আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চট্টগ্রামে সোনালি সূর্যোদয় ।। অবিস্মরণীয় বিজয়ে দেশজুড়ে বাঁধভাঙ্গা উল্লাস



ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৫৮ রানের হৃদয় বিদীর্ণ করা ইনিংস। এই ইনিংসটি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের তো বটেই দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর বুকের উপর যেন জগদ্দল পাথর হয়ে বসেছিল । সে পাথরটি সরানোর একটা সুযোগ বড় বেশি প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের জন্য। একটা মঞ্চ যেন খুঁজছিলেন সাকিব-তামিমরা। যেখান থেকে হাজারো প্রশ্নের একটা দাঁত ভাঙ্গা জবাব দেওয়া যাবে।

অবশেষে সেই মঞ্চটা পাওয়া গেল। আর এই মঞ্চটা যে হবে চট্টগ্রাম তেমনটি ভেবেছিলেন অনেকেই। বিস্তারিত দেখুন এখানে চট্টগ্রাম গতকালই ঢুকে পড়েছে ইতিহাসের পাতায়। জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়াম বিশ্বকাপের ভেন্যু হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেওয়ার দিনে আরো ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে গেল চট্টগ্রাম। আর তা হচ্ছে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপে টিকে থাকল বাংলাদেশ।

সে সাথে অনেক প্রশ্নের জবাবও দিয়ে দিল টাইগাররা। আহত সিংহের ন্যায় ইংলিশদের রক্তাক্ত করে বাংলাদেশ জানিয়ে দিল দুর্ঘটনা প্রতিদিন ঘটেনা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য সৌভাগ্যের পরশ নিয়ে বসে থাকে চট্টগ্রাম বরাবরই। তার প্রমাণ ইতিপূর্বে অনেকবারই দিয়েছে। সেই এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে প্রথম টেস্ট জয় থেকে শুরু করে বাংলাদেশের ক্রিকেটের পিঠ যখন দেয়ালে ঠেকে যায় তখনই ফিরে আসার মঞ্চটা তৈরি করে দেয় চট্টগ্রাম।

গতকাল তেমনই আরো একবার বাংলাদেশের ক্রিকেটে সোনালি সূর্য উদিত হল চট্টগ্রামে। ফ্লাড লাইটের আলোয় যেন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটে উদিত হওয়া নতুন একটা সূর্যকে। যে সূর্যটা উদিত হয়েছিল চট্টগ্রামের আকাশে। বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রাম। এই চট্টগ্রাম বরাবরই দেশের সম্মান পুনরুদ্ধারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সম্ভ্রম নিয়ে যখন অনেকেই টানাটানি করার চেষ্টা করছিলেন তখনই চট্টগ্রাম মঞ্চ প্রস্তুত করে জানিয়ে দিলেন এই সম্ভ্রম হারাতে দেওয়া যাবে না। আমরা হারতে জানি না। গতকাল বাংলাদেশ হারেনি। ঐতিহাসিক এক জয় নিয়ে বাংলাদেশ জানিয়ে দিল বিশ্বকাপ থেকে এত তাড়াতাড়ি সরে যাচ্ছিনা আমরা। শফিউল নামের এক তরুণের কাঁধে চড়ে বাংলাদেশ শুধু ২ উইকেটে ইংল্যান্ডকে হারায় নি, বিশ্বকাপের শেষ আটের রাস্তাটাও খোলা রেখেছে।

যে রাস্তার শুরুটা হল চট্টগ্রাম থেকে। শেষটা কোথায় হয় তার অপেক্ষায় এখন পুরো জাতি। জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের নব জন্মের দিনে বাংলাদেশের ক্রিকেটও যেন নতুন করে ফিরে পেল প্রাণ। যে প্রাণের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ এখন দৃষ্টি দিচ্ছে সেই দূরের পানে। যেখানে হয়তো দাঁড়িয়ে আছে আরো বড় সাফল্য।

যে সাফল্যের পথ দেখালো চট্টগ্রাম। ব্যাট বলের লড়াইয়ে বাংলাদেশ দাঁড়াতে দিলনা ইংলিশদের। যেখানে তফাৎটা বুঝিয়ে দিলেন টাইগাররা। যদিও কিছু কিছু ভুল ভ্রান্তি হয়েছে ২২ গজের সেই পুলসেরাতে। তবে শেষ পর্যন্ত জয় নামের সোনার হরিণটা যখন ধরা পড়ে খাঁচায় তখন কি আর ও সব নিয়ে ভাবার সময় থাকে।

