১৬ জানুয়ারি, রবিবার দুপুর ২টা থেকে ৩টা এই এক ঘণ্টায় ঢাকার কারওয়ান বাজারের ভেতর দিয়ে তেজগাঁওয়ের দিকে যাওয়ার রাস্তায় একে একে এসে থামে বেশ কয়েকটি ট্রাক। ট্রাকগুলোতে চালের বস্তা। বস্তার গায়ে লেখা ‘খাদ্য অধিদপ্তরের জন্য’। চাল ভরা বস্তার পাশাপাশি কিছু খালি বস্তাও থাকে। ট্রাকগুলো সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের জন্য একেকটি দোকানের সামনে থামে।
কয়েকজন শ্রমিক দ্রুত চালের বস্তাগুলো নামিয়ে ফেলেন। এরপর খুব তাড়াতাড়ি ট্রাকগুলো চলে যায়। দোকানের শাটার নামিয়ে ফেলা হয়।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় গরিব মানুষের জন্য ওএমএসের চাল বিক্রির একটি ট্রাকের সামনে প্রায় ২০০ মানুষের লাইন। পশ্চিম শেওড়াপাড়ার আমেনা বেগম জানান, সকাল সাড়ে ১০টায় চাল কিনতে এসেছেন।
তখন দুটি লাইনে প্রায় আড়াই শ মানুষ ছিল। এখন সামনে আছে তিনজন। আজ তিনি চাল পেতেও পারেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, কারওয়ান বাজারে গত রবিবার যে ট্রাকগুলো চাল নামিয়ে গেছে, সেগুলো এই গরিব মানুষদের কাছে কম দামে বিক্রির জন্য সরকারের দেওয়া ওএমএসের চাল। এগুলো পাচার হয়ে চলে আসছে দোকানে দোকানে।
বিক্রি হচ্ছে কমপক্ষে ৩৫ টাকা কেজি দরে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, এ চাল খাদ্য অধিদপ্তর থেকে ডিলাররা পান সাড়ে ২২ টাকা কেজি দরে। দেড় টাকা কমিশন ধরে তাঁদের সেটা দরিদ্রদের কাছে বিক্রি করার কথা ২৪ টাকা করে। কিন্তু তাঁরা ‘ঘুষ দিয়ে আনতে হয়’Ñএ অজুহাতে এই চালের একটা অংশ পাচার করে দেন।
জানা যায়, অসাধু ব্যবসায়ীরা
ডিলারদের কাছ থেকে সেটা কেনে ৩০ টাকা কেজি দরে আর খুচরা দোকানে সেটা বিক্রি হয় কমপক্ষে ৩৫ টাকা দরে।
এভাবে চোরাই চক্রের কারসাজিতে
দরিদ্র মানুষ বঞ্চিত হয় কম দামের চাল থেকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও তাদের ফিরে যেতে হয় খালি হাতে।
বরাদ্দ পাওয়া চালের বড় অংশ নিয়মিতই এভাবে পাচার করছে ওএমএসের ট্রাকসেল, দোকান ও ফেয়ার প্রাইস কার্ডের (এফপিসি) ডিলাররা। এ অভিযোগে গত ২২ দিনে সারা দেশে ছয়জনের ডিলারশিপ বাতিল করেছে খাদ্য অধিদপ্তর।
শুধু তাই নয়, ওএমএসের চাল নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে আরো গুরুতর তথ্য।
পাচারের এ ঘটনা সম্পর্কে জানার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য নিতে গেলে তিনি সঙ্গে সঙ্গে তদন্তদল পাঠান কারওয়ান বাজারে। তারা আবার সেখানে গিয়ে উদ্ঘাটন করে যে, ওই চাল পুলিশের রেশনের এবং সেটাও অবৈধভাবে পাচার হয়ে চলে এসেছে বাজারে। ছবিতে চালের বস্তায় খাদ্য অধিদপ্তরের সিল স্পষ্ট দেখা যায়। কর্মকর্তারা বলেন, এই সিল ওএমএস এবং পুলিশের রেশনেরÑদুই রকম চালের বস্তাতেই থাকে।
