আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হারিয়ে তোমায় খুঁজে ফিরি

চোখের দেখায় দেখছ যাকেহয়তো কোন মরীচিকা, আঁধার পথেখুঁজছ যাকে হয়তোকোন বিভীষিকা। তাই বারণ করি বারে বারে এসো না এই অন্ধকারে হৃদয় যে মোর কৃষ্ণগহ্বর হারিয়ে যাবে চিরতরে........... টিং টিং টিং........ঘণ্টা বেজে উঠার পর ফারহানের ঘোর হঠাৎ ভেঙ্গে গেল। সারারাত অঘুমা থাকার পর এখন ক্লাস করতে আসা তার উপর আবার টিচারের বোরিং লেকচারের চেয়ে ঘুমানোটাই তার বেশি পছন্দ হল। টিফিন ছুটির পরও সে ঘুমে ব্যস্ত। হঠাৎ ঠাস!!!! কে কে বলে আচমকা দাড়িয়ে গেল ফারহান।

কে যেন ওর মাথায় খুব জোরে থাপ্পর মেরেছে। আশেপাশে তো কাউকে দেখছে না কিন্তু কিছু দূরে বসে থাকা এক ক্লাসমেটের দিকে চোখ পরল। হাসছে ; একবার ফারহানের দিকে তাকিয়ে আর একবার দরজার দিকে তাকিয়ে। বুঝতে পারল যে কাজটা করেছে সে কোথায় লুকিয়ে আছে তাই আর ডানে বামে না তাকিয়ে সোজা দরজার কাছে চলে এলো ইনস্ট্যান্ট প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। দরজার কাছে এসে সমস্ত শক্তি এক করে দিল এক লাথি।

আউউউউউ !!!!!! দরজার ওপাশ থেকে আসা চিৎকার শুনে ক্লাসে থাকা অন্যরা রীতিমতো ভয় পাবার উপক্রম। ফারহানতো এতক্ষণ হাসছিল কিন্তু ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা মানুষটাকে দেখার পর কোঁকড়া চুল সব সাথে সাথে খাঁড়া হয়ে গেল,হাসিটাও কোথায় যেন উধাউ হয়ে গেল। তবে আশেপাশের সবাই ইতিমধ্য হাসাহাসি শুরু করে দিলো। না হেসে যাবে কোথায় , মানুষটি যে আর কেউ ছিল না বরং ফারহানের গার্লফ্রেন্ড তিন্নি ছিল। opsssss !!!!!! ফারহান আর তিন্নি স্কুলজীবন থেকেই একে অপরকে চেনে।

পরিচয়টা ঝগড়া দিয়ে শুরু হয়েছিলো বলে পুরো স্কুলজীবনটাই কেটে গেল ঝগড়া আর মারামারিতে, স্কুলজীবনও শেষ হল শত্রুতার মধ্য দিয়ে। পরে অবশ্য একই কলেজে ভর্তি হবার পরও তাদের ঝামেলা হতো। ফারহান খুব দুষ্টু স্বভাবের, সুযোগ পেলেই লেজ ধরে টানাটানি শুরু করে দেয়। তিন্নি কিছুটা ভাব দেখাতো আর কথায় কথায় খুব রেগে যেতো কিন্তু সেও কম দুষ্টু ছিল না। এদের শত্রুতার গল্পের মোড় হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালো এক ঈদের দিন।

কাকতালিওভাবে ফারহান ও তিন্নির বাবা বন্ধু বিধায় এক ঈদের দিন তারা তিন্নিদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলো। ঐ সুবাদে তাদের দেখা,তারপর ফ্যামিলি চাপে ভালভাবে কথা,অতঃপর ভাল বন্ধু হয়ে যাওয়া। কালের আবর্তনে আজ তাদের সম্পর্কটা আরও গভীর, একে অপরকে খুব ভালবাসে। কিন্তু মারামারি করার অভ্যাসটা যেন গেল না। গত কয়েকমাস আগে যখন ফারহান তিন্নিকে প্রপোজ করেছিল তখন রাগের মাথায় সে হাতের মোবাইলটা দিয়ে মেরে ফারহানের মাথা ফুলিয়ে দিয়েছিলো।

