রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে কবিতা। রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে ছবি, নাটক, উপন্যাস, ছোটগল্প, গান। সাদা দাড়ির অদ্ভুত এই মুখচ্ছবি আমাদের কাছে শিল্প আর সংস্কৃতির এক বটবৃক্ষ। রবীন্দ্রনাথ মানে বাঙালি। যুগ যুগ ধরে বাঙালির পরিচয় উজ্জ্বল করে রাখা এক দূত।
এ মানুষটি কোথায় পেয়েছিলেন এতসব শিল্পকর্মের উপকরণ? কীভাবে জীবনের গভীর জায়গাগুলো ছুঁতে পেরেছিলেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের একজন উত্তরসূরি হয়েও? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর একটাই, তা হলো_ তিনি ছিলেন মাটি ও প্রকৃতির নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ একজন মানুষ। এই বন্ধন তাকে কখনো নিয়ে গেছে দরিদ্র প্রজাকুলের জীবন-সংগ্রামের ভেতর, কখনো এই বাংলার কৃষকদের ভালোমন্দের ভাবনায়, কখনো গ্রামীণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের চিন্তায়, কখনো প্রান্তিক মানুষকে সংগঠিত হয়ে পথ চলার ভাবনায়।
এই বাংলাদেশ সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে যেমন ছিল রবীন্দ্রনাথের জীবনের সবচেয়ে সোনালি অধ্যায়, একইভাবে গ্রাম উন্নয়ন, সমবায়, দারিদ্র্য বিমোচন, প্রান্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাংগঠনিক চেতনা সর্ব ক্ষেত্রেই হাতে-কলমে পরীক্ষাভূমি ছিল এটিই। বিশেষ করে কুষ্টিয়ার শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ও তার সংলগ্ন এলাকা, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, নওগাঁর পতিসর ও শ্বশুরালয় খুলনার দক্ষিণডিহি। এসব এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে এখনো রবীন্দ্রনাথ এক অন্য মানুষ।
শুধু কবি নন, একজন প্রজাদরদি জমিদার, উন্নয়নের এক পথ-প্রদর্শক, একজন দার্শনিক, একজন সংগঠক ও একজন প্রকৃত নেতা। আমি ২০০৫ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের কৃষি, সমবায়, পল্লী উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে একটু খোঁজ-খবর করার জন্য একাধিকবার শিলাইদহ, শাহজাদপুর ও পতিসরে গেছি। সেখানকার মানুষদের সঙ্গে কথা বলেছি। দেখেছি, অনেক কৃষকও পূর্ব পুরুষের মুখে এক প্রজাদরদি জমিদারের কথা শুনেছেন_ যিনি কৃষকের, জেলের, কামারের, কুমারের জীবনকে উন্নত করার জন্য ছিলেন দারুণ আন্তরিক।
তার জীবনের বিস্ময়কর এ পর্বগুলো রবীন্দ্রঅনুরাগী গবেষক সবাইকেই অবাক করে।
প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী কিংবা বিশেষ দিনগুলোয় তাকে স্মরণ করা হয় গানের ভেতর দিয়ে কবিতার ভেতর দিয়ে নাটকের ভেতর দিয়ে। কিন্তু এই বাঙালির জীবন-যাপন ও চেতনার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে বন্ধন তা থেকে যায় অনুচ্চারিতই। পশ্চিমবঙ্গের শ্রীনিকেতন এখনো রবীন্দ্রনাথের সব উন্নয়ন চিন্তার এক মডেল বা জাদুঘর হয়ে আছে। সম্প্রতি রবীন্দ্রনাথের এ দিকগুলো নিয়ে প্রামাণ্য অনুষ্ঠান করার সুবাদেই পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন গবেষকের কথা শোনার সুযোগ হলো। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বভারতীর গবেষক প্রফেসর নবকুমার মুখোপাধ্যায়, পল্লী সংগঠন বিভাগের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর দিক্ষিত সিনহা, চিত্রশিল্পী শ্যামলী খাস্তগীর ও প্রফেসর মৃণাল কান্তি দাশগুপ্তের সঙ্গে।