রাজধানীর ডিলারদের সঙ্গে কথা বলে অভিযোগ পাওয়া যায়, সরকারি চাল বরাদ্দ পেতে খাদ্য অধিদপ্তরের গুদামের দারোয়ান থেকে শুরু করে রেশন অফিসের কর্মকর্তাদের লটপ্রতি ২০ টাকা থেকে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়।
ফলে চাল বিক্রির কমিশনের টাকা প্রায় পুরোটাই চলে যায়। এ খরচ পোষাতেই ডিলাররা কিছু চাল বিক্রি করে দেন ব্যবসায়ীদের কাছে। আর এ কাজে তাঁদের সহায়তা করেন ঢাকা রেশনিং অফিসের কিছু অসাধু কর্মকর্তা।
খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান বলেন, ‘গত ২৫ ডিসেম্বর থেকে ওএমএস চালুর পর এ পর্যন্ত সারা দেশের ছয়জন ডিলারের ডিলারশিপ ও লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। আমরা সর্বাÍক চেষ্টা চালাচ্ছি এসব অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত থাকবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার।
খাদ্য অধিদপ্তরের লোকজন এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’ তিনি বলেন, ‘কিছু কিছু ডিলার এ কাজ করে থাকতে পারে। তবে এটা সামগ্রিক চিত্র নয়। যারা এসব কাজ করছে, তারা ধরা পড়ে যাচ্ছে। ’
একজন ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘প্রতিটন চালের ডেলিভারি অর্ডার (ডিও) পেতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে এক হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়।
এ ছাড়া পরিদর্শককে দৈনিক ৫০০ টাকা, ডিও লেখাতে ১০০ টাকা, চাল মাপাতে লেবার চার্জের বাইরে অতিরিক্ত ২০০ টাকা, ডিও পোস্টিং করাতে ১০০ টাকা, গেট পাস পেতে ৫০ টাকা, দারোয়ানকে ২০ টাকা, ডিও পোস্টিংয়ের পিয়নকে ২০ টাকা ঘুষ দিতে হয়। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে কখনো কখনো এ হার কমবেশি হয়। ’
ওই ডিলার আরো বলেন, ‘ট্রাকসেল কর্মসূচির (ট্রাকে ওএমএসের চাল বিক্রি) একজন ডিলার দৈনিক তিন টন (তিন হাজার কেজি) চাল বরাদ্দ পান। প্রতি কেজিতে দেড় টাকা কমিশনে তাঁর লাভ হয় সাড়ে চার হাজার টাকা। লাভের টাকার চার হাজার টাকা চলে যায় ঘুষের পেছনে।
এর সঙ্গে দৈনিক এক হাজার থেকে এক হাজার ২০০ টাকা ট্রাক ভাড়া এবং চাল বিক্রির তিনজন শ্রমিকের মজুরি ৬০০ টাকা খরচ যোগ করলে লাভের বদলে উল্টো এক হাজার ৩০০ টাকা লোকসান দিতে হয়। ’
ওই ডিলার বলেন, ‘এ কারণেই রাজধানীসহ প্রায় সারা দেশের বেশির ভাগ ডিলার বরাদ্দ পাওয়া চালের বড় অংশ বিক্রি করে দেন। ২৪ টাকা কেজির চাল গোপনে বিক্রি করা হয় ৩০ টাকা দরে। এক টন চাল গোপনে বিক্রি করতে পারলেই ছয় হাজার টাকা লাভ হয়। ’
ফেয়ার প্রাইস কার্ডের একজন ডিলার জানান, প্রতি মাসে চাল ও গম মিলিয়ে পাঁচ টন খাদ্য বরাদ্দ পান তিনি।
এগুলো ছাড় করা ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাঁর ব্যয় হয় ১০ হাজার টাকার বেশি। কিন্তু আয় হয় সাড়ে সাত হাজার টাকা। এ কারণে চাল পাওয়ার পরপরই ডিলাররা অল্প কিছু সারা মাসে বিক্রির জন্য রেখে বাকিটা গোপনে বেচে দেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।