সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............
সামু ব্লগের একজন লেখক/সাহিত্যিকের অকাল মৃত্যু!
ব্যাক্তিগতভাবে আমি নিজেকে একজন ‘ভালো পাঠক’ মনে করি,লেখক নয়। পড়ার নেশা আমার সেই ছোটবেলা থেকেই। গত সারেতিন বতসরাধিক আমি নিজেই ভূল বানানেও অভ্র সফটওয়ারে লিখি।
গত বছর বই মেলার আগে আমার সাথে কয়েকজন ব্লগার প্রকাশক যোগাযোগ করেন-আমার লেখার প্রসংশা করে এবং একজন “আমরা সব সময় নতুন মেধাবী লেখকদের প্রমোট করি”-উল্লেখ করে আমার ভ্রমন পোস্ট নিয়ে একটি বই প্রকাশ করার ইচ্ছার কথা জানায়। “আমি “লেখক” হতে চাইনা”- বলে ফোন রেখেদেই।
কিন্তু ওরা আমার পিছু ছাড়েনা!২/১ দিন পর পর ফুনায়!একজন বলেন-আপনি “লেখক” হতে নাচান, আমাকে ১৫ মিনিট সময় দেন-আপনার সাথে সামনা সামনি একটু কথা বলে পরিচিত হবো”। ভদ্র লোকের কথায় আমার আদি আঞ্চলিকতার প্রভাব আছে-এবং নিশ্চিত হই। একদিন সময় নির্ধারিত হলো।
এলাইড প্রকাশনীর মালিক মিঃ মজিবুর রহমান আমার অফিসে এলেন। চেহারায় ক্লাসিক্যাল প্রকাশকের ভাব।
তাঁর নেম কার্ড এবং ১৫/১৬ পৃষ্ঠার ছোট্ট একটা পুস্তিকাও আমার হাতে দিলেন-সেই পুস্তিকায় এলাইড প্রকাশনী থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত যত বই প্রকাশিত হয়েছে সেইসব বইর তালিকা লেখকদের নামসহ। ভদ্রলোক রাস্ট্রবিজ্ঞানে অনার্স করেছিলেন বি এম কলেজ থেকে এবং মাস্টার্স করেছেন ঢাবি থেকে। আমার ৪/৫ বছরের সিনিয়র। মানিকগঞ্জের বাসিন্দা হলেও বাবার চাকরী সূত্রে প্রায় বিশ বছর বৃহত্তর বরিশালেই কাটিয়েছেন। ভদ্র লোকের কথা বলায় একধরনের মাদকতা আছে,বেশকিছু মুদ্রা দোষও আছে-অন্যতম মুদ্রা দোষ হচ্ছে “আউল-ফাউল”/”বিপ্লব ঘটাইয়া দেবো”/”ফাট্টাফাট্টি” ইত্যাদি।
আলাপ চারিতা ১৫ মিনিটের যায়গায় ঘন্টা পার হয়েগেলো!নানান কথা,তাঁর হাতধরে/প্রকাশনায় প্রথম বই বেরকরে কোন কোন “আউল-ফাউল” লেখক আজ ‘বিখ্যাত’ হয়েছেন, “বিপ্লব ঘটাইয়া” ফালাইছেন, তমুক লেখকের বই মানেই “ফাট্টাফাট্টি”-ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার শেষ কথা-“আমি মনে করি আমার লেখা পাঠক পয়শা খরচ করে কিনবেনা, ফলে আপনার ব্যাবসায়ীক ক্ষতি হবে। কাজেই আমি “লেখক” হতে চাইনা। “
এবারেরমত মিঃমজিবুর রহমান হতাশ হলেও সব সময়ই আমার সাথে যোগাযোগ রাখতেন। আমার নতুন পোস্ট পড়েই ফোন করে উইশ করেন।
উনার পটানীতে আমার কোম্পানীর বাতসরিক ১৮/২০ লক্ষা টাকার বিভিন্ন প্রিন্টিং’র কাজ দিয়ে তাঁকে সহযোগীতা করছি(যদিও তাঁর কাজের মান ভালোনা)। গত নভেম্বর থেকে আবার ইনিয়ে বিনিয়ে বই প্রকাশ করার “অনুমতি” চান। একপর্যায়ে উনি এমন এক ব্যাক্তির পরিচয় দেন-যিনি আমাদের টেক্সটাইল মিল ওনার্স এশোসিয়েসনের নির্বাহী সদস্য এবং আমরা একই প্যানেলের নির্বাচিত। মজিব সাহেব তাঁর আপন ভগ্নীপতি। একদিন তাঁকে সাথে নিয়েই মজিব সাহেব আমার অফিসে হাজির।
