আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফেরাউনের সংরক্ষিত লাশঃ মানবজাতির সামনে বড় এক নিদর্শন

নিজের সম্পর্কে কিছু বলার মত নাই। এক কথায বলতে গেলে উদ্দেশহীন ভাবে বেচে থাকা এক অলস যুবক।

হযরত মূসা এবং তাঁর অনুসারীদের মিসর ত্যাগের ঘটনাটি ধর্মগ্রন্থের আলোকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঐতিহাসিক বিচারেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে ইহুদিরা মিসর ত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং ইহুদীদের বিতাড়ণকারী একজন ফেরাউনের নীলনদে সলিল সমাধি ঘটে। তবে মাঝেমধ্যে অবিশ্বাসীরা গলাটান দেয় এই বলে যে, ধর্মগ্রন্থের এসব বর্ণনা নিছক উপকথা।

কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণী শুধু সঠিকই নয়, বরং এক ব্যাখ্যাতীত নির্ভুল সঠিকত্বে তা বিশ্বাসীদের মনকে দ্রবীভূত করে। আল-কুরআনে এই ঐতিহাসিক বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে। ফেরাউনের সাথে হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হযরত হারুন (আঃ)-এর এবং ইহুদিদের মিসর ত্যাগের ঘটনাবলী নিয়ে আল-কুরআনের দশটিরও বেশি সুরায় দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। ইহুদীদের নির্যাতনকারী মিসরীয় রাজার উপাধি হলো ফেরাউন। এই ফেরাউন নামটি কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে ঐতিহাসিকভাবে অনেক ফেরাউনের সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু কুরআনে মিসররাজ ফেরাউনের প্রকৃত নাম উল্লেখ করা হয়নি। কুরআন থেকে শুধু এটুকুই জানা যায় যে, মূসাকে (আঃ) রাসূল হিসেবে অবিশ্বাসী ফেরাউনের একজন উপদেষ্টা ছিলেন ‘হামান’। কুরআনে এই হামানের নাম ছযবার উল্লেখ করা হয়েছে। এবার আমরা কুরআনের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে জানার চেষ্টা করি।

ফেরাউন ছিল ইহুদি উৎপীড়কঃ “যখন মূসা বলিয়াছিলেন তাঁহার লোকজনদিগকেঃ স্মরণ কর, আল্লাহর সেই অনুগ্রহ তোমাদের প্রতি। এই অনুগ্রহ তিনি দিয়াছিলেন ফেরাউনের লোকজনের হাত হইতে তোমাদের মুক্ত করিতে। তাহারা তোমাদের উপর নিদারুণ নিপীড়ন চালাইত, তোমাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করিত এবং জীবিত রাখিত তোমাদের মহিলাদের। ” (সূরা ১৪, আয়াত ৬) শিশুনবী মূসা (আঃ) ছিলেন ইহুদি। তাঁকে ফেরাউনের সৈনিকদের ভয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল।

কুরআনের ২০নং সূরায় এবং ২৮ নং সূরার ৭ থেকে ১৩নং আয়াতে এ কাহিনী বর্ণিত আছে। প্রচলিত কাহিনী হলো, ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশুনবী মূসাকে (আঃ) লালন-পালন করেছিলেন। ফেরাউনের পরিবারের লোকজন মূসা নবীকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। “ফেরাউনের পরিবার তাহাকে তুলিয়া লইল। (ইহাই ছিল অভিপ্রায়) যে, মূসা তাহাদের বিরুদ্ধবাদী হইবে এবং তাহাদিগকে আজাবে ফেলিবে।

ফেরাউন, হামান এবং তাহাদের লোকজনেরা ছিল পাপাচারী। ফেরাউনের স্ত্রী কহিলেন, (সে হইবে) চোখের আনন্দ আমার ও তোমার জন্য। তাহাকে হত্যা করিও না। সে আমাদের কাজে লাগিতে পারে; অথবা আমরা তাহাকে পুত্র হিসাবেও গ্রহণ করিতে পারি। তাহারা ধারণা করিতে পারে নাই (সামনে কি হইবে।

” যৌবনে হযরত মূসা ফেরাউন ও তার অনুচরদের ভয়ে একাকী মাদিয়ানে চলে যান। মাদিয়ানে তাঁর অবস্থান এবং বিবাহ সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে কুরআনের ২৮ নং সূরার ১৩ থেকে ২৮নং আয়াতে। একসময় আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ) কে ফেরাউনের কাছে যাওয়ার এবং তাঁর ভাইদের (ইহুদীদের) মিসর থেকে বের করে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের কাছে মোজেজা প্রদর্শন করেও ফেরাউনকে দ্বীনে আনতে ব্যর্থ হোন। এরপর তিনি ইহুদিদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করার জন্য সংকল্প করেন।

কিন্তু “ফেরাউন তাহাদের ধাওয়া করিতেছিল নিজের লোকলশকরসহ এবং সমুদ্র তাহাদের ঢাকিয়া ফেলিল। ” (সূরা ২০, আয়াত ৭৮) কিন্তু ইহুদিরা রক্ষা পেয়ে গেল- ধ্বংস হয়ে গেল ফেরাউন। “আমি পার করাইয়া নিলাম বণী ইসরাইলকে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে। ফেরাউন ও তাহার লোকলশকর তাহাদিগকে ধাওয়া করিতেছিল- বিদ্রোহ ও আক্রোশবশত শেষ পর্যন্ত যখন সে ডুবিয়া যাইতে বসিল, বলিলঃ আমি ঈমান আনিলাম আর কোন মাবুদ নাই সেই আল্লাহ ছাড়া-যাঁহার উপরে বণী ইসরাঈল বিশ্বাসী। আমিও তাহাদের শামিল যাহারা তাঁহার প্রতি আত্মসমর্পণকারী।