তারা রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার দর্শন, যৌক্তিকতা ও সংগ্রাম সম্পর্কে সম্যক অবগত। এ বিষয়ে আরও অনেক জানাশোনা হলো প্রফেসর সনৎ কুমার সাহার একটি গবেষণা প্রবন্ধ পড়ে।
রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে ১৯২২ সালে তার বহুদিনের স্বপ্ন-ভাবনাপল্লী-পুনর্গঠন কর্মকাণ্ডকে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেন। ওই বছর ছয় ফেব্রুয়ারি সেখানকার কুঠিবাড়িতে শুরু হয় তার ইনস্টিটিউট অফ রুরাল রিকনস্ট্রাকশনের কাজ। রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'আমার জীবনের যে দুটি সাধনা, এখানে হয়তো তার একটি সফল হবে।
কবে হবে, কেমন করে হবে, তখন তা জানতুম না। অনুর্বর ক্ষেত্রেও বীজ পড়লে দেখা যায় হঠাৎ একটি অঙ্কুর বেরিয়েছে, কোনো শুভলগ্নে। কিন্তু তখন তার কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। সব জিনিসেরই তখন অভাব। তারপর, আস্তে আস্তে বীজ অঙ্কুরিত হতে চলল।
' শ্রীনিকেতনে প্রাণ-প্রতিষ্ঠা হলো। তার পল্লী-উন্নয়নের উদ্যোগ-কল্পনা একটু একটু করে আকার পেতে লাগল। শান্তিনিকেতন থেকে মাইল দুয়েক দূরে সুরুলে এই শ্রীনিকেতন। তার জীবনের যে দুটি সাধনার কথা তিনি বলেছেন, তার একটির কেন্দ্র শান্তিনিকেতন; অন্যটির শ্রীনিকেতন। যেখানকার অনেক ইতিহাস, অনেক ঘটনা, অনেক সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্র গবেষকদের কাছে আজও এক জীবন্ত আখ্যান।
শান্তিনিকেতন-শ্রীনিকেতন নিয়েই ছিল রবীন্দ্রনাথের সব সময়ের চিন্তা। একদিকে শিক্ষায় মনের মুক্তি খোঁজা, অন্যদিকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে উপেক্ষিত পল্লীবাসীর উদ্ধারের পথ অনুসন্ধান। শুধুই চিন্তার ছক কেটে নয়, একেবারে হাতে-কলমে। এক রকম নিজের সর্বস্ব পণ করেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন, 'এক তাল সোনা নয়, এক প্রজ্বলিত প্রদীপ আমাদের লক্ষ্য।
আমি রাজনীতি বা সমাজসেবার পথে যেতে পারতাম, দেশবাসীর পুজোও তাতে পেতাম, কিন্তু স্বভাবতই আমি তা এড়িয়ে গেছি। ' অবাক হই, আজ থেকে শত বছর আগেও রবীন্দ্রনাথ নিজের খ্যাতি ও যশের প্রশ্নে এই সংযম দেখাতে পেরেছিলেন জেনে।
শ্রীনিকেতন রবীন্দ্রনাথের জন্য এক পর্যায়ে হয়ে দাঁড়ায় দারুণ বিশ্বাসের এক জায়গা। তিনি কী করতে চান, কতটা পারেন, কীভাবে পারেন, এসবের প্রাথমিক উপলব্ধি একটা আকার পায় ওই পতিসর-শিলাইদহের পরীক্ষা-নিরীক্ষায়। একে বলা যেতে পারে পাইলট-প্রজেক্ট।
প্রায় ষাট বিঘার মতো ছিল শ্রীনিকেতনের খামারের আয়তন। সেচের জন্য ছিল মাঝখানে বড় একটা দিঘি। গতানুগতিক ফসলের বাইরে শাকসবজি, ফলমূল উৎপাদনেও নজর দেন তিনি। নজর দেন উন্নতজাতের হাঁস-মুরগি ও গবাদিপশু পালনে। সেই সঙ্গে জমির উর্বরতা যাতে না কমে, সে দিকেও খেয়াল রাখেন।
সার-বীজ এসবের সুষ্ঠু ব্যবহার আর উপযুক্ত সেচে কৃষিতে উৎপাদিকা শক্তি ও উৎপাদন বাড়াবার কৌশলও হাতে-কলমে শেখানো হয় কৃষকদের। আদর্শ খামার গড়ে আশপাশের গ্রামবাসীকে ডেকে এনে তাদের তা দেখান। নতুন জ্ঞান তাদের ভেতর ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেন। আর রবীন্দ্রনাথ যাকে দিয়ে এই কাজগুলো করার জন্য নিয়োগ করেছিলেন কৃষি অর্থনীতিবিদ ব্রিটিশ যুবক লিওনার্দো এল্মহার্স্টকে। রবীন্দ্রনাথ তার জীবদ্দশায় বিশ্বভারতী-শ্রীনিকেতন উদ্যোগে অর্থ সংগ্রহের আশায় দেশে-বিদেশে হন্যে হয়ে ছুটেছেন।
