আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্থানীয় সরকার : বাংলাদেশে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না কেন?

দেশে চলছে উপজেলা নির্বাচন। উপজেলা পরিষদ স্থানীয় সরকারের অংশ। বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার পদ্ধতি প্রচলন অনেক কাল আগে (১৮৭০ সাল থেকে)। স্থানীয় সরকার বলতে, কোন একটি নির্দিষ্ট এলাকায় সেই এলাকার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনকে বুঝায় যা কেন্দ্রীয সরকারেরই একটি সম্প্রসারিত অংশ। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক উন্নযন ত্বরান্বিতকরণ, গণতন্ত্রকে শক্তিশালীকরণ, স্থানীয় সামাজিক সমস্যার নিরসন ও তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার গুরুত্ব ব্যাপক।

বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাগণ এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব দিযেেছন। বাংলাদেশের সংবিধানে তৃনমূল পর্যায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য স্থানীয় সরকারকে প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং একই সাথে জনগণের অংশগ্রহণের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদ অনুযাযী নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উপর ‘স্থানীয় শাসনের ভার’ ন্যস্ত করা হযেেছ এবং ৬০ নং অনুচ্ছেদে স্থানীয় শাসন-সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহকে স্থানীয় প্রযােজনে কর আরোপ করার মতাসহ বাজেট প্রস্তুতকরণ এবং নিজস্ব তহবিল রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। এ অনুচ্ছেদে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক মতা প্রদানের বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে।

এখানে এর কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো:

আবারও সৈয়দ আশরাফুল হক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নযন ও সমবায মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীত্ব পেলেন। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই বরং এটা পূর্বানুমিতই ছিল কারণ তিনি দলের সাধারণ সম্পাদক। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভবত স্থানীয় সরকারের ক্ষমতাযন চান না। তারা স্থানীয় সরকারের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চান। দেশে বর্তমানে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান (ইউনিযন পরিরষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদি) রয়েছে যা স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নযন ও সমবায মন্ত্রণালয়ের তত্ত¦াবধানে পরিচালিত হয়।

লক্ষ্য করলেই দেখবেন, ১৯৯১ সাল থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব¡প্রাপ্ত মন্ত্রীগণ ছিলেন ক্ষমতাসীন দলগুলোর মহাসচিব/সাধারণ সম্পাদক - আবদুস সালাম তালুকদার (বিএনপি), জিল্লুর রহমান (আওযামী লীগ), আবদুল মান্নান ভূঞা, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম (আওযামী লীগ) এবং এই ধারা অব্যাহত থাকলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় আগামী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নযন ও সমবায মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন তখন যে দল ক্ষমতায যাবে সে দলের সেক্রেটারী / পরিবর্তিত সেক্রেটারী।


স্থানীয় সংসদ সদস্য, উপজেলা পরিষদ চেযারম্যান এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও)-’র মধ্যে ত্রিমূখী ¯œাযূর দ্বন্দ¦ কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার অন্তরায। বিশেষত: উপজেলা প্রশাসনের কর্তৃত্ব নিয়ে এমপি ও উপজেলা পরিষদ চেযারম্যানদের দ্বন্দ¦ মিডিযায় বহুবার এসেছে। তাঁদের মধ্যকার ত্রিমূখী দ্বন্দে¦র কারণে উপজেলা পরিষদের দৈনন্দিন কার্যক্রমসহ স্থানীয় উন্নযনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং পরিষদ অকার্যকর হয়ে পডছে। যখন কোন একটি বিষয়ে উপজেলা চেযারম্যান ও ইউএনওর দিক থেকে নির্দেশনা ভিন্ন থাকে তখন প্রকল্প বাস্তবাযনকারী দ্বিধায পড়ে যান।



স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর যেমন জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিযন পরিষদ, পৌরসভা ইত্যাদির মধ্যে কর্মকান্ডে সমন্বযহীনতা বা দ্বৈততা রয়েছে। বাংলাদেশের মত একটি দেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় এতগুলো স্তর-এর যৌক্তিকতা কতটুকু তাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।

বরাদ্দ, কর্মসূচী বাস্তবাযন কৌশল, বিধিমালা, নীতিমালাসহ অনেক বিষয়ে কেন্দ্রীয়(!) সরকারের উপর নির্ভর করতে হয় বলে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয সরকার সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। স্থানীয় জনগণও কেন্দ্রীয় সরকার ও এনজিওগুলোর উপর আস্থাশীল। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাসও যেন কাজ করে।

