আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নাগরিক জীবনে সাংবিধানিক স্থানীয় শাসন

উৎসব আনন্দের দিনগুলোতে প্রিয়জনের সাথে মিলিত হওয়া মানুষের চিরন্তন আকুতি। মূলত ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতেই মানুষ হৃদয়ের টানে ছুটে যায় আপনজনের কাছে আপন ভূমিতে। আদিকাল থেকে মানুষের এই প্রবণতা চলে আসছে। বাস্তবতা হচ্ছে মানুষ আপনজনদের মাঝে একত্রে বাস করতে চাইলেও জীবিকার প্রয়োজনে তাকে স্থানান্তরে যেতে হয়। কর্ম সংস্থানের সুযোগই এক্ষেত্রে নিয়ামক ভ’মিকা পালন করে।

রাষ্ট্রের উদ্ভবের পর নাগরিকদের কর্ম-সংস্থানের দায়িত্ব রাষ্ট্রকেই পালন করতে হয়। নাগরিকদের সাম্য মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ়করণ ও তাদের অন্ন , বস্ত্র, আশ্রয় , শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করার দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রের । এই অবস্থান বিবেচনা করেই গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছেঃ ‘১৬। নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবন যাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করিবার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ , গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা , কুটির শিল্প ও অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা , যোগাযোগ-ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তরসাধনের জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন। ’ এর বাস্তবায়নের জন্য স্থানীয় শাসন ব্যবস্থা কার্যকর , গতিশীল ও গণমুখী করতে হবে।

তাই সংবিধানে বলা হয়েছেঃ ‘৫৯। (১) আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক এককাংশের স্থানীয় শাসন ভার প্রদান করা হইবে। (২) এই সংবিধান ও অন্য কোন আইন সাপেক্ষে সংসদ আইনের দ্বারা যেরূপ নির্দিষ্ট করিবেন, এই অনুচ্ছেদের (১) দফায় উল্লিখিত প্রত্যেক প্রতিষ্ঠান যথোপযুক্ত প্রশাসনিক এককাংশের মধ্যে সেইরূপ দায়িত্ব পালন করিবেন এবং অনুরূপ আইনে নিম্লিলিখিত বিষয় সংক্রান্ত দায়িত্ব অর্ন্তভুক্ত হইতে পারিবেঃ (ক) প্রশাসন ও সরকারী কর্মচারীদের কার্য , (খ) জনশৃংখলা রক্ষা , (গ) জন সাধারণের কার্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন। ৬০। এই সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদের বিধানাবলীকে পূর্ণ কার্যকরতা দানের উদ্দেশ্যে সংসদ আইনের দ্বারা উক্ত অনুচ্ছেদে উল্লিখিত স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমূহকে স্থানীয় প্রয়োজনে কর আরোপ করিবার ক্ষমতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ ও নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করিবেন।

’ সাংবিধানিক এই বিধান কার্যকর করা হলে দেশের প্রতিটি গ্রামই হয়ে উঠতো সুশিক্ষিত জনগণের আবাসভূমি। নিজ অঞ্চলে অবস্থান করেই তারা স্বাচ্ছন্দে জীবিকা অর্জন করতে পারতো , পেতো প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা। সন্তান ও পোষ্যদের সাধারণ ও পেশাগত শিক্ষার জন্য দূরান্তরে যেতে হতো না। শাসন কার্যে থাকতো জবাবদিহিতা। ফলে সুশাসনের সুবাতাস জনজীবনে স্থাপন করতো শান্তি ও শৃঙ্খলা।

স্থানীয় ও আভ্যন্তরিন ব্যবসা বাণিজ্য গতিশীল হতো , ফলে সবাইকে দূর দূরান্তরে যাবার প্রয়োজন হতো না। বাস্তবে আমরা কি দেখছি ? বিগত ঈদুল ফিতরের কিছু আগে সারাদেশে যানবাহনে টিকিটের সংকট দেখা দেয়। আগাম টিকিট কেনার হিড়িক পড়ে যায়। নাগরিকেরা নিজ নিজ প্রয়োজনীয় কাজ ফেলে টিকিটের জন্য কাউন্টার থেকে কাউন্টারে লাইনে দাঁড়াতে শুরু করে নাগরিকেরা। ট্রেন বাস স্টীমার সবত্রই একই অবস্থা।