অনেক ব্রিটিশ নাগরিককে রবীন্দ্রনাথ শ্রীনিকেতনে এনে যখন তার পরিকল্পনার কথা শোনান, অনেকেই প্রাথমিকভাবে মনে করেছিলেন, এটি রীতিমতো একটি পাগলামি ছাড়া কিছু নয় এবং ওই উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তাদের ভুল প্রমাণ করে রবীন্দ্রনাথ অল্প দিনেই বিদেশি অর্থ-সহায়তা জোগাড় করে তার স্বপ্নের আদলেই গড়তে শুরু করেন শ্রীনিকেতন। রবীন্দ্রনাথ জীবদ্দশাতেই শ্রীনিকেতন প্রতিষ্ঠার দারুণ সাফল্য দেখে গেছেন। তিনি বলেছেন, শ্রীনিকেতনের সহমর্মিতার ও উদ্দীপক ভূমিকার অনুপ্রেরণা চারপাশের গ্রামগুলোতে যে বিপুল উপকার সাধন করেছে, বিজ্ঞানের কোনো নৈর্ব্যক্তিক মানরাশি যত মূল্যবানই হোক, তার সঙ্গে তুলনায় তাকে কখনোই খাটো করে দেখা যায় না।
কৃষি ও পল্লীর জনজীবনের উন্নয়নে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা আজ সভ্যতার এই বিকশিত সময়ে এসেও দারুণ উপযোগী।
জীবন জীবিকা ও অর্থনীতির প্রশ্নে তার দর্শন সত্যিই অভাবনীয়। তিনি বলেছেন, 'কোনোমতে খেয়ে-পরে টিকে থাকতে পারে এতটুকুমাত্র ব্যবস্থা কোনো মানুষের পক্ষেই শ্রেয় নয়, তাতে তার অপমান। যথেষ্ট পরিমাণে উদ্বৃত্ত অর্থ, উদ্বৃত্ত অবকাশ মনুষ্যত্ব-চর্চার পক্ষে প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন। ' কিন্তু বিশাল এই দিক-নির্দেশনা, সৃজনশীলতার এই প্রেরণাকে আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। এ নিয়ে গবেষকদের মধ্যেও অনেক খেদ রয়েছে।
বলা বাহুল্য, আমাদের সমাজের অনেক উন্নয়ন ইস্যুতেই রবীন্দ্রনাথ তার চিন্তা-চেতনা হতে পারে মডেল, কিন্তু সেগুলো তলিয়ে দেখাই হয়নি। আজও পর্যন্ত আমরা কবি-সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যতটা নাচছি, ততটা নাচছি না তার দেশ গড়ার সূত্রগুলো নিয়ে। বহুযুগ পার হলেও রবীন্দ্রনাথের এ দিকগুলো নিয়ে খুব বেশি গবেষণা যেমন হয়নি, তেমনি এগুলোর দিকে দৃষ্টি পড়েনি নীতি-নির্ধারকদেরও। আজ সময়ের প্রয়োজনেই এ দিকটিকে মনযোগ দেওয়া অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। রবীন্দ্রনাথের শ্রীনিকেতন এই বাংলার অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হলেও আমাদের এখানে আমরা রবীন্দ্রনাথকে পাচ্ছি শিল্প-সংস্কৃতির দিকপাল হিসেবে।
আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা, আমাদের কৃষি, আমাদের অর্থনীতি, আমাদের গ্রামোন্নয়ন, আমাদের সমবায়, আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, আমাদের সংগঠন এসব ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথের বিশাল অবদানকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে আমরা যত দ্রুত আন্তরিক হতে পারব, অনুসরণ করতে পারব_ তত দ্রুত আমরা খুঁজে পাব দিশাহারা প্রান্তিক মানুষের মুক্তি। বিশ্বকবির সার্ধশততম জন্মবার্ষিকীর এই শুভক্ষণে বাংলা ভাষাভাষী সব পাঠকের কাছে বিনীত আহ্বান_ 'আসুন চর্চা করি উন্নয়নমনস্ক এক রবীন্দ্রনাথের'। ই-মেইল : shykhs@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।