” “আল্লাহ বলিলেন, কি? তুমি বিদ্রোহ করিয়াছ, নীতিভ্রষ্টতার কারণ হইয়াছ। এখন আমি তোমাকে টিকাইয়া রাখিব তোমার লাশের মাধ্যমে। যাহাতে তুমি নিদর্শন হইতে পার তাহাদের জন্য যাহারা তোমার পরে আসিবে। তবে, নিশ্চয় মানবজাতির অনেকেই আমার নির্দশনাবলী সম্পর্কে গাফেল। ” (সূরা ১০- আয়াত ৯০-৯২) উপর্যুক্ত আয়াতগুলো স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে যে, রাসূল মূসা (আঃ) ফেরাউনকে সৎ পথে আনবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফেরাউন আক্রোশবশতঃ তার বিদ্রোহী হয়েছে।

ফেরাউন সমুদ্রে ডুবে মরার সময় আল্লাহকে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু তখন আর তার আনুগত্য গ্রহণ করা হয়নি। সে মারা গেল। তার লাশটি সংরক্ষণ করা হলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তবে মানব জাতির অনেকেই এসবের কোন খবর না রেখে নিজেদের খেয়াল-খুশি ভোগ-উপভোগ নিয়েই মত্ত। এখানে আরেকটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

বাইবেলের পুরাতন নিয়মেও (প্রচলিত তাওরাত, যবুর) ইহুদিদের মিসর ত্যাগ এবং ফেরাউনের নীল নদে ডুবে মরার কথা উল্লেখ আছে। এইসব বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রেই কোরআনের অনুরূপ। তবে কিছু কিছু ভিন্নতাও আছে। মূসার (আঃ) জন্ম বৃত্তান্ত কুরআন ও বাইবেলে অভিন্ন। কিন্তু বাইবেল বলছে শিশু মূসাকে (আঃ) কুড়িয়ে পেয়েছিল ফেরাউনের কন্যা।

মুসাকে (আঃ) লালন-পালনের প্রক্রিয়াও অভিন্ন। বাইবেল মতে, ফেরাউন ইহুদিদের দুটি নগরী পিথম ও রামিষেষ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলো। মিসর ত্যাগের সময় ইহুদীরা “রামিসেস নগরী” থেকে জোট বেঁধে একযোগে বেরিয়ে পড়ে এবং মহিলা ও শিশুদের ছাড়াই তাদের সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞই এই বিশাল সংখ্যাটিকে অস্তিতজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা হোক, এই পর্যায়ে ফেরাউন- “আপন রথ প্র‘ত করাইলেন ও আপন লোকদের সঙ্গে লইলেন।

----- মিসররাজ ফেরৌন ----- ইস্রায়েল সন্তানদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, তখন ইস্রায়েল-সন্তানেরা ঊর্ধ্বহস্তে বহির্গমন করিতেছিল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬-৮) ফেরাউনের নেতৃত্বে মিসরীয়রা সমুদ্রের পাড়ে হজরত মূসার লোকজনদেরকে ধরে ফেলার উপক্রম করল। হজরত মূসা তাঁর লাঠি তুলে নির্দেশ দিলেন- সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গেল। তাঁর অনুসারীরা হেঁটে সমুদ্র অতিক্রম করল। তাদের পা পর্যন্ত ভিজল না।

“পরে মিস্রীয়েরা, ফরৌনের সকল অশ্ব ও রথ এবং অশ্বারূঢ়গণ ধাবমান হইয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবেশ করিল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৩) “জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল। তাহাতে ফরৌনের সে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না। কিন্তু ইস্রায়েন সন্তানেরা শুষ্ক পত্রে সমুদ্রের মধ্য দিয়া চলিল এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীরস্বরূপ হইল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯) অর্থাৎ বাইবেলের মতে, ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউন যে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল’ তাতে কোন সন্দেহ নাই।

কিন্তু ফেরাউনের লাশের ব্যাপারে বাইবেল কোন ইংগিত দেয় না। তবে মিসররাজ ফেরাউনের প্রকৃত নাম-পরিচয় অনুসন্ধানে বাইবেলের কিছু কিছু তথ্য আমাদের সাহায্য করে। বাইবেল থেকে আরেকটি তথ্য জানা যায়। বাইবেলের মতে হজরত মূসার (আঃ) জীবদ্দশার বিভিন্ন ঘটনার সাথে দুইজন ফেরাউন সম্পৃক্ত। যে ফেরাউন মুসাকে (আঃ) লালন-পালন করেছিলেন, সে মুসার (আঃ) মাদিয়ানে অবস্থানের সময় মারা যায়।

