আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চা

এক. গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য আমাদের নিরবচ্ছিন্ন ক্যাম্পেইন দেখে কোনো কোনো গবেষক ব্যঙ্গ করে বলেছেন, 'যে দেশে জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র নেই, সে দেশের স্থানীয় সরকারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় কিভাবে!' তাদের প্রতি আমাদের পাল্টা প্রশ্ন থাকে, 'পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় আমলে আমরা জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছি, এমনকি আমাদের ১৯৭১ সালে সশস্ত্র যুদ্ধও করতে হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র না থাকার কারণে। এই ৬৭ বছরের অহিংস ও সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে আমরা জাতীয় পর্যায়ে কতটুকু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি? আরও ৬৭ বছর আন্দোলন করে গণতন্ত্র পাওয়া যাবে- এমন গ্যারান্টি কোথায়। ' আবার তাদের মতো যেসব রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবী সারাক্ষণ জাতীয় রাজনীতি নিয়ে দেহ-প্রাণ নিবিষ্ট রেখেছেন, তাদের কাছে আরও প্রশ্ন- 'জাতীয়কে গণতান্ত্রিক করার জন্য যারা সচেষ্ট রয়েছেন তাদের চিন্তায় ও কাজে গণতন্ত্র আছে কি না ?' আমাদের মনে রাখা উচিত- দেশটি পরাধীন নয়, স্বাধীন হয়েছে বহু আগেই। শাসকদের 'নির্বাচিত', 'অনির্বাচিত' কিংবা 'স্বৈরাচারী' যে নামেই ডাকি না কেন, তারা সবাই এ দেশের সন্তান। তাদের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলন করে পরাধীন আমলের মতো সুফল পাওয়া যাবে না।

এ দেশের প্রায় সব নাগরিক স্থানীয়তা, আত্দীয়তা ও আঞ্চলিকতার বন্ধনে আবদ্ধ থেকে কোনো না কোনো স্থানীয় ইউনিটে বসবাস করছেন। সে জন্য আমাদের বক্তব্য, স্থানীয় পর্যায়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেও জাতীয়তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

দুই. মানুষ যেদিন ঘর-বাড়ি নির্মাণ করে এক জায়গায় বসবাস শুরু করে, তখন থেকেই গোত্রীয় বন্ধনের পাশাপাশি স্থানীয়তার বন্ধন শুরু হয়। এরিস্টটালের মতে, 'কয়েকটি গ্রাম মিলে একটি নগর রাষ্ট্র সৃষ্টি করে। ' অর্থাৎ সে কালে স্থানীয়তার সঙ্গে নগর-রাষ্ট্র নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।

প্রাচীন গ্রিসের নাগরিকদের দৃষ্টিতে নগর রাষ্ট্রই ছিল সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে কিছু নগর রাষ্ট্র নিজেদের শক্তিমত্তায় সাম্রাজ্যিক রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। নানা কারণে সে সব রাষ্ট্র ভেঙে জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতি-রাষ্ট্রগুলো মিলে গঠন করে জাতিসংঘ। বর্তমান প্রজন্ম স্থানীয় ও জাতীয় পরিচয়ের পাশাপাশি নিজেকে বৈশ্বিক পরিবারের সদস্য মনে করে।

সে কারণে স্থানীয়তাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা করার সুযোগ নেই। একজন মানুষ জন্ম গ্রহণের পর প্রথমে পরিবার ও স্থানীয় পরিবেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠে। বিশ্বখ্যাত ব্যক্তিরাও স্থানীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেন না। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশ করে একটি বিশ্ববিদ্যালয়। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসও চট্টগ্রামের জোবরা গ্রাম থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন।

এ দেশের মানুষ দীর্ঘকাল স্থানীয়তে এক প্রকার গণতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে বসবাস করে আসছেন। তারা একে অপরের বিপদে ছুটে যান, ঘূর্ণিঝড়ে ঘর-বাড়ি উড়ে গেলে মিলেমিশে নির্মাণ করেন, সমবায় ভিত্তিতে পরস্পরের জমি চাষাবাদ করেন, এমনকি চাঁদা তুলে রাস্তা-ঘাট নির্মাণসহ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। জাতীয় রাজনীতিকদের দায়িত্ব ছিল সেগুলোকে আরও গণতান্ত্রিক করা। আমাদের দুর্ভাগ্য, বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে বার বার আন্দোলন করার কারণে আমরা অতিমাত্রায় 'জাতীয়' হয়ে পড়ি। একই কারণে দ্বিধা-বিভক্তও।

উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, কুষ্টিয়া জেলার এক গ্রামে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির লোকেরা দুটি কাঠের সাঁকো নির্মাণ করে নাম দিয়েছে আওয়ামী লীগ সাঁকো ও বিএনপি সাঁকো। ফলে দেখা যায়, একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী ব্যবসা করছেন স্থানীয়তে কিন্তু সারাক্ষণ চিন্তা করেন জাতীয় রাজনীতি নিয়ে। তারপরও বলা যায়, স্থানীয়তে যতটুকু গণতন্ত্র অর্থাৎ সহনশীলতা, পরমত সহিষ্ণুতা ইত্যাদি আছে জাতীয়তে সেটুকুও নেই। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচটি সিটি নির্বাচনের পর দেখা যায়, বিজয়ী প্রার্থীরা পরাজিত প্রার্থীর বাড়িতে গিয়ে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন এবং পরস্পর মিলে নগর উন্নয়ন করবেন বলে অঙ্গীকার করছেন। তাদের এই গণতান্ত্রিক আচরণকে আরও গণতান্ত্রিক করার জন্য জাতীয় নেতাদের কোনো পদক্ষেপ দেখা যায় না।

তিন. মিডিয়াকেও স্থানীয়কে জাতীয় রাজনীতির আওতাভুক্ত করার জন্য সচেষ্ট বলে প্রতীয়মান হয়। একটি স্বনামধন্য পত্রিকা নব-নির্বাচিত সিটি মেয়রদের ইঙ্গিত করে 'স্থানীয় নেতাদের থেকে শিক্ষা নিন' নামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন। কিন্তু বাস্তবে পত্রিকাটি স্থানীয় ভোটারদের জাতীয় রাজনীতির বিবেচনায় ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল বলে লক্ষ্য করা গেছে। পত্রিকাটির প্রতিদিনকার রিপোর্ট বিশ্লেষণ করলে এর পক্ষে শতভাগ প্রমাণ পাওয়া যাবে। একই পত্রিকায় একজন স্বনামধন্য কলাম লেখক 'সিটিগুলো মিনি সংসদ হতে পারত' শিরোনামের একটি কলামের শেষে লেখেন- 'যেখানে জাতীয় সংসদই কার্যকর নয়, সেখানে স্থানীয় সংসদ কার্যকর হয় কিভাবে।

' অথচ পত্রিকাটির আরেক সম্পাদকীয়তে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের জন্য মায়াকান্না দেখিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের সিটি মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি টেলিভিশনের এক টকশোতে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জের বিএনপি নেতা তৈমুর আলম খন্দকার তার বাবার বন্ধু এবং নিকটাত্দীয়। কিন্তু তিনি (আইভি) তার কাছে পরামর্শ নিতে, এমনকি দাওয়াত খেতেও তার বাড়িতে যান না। কারণ তার বাড়িতে গেলে পরদিনই মিডিয়া উল্টা-পাল্টা লেখা শুরু করবে। ' এখানে আরও উল্লেখ্য, যারা জাতীয় সংসদে গিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে অশালীন আচরণ করেন, তারাও স্থানীয়তে গণতান্ত্রিক আচরণ করে থাকেন।

আমরা দেখেছি, বিরোধী দলের দু'জন নারী সংসদ সদস্য সরকারি দলের সংসদ সদস্যের সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন এবং একই হোটেলে রাত যাপন করেছেন। আবার যেসব বামপন্থি নেতা রাষ্ট্র ও জাতীয় রাজনীতি নিয়ে অধিক মাত্রায় চিন্তাশীল, তারাও দিনের উল্লেখযোগ্য সময় ব্যয় করেন স্থানীয় পর্যায়ে। তারা বাচ্চাদের যে স্কুলে পাঠান, যে দোকান থেকে সওদা করেন, যে চায়ের দোকানে বসে চা পান করেন, সেগুলো সবই স্থানীয়তে অবস্থিত। সে জন্য বলা যায়, স্থানীয়তাকে অবহেলা করে জাতীয় পর্যায়ে গণতান্ত্রিক হওয়ার চেষ্টা ঊধর্্বমুখী পথ চলার মতো।

চার. বাংলাদেশে কেন্দ্রীভূত সরকার ব্যবস্থার বিপরীতে এখন অনেকেই একাধিক সরকার ব্যবস্থা দাবি করছেন।

এটিকে দৃষ্টিভঙ্গির ইতিবাচক পরিবর্তন বলা যায়। কিন্তু যারা তিন প্রকারের সরকার, তথা জাতীয়, প্রাদেশিক ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা চাইছেন, তারা একটি মারাত্দক ভুলের মধ্যে বন্দী আছেন বলে আমাদের ধারণা। আমরা ঢাকাতে বিভিন্ন জেলার নামে সমিতির অফিস দেখি। ঢাকাতে কেউ গেলে প্রথমে জেলার নামে পরিচয় দিতে হয়। কিন্তু কলকাতার লোক দিলি্ল গেলে তাকে রাজ্যের পরিচয় দিতে হয়।