আমি উনার অনুরোধে নিমরাজী হই।
পর দিন মজিব সাহেব এসে আমাকে জানালেন-তিনি একই সাথে আমার “তিনটি বই” প্রকাশ করবেন। একটা বই হবে চীন ভ্রমনের উপর, ২য় বইটা হবে আমেরিকা ভ্রমনের উপর এবং তৃতীয়টা হবে অন্যান্য দেশ ভ্রমনের উপর লেখা-“পাঁচ মিশালী ভ্রমন কথা”! আমি বলি-ভাই, আমারতো মনে হয়না, আমারমতো অখ্যাত এক জনের লেখা ভ্রমন কাহিনীর বই কেউ কিনে পড়বেন! উনি বলেন-কবিতা, গল্প, উপন্যাসের চাইতে হাজারগুণ বেশী “খায়” ভ্রমন কাহিনীর বই। তরুন পাঠকদের প্রথম পছন্দ ভ্রমন কাহিনী। আমি নিতান্ত বাধ্য হয়ে “এলাইড প্রকাশনী”কে আমার লেখা তিনটি বই প্রকাশের একটা খশড়া অনুমতি পত্রে সইকরে দেই-যে খশড়াটা তিনি সাথে করেই নিয়ে এসেছিলেন।
ডিসেম্বরের প্রথম দিকে আবার আমার হাতে তুলেদেন-“এলাইড প্রকাশনীর প্রকাশিত এবং প্রকাশিতব্য বই এর তালিকা-২০১১” নামক একটি চটি বই। সেই বইয়ে আমার নামে প্রকাশিতব্য তিনটি বইয়ের নাম দেখে আমি ভরকে যাই!বইগুলোর নাম আমি দেইনি-উনিই দিয়েছেন। এখন প্রায়শই মজিব সাহেব আমার অফিসে এসে বই প্রকাশের নানান প্রকৃয়ার কথা শেয়ার করেন। কত ফর্মায় কত পৃষ্ঠার বই হবে। কোন কাগজে ছাপানো বই বেশী চলে, শুধু ফেব্রুয়ারীর বই মেলাতেই কত হাজার কপি বই বিক্রি হয়-ইত্যাদি।
আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার “সৌযন্য কপি” কয় হাজার কপি লাগবে? আমি বলি-“হাজার কপি মানে!৫/১০ কপিই যথেস্ট”!উনি আমার কথা শুনে চোখদুটো ছানাবড়া করে বলেন-“কী বলেন ভাই, আপনার আত্মীয় স্বজন, ব্যাবসায়ীক বন্ধুইতো আছে কয়েক হাজার,স্টাফ আছে শত শত,আপনি কি চান তাঁরা আপনার বই কিনে পড়বেন? আপনার কি উচিত হবেনা-তাঁদের সকলকে ‘সৌযন্য কপি’ দেয়া”? আমি বলি-কাউকে বই দেবার মতো সম্পর্ক আমার সংগে তেমন কারোর নেই। এবার উনি বলেন-ইচ্ছাছিল প্রতিটা বই ৪/৫ হাজার কপি করে ছাপববো। যেহেতু আপনার সৌজন্য কপি বেশী দরকার নেই-তাই প্রতিটা বই তিন হাজার কপি করে ছাপালে কত ফর্মা কাগজ লাগবে, প্রতি রিম অপসেট পেপারের দাম কত,অফসেট কাগজে ছাপলে কি সুবিধা-ইত্যাদি। আমি বলি-“ভাই, আপনি যেভাবে ভালো হয়-সেই ভাবে করবেন, এটা আমাকে জিজ্ঞেশ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আপনার উপর আমার আস্থা আছে”।
“এলাইড প্রকাশনীর প্রকাশিত এবং প্রকাশিতব্য বই এর তালিকা-২০১১” নামক একটি চটি বইতে আমার নাম দেখেই আমি অস্থিরতায় ভূগছি! আমার মনের ভিতর একধরনের আনন্দ, ভয় এবং লজ্জা। “লেখক” হতে যাচ্ছি-তাই ‘আনন্দ’। বই যদি পাঠক নাকিনেন-তাহলে প্রকাশক বিরাট আর্থীক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন-সেই ‘ভয়’ এবং পাঠক আমার লেখা পড়ে “আউল-ফাউল” বলে গালিদিবেন-সেই ‘লজ্জা’!বিষয়টা কি ছেলেদের সাথে, স্ত্রীর সাথে শেয়ার করবো...ভাবতে পারছিনা!
