয়তো আল্লাহ্ সবসময় সহায় হয়েছেন।

স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলাম। আরো বড় শহর। আরো বেশী ঝলমলে বাতি। আর বড় রাস্তা। আরো বেশী ঘোমট হাওয়া, ধুলিঝড়।

আরো বেশী কূটিলতা। আরো বেশী মানুষ, কোটি মানুষের শহরে। আমি এ শহরে দেখেছি মানুষ ঠকানোর সহস্র রকমের পন্থা ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে অট্টালিকার শতরঞ্জি মুড়ানো বসার ঘরের চায়ের টেবিল পর্যন্ত। ঢাকা শহরে আমার দমবন্ধ ভাব যেনো কিছুতেই পিছু ছাড়ছেনা। কিছুতেই এ শহরকে নিজের মনে হতো না।

এ শহরকে মনে হতো বিষ্টা ও আবর্জনার শহর। গ্রামের বাতাসের নিশ্বাস ভরা সময়গুলো মনে পরতো খুব। সুতীব্র কষ্টে এখানেও মঝে মাঝে হাউ মাউ করে কেঁদেছি অনেক দিন। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একটা ধামড়া ছেলে একা একা মায়ের জন্য-বাবার জন্য কাঁদে। শুনতেই যেমন কেমন লাগে! তবুও লজ্জিত নই।

কারন এ কান্না আমার অহংকার। আমি আমার জননীর জন্য কেঁদেছি, আমি আমার জনকের জন্য কেঁদেছি। স্বপ্ন পূরণের আশায় যখন আমি রাজধানী ঢাকার রাজপথে স্বপ্নের প্রদীপ খুঁজছি তখন হঠাৎ ঠিকানা বদলে চলে এলাম পৃথিবীর রাজধানী লন্ডন শহরে। নিজেকে একদিন আবিষ্কার করালাম ৩৬ হাজার ফিট উপরে মেঘের সাথে আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছি। তারপর আবিষ্কার করলাম আরো বেশী আলোকজ্ঝল পথ-ঘাট, রঙিন বাতিময় দোকানের জানালা, ট্রাফিকের সিগনাল, আর যাদুকরী এক নদী রিভার থেমস।

বড় বেশী অচেনা লাগে এই শহরে নিজেকে। কখনো গিনিপিগ, কখনো আ্যালিয়েন। আর আমার গায়ের শ্যামল রং আর মাটির সোঁদা গন্ধ আমাকেই মনে করিয়ে দেয় আমি বাংলাদেশী, আমি বাঙালী। আমি গর্বিত এ বোধটুকু না যাওয়ার জন্য। এ শহর সুন্দর নিঃসন্দেহে।

তবে আমার শহর নয়। এ শহর যেনো আমার জন্য কারাগার। সময়ের কারাগারে কঠিন নিয়ম কানুনে বন্দী কয়েদীর মতো আমার যাপিত জিবন এখানে। দমবন্ধ ভাবটা ঢাকার চে এখানে আরো বেশী, প্রকট। যেমন, আজ ১৪ই মার্চ নিজের জন্মদিনেই কেমন জানি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা বলে মনে হচ্ছে।

কি নিদারুন অভিসম্পাতের কারনে পরবাসী এই আমি পৃথিবীর অন্যতম বিলাসবহুল, ধনাঢ্য আর অভিজাত ইট-পাথরের জঙ্গল চেলসিতে দিনাতিপাত করছি গিনিপিগ হয়ে। হায় জিবন। হায় সুখের জিবন। মজবুত পিঞ্জিরা ময়না ভাঙ্গিতে না পারে উড়িয়া যাইবো শোয়া পাখি, পড়িয়া রইবো কায়া জিবনের যাঁতাকলে আর নানান জটিলতায় পিষ্ট দেলওয়ার সুম্মান ভুলেই গেছিলো তার জন্ম দিবস। বন্ধুর টেক্সট মেসেজ মনে করিয়ে দিলো যে ২৯ বছর পূর্বের আজকের দিনটাতে আলোকিত করেছিলো তার পিতা-মাতার উঠোন।

তাই জন্মদিন নিয়ে য্তটা না ভাবছি তার চেয়ে বেশী বিচলিত ভবিষ্যত নিয়ে। আজ ২৯ বসন্তের শেষে চোখের কোণে জল নিয়ে ভাবি কি প্রতিদান দিয়েছি মায়ের দুধের? কি সম্মান দিয়েছি মায়ের গর্ভের? কি মান রেখেছি পিতৃস্নেহের? ক্ষমা চাওয়া ছাড়া আর কি করতে পারি এই আমি? আমার মতো অকৃতজ্ঞ সন্তানের পদভারে এ পৃথিবী কি লজ্জিত হয়ে লানত দিচ্ছে? কেনো আরো ভালোবেসে যেতে পারেনা এ হৃদয় তোমাদেরকে প্রিয় আব্বা-আম্মা? কেনো তোমাদের সেবায় আরো অনেক বেশী নিবেদিত হতে পারিনা? মানুষ তো একদিন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেই, চিরকালের জন্য, চিরটা দিনের জন্য মায়ার পৃথিবী ছেড়েতো সবাইকেই চিরবিদায় নিতে হবেই। স্মৃতির মেঠো পথ, ২৯ নং রোড, জিগাতলার মোড়, মল চত্বর, বিডিআর ৩ নং গেইট, ধানমন্ডির লেক, চেলসি ব্রীজ, কিংস রোড সব ছেড়ে আমিওতো একদিন চলে যাবো। তার পূর্বে কি আমি আমার বাবা-মায়ের ন্যায্য পাওনা শোধ করতে পারবো? ''রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানিসসাগিরা। '' গোনাহগারের দোআয় যেনো তার পিতা-মাতা সুস্থ থাকেন।

দয়াময় মেহেরবান খোদার করুনার রহমত বর্ষনে যেনো বাবা-মা সুখী হোন। কিসের দেশ কিসের খেশ কিসের দয়া মায়া কান্দে হাসন রাজার মন মুনিয়ায়রে হাসন রাজার এই গানটা আমার খুবই প্রিয়। আজ আমার জন্মের ২৯ তম বার্ষিকীতে গানটি খুবই মনে পড়ছে। কারন আমার ও হাসন রাজার অনুভূতিগুলো কখনো কখনো এক হয়ে মিশে যায়, মিশে যায় তার গানে, তার সুরে, গুনগুন করে গেয়ে কষ্টময় সময়গুলো পার করি তার সাথে। ভুলে থাকার চেষ্টা করি অনেক কিছুই।

আজ যখন আমার মনের কোণে স্মৃতির শতকোটি শব্দাবলী উঁকি দিচ্ছে, জন্ম দিবসের শুভক্ষণে তার মাঝ থেকে কিছু কথা, কিছু ব্যাথা লিখে নিলাম স্মৃতির খেরো খাতায়। আজ মাকে খুব মনে পড়ছে। যে নারীর গর্ভে জন্ম নিয়ে আমি আজ এই আমি, তার কথা খুবই মনে পড়ছে। প্রিয় বাবা-মা আমি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। যে কৃতজ্ঞতার কোন শেষ নেই, শেষ নেই।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.