কারণটা খুব একটা অস্বাভাবিক ছিল না, ফারহান এত দেরিতে কেন ওকে I love u বলেছিল এতেই সে ক্ষেপে গিয়েছিলো,পরে আবার নিজ হাতে বরফ লাগিয়ে দিয়েছিলো। তারপর থেকে ফারহান ওকে খুব ভয় পায়,এক আধটু দুষ্টুমি করে তবে অনেক সাবধানে। কিন্তু এখন ফারহান যা করলো তাতে তিন্নি রেগেমেগে আগুন। হাতে ব্যাথা পাওয়াটা বড় ছিল না বরং ক্লাসের অন্যরা তিন্নির অবস্থা দেখে হাসছিল এটাই তাকে বেশি রাগিয়ে তুলেছিল। উচু গলায় চেঁচিয়ে বলল, ------- এটা কি করলে তুমি? কি চুপ করে আছো কেন? ফারহান নিজের হাসিটা কোনরকম চেপে রেখেছিল,কিন্তু মুচকি হাসির মাঝে দাঁতগুলো একটু একটু দেখা যাচ্ছিল।

------- আহাহাহাহা.........! দেখো দেখো মুখটা কেমন বানরের মত করে হাসছে। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে আর তুমিও তাদের সাথে এক হয়েছ? কাজটা মোটেও ভাল কর নি তুমি,ফারহান। ------- আরে আরে ! এখানে আমার কি দোষ বল? প্রথমে তো তুমিই আমার মাথায় থাপ্পড় দিলে। আর আমি কি জানতাম ওটা যে তুমি ছিলে ! ------- o u shut up! আজ তোমার একদিন কি আমার একদিন। তোমাকে তো, তোমাকে তো............... এই বলে তিন্নি আশেপাশে কিছু খোঁজা শুরু করলো ফারহানকে মারার জন্য।

আকার-ইঙ্গিত বুঝতে পেরে ফারহান পিছন ফিরে দিলো ভোঁ দৌড় আর তার পিছু নিল তিন্নি। এই টম এন্ড জেরি খেলায় কয় জনকে যে ধাক্কা দেয়া হয়েছে সে খবর ওদের ছিল না। পরে অবশ্য তিন্নি হাল ছেড়ে ক্লাসে ফিরে যায়। কিন্তু টিফিন ছুটি শেষ হওয়া পর্যন্ত ফারহান স্টোররুমেই লুকিয়ে ছিল মশার কামড় খেয়ে খেয়ে। পরে ফারহানা সাবধানে ক্লাসে প্রবেশ করছিল হঠাৎ তিন্নির হাত থেকে ছোড়া একটা ডাস্টার অতিবেগে নিজের দিকে আসতে দেখে ফারহান সাথে সাথে পাশ কাটিয়ে ফেলে।

ঠিক ঐ মুহূর্তে ম্যাডাম ক্লাসে প্রবেশ করতেই ডাস্টার গিয়ে উনাকে আঘাত করলো। ক্লাসের অন্যরা চুপচাপ ব্যাপারটা খেয়াল করলো আর দেখল চশমার জন্য ম্যাডামের যে চোখ দুটি বড় দেখায় তা এখন আরও কয়েকগুণ বড় হয়ে তিন্নির দিকে তাকিয়ে আছে। পানিশমেন্ট দিতে যাবে ঠিক তখনই ফারহান এসে উনাকে পুরো ব্যাপারটা খুলে বলে আর তিন্নিকে মাফ করে দিতে বলে। ম্যাডামঃ উফফ! তোমাদের জ্বালায় এই কলেজে থাকা দায় হয়ে যাবে দেখছি। সারাক্ষন শুধু টম এন্ড জেরির মত লেগে থাকো।