জানুয়ারীর তিন তারিখ রাতে মজিব সাহেব ফোন দিয়ে জানালেন-সব কিছু ফাইনাল হয়ে গিয়েছে-ইনশআল্লাহ ফেব্রুয়ারীর এক তারিখ আপনার বই উদ্ভোধনীর দিন পাঠকদের হাতে পৌঁছে দেবো। কাল সকালে আমি আসবো-কোন বই কার নামে উতস্বর্গ করবেন-তা ঠিক করে রাখবেন। আর একটা কথা, নতুন লেখক হিসেবে কয়েকজন বিখ্যাত লেখক/সাহিত্যিকের শুভেচ্ছা বার্তা নিতে হবে।
আপনি কারকার শুভেচ্ছা বার্তা দিতে চান?আমি বলি-আমার বই প্রকাশ হলেইনা কেউ পড়বেন এবং পড়ে যদি কোনো শুভেচ্ছা বার্তা দিতেই চান-তখন তা ২য় সংস্করনে সংযুক্ত হতে পারে।
মজিবঃ “আরে ভাই, শুভেচ্ছা বার্তা কেউ বই পড়ে দেয়না, ওসব সংগ্রহ করার “তরিকা” আছে-যা কাল আপনার অফিসে এসে সামনা সামনি বলবো-আপনি কোনো চিন্তা করবেননা। দ্বায়িত্ব যখন নিয়েছি-তখন আপনাকে কস্ট দেবো কেন?”
পরদিন মজিব সাহেব আমার প্রকাশিতব্য বইয়ের মলাট/প্রচ্ছদের তিনটি ডামী কপি নিয়ে এসেছেন-আমার এপ্রুভালের জন্য। নিজেই আমার বইয়ের ‘মুখবন্ধ’ লিখে নিয়ে এসেছেন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এশ।
সাথে দুই জন বিখ্যাত লেখক এর দুটি শুভেচ্ছা বার্তার ড্রাফট কপি। লেখকদ্বয় হালের ইয়াং পাঠকদের ক্রেজ। একজনের নামের পুর্বে ডঃ আছে, অন্যজনের নামের পুর্বে ডঃ নাথাকলেও তিনিও বিখ্যাত লেখক(তার বিরুদ্ধে অন্যের হয়েও টাকার বিনিময়ে বই লেখার দূর্ণাম আছে)। অন্য একটা বইয়ের শুভেচ্ছা দিবেন “বিখ্যাত ---“......(পাঠক, আমি ভীতু মানুষ, তাই প্রথম দুইজনেরসহ কারো কারো নাম প্রকাশ করলামনা, তবে “বিখ্যাত” জনের একটু প্রাক ধারনা দিচ্ছি- এই বিখ্যাত লোকটির নামের পুর্বে প্রফেসর এবং শেষে চৌধুরী)। মিঃ মজিব বলেন-“ওনার সাথে কথা হইছে”।
আমি বলি-“কেউ বই/লেখা নাপড়ে শুভেচ্ছা বার্তা দিবে কেন”?
মজিবঃ “এজন্য উনাদের কিছু সম্মানী দিতে হয়, ওসব নিয়ে আপনি ভাববেননা-আমি ম্যানেজ করবো”।
আমিঃ “অধ্যাপক আবু সাইদ স্যার, জনাব বদুরদ্দীন ওমর আর শফিক রেহমান স্যারের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক। আমার ইচ্ছা জনাব বদরুদ্দীন ওমর, অধ্যাপক আবু সাইদ স্যার এবং শফিক রেহমান স্যারের কাছে আমার লেখার পান্ডুলিপি পড়তে দেবো, ওনারা পড়ে ভালো মন্দ যা খুশী লিখবেন-আমি তাই প্রকাশ করতে চাই”।
মজিবঃ “আরে ভাই, ঐতিন ছাগলের হাতে পান্ডুলিপি পড়তে দিলে জিন্দেগীতেও আপনি শুভেচ্ছা পাবেননা। ওরা নাপড়ে কোনো শুভেচ্ছা দেয়না-ঐ তিন বুইড়ড়া বহুত ত্যাদোড়”!