জনদুর্ভোগ লাঘব করতে মন্ত্রী মহোদয়কে নিজে আত্মনিয়োগ করতে হয মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য কাজ রেখে। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করতে হয় মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরকেউ । টিকিট প্রার্থীগণ সবাই ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যাত্রী। তারা সবাই জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় এসেছে। ঈদের উৎসবটা তারা পালন করতে চায় আত্মীয়-পরিজনের সাখে।

এ জন্যই টিকিটের এতো কদর ও চাহিদা। প্রথমে আশ্বাস দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষকে স্বীকার করতে হয় যাত্রী বহনের জন্য রেলপথ বিভাগে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ইঞ্জিন ও বগি নাই। সড়ক পথে নাই বাস , জল পথে নাই লঞ্চ ও ষ্টিমার। তাই প্রাণের ঝুকি নিয়ে , প্রাণের টানে ,প্রিয়জনের সাথে ঈদের আনন্দে শামিল হতে যাত্রীদের প্রাণান্তকর অবস্থা। এ জ্বালার এখানেই শেষ নয়।

বাড়ি পৌঁছে স্বজনদের সাথে একান্ত পরিবেশে কাটানোর সে সুযোগটাও নাই। ঈদ শেষে কর্মস্থল ঢাকায় ফেরার চিন্তা , এবার টিকিট নিয়ে সেই বিপত্তির পূনরাবৃত্তি। গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার কেন্দ্রের সদস্য মোশাররফ হোসেন মুসা ফোনে জানালেন ঈদ উপলক্ষ্যে ফাঁকা হয়ে গেছে ঢাকা মহানগর। এ দৃশ্য প্রমান করে ঢাকায় যারা বাস করে তাদের অধিকাংশই ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা নয়। কর্মসংস্থান ও নাগরিক সুবিধার কারণেই ঢাকার জন সংখ্যা বেড়ে চলেছে।

এখানে দ্বিমত পোষন করার কোনই অবকাশ নাই। রাজধানীর বাইরের জনপদগুলোতে কর্ম সংস্থানের কোন সুযোগ নাই , নাগরিক সুবিধা নাই , শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও নিতান্ত অপ্রতুল। সে কারণেই জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ ছুটে যায় রাজধানীতে। নাগরিক সুবিধা শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা পাবার জন্য তারা বসতি স্থাপন করছে রাজধানীতে। ফেলে আসছে চির পরিচিত গ্রামে পূর্ব পুরুষের বাস্তভিটা।

এভাবেই বাড়তি জনসংখ্যার ভারে ন্যুয়ে পড়ছে রাজধানী। উজার হচ্ছে গ্রাম। এই জনগণের খাদ্য সরবরাহের জন্য মফস্বল এলাকা থেকে আসছে ট্রাকভর্তি চাউল ,গরু , মহিষ , মুরগী , মাছ , কাঁচা তরি-তরকারী , দুধ , মিষ্টি ইত্যাদি। সড়ক মহাসড়ক সমূহে ভিড় জমাচ্ছে এ সব পণ্য সামগ্রী পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত যান বাহন। এক লাখ ত্রিশ হাজার টাকা মূল্যমানের সম্পত্তির মামলায় আপিল দায়েরের জন্য বিচার প্রার্থীকে যেতে হয় ঢাকায়।

