বাড়ির ছোট-বড় সবাই বাসষ্ট্যান্ড থেকে নিশি ফুপুকে এগিয়ে নিয়ে এলো। এগিয়ে না এনে উপায় নেই। নিশি ফুপুর সাথে সাত-আটটি ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে লেপ, জামা-কাপড়,আতপ চাল, সিদ্ধ চাল, পিঠার গুড়ি, পিঠা আরো বহু কিছু। বাসের দু'টি ক্যারিয়ার থেকেই নামল তার বিশাল আয়তনের ব্যাগগুলি।
ময়মনসিংহ থেকে তাকে বাসে তুলে দিয়ে গেছে শশি চাচা। বাসের শেষ ষ্টপেজ নারায়ণগঞ্জ। বাসের হেলপার ব্যাগগুলি নামিয়ে দিয়েছে। রাস্তায় ছোটখাট ব্যাগের স্তুপ সাজিয়ে নিশি ফুপু দাড়িয়ে আছেন। সাথে তার ছেলে আমন।
তাদের দু'জনের পক্ষে এতগুলি ব্যাগ বাসায় নেয়া সম্ভব না। তাই সবাই এসেছে ব্যাগগুলি নিতে।
তিন রিকশায় বিশাল বিশাল লটবহর নিয়ে বাসায় ফিরে এলো সবাই। ব্যাগ থেকে একে একে নামতে লাগলো নানা জিনিসপত্র। শেষে বাকি রইলো ছোট একটি ব্যাগ।
বাজারের ব্যাগ।
'এটার ভেতরে কি ফুপু?' অনন্ত জিজ্ঞেস করলো।
'এটার ভিতরে?দাড়া দেখাচ্ছি। '
নিশি ফুপু ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে বের করে আনলেন আস্ত একটা পাতিহাঁস। বের হয়েই সে প্যাক প্যাক করে ডাকলো।
'মা' বলে চিৎকার দিয়ে দূরে সড়ে গেলো অনন্ত। হাঁস-মুরগী দেখলে অনন্ত ভয় পায়।
'এটা তো কিছু বলবে না। ভয় পাবার কিছু নেই। আয় সামনে এসে ধর।
এটার ডানা বাঁধা দেখ...। '
নানাভাবে বুঝাতে লাগলেন নিশিফুপু। কিন্তু অনন্তর ভয় ভাঙ্গলো না।
নিশিফুপুর ছেলে আমন ক্লাস ফোরে পড়ে। ও সুন্দর করে হাঁসের ডানা থেকে বাঁধন খুলে ফেললো।
রওনক,ইলিন,নদী,বৈশাখি বাড়ির পিচ্চিরা সবাই অবাক হয়ে দেখলো। বাববাহ। আমন ভাইয়ার কত সাহস।
শিরিন মামী বললেন, 'যাও হাঁসটাকে বাড়ান্দায় নিয়ে যাও। আমি হাঁসের ঘর এনে দিচ্ছি।
'
সবাই গেলো আমন ভাইয়ার পেছন পেছন। শুধু অনন্ত গেলো ওর মা'র পিছু পিছু। মা কি হাঁসের জন্য নতুন একটা ঘর তৈরী করবে? কি দিয়ে হাঁসের ঘর তৈরী হয়?
অনন্ত অবাক হয়ে দেখলো মা গিয়ে ওদের পুরনো পত্রিকা রাখার বাঁশের খাচিটা নিলেন। ড্রইংরুমে এটা সাজানো থাকে। উপরের দিকটা অনেকটা মসজিদের মিনারের মতো সরু হয়ে এসেছে।
আর নিচের দিকটা ছড়ানো।
'এটাই হাঁসের ঘর মা?'
'এটাই হাঁসের ঘর। এটার নাম হচ্ছে পলো।
'পলো?'
'হ্যা পলো । পলো দিয়ে মাছ ধরে।
আবার পলোর নিচে হাঁস-মুরগীও রাখে। '
ওদের বিশাল ফ্ল্যাটের বিশাল বাড়ান্দা। বাড়ান্দায় হাঁস ঘিরে বসে আছে পিচ্চিরা। অনন্তর মা পলো দিয়ে হাঁসকে ঢেকে দিলেন। বাড়ান্দায় বক্তৃতা ঝাড়ছে আমন ভাইয়া।
শশি চাচা ময়মনসিংহের গ্রামে বাড়ি করেছে। গ্রামে হাসেরা কি করেছে এখন সে গল্প চলছে।
'হাঁসেরা তো মুরগীর মতো অভদ্র না। তারা বাচ্চাদের দেখলেও দৌড়ে চলে যায় না। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকে।
নিজের কাজ করে। আর চলে গেলেও আস্তে আস্তে সুন্দর করে যায়। আমাদের স্যারের মতো, আস্তে আস্তে। হাঁসেরা ভাত খায়। ভুসি খায়।
মাঝে মধ্যে একটু কাঁদা ঘাটাঘাটি করে না , তা-না। এটা তো মুরগীরাও করে। তবে হাসেরা একটু পরেই পুকুরে গিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলে। ওরা যা পরিস্কার না!'