অর্থাৎ ভারতের আয়তন, ভৌগোলিক ইতিহাস-ঐতিহ্য, ভাষা-ধর্ম-বর্ণ ইত্যাদি বিবেচনায় সেখানকার নাগরিকরা স্থানীয়, রাজ্যিক, জাতীয় পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকেন। সে জন্য সিডিএলজি অর্থাৎ সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক লোকাল গভর্নেন্স বার বার বলে আসছে, এ দেশে দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা, তথা জাতীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাই বাস্তবায়নযোগ্য। এ ব্যবস্থায় জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো জাতীয় সরকারের জন্য এবং যাবতীয় স্থানীয় কাজগুলো স্থানীয় সরকারের জন্য নির্দিষ্ট থাকবে। সে ক্ষেত্রে সমস্ত স্থানীয় কাজ (গ্রামীণ ও নগরীয়) জেলার হাতে ন্যস্ত করা যেতে পারে। জেলা এক হাতে গ্রামীণ ইউনিট তথা ইউনিয়ন ও উপজেলা এবং অন্য হাতে নগরীয় ইউনিট অর্থাৎ পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলো তত্ত্বাবধান করবে।

তার আগে সবগুলো স্থানীয় ইউনিটে 'সরকার কাঠামো', যেমন- জেলা সরকার, নগর সরকার, ইউনিয়ন সরকার ইত্যাদি স্থাপন করে সেগুলো পরিচালনার ভার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দিতে হবে।

পাঁচ. অব্যাহত নগরায়নের কারণে ধারণা করা যায়, ২০৫০ সালের মধ্যে দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী নগরীয় সুযোগ-সুবিধার মধ্যে এসে পড়বে। তখন গ্রামীণ ইউনিটগুলো নগরীয় ইউনিটে রূপান্তরিত হবে। অর্থাৎ নগর সরকারগুলো জেলা সরকারের অধীনস্থ হয়ে পড়বে। এখানে সংক্ষেপে প্রস্তাবিত ইউনিয়ন সরকারের রূপরেখা তুলে ধরা যেতে পারে।

ইউনিয়ন সংসদ, ইউনিয়ন প্রশাসন ও ইউনিয়ন আদালত মিলে (গ্রাম আদালতের পরিবর্তে) 'ইউনিয়ন সরকার' গঠিত হবে। ইউনিয়নের পুরুষ ও নারী কাউন্সিলররা ইউনিয়ন সংসদের সদস্য হবেন। তারা ইউনিয়ন কেন্দ্রিক যাবতীয় সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন এবং প্রয়োজনীয় বিধি-বিধান তৈরি করবেন। তাদের প্রস্তাবিত প্রকল্প ইউনিয়ন প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। চেয়ারম্যান ইউনিয়ন প্রশাসনের প্রধান হবেন।

তিনি সরাসরি (বর্তমান নিয়মে) জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন। ইউনিয়ন আদালতের বিচারকরা আলাদাভাবে মনোনয়নের মাধ্যমে অথবা নির্বাচনের মাধ্যমে নিযুক্ত হবেন। চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলররা ইউনিয়ন আদালতের সদস্য হবেন না (বর্তমানে চেয়ারম্যান-কাউন্সিলররা বিচারিক কাজ করে থাকেন)। ইউনিয়ন সরকারের বাইরে 'ইউনিয়ন নির্বাচনিক বোর্ড' ও 'ইউনিয়ন ন্যায়পাল' থাকবে। স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তির সমন্বয়ে ইউনিয়ন নির্বাচনিক বোর্ড গঠিত হবে।

ইউনিয়ন সরকারের মেয়াদ শেষে 'ইউনিয়ন নির্বাচনিক বোর্ড' স্ব-উদ্যোগে নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। সে ব্যবস্থায় বর্তমানের মতো ভোট পাহারা দেওয়ার জন্য সরকারি বাহিনীর প্রয়োজন হবে না। ইউনিয়নবাসীর সম্মতিক্রমে অথবা ভোটের মাধ্যমে একজন 'ন্যায়পাল' নিযুক্ত হবেন। তিনি ইউনিয়ন সরকারের তিন বিভাগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন। একই নিয়মে জেলায় 'জেলা সরকার' ও নগরে 'নগর সরকার' গঠিত হবে।

সিডিএলজির প্রস্তাবিত ডিজাইনটি যদি বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে সমগ্র দেশটি গণতন্ত্রায়নের পথে ধাবিত হবে এবং জাতীয় পর্যায়েও গণতন্ত্র বাস্তবায়নের কাজ সহজ হবে, এটি নিশ্চিত করেই বলা যায়।

লেখক: চেয়ারম্যান, জানিপপ; প্রফেসর ড. এ. কে. এম. রিয়াজুল হাসান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা; এবং মোশাররফ হোসেন মুসা, সদস্য, সিডিএলজি। ই-মেইল- janipop1995@gmail.com

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.