তবে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের যে দৃষ্টি এখন তাক করেছে দূরের পানে তা এগিয়ে নেওয়াটাই হবে ১৫ স্বপ্ন সারথীর প্রধান কাজ। গতকাল টানা চতুর্থ ম্যাচে টস জিতলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। যে স্পিনারদের ভরসায় প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ডের হাতে ব্যাট তুলে দিয়েছিলেন সাকিব সে স্পিনাররা হতাশ করেন নি তাকে। প্রথম ব্রেক থ্রোটা এনে দিয়েছিলেন সেই স্পিনারই। ইনিংসের অষ্টম ওভারে বল করতে আসা রাজ্জাক তার প্রথম বলেই মেট প্রায়রকে যখন মুশফিকের স্টাম্পে পরিণত করে ফিরিয়ে দেন ইংলিশদের সংগ্রহ তখন মাত্র ৩২।

দুই পেসারের জায়গায় দুপ্রান্ত থেকে দুই স্পিনার নাঈম এবং রাজ্জাক ভালই ভুগিয়েছেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের। নিজের তৃতীয় ওভারে নাঈম যখন ফেরান ইংলিশ অধিনায়ক স্ট্রসকে তখন ইংল্যান্ডের খাতায় যোগ হয়েছে ৩৯। ১৭ তম ওভারে নাঈমের জায়গায় বল করতে এসে মাহমুদুল্লাহ নিজের প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দিলেন ইংলিশদের আরেক ব্যাটিং ভরসা ইয়ান বেলকে। ৫৩ রানে তিন উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের স্পিনাররা যখন রাজত্ব কায়েমের স্বপ্ন দেখছিল তখনই দেওয়াল হয়ে দাঁড়ান ট্রট এবং ইনজুরি কাটিয়ে পিটারসেনের জায়গায় দলে ফেরা মর্গান। এ দুজন এতটাই প্রতিরোধ গড়ে তুলেন যে, ১০৯ রানের একটি দীর্ঘ পার্টনারশিপও গড়ে তুলেন দুজন।

অবশ্য এই পার্টনারশিপ এতদূর গড়াত না যদি দলীয় ৯৪ রানের মাথায় ২৭ রান করা মর্গান নাঈমের থ্রোতে রান আউটের হাত থেকে বেঁচে না যেতেন। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে নাঈম এই জুটি ভেঙ্গেছেন বটে, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মরগানের কাম ব্যাক করা ৬৩ রানের ইনিংসের সুবাদে ইংল্যান্ডের রান দুইশ পার করার পথও প্রশস্ত করে। সে সুবাদে চট্টগ্রামের মাঠে মর্গান তার আগের সর্বোচ্চ ৩৬ রান টপকে ৬৩ রানে পৌঁছে গেলেন। অবশ্য ঢাকার মাঠে বাংলাদেশের বিপক্ষে তার একটি সেঞ্চুরিও রয়েছে।

১৬২ রানের মাথায় মরগান ফিরে আসার পর দলকে ১৮২ রানে পৌঁছে দিয়ে ফিরেন জোনাথন ট্রট। ৬৭ রান করা ট্রটকে ফেরান অধিনায়ক সাকিব। ১৮২ রানের মাথায় পঞ্চম উইকেট হিসেবে ট্রট ফিরে আসার পর বাংলাদেশের পেসাররা এক রকম চেপে ধরেন ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের। ফলে শেষ পাওয়ার প্লেতে ৩৩ রান তুলতে সমর্থ হলেও হারাতে হয়েছে ২ উইকেট। শেষ পর্যন্ত ২ বল বাকি থাকতে ২২৫ রানে থামে ইংল্যান্ড।

ট্রট-মরগানের ১০৯ রানের কল্যাণে দুইশ রানের সীমানা পার হয় ইংল্যান্ড। বাংলাদেশের স্পিনাররা ভালই আটকে রাখতে সক্ষম হয় ইংলিশ ব্যাটসম্যানদের। বাংলাদেশের পক্ষে ২ টি করে উইকেট নেওয়া তিন স্পিনার যথাক্রমে রাজ্জাক, নাঈম এবং সাকিব খরচ করেছেন ৩২,২৯ এবং ৪৯। ২২৬ রানের টার্গেট। খুব কঠিন কোন লক্ষ্য নয়।

কিন্তু আগের ম্যাচে ইংলিশরা ১৭১ রান করেও দক্ষিণ আফ্রিকার মত পরাশক্তির বিপক্ষে জিতেছিল। সে দিক থেকে ২২৫ কেও বড় স্কোর মনে হতে বাধ্য। কিন্ত আগের ম্যাচের ব্যাটিং ব্যর্থতা কাটিয়ে গতকাল বাংলাদেশের শুরুটা ছিল দুর্দান্ত। দর্শকদের চাহিদার কথা মাথায় রেখে ঝড় তুলছিলেন তামিম। অপর প্রান্তে তার পার্টনার ইমরুল কায়েস ছিলেন ধীর স্থির।