যুগ্ম দায়রা জজ কর্তৃক পাঁচ বৎসরের অধিককাল মেয়াদের কারাদন্ডাদেশে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকেও আপিল দায়ের করতে ঢাকা যাওয়া ছাড়া বিকল্প নাই। এভাবেই রাজধানী নিজ ধারণ ক্ষমতার অধিক জনসংখ্যায় ভরে যাচ্ছে। এই বাড়তি জনসংখ্যার ভার বহনের ক্ষমতা রাজধানীর নাই। সড়ক মহাসড়কগুলোও এতো যান-বাহন চলাচলের উপযোগী নয়। সে কারণেই যানজট,দুর্ঘটনা , আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি , রাস্তার ধারে ধারে পুঁতিগন্ধময় আবর্জনার স্তুপ, দুষিত পানির কারণে পানিবাহিত রোগে প্রতিনিয়ত ভোগান্তি , ট্রেন বাসে চড়ে ঘরে ফেরা জন্য টিকিটের দুষ্প্রাপ্যতা, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অস্বাভাবিক মূল্য ইত্যাকার দুর্ভোগ নাগরিকদের জীবন করে তুলছে অতিষ্ট।

প্রতি দিন সারা দেশের হাসপাতাল সমূহে জরুরী বিভাগে বেশী সংখ্যক রোগী আসে সড়ক দুর্ঘটনায় আহতরা । সপারিষদ বাজার পরিদর্শন , রাস্তায় কয়েক ড্রাম পীচ ঢেলে রোলার দিয়ে মসৃণ করা বা গোটা মন্ত্রণালয় রেল স্টেশনে গিযে টিকেট বিক্রি স্বাভাবিকরণের চেষ্টা , সন্ত্রাসীর হাতে নিহত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে সমবেদনা জ্ঞাপন দ্বারা উদ্বেগাকুল , ব্যথাহত, শোকাহত নাগরিকদেরকে সান্ত¦না প্রদান সাময়িকভাবে জনগণকে আশ্বস্থ করতে পারলেও এর দ্বারা সমস্যার স্থায়ী সমাধান হবে না। দিন যত যাবে রাজধানীতে বাড়তি জনসংখ্যার চাপও বাড়তে থাকবে। সেই সাথে প্রাগুক্ত উপসর্গগুলোও নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবন যাত্রায় ব্যাঘাত ঘটাতে থাকবে। এভাবে রাজধানীর প্রাণচাঞ্চল্য হতে চলেছে স্তব্ধ ও স্থবির , গতিশীলতা হারাচ্ছে রাজধানীর দৈনন্দিন কর্ম।

এ অবস্থা চলতে থাকলে রাজধানীর কার্যক্রম হয়ে যাবে স্থবির। জন জীবন হবে আরো বিপর্যস্থ। যা স্বয়ং রাজধানীর অস্থিত্ব ও নিরাপত্তাকেই করতে পারে বিপন্ন। স্থানীয় সরকার সম্পর্কে সাংবিধানিক বিধান পরিহার করাতেই এই সংকট গুলোর জন্ম হয়েছে। সমস্যার সমাধান করতে হলে জনগণের রাজধানী মুখি হবার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে।

সে জন্য স্থানীয় শাসন ব্যবস্থাকে প্রকৃত অর্থে গণমুখি , কার্যকরী , গতিশীল ও প্রাণবন্ত করতে হবে। এতে কিছু লোকের স্বার্থে আঘাত লাগতে পাওে কিন্ত ব্যাপক জনগোষ্ঠি হবে উপকৃত। বাড়িতি জনসংখ্যার ভারে ভারাক্রান্ত রাজধানীর কারণে রাজধানীতে যান বাহন , হোটেল ও বিনোদন নিয়ে যারা ব্যবসা করেন তারা নিজেদের লভ্যাংশ কমে যাবার আতংঙ্কে এর বিরোধিতা করবে সন্দেহ নাই । দুর্নীতি পরায়ণ আমলা গোষ্ঠিও এদের সাতে সুর মেলাবে। সুবিধাভোগী আইনজীবীরাও দূরে থাকবে না।

তা সত্ত্বেও স্থানীয় শাসন কায়েমের সাংবিধানিক বিধানের বাস্তবায়ন করতেই হবে। স্থানীয় শাসন কায়েম হলে সুফল প্রাপ্ত জনগনের আওয়াজের কাছে উক্ত বিরোধীতাকারীদের কন্ঠ একদিন মিলিয়ে যাবেই। লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.