এই পর্যন্ত তোমাদের জন্য ল্যাবের টেস্টটিউব ভেঙ্গেছে,কেমিস্ট্রি স্যারের হাতে এসিড পরেছে, বায়োলজি ম্যাডামের হাত কেটেছে,ফারহানের ধাক্কা খেয়ে ফিজিক্স স্যার সিঁড়ি থেকে পড়েছে, এইতো গত সপ্তাহে তিন্নির চিৎকারে আমি হার্টএটাক প্রায় করেই ফেলতাম। সামনে আর কি কি করবে আল্লাহ্ই জানে। আচ্ছা ,তোমরা নিজেদেরকে কি কখনো আয়নায় দেখনি? এত বড় ছেলে-মেয়ে, কলেজে পড় আর স্বভাব ক্লাস ফাইভের স্টুডেন্টদের মতো। না, এসব আর চলবে না , আগামীকাল অবশ্যই তোমাদের অভিভাবক আনবে and that is final.পরের দিন ওদের বাবা এসে টিচারদের সাথে দেখা করে, কথা শেষে তিন্নি-ফারহানের ছুটি নিয়ে চারজনেই চলে গেল ফাস্টফুডের দোকানে। তিন্নি-ফারহানের মুখে কলেজের গল্প শুনে ওদের বাবা তো হেসেই আটখানা।

ফারহান-তিন্নির ভালবাসার গল্পটা যেন খুব সহজ। সাধারণত ফ্যামিলি ব্যাপারটা মেনে নেয় না অথবা অন্য কোন বাধা থেকেই যায়। কিন্তু ওদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন ছিল। ওদের সম্পর্কে ফ্যামিলি অনেক সন্তুষ্ট ছিল,বাবা-মা ওদেরকে অনেকটা স্বাধীন করেছিল অন্যদিকে ওরা দুজন নিজেরদের মধ্য আর মা-বাবার বিশ্বাসটুকু ধরে রাখতো। ওদের পৃথিবীতে বাবা শব্দের অর্থ ছিল বেস্ট ফ্রেন্ড আর মা তো বন্ধু ছিলই।

কলেজের অনেকেই ওদের এত জোরালো সম্পর্ক দেখে হিংসা করত,একদিকে স্টুডেন্ট হিসেবে অনেক ভাল অন্যদিকে সবার মাঝে বেশ পপুলারও ছিল। এক কথায় ওদের জীবনটা অনেক সুখের যেখানে তৃতীয় কোন মানুষ জায়গা পাবার সাহস করত না। শীতকালীন অবকাশে কলেজ ছুটি। ইতিমধ্য তিন্নি বায়না করলো গ্রামের বাড়ি যাবে আর এবার ওদের সাথে ফারহান আর ওর বাবা-মাও আসবে। সবাই রাজি হল।

কিন্তু যেদিন রওনা হবে ঐ দিন ফারহানের বাবার ব্লাড প্রেসার কমে যাওয়ায় খানিকটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল তাই ফারহানকে তিন্নিদের সাথে চলে যেতে বলল। একটু সুস্থ হলে পরে উনারা চলে আসবেন। ফারহান গাড়ি চালাচ্ছিল আর তিন্নির সাথে গল্প করছিল। কথার ফাঁকে তিন্নি ফাজলামি করে ফারহানের ড্রাইভিং এর উপর খোঁটা মেরে বসলে সে অপমানবোধ করে। তাই সে গাড়ীর স্পীড বাড়িয়ে এঁকে-বেঁকে গাড়ি চালান শুরু করে দেয় শুধুমাত্র তিন্নিকে ভয় লাগানোর জন্য।