মাদ্রিয়ান থেকে মিসরে ফিরে এসে মুসা (আঃ) আগের ফেরাউনের উত্তরাধিকারীর সাথে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে যান। যে ফেরাউন সমুদ্রে ডুবে মারা যায়, সে মুসার লালন-পালনকারী নয়। উল্লেখ্য, ফেরাউন মিসররাজের উপাধি, কোন নাম নয়। ফারাও বংশের সকল মিসররাজকেই ফেরাউন নামে ডাকা হয়। মোটামোটি নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, ইহুদীয়া মিসরে বসবাস করেছিল মোটামুটিভাবে ৪০০ অথবা ৪৩০ বছর।

পি· র্মতে থেকে শুরু করে জ্যানিয়েল রপস্‌ পর্যন্ত আধুনিক ভাস্যকারবৃন্দ মনে করেন যে, হযরত ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের মিসর গমন এবং হাইক্‌সম্‌ রাজবংশের মিসর অধিকারের ঘটনা খুব সম্ভব একই সময়ের। বাইবেলের হিসাব থেকে পাওয়া যায়, জুহুদিদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল মোটামুটিভাবে খ্রীস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে। ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও সাংকেতিক চিত্রলিখন পদ্ধতিতে রচিত (হাইয়ারোগ্লিফিক) এমন কিছু দলিলপত্র পাওয়া যাচ্ছে- যাতে দেখা যায় এককালে মিসরে এমন এক ধরনের শ্রমিক ছিল যাদের বলা হত আপিরু, হাপিরু অথবা হাবিরু। এই শ্রমিক শ্রেণীকেই হিসু বা ইহুদী হিসেবে সনাক্ত করা হয়। সাধারণত এই শ্রেণীর শ্রমিক রাজমিস্ত্রি, কৃষক-মজুর অথবা ফসল কাটার কামলা হিসাবে কাজ করত।

যাহোক, ধর্মতত্ত্বাবিধ ও ইতিহাসবিদদের পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে এই যে হিসু (ইহুদী বাইবেলের বর্ণনামতে) অথবা এই যে আপিরু (সাংকেতিক ভাষার রচনা মতে) এদের ফেরাউনের নির্দেশ মোতাবেক বড় বড় কাজে লাগানো হয়ে থাকে। এসব শ্রমিক সবাই ছিল জবরদস্তির শিকার। বাইবেলে উল্লেখিত রামেসিস ও ‘পিথমনগরী’ নীল-বদ্বীপের পূর্বঅঞ্চলে অবস্থিত ছিল। অধুনা তামিস ও কানতির বলে পরস্পর মাইল পনেরো ব্যবধানে যে দু’টি নগরী মিসরে বিদ্যমান, উল্লেখিত দুটি প্রাচীন নগরী এই দুই স্থানেই অবস্থিত ছিল। আর এই স্থানেই দ্বিতীয় রামেসিস কতৃêক স্থাপিত হয়েছিল উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী।

গত কয়েক দশক ধরে এই এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নিজের নামে এই নগরী নির্মাণেই ফেরাউন রামেসিস কৃতদাসে পরিণত ইহুদীদের কাজে লাগিয়ে ছিলেন। সুতরাং দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদী নিপীড়ক সেই ফেরাউন, যিনি ইহুদীদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করতেন। একজন খ্রিস্টধর্মতত্ত্বাবিধ ফাদার ডি-ভক্স-এর অভিমত, দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদীদের মিসর ত্যাগকালীন ফেরাউন। তিনি তাঁর “দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইসরাঈল” পুস্তকে তাঁর অনুমানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।

তবে তাঁর এই অনুমান খোদ বাইবেলের বর্ণনার সাথেই সামঞ্জস্য রক্ষা করছে না। তিনি কেবল একটা দিক দেখেছেন। তিনি তাঁর অনুমানের ভিত্তি হিসাবে বাইবেলের এই বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন যে, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে তার দ্বারাই রামেষিষ ও পিথম নগরীদ্বয় নির্মিত হয়েছিল। এর দ্বারা অবশ্য একথা প্রমাণ হয় যে, দ্বিতীয় রামেসিসের আগে এই দুটি নগরী নির্মিত হতে পারে না এবং দ্বিতীয় রামেসিসের আগের কোন ফেরাউনের আমলে ইহুদীদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটতে পারে না। যদি কোন কোন গবেষক দ্বিতীয় রামেসিসের আগের ফেরাউনদেরও ইহুদী বিতাড়নকারী এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণকারী ফেরাউন হিসেবে সনাক্ত করার চেষ্টা করে গেছেন।

কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট তথ্যবহুল না হওয়াতে বাধ্য হয়েই সরিয়ে রাখতে হয়। তবে ফাদার ডি মুসার (আঃ) সাথে শত্রুতা পোষণকারী এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণকারী ফেরাউন হিসেবে দ্বিতীয় রামেসিসকেই সনাক্ত করার দাবি করেছেন। কিন্তু তার এই দাবির পিঠে দুটি প্রশ্ন কিন্তু অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমতঃ বাইবেলের যাত্রা পুস্তকে (২-২৩) বর্ণিত আছে হযরত মুসা যখন মাদিয়ানে তখন মিসররাজ মৃত্যুবরণ করেন। যাত্রাপুস্তফের বর্ণনামতে এই মৃত্যুবরণকারী মিসররাজ হচ্ছেন তিনিই যিনি জবরদস্তিমূলকভাবে ইহুদী শ্রমিকদের দিয়ে রামেসিস পিথম নগরী দুটি নির্মাণ করেছিলেন।