আমিঃ “কেউ বই নাপড়ে মন্তব্য করবে-তা আমি ভাবতেও পারছিনা”!
মজিবঃ “বস,আপনার ভাবাভাবির দরকার নাই-যা করার আমিই করবো।
আপনি বই উতসর্গ করবেন কার নামে? আমি ঠিক করছি একটা ভাবীর নামে আর অন্য দুইটা দুই ছেলের নামে উতসর্গ করেন”।
আমিঃ “বই বের করতে উতসর্গ করা যদি বাধ্যতামুলক হয়-তাহলে একটা বই অবশ্যই সামহোয়্যারইন ব্লগারদের নামে উতসর্গ করবো-যাদের প্রেরণায় আমার এই লেখালেখি”।
মজিবঃ “ভাই, আসেন, একটু কোলাকুলি করি-আপনার মত হৃদয়বান মানুষের পক্ষেই সম্ভব এমন উতসর্গ! আপনেরে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। পেটের ধান্ধা নাথাকলে আমি ডেইলী আপনার সাথে ২/৪ ঘন্টা থাকতাম......জ্ঞানী লোকের সাথে থাকলে হৃদয় অনেক বড় হয়! জানেন বস,আজকালকার লেখকেরা পারলে শালা/শালীর নামেই বই উতসর্গ করে বৌরে খুশী করে-আর ঘরের বাইরে হোটেলে বইস্যা লাফাংগারী করে!”
আমিঃ আমিতো জ্ঞানী লোক নই এবং আপনাকে মোটেই সময় দিতে পারতামনা-নিজের পেটের ধান্ধায়।
মজিবঃ “কি বলেন ভাই, আপনারা সোনার চামচ মুখে নিয়া জন্মাইছেন-আপনারা সময় কাটাবার জন্য ব্যাবসা করেন, আর আমরা পেটের ধান্ধায় দিন রাইত কামকরি”!
আমিঃ মজিব সাহেব, বইয়ের “মুখবন্ধ” তথা লেখকের পরিচয় যেভাবে লিখে দিয়েছেন-তা আমার মোটেই পছন্ধ হয়নি।
আমি নিজেই আমার কথা ২/৩ লাইনে লিখতে চাই......। কাল এসে লেখাটা নিয়ে যাবেন-আজ আর সময় দিতে পারছিনা।
মজিবঃ “আল্লাহরে! দেখতে দেখতে সারে এগারোটা বাইজ্জা গ্যাছে, আমারওতো অনেক কাজ। আগামী পরশু আপনার বই প্রেসে দিতে নাপারলে আমার ইজ্জত থাকবেনা। ঠিক আছে বস, আমি এখন যাই, কাল আইস্যা সব ফাইলান করে যাবো”।
পরদিন আমি অফিসের সিড়িতেই পা দিতেই মিঃ মজিব আমার সংগী হয়ে অফিসে ঢোকে। উনি আগেই ওনার গাড়ি নিয়ে আমার জন্য নীচে অপেক্ষা করছিলেন। অফিসে বসে চা খাবার ফাঁকে আমি তাঁকে দেখালাম আমি উতসর্গে কি লিখেছি। উনি দেখেতো মহা খুশী উনার “২৮ বছরের প্রকাশনা পেশায় এমন সুন্দর উতসর্গ লেখা উনি এর আগে দেখেননি”!সেই সাথে ভুয়সী প্রসংশা আমার মেধা, বিদ্যা-বুদ্ধি, শরির স্বাস্থ্য আর ব্যাবসায়ীক সাফল্যের……
মজিবঃ “বস, আমার এখন উঠতে হবে। আপনার বই’র জন্য সব কাগজ একসাথে কিনবো-তাহলে দাম কিছুটা কম পাওয়া যাবে।
বোঝেনইতো ফেব্রুয়ারী মাসে আউল ফাউল লোকেও বই বাইর করে-এই সময় মার্কেটে কাগজ পাওয়া মুশকিল। আমাকে যেতে হবে কাওরান বাজার টিকে গ্রুপের অফিসে। ওদের সাথে ফাইলান করেছি আজ ফুল পেমেন্ট দিয়ে দেবো-কাল ওরা প্রেসে কাগজ পৌঁছে দেবে। ভাই, অপসেট কাগজেই সব দিয়া দিলাম-পাঠক বই কিনে বিদেশী বই’র আমেজ পাইবে। খালি কাগজের দামই পরবে ৩ লক্ষ ৯০ হাজার টাকা”।
আমিঃ “আপনার যা ভালোমনে হয় তাই করবেন। আপনি বই ব্যাবসার সাথে জড়িত, কাজেই ভালো মন্দ আপনারাই ভালো বুঝবেন”।
মজিবঃ “বস, টাকা কি ক্যাশ দিবেন, না চেক দিবেন”?