তিন্নি অনেক মানা করার পরও সে শুনছিল না। পেছনে ওর বাব-মা ঘুম ছিল বলে ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। এভাবে দুষ্টুমি করতে করতে হঠাৎ কোন দিকে রাস্তার মাঝে একটা চিকন বাঁক চলে আসে ফারহান খেয়ালই করতে পারে নি। এত দ্রুত গতিতে সে গাড়ি ঘোরাতেই তা উল্টে গিয়ে রাস্তার পাশে ডোবাতে গিয়ে পড়ল। তারপর......... চোখ খুলতেই তিন্নি নিজেকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখল,মাথায় ব্যান্ডেজ করা।

কিছু বুঝতে পারছে না কি হয়েছে,পাশে ফারহানের বাবা আর ডাক্তারকে দেখতে পেল। অন্যদের কথা জিজ্ঞেস করতেই উনি চুপ হয়ে গেলেন। পরে পুরো ঘটনা তিন্নিকে এক এক করে বলল। ফারহান গাড়ি চালানর সময় সিট বেল্ট বন্ধ না করেই গাড়ি চালাচ্ছিল বলে ঐ দিন আহত অবস্থায় নিজেকে আর তিন্নিকে উদ্ধার করতে পেরেছিল। কিন্তু তিন্নির বাবা-মা সিট বেল্ট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছিল বলে উল্টে যাওয়া গাড়ি থকে তারা বের হতে পারে নি, তাদেরকে বাঁচানো আর সম্ভব হয় নি।

কথাটা শোনার পর তিন্নির মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, চারিদিকে কেমন যেন ঘোর অন্ধকার দেখছিল,হতাশার বিভীশিখার মাঝে হারিয়ে যাওয়া তিন্নি নির্বাক, নিশ্চুপ বিছানায় শুয়ে আছে। উপরের দিকে অপলক চেয়ে আছে আর চোখ থেকে ধীরেধীরে অশ্রু ঝরে পরছে। এতো মানুষের ভিড়ে নিজেকে যেন একা মনে হচ্ছিল আর সেই সাথে ফারহানের উপর তীব্র একটা ক্ষোভের সঞ্চার হচ্ছিল। পুরো দুর্ঘটনার জন্য একমাত্র ফারহানই দায়ী। ওর ফাজলামির কারনে আজ তিন্নি তার সবচেয়ে আপন মানুষগুলোকে হারাল।

আর সেই সাথে তিন্নির জীবনে নেমে এলো এক বড় মাপের কালো অধ্যায়। এক সপ্তাহ পর.........তিন্নি বাসায় বসে বাবা-মার ছবিগুলো দেখছে একটা একটা করে ,চোখে স্বজন হারানোর কান্না, কিছুক্ষণ পর পর শূন্য আকাশটার দিকে তাকাচ্ছে , তাকাচ্ছে ঘরের চারপাশের দেয়ালগুলোর দিকেও কি যেন একটা নীরব আর্তনাদে চারিদিক হাহাকার করছে। অনেকগুলো প্রশ্ন ওর মনে দাগ কাটছিল। কেন এমনটা হল? ফারহান কেন দুষ্টুমিটা করতে গেল? বাবা-মা সিট বেল্ট লাগিয়ে কেন ঘুমিয়ে পড়েছিল? আমিই বা কেন গ্রামের বাড়িতে যাবার বায়না করেছিলাম?হঠাৎ তিন্নির ফোন বেজে উঠল। ফারহান।

দুর্ঘটনা হবার পর ফারহান নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিল না বলে কাউকে কিছু না কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো,মোবাইলটাও অফ করে দিয়েছিলো। তিন্নি কল রিসিভ করলো না,ফারহান ওর বাসায় এসেছিল কিন্তু দরজা খোলে নি। তিন্নি কলেজে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছে। তিন্নির বাসা পাশে ছিল বলে ফারহানের বাবা-মা প্রায় ওকে দেখতে আসতো, বাড়িতে একা মেয়েকে দেখে ওদের খুব মায়া হতো তাই যতটুকু পারতো সান্ত্বনা দিত। ফারহানের বাবা তিন্নিকে বলেছিল উনাদের সাথে থাকতে কিন্তু তিন্নি কি ভেবে যেন না বলে দিলো।