আর এই ফেরাউন যদি দ্বিতীয় রামেসিস হয়ে থাকেন তা হলে কেবলমাত্র তার উত্তরাধিকারীর আমলেই ইহুদীদের মিসর ত্যাগ সম্ভব হতে পারে। বাইবেলের বর্ণনামতে, মুসার (আঃ) জীবদ্দশায় দুইজন ফেরাউনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল। ইহুদিদের নির্যাতনকারী এবং শিশু মুসার (আঃ) পালনকারী ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। অথচ বাইবেলের মতে, হজরত মুসা (আঃ) মাদিয়ানে অবস্থানকালেই দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যু ঘটে। তো বলা যায়, মুসার (আঃ) সাথে ঘটনা দুর্ঘটনায় জড়িত ফেরাউন দুইজন, একজন নয়।

আর আল কুরআনও এর বিরোধিতা করে না। সবদিক বিবেচনা করে বিখ্যাত গবেষক ডঃ মরিস বুকাইলি বলেন-সুতরাং হযরত মুসার জীবদ্দশাতেই তিনি যখন মাদিয়ানে ছিলেন, তখন এক ফেরাউনের মৃত্যু হয় এবং অপর ফেরাউন মৃত্যুবরণ করেন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের কালে। অতএব একজন নয়, হযরত মুসার আমলে আমরা পাচ্ছি দুজন ফেরাউন একজন নির্যাতনের কালের অন্যজন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের সময়কার। সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশেস্নষণ করে ডঃ মরিস বুকাইলি নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ক) (মিসরের দ্বিতীয় অধিপতি) রামেসিসের সিংহাসন আরোহণের পূর্বে ইহুদীদের মিসর ত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না।

খ) হযরত মুসা এমন এক ফেরাউনের আমলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন-যিনি রামেসিস ও পিথম নগরী নির্মাণ করেন। তিনিই হচ্ছেন দ্বিতীয় রামেসিস। গ) হযরত মুসার মাদিয়ানে অবস্থানকালে ক্ষমতাসীন ফেরাউনের (অর্থাৎ দ্বিতীয় রামেসিসের) মৃত্যু ঘটে এবং হযরত মুসার জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলী সংঘটিত হয় দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহর রাজত্বকালে। ইতিহাসের নিদর্শনাবালীর সংরক্ষণ সবারই কাম্য। কিন্তু যে মমিটির সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে তা শুধু নিছক কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এ মমিটির গুরুত্ব তার চেয়েও অনেক বেশি।

এটি এমন একজন মানুষের মরদেহ হযরত মুসার সাথে যার পরিচয় হয়েছিল, সে মানুষটি হযরত মুসার ধর্মীয় প্রচার প্রতিহত করতে চেয়ে ছিল এবং হযরত মুসা যখন ইহুদীদের নিয়ে মিসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সেই লোকটিই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছিল। আর ধাওয়া করতে গিয়েই মারা পড়েছিল সমুদ্রের পানিতে ডুবে। আল্লাহর ইচ্ছাতেই তার মরদেহ ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছে এবং কোরআনের বাণী অনুসারেই ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য তা নিদর্শন হিসাবে রয়ে গেছে সংরক্ষিত। এ যুগের অনেকেই আধুনিক তথ্য প্রমাণের আলোকে ধর্মীয় গ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনায় সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে চান তাদের কাছে অনুরোধ তারা যেন মেহেরবানী করে কায়রো গমন করেন এবং তথাকার মিসরীয় জাদুঘরে ‘রয়্যাল মামিজ,’ কক্ষে, সংরক্ষিত ফেরাউনের এই মমিটি দর্শন করে আসেন। আর তা হলেই তারা বুঝতে পারবেন কোরআনের আয়াতে ফেরাউনের মরদেহ সংরক্ষণের যে বর্ণনা রয়েছে তার বাস্তব উদাহরণ কত জাজ্জ্বল্যমান।

হযরত মূসা এবং তাঁর অনুসারীদের মিসর ত্যাগের ঘটনাটি ধর্মগ্রন্থের আলোকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ঐতিহাসিক বিচারেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই ঘটনার মধ্যদিয়ে ইহুদিরা মিসর ত্যাগ করতে সক্ষম হয় এবং ইহুদীদের বিতাড়ণকারী একজন ফেরাউনের নীলনদে সলিল সমাধি ঘটে। তবে মাঝেমধ্যে অবিশ্বাসীরা গলাটান দেয় এই বলে যে, ধর্মগ্রন্থের এসব বর্ণনা নিছক উপকথা। কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞানের কষ্টিপাথরে এবং নির্মোহ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের বাণী শুধু সঠিকই নয়, বরং এক ব্যাখ্যাতীত নির্ভুল সঠিকত্বে তা বিশ্বাসীদের মনকে দ্রবীভূত করে। আল-কুরআনে এই ঐতিহাসিক বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা স্থান পেয়েছে।