অবাক করার বিষয়, ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদারদের বাঁশির নমুনাও মন্ত্রণালয থেকে ঠিক করে দেওযা হয়।

স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের নিজ দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে সম্যক ধারণার অভাব পরিলক্ষিত হয়। চেযারম্যান, মেম্বারগণ সঠিকভাবে জানেন না আইনানুযাযী সংশ্লিষ্ট পরিষদের বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক কাজগুলো সম্পর্কে। নির্বাচিত মহিলা প্রতিনিধিগণও অজ্ঞতার কারণে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন না বা তাঁদের অবহেলা করা হয়। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন স্তরগুলোর বাধ্যতামূলক ও ঐচ্ছিক কর্মকান্ড নির্ধারণ করা আছে।

যেমন: ইউনিযন পরিষদের ১০ টি বাধ্যতামূলক ও ৩৮টি ঐচ্ছিক কার্যাবলী রয়েছে। জেলা পরিষদের ১২টি বাধ্যতামূলক ও ৬৮টি ঐচ্ছিক কার্যাবলী রযেেছ। জনবল ও ব্যবস্থাপনাগত কারণে ইহা একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। তাছাডা সবগুলো কার্যাবলী স্থানীয় প্রেক্ষাপটে কতটুকু বাস্তবসম্মত তাও একটি বিষয়।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত নিজস্ব তহবিল নেই।

স্থানীয় সরকারের জন্য এডিপির বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৩৯। স্থানীযভাবে প্রাপ্ত কর-ই রাজস্ব আযরে একমাত্র উৎস। জনপ্রিযতা হ্রাসের ভযে স্থানীয় পর্যায়ে কর বাড়ানোর ক্ষেত্রেও উৎসাহ দেখা যায় না। তাঁরা মনে করেন, এতে তারা পরবর্তীতে ভোট পাবেন না এবং নির্বাচিতও হতে পারবেন না। এজন্য স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিকভাবে অসচ্ছল।



জেলা পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত জেলা পরিষদের কোন নির্বাচন হয়নি। সম্প্রতি সরকার দলীয লোকদের জেলা পরিষদগুলোর প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন যা নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমারোচনা হয়েছে। উপজেলা পরিষদে মহিলা ভাইস চেয়ারম্যানের কোটা থাকলেও দায়সারা ভাব লক্ষ্য করা যায়।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোতে পর্যাপ্ত জনবলের সংকট রয়েছে। একটি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য জনবল মাত্র ১১ জন - সচিব ১ জন, গ্রাম পুলিশ বা দফাদার ১ জন, চৌকিদার ৯ জন।

তাঁদের বেতন-ভাতাও খুবই নগন্য। এছাডা প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদে ১জন চেযারম্যান, মেম্বার ১২ জন (সংরক্ষিত ৩ জন মহিলাসহ) নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।

স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বিভিন্ন সরকারী বিভাগের (যেমন: পরিবার পরিকল্পনা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিক্ষা ইত্যাদি) প্রতিনিধিদের মধ্যে কর্মকান্ডের সমন্বযরে অভাব রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় কর্মরত সরকারী বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিকট রিপোর্ট করা বা জবাবদিহিতা করতে হয না। যেমন কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের ব্লক সুপারভাইজারগণ সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি অফিসারের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন কিন্তু সংশ্লিষ্ট ইউনিযন পরিষদ চেযারম্যানের নিকট নয় বিধায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান কোন ভ’মিকা রাখতে পারেন না।



শক্তিশালী ও কার্যকর স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে এ সকল প্রতিষ্ঠানকে যথাযথ দায়-দায়িত্ব, প্রয়োজনীয় সম্পদ, স্বাযত্তশাসন ও আবশ্যকীয কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রদান করা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যথাযথ দায়-দায়িত্ব¡ না থাকলে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা স্থানীয় সমস্যা সমাধানে অপারগ হবে। এ সকল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয সম্পদ না থাকলে এগুলোর পক্ষে কোনরূপ কার্যকারিতা প্রদর্শন সম্ভব নয। কার্যকারিতা প্রদর্শনের জন্য আরো প্রয়োজন এগুলোর স্বায়ত্তশাসন। একই সাথে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজন যথাযথ জনবল বা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক সদিচ্ছা।


:--: মুনতেসার আলী :--:।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.