আমিঃ “কিশের টাকা”?
মজিবঃ “ভাই, কাগজ কেনার টাকাটা আপনাকেই দিতে হবে। আমারতো সেই রকক ক্যাশ পুঞ্জি নাই, থাকলে আমি নিজেই সব খরচ করে একবারে বিল সাবমিট করতাম। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশ হাজারের উপ্রে আমি পকেট থেকে খরচা করে ফেলেছি।
আপনি বাবুল ভাইর বন্ধু,আপনার কাছথেকে এডভান্স টাকা নিতে আমারই খারাপ লাগছে”!
আমিঃ “মজিব সাহেব, প্রকাশনা আপনাদের ব্যাবসা। পান্ডুলিপি পড়ে আপনারা বুঝবেন-বই ছাপালে আপনাদের লাভ হবে, না লোকসান হবে। লাভ করার জন্যই আপনারা ইনভেস্ট করবেন। আমি জানি-নতুন লেখকদের বই’র জন্য কোনো রয়ালিটি দেননা। আমি বই’র ব্যাবসা করিনা, লেখক হবার যোগ্যতাও আমার নেই-যা আমি আপনাকে প্রথম থেকেই বলে আসছি।
নিজের টাকায় বই ছাপিয়ে বন্ধুদের বিলিয়ে নাম কামানোরমতো মানষিকতা আমার নেই”।
আমার কথাশুনে মজিব সাহেবের চেহারা এবং ভাষা সম্পুর্ণ অন্যরকম হয়ে যায়। তিনি চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলেন-“আপনি কি নিজেরে হুমায়ুন আহমেদ, ডঃ জাফর ইকবাল ভাবেন-যে আপনারমতো ‘আউল-ফাউল’ লোকের বই ছাপার জন্য পাবলিশার্স আপনারে আগাম টাকা দিয়া আপনার পিছপিছ ঘোরবে?দুনিয়ার সব নতুন লেখকরা নিজ টাকায় বই ছাপাইয়া লেখক হয়”।
আমিঃ “মজিব সাহেব, আপনি খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছেন। আপনাকে আমি আমার বই ছাপার জন্য কোনোদিন রিকোয়েস্ট করিনি।
আপনি গত দুইবছর ধরে আমার লেখা বই “হট কেকেরমত পাঠক কিনবে”-সেইজন্যই আপনি নিজের ব্যাবসার জন্য আমার পান্ডুলিপি ব্লগ থেকে নিয়ে নিজের ইচ্ছামত সাজিয়ে নিজেই বই’র নাম দিয়েছেন। আপনি বাবুল সাহেবের ভগ্নীপতি বলেই আপনাকে দিনেরপর দিন সময় দিয়েছি, অফিসের সব প্রিন্টিং’র কাজ আপনাকে দিয়েছি-আপনার ব্যাবসায়ীক উপকার হবে ভেবেই”।
মজিব সাহেব ধপাস করে আবার বসে পরলেন। কতক্ষণ নিরব থাকারপর বলেন-“ভাই, বুজ্জি!যা হবার তাতো হইছেই, আমারই কপাল খারাপ। তিন হাজার কপি করে নয়, এক হাজার কপি করে তিনিটি বই আপাতত ছাপাই, যদি বই ভালো “খায়”-তাইলে ২য় সংস্করনে আবার এক হাজার কপি করে ছাপাবো।
ঠিক আছে আপনি দুই লাখ টাকা দেন-আমি বাকিটা ব্যাবস্থা করছি”।
আমিঃ “আপনি এতো দিন বলে আসলেন-তিন হাজার কপি করে ছাপালে শুধু ফেব্রুয়ারী মাসেই সব বই বিক্রি হয়ে যাবে……”
মজিবঃ “আমি চ্যালেঞ্জ করছি-আপনি তিন হাজার কপি করে বই ছাপান, আমি ফেব্রুয়ারীর ২৮ তারিখ রাত্রেই আপনার সব ইনভেস্টমেন্ট ফিরিয়ে দেবো। আমি যদি তখন দুই লাখ টাকা লাভ করি-তাদেইখ্যা আবার পস্তাইবেন্না। আমি আপনারে ২৮ তারিখের এডভান্স চেক লিখেদিচ্ছি!দেন টাকা দেন…”