ফেরাউনের সাথে হযরত মূসা (আঃ) ও তাঁর ভাই হযরত হারুন (আঃ)-এর এবং ইহুদিদের মিসর ত্যাগের ঘটনাবলী নিয়ে আল-কুরআনের দশটিরও বেশি সুরায় দীর্ঘ বর্ণনা রয়েছে। ইহুদীদের নির্যাতনকারী মিসরীয় রাজার উপাধি হলো ফেরাউন। এই ফেরাউন নামটি কুরআনের ২৭টি সূরায় ৭৪ বার উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঐতিহাসিকভাবে অনেক ফেরাউনের সাথে আমরা পরিচিত। কিন্তু কুরআনে মিসররাজ ফেরাউনের প্রকৃত নাম উল্লেখ করা হয়নি।

কুরআন থেকে শুধু এটুকুই জানা যায় যে, মূসাকে (আঃ) রাসূল হিসেবে অবিশ্বাসী ফেরাউনের একজন উপদেষ্টা ছিলেন ‘হামান’। কুরআনে এই হামানের নাম ছযবার উল্লেখ করা হয়েছে। এবার আমরা কুরআনের বর্ণনা ধারাবাহিকভাবে জানার চেষ্টা করি। ফেরাউন ছিল ইহুদি উৎপীড়কঃ “যখন মূসা বলিয়াছিলেন তাঁহার লোকজনদিগকেঃ স্মরণ কর, আল্লাহর সেই অনুগ্রহ তোমাদের প্রতি। এই অনুগ্রহ তিনি দিয়াছিলেন ফেরাউনের লোকজনের হাত হইতে তোমাদের মুক্ত করিতে।

তাহারা তোমাদের উপর নিদারুণ নিপীড়ন চালাইত, তোমাদের পুত্রসন্তানদের হত্যা করিত এবং জীবিত রাখিত তোমাদের মহিলাদের। ” (সূরা ১৪, আয়াত ৬) শিশুনবী মূসা (আঃ) ছিলেন ইহুদি। তাঁকে ফেরাউনের সৈনিকদের ভয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল। কুরআনের ২০নং সূরায় এবং ২৮ নং সূরার ৭ থেকে ১৩নং আয়াতে এ কাহিনী বর্ণিত আছে। প্রচলিত কাহিনী হলো, ফেরাউনের স্ত্রী বিবি আছিয়া শিশুনবী মূসাকে (আঃ) লালন-পালন করেছিলেন।

ফেরাউনের পরিবারের লোকজন মূসা নবীকে কুড়িয়ে পেয়েছিল। “ফেরাউনের পরিবার তাহাকে তুলিয়া লইল। (ইহাই ছিল অভিপ্রায়) যে, মূসা তাহাদের বিরুদ্ধবাদী হইবে এবং তাহাদিগকে আজাবে ফেলিবে। ফেরাউন, হামান এবং তাহাদের লোকজনেরা ছিল পাপাচারী। ফেরাউনের স্ত্রী কহিলেন, (সে হইবে) চোখের আনন্দ আমার ও তোমার জন্য।

তাহাকে হত্যা করিও না। সে আমাদের কাজে লাগিতে পারে; অথবা আমরা তাহাকে পুত্র হিসাবেও গ্রহণ করিতে পারি। তাহারা ধারণা করিতে পারে নাই (সামনে কি হইবে। ” যৌবনে হযরত মূসা ফেরাউন ও তার অনুচরদের ভয়ে একাকী মাদিয়ানে চলে যান। মাদিয়ানে তাঁর অবস্থান এবং বিবাহ সংক্রান্ত বর্ণনা রয়েছে কুরআনের ২৮ নং সূরার ১৩ থেকে ২৮নং আয়াতে।

একসময় আল্লাহ হযরত মূসা (আঃ) কে ফেরাউনের কাছে যাওয়ার এবং তাঁর ভাইদের (ইহুদীদের) মিসর থেকে বের করে নিয়ে আসার নির্দেশ দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) ফেরাউনের কাছে মোজেজা প্রদর্শন করেও ফেরাউনকে দ্বীনে আনতে ব্যর্থ হোন। এরপর তিনি ইহুদিদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করার জন্য সংকল্প করেন। কিন্তু “ফেরাউন তাহাদের ধাওয়া করিতেছিল নিজের লোকলশকরসহ এবং সমুদ্র তাহাদের ঢাকিয়া ফেলিল। ” (সূরা ২০, আয়াত ৭৮) কিন্তু ইহুদিরা রক্ষা পেয়ে গেল- ধ্বংস হয়ে গেল ফেরাউন।

“আমি পার করাইয়া নিলাম বণী ইসরাইলকে সমুদ্রের মধ্য দিয়ে। ফেরাউন ও তাহার লোকলশকর তাহাদিগকে ধাওয়া করিতেছিল- বিদ্রোহ ও আক্রোশবশত শেষ পর্যন্ত যখন সে ডুবিয়া যাইতে বসিল, বলিলঃ আমি ঈমান আনিলাম আর কোন মাবুদ নাই সেই আল্লাহ ছাড়া-যাঁহার উপরে বণী ইসরাঈল বিশ্বাসী। আমিও তাহাদের শামিল যাহারা তাঁহার প্রতি আত্মসমর্পণকারী। ” “আল্লাহ বলিলেন, কি? তুমি বিদ্রোহ করিয়াছ, নীতিভ্রষ্টতার কারণ হইয়াছ। এখন আমি তোমাকে টিকাইয়া রাখিব তোমার লাশের মাধ্যমে।