তিন্নির মানসিক অবস্থা আর ফারহানের উপর অভিমানটা বুঝতে পেরে তিনি আর কিছু বললেন না কিন্তু মনে মনে তিন্নির সবটুকু দায়িত্ব নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এদিকে ফারহান অনেক চেষ্টা করেও তিন্নির সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি, পরে ফারহানের বাবা-মা ফারহানকে ধৈর্য ধারনের পরামর্শ দিলেন। এভাবে কয়েকমাস কেটে গেল। তিন্নি এখন অনেকটা স্বাভাবিক , আজকাল ঘর থেকে বের হয় কিন্তু আগের মত আর নেই। একেবারে শান্ত, চুপচাপ,স্থির।

কারো সাথে দেখা হলে বেশিক্ষণ কথা বলে না। ঘর থেকে বের হয়ে সোজা স্যারের কাছে পড়তে যায় তারপর আবার সোজা চলে আসে। এদিকে ফারহানের অবস্থাও স্বাভাবিক। সম্প্রতি জেরিন নামের একটি মেয়ের সাথে দেখা যায় ওকে। জেরিন ফারহানের ক্লাসমেট , ক্লাসে ওরাই সবচেয়ে ভালো স্টুডেন্ট বলে একে অপরকে পড়ালেখায় অনেক হেল্প করে।

কয়েকমাস আগের ঐ দুর্ঘটনার পর ফারহান মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিল আর ঐ মুহূর্তেই জেরিন ওর পাশে দাঁড়িয়েছিল। সময়ের সাথে জেরিন ওর প্রতি দুর্বল হতে থাকে,এখন ভালবাসে কিন্তু ফারহানকে বলতে ভয় পায়। আর এক মাস পর H.S.C. পরীক্ষা। তিন্নি সন্ধ্যায় স্যারের বাসা থেকে ফিরছিল হঠাৎ কে যেন পেছন থেকে ওর কাঁধে হাত রাখে,আচমকা পেছনে ফিরতেই দেখে ফারহান। কোন কথা না বলে আবার হাঁটা শুরু করে তিন্নি।

-------- প্লিজ ! তিন্নি, একটু দাঁড়াও, আমার কথাটা অন্তত শোন,তিন্নি প্লিজ! এই বলে পেছন থেকে তিন্নির হাত ধরে ফেললে তিন্নি ঝারি দিয়ে হাত সরিয়ে নেয়। ফারহান ওকে থামানোর জন্য সামনে দাড়িয়ে গেলে তিন্নি ওকে ধাক্কা দিয়ে দৌড়ে চলে যায়। মন খারাপ ফারহানের , মাথা নিচু করে বাসায় আসার সময় তিন্নির বাসার দিকে তাকাল। দরজার পাশে সিঁড়িতে বসে তিন্নি হাঁটুতে মাথা গুঁজে চুপিসারে কাঁদছিল। আস্তে আস্তে ফারহান ওর কাছে গিয়ে বসলো।

আবছা ভেজা চোখে ধীরেধীরে তিন্নির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তিন্নি ওকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাঁদা শুরু করলো। এতটা সময় ফারহান তিন্নি থেকে দূরে থেকে যতটা কষ্টে ছিল ঠিক ততটা কষ্টও তিন্নির মনে বাসা বেঁধেছিল। এতদিনের অভিমানটা তীব্র ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া বুঝি আর কিছুই ছিল না। ক্ষোভ আর অভিমান যতই বেশি হক না কেন ভালোবাসার মানুষকে নিজ থেকে দূরে রাখাটা তিন্নির জন্য অসম্ভব আর অভিশাপে পরিণত হয়েছিল। তাই আজ সকল অভিমান ছিন্ন করে তিন্নি আবার ফিরে এলো ফারহানের বুকে।