আমিঃ “মজিব ভাই, আমি পকেটের টাকা খরচ করে বই ছাপিয়ে “লেখক” হতে চাইনা”।
মজিবঃ “আরে ভাই সবাইতো এইডাই করে।
কত মানুষ আছে-যারা অন্যের দ্বারা ১২/১৪ টা ‘আউল ফাউল’ কবিতা, ‘আউল ফাউল’ কিছু লিখে বই ছাপায়-আর নিজেকে ‘ছয়টা কবিতার বই ও তিনটি উপন্যাসের জনক’ পরিচয় দেবার জন্য লাইন দিয়া বইস্যা থাকে। এই ব্লগে যাদের বই ছাপানোর বিজ্ঞাপন দেখেন-হ্যারা সবাই বাপের টাকায় বই ছাপাইতাছে, প্রমান চাইলে কন-এইখানেই বইস্যা সব ব্যাটাদের নাম বইল্যা দিমু কে কয় কপি বই ছাপাইয়া কবি/সাহিত্যিক হইছে”।
আমিঃ মজিব ভাই, স্যরি, আপনার সাথে আর কথা বলতে চাইনা। আপনার ব্যবসা হইলে বই ছাপাবেন, নাহলে নাছাপাবেননা-আপনার কাছতো পান্ডুলিপি আছেই……
মজিবঃ “ভাই, আমার ৫০/৬০ হাজার টাকা ইতোমধ্যে খরচ হইয়া গ্যাছে। আপ্নে আমারে এক লাখ টাকা দেন-আমি একটা ব্যাবস্থা করতাছি।
বই ছাপানো হইলে আপনি ইচ্ছা হইলে টাকা দিয়েন, ইচ্ছা নাহইলে দিবেননা। জীবনে এই হাতদিয়া বহুত টাকা কামাইছি, আপনার কামকইররা নাহয় লোকসানই দিলাম। তবুও মনেরে শান্তনা দেবো-আপ্নার বইগুলা আমিই ছাপাইয়া দিয়া আপ্নেরে দেশের একজন বড় সাহিত্যিক বানাইছি”।
আমিঃ “মজিব ভাই, আপনি আমার বই ছাপানোর কথা বলার পুর্বে আমি কখনোই কল্পনা করিনি-আমার বই বেরহবে। আপনি জোড় করে আমাকে লেখক বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
আমার সেই লেখক হবার স্বপ্নের এক্ষনি মৃত্যু হলো। নিজের পয়শায় বই ছাপিয়ে “লেখক” হওয়াটা আমার কাছে লজ্জার, আমি এইকাজ করতে পারবোনা। বই ছাপিয়ে আমি নাম ফুটাতে চাইনা। দয়া করে আপনি যান”।
"বইয়ের দাম বেশি তাই বই কেনা যাচ্ছে না, আবার বইয়ের বিক্রি কম তাই দাম কমানো যাচ্ছে না"-সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর 'বই কেনা' প্রবন্ধে প্রকাশক ও পাঠকের মধ্যকার এমনই একটি দুষ্টচক্রের কথা উল্যেখ করেছিলেন।
আমাদের দেশের একজন মানুষের সীমিত আয়ের মধ্যেও বই কিনে পড়া মোটামুটি কস্ট সাধ্যই বলাযায়। অবশ্য এখন আমাদের সমাজে নব্য ধনিক শ্রেনীর আবির্ভাব হয়েছে-যারা প্রচুর দেশী বিদেশী সুদৃশ্ব্য মলাটের বই কিনে ঘরের শোভা বর্ধন করেন-কিন্তু কোনো দিন সেইসব বইয়ের একটা পৃষ্ঠাও উল্টিয়ে দেখেননা। এখন দেখছি-একশ্রেনীর লোক “আউল-ফাউল” লিখে পকেটের টাকা ব্যয় করে নিজ নামে বই ছাপিয়ে পরিচিতজনদের “সৌজন্য কপি” বিলি করে “লেখক” হবার প্রতিযোগীতায় নেমেছে।
প্রিয় পাঠক, আসুন সামহোয়্যারইনব্লগের একজন লেখকের অকাল মৃত্যুতে সকলে তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।