যাহাতে তুমি নিদর্শন হইতে পার তাহাদের জন্য যাহারা তোমার পরে আসিবে। তবে, নিশ্চয় মানবজাতির অনেকেই আমার নির্দশনাবলী সম্পর্কে গাফেল। ” (সূরা ১০- আয়াত ৯০-৯২) উপর্যুক্ত আয়াতগুলো স্পষ্ট নির্দেশ দিচ্ছে যে, রাসূল মূসা (আঃ) ফেরাউনকে সৎ পথে আনবার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ফেরাউন আক্রোশবশতঃ তার বিদ্রোহী হয়েছে। ফেরাউন সমুদ্রে ডুবে মরার সময় আল্লাহকে বিশ্বাস করেছিল, কিন্তু তখন আর তার আনুগত্য গ্রহণ করা হয়নি। সে মারা গেল।

তার লাশটি সংরক্ষণ করা হলো পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তবে মানব জাতির অনেকেই এসবের কোন খবর না রেখে নিজেদের খেয়াল-খুশি ভোগ-উপভোগ নিয়েই মত্ত। এখানে আরেকটি কথা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বাইবেলের পুরাতন নিয়মেও (প্রচলিত তাওরাত, যবুর) ইহুদিদের মিসর ত্যাগ এবং ফেরাউনের নীল নদে ডুবে মরার কথা উল্লেখ আছে। এইসব বর্ণনা অনেক ক্ষেত্রেই কোরআনের অনুরূপ।

তবে কিছু কিছু ভিন্নতাও আছে। মূসার (আঃ) জন্ম বৃত্তান্ত কুরআন ও বাইবেলে অভিন্ন। কিন্তু বাইবেল বলছে শিশু মূসাকে (আঃ) কুড়িয়ে পেয়েছিল ফেরাউনের কন্যা। মুসাকে (আঃ) লালন-পালনের প্রক্রিয়াও অভিন্ন। বাইবেল মতে, ফেরাউন ইহুদিদের দুটি নগরী পিথম ও রামিষেষ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলো।

মিসর ত্যাগের সময় ইহুদীরা “রামিসেস নগরী” থেকে জোট বেঁধে একযোগে বেরিয়ে পড়ে এবং মহিলা ও শিশুদের ছাড়াই তাদের সংখ্যা ছিল ছয় লক্ষ। প্রায় সমস্ত বিশেষজ্ঞই এই বিশাল সংখ্যাটিকে অস্তিতজ্ঞান হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যা হোক, এই পর্যায়ে ফেরাউন- “আপন রথ প্র‘ত করাইলেন ও আপন লোকদের সঙ্গে লইলেন। ----- মিসররাজ ফেরৌন ----- ইস্রায়েল সন্তানদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন, তখন ইস্রায়েল-সন্তানেরা ঊর্ধ্বহস্তে বহির্গমন করিতেছিল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ৬-৮) ফেরাউনের নেতৃত্বে মিসরীয়রা সমুদ্রের পাড়ে হজরত মূসার লোকজনদেরকে ধরে ফেলার উপক্রম করল।

হজরত মূসা তাঁর লাঠি তুলে নির্দেশ দিলেন- সমুদ্র দু’ভাগ হয়ে গেল। তাঁর অনুসারীরা হেঁটে সমুদ্র অতিক্রম করল। তাদের পা পর্যন্ত ভিজল না। “পরে মিস্রীয়েরা, ফরৌনের সকল অশ্ব ও রথ এবং অশ্বারূঢ়গণ ধাবমান হইয়া তাহাদের পশ্চাৎ পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবেশ করিল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৩) “জল ফিরিয়া আসিল ও তাহাদের রথ ও অশ্বারূঢ়দিগকে আচ্ছাদন করিল।

তাহাতে ফরৌনের সে সকল সৈন্য তাহাদের পশ্চাৎ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইয়াছিল, তাহাদের একজনও অবশিষ্ট রহিল না। কিন্তু ইস্রায়েন সন্তানেরা শুষ্ক পত্রে সমুদ্রের মধ্য দিয়া চলিল এবং তাহাদের দক্ষিণে ও বামে জল প্রাচীরস্বরূপ হইল। ” (যাত্রাপুস্তক ১৪, ২৮-২৯) অর্থাৎ বাইবেলের মতে, ইহুদীদের পশ্চাদ্ধাবনকারী ফেরাউন যে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল’ তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ফেরাউনের লাশের ব্যাপারে বাইবেল কোন ইংগিত দেয় না। তবে মিসররাজ ফেরাউনের প্রকৃত নাম-পরিচয় অনুসন্ধানে বাইবেলের কিছু কিছু তথ্য আমাদের সাহায্য করে।

বাইবেল থেকে আরেকটি তথ্য জানা যায়। বাইবেলের মতে হজরত মূসার (আঃ) জীবদ্দশার বিভিন্ন ঘটনার সাথে দুইজন ফেরাউন সম্পৃক্ত। যে ফেরাউন মুসাকে (আঃ) লালন-পালন করেছিলেন, সে মুসার (আঃ) মাদিয়ানে অবস্থানের সময় মারা যায়। মাদ্রিয়ান থেকে মিসরে ফিরে এসে মুসা (আঃ) আগের ফেরাউনের উত্তরাধিকারীর সাথে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে যান। যে ফেরাউন সমুদ্রে ডুবে মারা যায়, সে মুসার লালন-পালনকারী নয়।