সবকিছু আবার ঠিকঠাক হয়ে গেল। সম্প্রতি তিন্নি ওদের সাথেই থাকে। আর এক সপ্তাহ পর ফাইনাল পরীক্ষা কিন্তু তিন্নি যতটা সিরিয়াস ফারহান ততটা নয়। তিন্নিকে ফিরে পেয়ে যেন সবকিছু ভুলে গেল সে। পরীক্ষার আগের রাতে খাবার টেবিলে বসে ওরা কথা বলছিল--- ফারহানঃ তোমার প্রিপারেশন কেমন হল? মিষ্টি এবার খাওয়া হবে তো? ------প্রিপারেশন কেমন তা পরীক্ষা দেয়ার পর বুঝবে,তবে এটা অন্তত বলতে পারি তোমার চেয়ে ভালো।

তুমি তো এতদিন ঠিকমত পড়ালেখা কর নি, বসে বসে ডিম পেড়েছ। ডিম এবার খাওয়া হবে তো? তিন্নির কথায় ফারহান ওর দিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা মায়াবী স্নিগ্ধ হাসি দিলো তারপর বলল, ----- তা অবশ্য ঠিক। যাই হোক কাল পরীক্ষা শেষে আমার জন্য দাঁড়াবে,আমি আর তুমি বাইরে কোথাও লাঞ্চ করতে যাব, ঠিক আছে? হুম! তিন্নি সম্মতি জানালো। পরের দিন ফারহান পরীক্ষা শেষে হল থেকে বেরনোর পথে করিডোরে জেরিনকে চেয়ারে বসে থাকতে দেখল , জেরিন মাথা নিচু করে কান্না করছে। জ্বর ছিল বলে প্রিপারেশন ভালো হয় নি, এখনও জ্বর শরীরে রয়ে গেছে।

এই পরিস্থিতিতে ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেয়ে জেরিন আবেগ ধরে রাখতে পারে নি তাই ফারহানকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরে কান্না করতে থাকল। জেরিনের অবস্থা খেয়াল রেখে ফারহান ব্যাপারটা খারাপভাবে নিল না বরং সান্ত্বনা দিচ্ছিল। পুরো ঘটনাটা তিন্নি এতক্ষণ অনেক দূর থেকে দেখছিল। ফারহানের আসতে দেরি হচ্ছে দেখে সে নিজেই ফারহানের কাছে আসছিল কিন্তু ঘটনার নেতিবাচক দৃশ্যটা দেখে তিন্নি ফারহানকে ভুল বুঝে বসলো। ফারহানের চোখাচোখি হতেই তিন্নি পেছন ফিরে সজোরে হাঁটা দিলো।

ফারহান তিন্নিকে থামাতে যাবে ঠিক ঐ মুহূর্তে খেয়াল করলো জেরিন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ফলে তিন্নির পিছু আর নেয়া হল না। জেরিনকে ওর বাসায় রেখে সন্ধ্যায় ফারহান বাসায় ফিরলে জানতে পারে তিন্নিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তিন্নির রুমে গিয়ে দেখল কাপড় আর অন্যান্য জিনিসপত্র নেই, ওর নিজ বাসায় তালা মারা,ওর বান্ধবী,আত্মীয় সবাইকে কল করেও ওর কোন খোঁজ পেল না। তাহলে কোথায় গেল তিন্নি? হতাশ মনে এই একটি কথা চিন্তা করছিল।