কিন্তু তামিমের ২৬ বলে ৩৮ রানের ইনিংসটি যখন থামিয়ে দেন ব্রেসনান তখন বাংলাদেশের সংগ্রহ ৫২। এমন সুন্দর একটি ভিত্তির দাঁড়িয়ে নিজেদের প্রমাণ করতে পারলেননা জুনায়েদ এবং রকিবুল। বড় ইনিংস খেলার প্রত্যয় ঘোষণা করা জুনায়েদ রান আউট হলেন অবিবেচকের মত। আর রকিবুল যেভাবে বোল্ড হলেন তা প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে তার ক্রিকেট জ্ঞানকে। ৫২ রানে উদ্বোধনী জুটি ভাঙ্গার পর ৭৩ রানে পৌঁছতে আরো ২ উইকেট নেই বাংলাদেশের।

৭৩ রানে ৩ উইকেট হারানো বাংলাদেশকে টেনে নেওয়ার দায়িত্বটা এরপর তুলে নিলেন সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন ইমরুল কায়েসকে। দুজনে মিলে এগিয়েও নিয়ে যাচ্ছিলেন দলকে। এরই মধ্যে ইমরুল তার ক্যারিয়ারের সপ্তম এবং বিশ্বকাপের প্রথম হাফ সেঞ্চুরি আদায় করে নেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের হাজার রানও পূরণ করে নেন ইমরুল। কিন্তু কেন যেন ধৈর্য হারিয়ে ফেললেন শুরু থেকেই ব্যাট করা এই বাঁ হাতি।

একেবারেই অপ্রয়োজনীয় সিঙ্গেলস কে ডাবল করতে গিয়ে রান আউটের ফাঁদে পড়লেন। নিজের ৬০ রানের ইনিংসটি বৃথায় ফেলে দিয়েই শুধু আসেননি ইমরুল। সাকিবকে নিয়ে ৮২ রানের জুটিটা ভেঙ্গে দিয়ে এলেন। ১৫৫ রানের চতুর্থ উইকেট হিসেবে ইমরুল ফিরে এলেও বাংলাদেশের ইনিংসে সবচাইতে বড় ধাক্কাটা দিয়েছেন সোয়ান। অবশ্য সাকিবের এই আউটে যতটা না সোয়ানের কৃতিত্ব তার চাইতে বেশি দায়ী করতে হবে সাকিবকে।

দলের এমন অবস্থায় সাকিবকে যেখানে দলকে টেনে নেওয়ার কথা সেখানে তিনি গেলেন অফ স্টাম্পের বাইরের বল সুইপ করতে। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। সরাসরি বোল্ড হয়ে ফিরে আসেন ৩২ রান করে। সাকিব ফিরে আসার পর বাংলাদেশ দলের ব্যাটিং লাইনের উপর দিয়ে একটা ঝড় বয়ে দিয়েছেন তৃতীয় স্পেলে বল করতে এসে ইংলিশ পেসার আজমল শেহজাদ। ১৫৫ থেকে ১৬৯ এই ১৪ রানের এই মিনি সুনামিতে বাংলাদেশ হারায় ৫ উইকেট।

যার মধ্যে বিশ্বকাপে এ পর্যন্ত ব্যর্থ মুশফিক ছাড়াও নাঈম, রাজ্জাকরা রয়েছেন। ১৬৯ রানের মাথায় রাজ্জাক যখন আউট হয়ে আসেন অষ্টম উইকেট হিসেবে তখন বাংলাদেশ রীতিমত সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। যেখান থেকে হাসের বাচ্চার মত ভেসে উঠার অসম্ভব যুদ্ধটা শুরু করেছিল রিয়াদ এবং শফিউল। এক প্রান্তে শফিউল যখন অবতীর্ণ হয়েছিলেন তামিমের ভূমিকায় তখন অপর প্রান্তে রিয়াদ যেন হয়ে দাঁড়ালেন ধৈর্যের মূর্ত প্রতীক। এ দুজন অসম্ভবকে সম্ভব করার কঠিন যুদ্ধে জয়ী হয়ে সাগরের অতল গহবর থেকে বের করে নিয়ে আসলেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরো একটি হৃদয় নিংড়ানো জয়।

এ দুজনের অমৃত সুধা সম ৫৮ রানের জুটিটা বাংলাদেশকে শুধু একটি জয়ই উপহার দেয়নি বিশ্বকাপের অনেক প্রশ্নের জবাবও দিয়েছে। শফিউলের ২৪ বলে ২৪ রানের ইনিংসটা যদি হয় হীরক মূল্যের তাহলে রিয়াদের ৪২ বলে ২১ রানের ইনিংসটা হবে অমূল্য রতন। যে রতনের বদৌলতে বাংলাদেশ পেল অনেক প্রশ্নের দাঁতভাঙ্গা জবাব দেওয়া ২ উইকেটের ঐতিহাসিক এবং মহা মূল্যবান এক জয়। বাংলাদেশ দলকে অভিনন্দন

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.