উল্লেখ্য, ফেরাউন মিসররাজের উপাধি, কোন নাম নয়। ফারাও বংশের সকল মিসররাজকেই ফেরাউন নামে ডাকা হয়। মোটামোটি নিশ্চিতরূপেই বলা যায়, ইহুদীয়া মিসরে বসবাস করেছিল মোটামুটিভাবে ৪০০ অথবা ৪৩০ বছর। পি· র্মতে থেকে শুরু করে জ্যানিয়েল রপস্‌ পর্যন্ত আধুনিক ভাস্যকারবৃন্দ মনে করেন যে, হযরত ইউসুফ ও তাঁর ভাইদের মিসর গমন এবং হাইক্‌সম্‌ রাজবংশের মিসর অধিকারের ঘটনা খুব সম্ভব একই সময়ের। বাইবেলের হিসাব থেকে পাওয়া যায়, জুহুদিদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটেছিল মোটামুটিভাবে খ্রীস্টপূর্ব ১৪৫০ অব্দে।

ধর্মগ্রন্থ ছাড়াও সাংকেতিক চিত্রলিখন পদ্ধতিতে রচিত (হাইয়ারোগ্লিফিক) এমন কিছু দলিলপত্র পাওয়া যাচ্ছে- যাতে দেখা যায় এককালে মিসরে এমন এক ধরনের শ্রমিক ছিল যাদের বলা হত আপিরু, হাপিরু অথবা হাবিরু। এই শ্রমিক শ্রেণীকেই হিসু বা ইহুদী হিসেবে সনাক্ত করা হয়। সাধারণত এই শ্রেণীর শ্রমিক রাজমিস্ত্রি, কৃষক-মজুর অথবা ফসল কাটার কামলা হিসাবে কাজ করত। যাহোক, ধর্মতত্ত্বাবিধ ও ইতিহাসবিদদের পর্যালোচনা থেকে বলা যায়, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে এই যে হিসু (ইহুদী বাইবেলের বর্ণনামতে) অথবা এই যে আপিরু (সাংকেতিক ভাষার রচনা মতে) এদের ফেরাউনের নির্দেশ মোতাবেক বড় বড় কাজে লাগানো হয়ে থাকে। এসব শ্রমিক সবাই ছিল জবরদস্তির শিকার।

বাইবেলে উল্লেখিত রামেসিস ও ‘পিথমনগরী’ নীল-বদ্বীপের পূর্বঅঞ্চলে অবস্থিত ছিল। অধুনা তামিস ও কানতির বলে পরস্পর মাইল পনেরো ব্যবধানে যে দু’টি নগরী মিসরে বিদ্যমান, উল্লেখিত দুটি প্রাচীন নগরী এই দুই স্থানেই অবস্থিত ছিল। আর এই স্থানেই দ্বিতীয় রামেসিস কতৃêক স্থাপিত হয়েছিল উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী। গত কয়েক দশক ধরে এই এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এর বহু নিদর্শন পাওয়া গেছে। নিজের নামে এই নগরী নির্মাণেই ফেরাউন রামেসিস কৃতদাসে পরিণত ইহুদীদের কাজে লাগিয়ে ছিলেন।

সুতরাং দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদী নিপীড়ক সেই ফেরাউন, যিনি ইহুদীদের নবজাতক পুত্র সন্তানদের হত্যা করতেন। একজন খ্রিস্টধর্মতত্ত্বাবিধ ফাদার ডি-ভক্স-এর অভিমত, দ্বিতীয় রামেসিসই ছিলেন ইহুদীদের মিসর ত্যাগকালীন ফেরাউন। তিনি তাঁর “দি এনসিয়েন্ট হিস্ট্রি অব ইসরাঈল” পুস্তকে তাঁর অনুমানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তবে তাঁর এই অনুমান খোদ বাইবেলের বর্ণনার সাথেই সামঞ্জস্য রক্ষা করছে না। তিনি কেবল একটা দিক দেখেছেন।

তিনি তাঁর অনুমানের ভিত্তি হিসাবে বাইবেলের এই বর্ণনাকে প্রাধান্য দিয়েছেন যে, ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিসের আমলে তার দ্বারাই রামেষিষ ও পিথম নগরীদ্বয় নির্মিত হয়েছিল। এর দ্বারা অবশ্য একথা প্রমাণ হয় যে, দ্বিতীয় রামেসিসের আগে এই দুটি নগরী নির্মিত হতে পারে না এবং দ্বিতীয় রামেসিসের আগের কোন ফেরাউনের আমলে ইহুদীদের মিসর ত্যাগের ঘটনা ঘটতে পারে না। যদি কোন কোন গবেষক দ্বিতীয় রামেসিসের আগের ফেরাউনদেরও ইহুদী বিতাড়নকারী এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণকারী ফেরাউন হিসেবে সনাক্ত করার চেষ্টা করে গেছেন। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টা যথেষ্ট তথ্যবহুল না হওয়াতে বাধ্য হয়েই সরিয়ে রাখতে হয়। তবে ফাদার ডি মুসার (আঃ) সাথে শত্রুতা পোষণকারী এবং সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণকারী ফেরাউন হিসেবে দ্বিতীয় রামেসিসকেই সনাক্ত করার দাবি করেছেন।