টেবিলের উপর চোখ পড়তেই দেখল নীল পেন্সিল বক্স যেটা গতকাল রাতে ফারহান তিন্নিকে উপহার দিয়েছিলো। কাঁদো কাঁদো চোখে বক্সটি খুলল। চিঠি; তিন্নির লেখা------- চিঠির শুরুতে ‘প্রিয়’ শব্দটি লিখতে খুব ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু হাজার চেষ্টার পরও কেন জানি লিখতে পারলাম না। কিভাবে লিখবো?যারা সবচেয়ে প্রিয় ছিল এই পৃথিবীতে তারা আমাকে একা করে চলে গেল শুধুমাত্র আর একটি প্রিয় মানুষের ভুলের কারণে। তার উপর দীর্ঘ সময় অভিমান করে ছিলাম কিন্তু প্রতিটা মুহূর্ত তার শূন্যতা আমি অনুভব করতাম।

পরে সে অভিমান আমার ভালোবাসার কাছেই হার মানে। কেন জানো? আমি ভেবেছিলাম মা-বাবার পর এখন শুধু তুমিই একজন প্রিয় মানুষ পৃথিবীতে আছো যে আমাকে অনেক ভালবাসবে,আমার বিশ্বাসটুকু রাখবে, আমাকে সুখে রাখবে আর বাবা-মার শূন্যতাটাও ভুলিয়ে দেবে ধীরেধীরে। কিন্তু আজ নিজ চোখে যা দেখলাম তাতে এইটুকু অন্তত বুঝতে পেরেছি যে মা-বাবার পর পৃথিবীতে আর কেউ প্রিয় হতে পারে না। তাই আজ ‘প্রিয়’ শব্দটি আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে। ভুলের হাজার ক্ষমা হয় কিন্তু দোষের কোন ক্ষমা হয় না, ফারহান ।

তাই আজ আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে তোমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছি এক অন্ধকার জগতে যেখানে শত ডাকেও তুমি আমাকে খুঁজে পাবে না আর না আমি তোমায় সাড়া দেব। না,আমি এতটা সবল না যে আত্মহত্যা করব আর না এতটা দুর্বল যে একা একা জীবন পাড়ি দিতে পারব না। আমি পারবো, তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো, নিশ্চয় পারবো! এখন হয়ত তোমার মনের মানুষের অভাব হবে না তবে এটা জেনে রাখো আমি তোমার কাছে আর কখনো ফিরবো না আর না তুমি আমার মতো কাউকে কখনো খুঁজে পাবে। এখানেই আমাদের সব শেষ আর না এখানে আমার কিছু বেচে আছে তাই আমি চলে গেলাম। ভালো থেকো।

সারারাত ফারহান বালিশে মাথা লুকিয়ে কান্না করছিলো। ফারহান কোনভাবেই তিন্নির এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে পারে নি। হঠাৎ করে তিন্নিকে হারানোর কষ্টে ফারাহানের পরীক্ষাগুলোও আর দেয়া হল না। প্রায় একমাস পর পরীক্ষা শেষ হল। ফারহান লেকের পাড়ে বসে ডায়েরীতে কি যেন লিখছিল।

হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ওর কাঁধে হাত রাখলো, ফারহান খুব তাড়াহুড়ো করে হাসিমুখে পেছন ফিরে,এই বুঝি তিন্নি ওর কাঁধে হাত রাখল কিন্তু না ওটা জেরিন ছিল। মুখটা আবার ফ্যাঁকাসে হয়ে গেল ,ওকে দেখে ডায়েরীটাও বন্ধ করে দিয়ে পাশে রেখে দিলো। ফারহানের মার কাছে ঘটনাটা শোনার পর জেরিন মনে মনে খুব কষ্ট পেল,কোথাও না কোথাও দোষ তারও ছিল, সে ই তো দায়ী। তাই ক্ষমা চাওয়ার জন্য সে ফারহানকে খুঁজতে খুঁজতে এখানে চলে এলো। ফারহান চুপচাপ শূন্য আকাশটার দিকে আনমনে তাকিয়ে আছে।