কিন্তু তার এই দাবির পিঠে দুটি প্রশ্ন কিন্তু অবশ্যই বিবেচনার দাবি রাখে। প্রথমতঃ বাইবেলের যাত্রা পুস্তকে (২-২৩) বর্ণিত আছে হযরত মুসা যখন মাদিয়ানে তখন মিসররাজ মৃত্যুবরণ করেন। যাত্রাপুস্তফের বর্ণনামতে এই মৃত্যুবরণকারী মিসররাজ হচ্ছেন তিনিই যিনি জবরদস্তিমূলকভাবে ইহুদী শ্রমিকদের দিয়ে রামেসিস পিথম নগরী দুটি নির্মাণ করেছিলেন। আর এই ফেরাউন যদি দ্বিতীয় রামেসিস হয়ে থাকেন তা হলে কেবলমাত্র তার উত্তরাধিকারীর আমলেই ইহুদীদের মিসর ত্যাগ সম্ভব হতে পারে। বাইবেলের বর্ণনামতে, মুসার (আঃ) জীবদ্দশায় দুইজন ফেরাউনের সাথে সাক্ষাৎ ঘটেছিল।

ইহুদিদের নির্যাতনকারী এবং শিশু মুসার (আঃ) পালনকারী ফেরাউন দ্বিতীয় রামেসিস হওয়ার সম্ভবনাই বেশি। অথচ বাইবেলের মতে, হজরত মুসা (আঃ) মাদিয়ানে অবস্থানকালেই দ্বিতীয় রামেসিসের মৃত্যু ঘটে। তো বলা যায়, মুসার (আঃ) সাথে ঘটনা দুর্ঘটনায় জড়িত ফেরাউন দুইজন, একজন নয়। আর আল কুরআনও এর বিরোধিতা করে না। সবদিক বিবেচনা করে বিখ্যাত গবেষক ডঃ মরিস বুকাইলি বলেন-সুতরাং হযরত মুসার জীবদ্দশাতেই তিনি যখন মাদিয়ানে ছিলেন, তখন এক ফেরাউনের মৃত্যু হয় এবং অপর ফেরাউন মৃত্যুবরণ করেন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের কালে।

অতএব একজন নয়, হযরত মুসার আমলে আমরা পাচ্ছি দুজন ফেরাউন একজন নির্যাতনের কালের অন্যজন ইহুদীদের মিসর ত্যাগের সময়কার। সমস্ত তথ্য উপাত্ত বিশেস্নষণ করে ডঃ মরিস বুকাইলি নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ক) (মিসরের দ্বিতীয় অধিপতি) রামেসিসের সিংহাসন আরোহণের পূর্বে ইহুদীদের মিসর ত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। খ) হযরত মুসা এমন এক ফেরাউনের আমলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন-যিনি রামেসিস ও পিথম নগরী নির্মাণ করেন। তিনিই হচ্ছেন দ্বিতীয় রামেসিস।

গ) হযরত মুসার মাদিয়ানে অবস্থানকালে ক্ষমতাসীন ফেরাউনের (অর্থাৎ দ্বিতীয় রামেসিসের) মৃত্যু ঘটে এবং হযরত মুসার জীবনের পরবর্তী ঘটনাবলী সংঘটিত হয় দ্বিতীয় রামেসিসের উত্তরাধিকারী মারনেপতাহর রাজত্বকালে। ইতিহাসের নিদর্শনাবালীর সংরক্ষণ সবারই কাম্য। কিন্তু যে মমিটির সংরক্ষণের কথা বলা হচ্ছে তা শুধু নিছক কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন নয়, এ মমিটির গুরুত্ব তার চেয়েও অনেক বেশি। এটি এমন একজন মানুষের মরদেহ হযরত মুসার সাথে যার পরিচয় হয়েছিল, সে মানুষটি হযরত মুসার ধর্মীয় প্রচার প্রতিহত করতে চেয়ে ছিল এবং হযরত মুসা যখন ইহুদীদের নিয়ে মিসর থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলেন তখন সেই লোকটিই তাদের পিছনে ধাওয়া করেছিল। আর ধাওয়া করতে গিয়েই মারা পড়েছিল সমুদ্রের পানিতে ডুবে।

আল্লাহর ইচ্ছাতেই তার মরদেহ ধ্বংস হওয়ার হাত থেকে উদ্ধার পেয়েছে এবং কোরআনের বাণী অনুসারেই ভবিষ্যৎ মানবজাতির জন্য তা নিদর্শন হিসাবে রয়ে গেছে সংরক্ষিত। এ যুগের অনেকেই আধুনিক তথ্য প্রমাণের আলোকে ধর্মীয় গ্রন্থের বিভিন্ন বর্ণনায় সত্যাসত্য যাচাই করে নিতে চান তাদের কাছে অনুরোধ তারা যেন মেহেরবানী করে কায়রো গমন করেন এবং তথাকার মিসরীয় জাদুঘরে ‘রয়্যাল মামিজ,’ কক্ষে, সংরক্ষিত ফেরাউনের এই মমিটি দর্শন করে আসেন। আর তা হলেই তারা বুঝতে পারবেন কোরআনের আয়াতে ফেরাউনের মরদেহ সংরক্ষণের যে বর্ণনা রয়েছে তার বাস্তব উদাহরণ কত জাজ্জ্বল্যমান।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।