ওর নীরবতা দেখে জেরিনও কিছু বলার সাহস করতে পারল না,তাই ফারহানের চোখের আড়ালে ডায়েরীটা নিয়ে পড়া শুরু করলো......... ------- কখনো ভাবিনি তোমাকে এত সহজে হারিয়ে ফেলব, না কখনো ভেবেছিলাম তুমি আমাকে ছেড়ে এভাবে চলে যাবে বহুদুরে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি যে এতটা অভিমানী,আজ তুমিই এমনটা করেছ। মাঝে মাঝে চোখের দেখাও ভুল হয় কিন্তু তুমি কোন কিছু যাচাই না করেই কতটা সহজে আমাকে শাস্তিটা দিয়ে দিলে। অনেক সুখেই তো ছিলাম আমরা,হয়ত একটা ভুলের জন্য বিপর্যয় নেমে এসেছিল আর তুমি আমার আমার উপর অভিমান করে দূরে ছিলে,অতঃপর তুমি আবার আমার কাছে ফিরে এসে আমার রঙহীন অন্ধকার জীবনটাকে রংধনুর সাত রঙে রাঙিয়ে দিয়েছিলে। ভেবেছিলাম তোমার বাবা-মার পর তোমার পৃথিবীতে সবচেয়ে প্রিয় মানুষের জায়গাটা আমি ধারণ করে বাকি জীবনটা আনন্দে কাটিয়ে দেব।

কিন্তু না,আমার কল্পনাগুলো আজ কালো ধোয়ার মতো চারিদিক বিলীন হয়ে গেল। রাগের মাথায় তুমি আমাকে কতই না মারধর করতে,ঐ দিনও না হয় কিছু একটা মেরে বসতে আমাকে। কিন্তু ঐ মুহূর্তে তোমার অভিমানের রূপটা ঠিক অন্যরকমভাবে দেখা দিলো। তুমি থামলে না আর আমারও দুর্ভাগ্য যে আমিও ঐ মুহূর্তে তোমাকে থামাতে পারলাম না। আমি কি জানতাম ওটাই হবে তোমার সাথে আমার শেষ দেখা।

নাহ! ঐ দেখাকে আমি শেষ দেখা হতে দেব না। খুঁজবো, হ্যাঁ , আমি অবশ্যই আমার হারিয়ে যাওয়া রাজকন্যাকে খুঁজে বেড়াবো আর তাকে একদিন নিশ্চয় খুঁজে পাবো ! ওর ভুল ভাঙ্গাতে হবে,রাখুক সে নিজের অস্তিত্বকে লুকিয়ে,হয়ত তার খোঁজে পৃথিবীর সীমানায় চলে যাবো একদিন কিন্তু আমার বিশ্বাস আমার ভালোবাসা যদি সত্যি হয়ে থাকলে নিশ্চয় সে একদিন ধরা দেবে আমার ভালোবাসার কাছে.........। লেখাগুলো পড়া শেষে ফারহানকে সান্ত্বনা দেয়ার ভাষাগুলোও জেরিন হারিয়ে ফেলে,চেয়েছিল আজ মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসার পঙক্তিগুলো ওকে জানিয়ে দেবে। কিন্তু ফারহানের দিকে তাকাতেই দেখল পাশে নেই, জেরিন পেছন থেকে চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে, ফারহান হেঁটে চলেছে পশ্চিমাকাশের সূর্যাস্তের পথ ধরে আর নীরবে ভাবছে হারিয়ে তোমায় খুঁজে ফিরি...... শেষকথাঃ যাদের প্রতি আমাদের আবেগ-ভালবাসা বেশি থাকে তাদের সামান্যতম অবহেলায় আমরা অনেক বেশি অভিমান করে থাকি। হয়ত অভিমান একসময় কমে যায় কিন্তু পরে তাদের সামনে দাড়িয়ে সাথে কথা বলার সাহসটা যেন আমরা হারিয়ে ফেলি।

তাই তাদের এড়িয়ে চলি,নিজেদেরকে তাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করি।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।