অনন্ত দূরে দাড়িয়ে আমন ভাইয়ার কথা শুনছে। ময়মনসিংহ থেকে নারায়ণগঞ্জ আসতে পাঁচ ঘন্টা লাগে।
এ পাঁচ ঘন্টা তো তাহলে হাঁসটি কিছু খায়নি। ওকে তো আগে খাওয়াতে হবে।
অনন্ত দৌড়ে গেলো মা'র কাছে। 'মা হাঁসের অনেক ক্ষুধা পেয়েছে। ওকে ভাত দাও।
'
'ও,আচ্ছা। দিচ্ছি। '
বাসার একটা পুরনো প্লেটে হাঁসের জন্য ভাত দিলেন মা। অনন্ত প্লেট নিয়ে গেলো হাঁসের কাছে।
'ও, হাঁসের জন্য ভাত এনেছিস।
ভালো করেছিস। দে খাওয়াই। ' আমন অনন্তের কাছ থেকে প্লেট নিয়ে পলোর ভেতরে দিলো। সাথে সাথেই খেতে শুরু করলো হাঁসটি।
'আহারে ওর খুব ক্ষুধা পেয়েছিলো।
' মনে মনে বললো অনন্ত। এরপর ও ছুটলো পানি আনতে। ভাত খাওয়ার পর অনন্তর পানি খেতে ইচ্ছে করে। হাঁসটিরও নিশ্চই ইচ্ছে করবে।
পানি নিয়ে যখন আসছিলো তখন ওরা মা বললেন,'অনন্ত পানি নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?'
'হাঁস খাবে মা।
'
'তোর গ্লাসে কেন?'
'ও ভালো গ্লাস ছাড়া খেতে পারে না। '
'পারে। ' বলে মা অনন্তর গ্লাস রেখে পুরনো একটা মগে পানি দিলেন।
পানি দিতেই হাঁসটা লম্বা ঠোঁট মগে ঢুকিয়ে ঠিকই পানি খেলো। ওর পানি পিপাসাও লেগেছিলো।
ইলিন একটা পাখা নিয়ে এলো। হাঁসটাকে বাতাস করতে লাগলো।
'বাতাস করছিস কেনো?' আমন জিজ্ঞেস করলো।
'হাসটা তো আসার সময় ব্যাগে ছিলো। ঠিকমতো নি:শ্বাস নিতে পারেনি।
তাই বাতাস করছি। যাতে এখন ঠিকমতো নি:শ্বাস নিতে পারে। '
'বাসে হাঁসও ঠিকমতোই নি:শ্বাস নিয়েছে। শশি মামা হাঁস ঢুকিয়ে ব্যাগে একটা জানালা বানিয়ে দিয়েছেন। ' আমন বললো।
'ব্যাগে জানালা? কই দেখলাম না তো?' নদী বললো।
'ব্যাগটা নিয়ে আয় দেখাই। '
নদী দৌড়ে গিয়ে ব্যাগটা নিয়ে এলো। আসলেও তো ব্যাগের নিচের দিকটা ছোট করে কাটা। যাতে ব্যাগে হাঁস ঢোকালে এদিক দিয়ে নি:শ্বাসের যতো বাতাস পেতে পারে।
বাড়ির ছেলেমেয়েরা ছোট চাচার (কারো চাচা কারো মামা) বুদ্ধি দেখে গর্বিত হয়ে উঠলো। কাদের ছোট চাচা দেখতে হবে না?
আস্তে আস্তে অনন্তর ভয় কেঁটে গেলো। বাড়ির সব ছেলেমেয়ে এখন হাঁস ঘিরে বসে থাকে। নড়তেই চায় না। হাঁসের সাথে ওরা কথা বলার চেষ্টা করছে।
হাঁসও ওদের সাথে কিছুটা শুনছে বলে মনে হয়। 'এই হাঁস এই হাঁস' বলে ডাক দিলে হাঁসটি মুখ তুলে এদিক ওদিক তাকায়। কে ডাকলো খুঁজে। ওরা চিপস, চকলেট খেলে হাঁসকেও দেয়। হাঁস শক্ত ঠোট দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেখে।
তবে খায় না। বিকেলে সবাই ব্যাডমিন্টন খেলতে বাইরে যায়। হাঁসকে পেয়ে আজ আর গেলো না।
শীতের দিন। তাড়াতাড়ি সন্ধা নেমে এলো।
সবাইকে ডেকে নিয়ে পড়তে বসালেন বড়রা। কিন্তু সবারই মন পড়ে রইলো হাঁসটার কাছে। আহা হাঁসটা কি জানি করছে। ও একা একা থাকতে ভয় পাবে না? নানা অযুহাতে একটুপরপর একজন একজন উঠে গিয়ে হাঁসটাকে দেখে আসলো।
অনন্ত স্কুলে ভতর্ী হতে পড়ছে।
রাতে পড়া আর খাওয়া শেষ করে ঘুমুতে গেলো। ভালো শীত পড়ছে কয়েকদিন ধরে। বিছানায় কম্বলের নিচে শুয়ে হঠাৎ মনে হলো আরে হাঁসের শীত করছে না?
'মা একটা পুরনো কম্বল দাও। ' অনন্ত বললো।
'কেন?'
'হাঁসকে ঢেকে দিয়ে আসি।
হাঁসের শীত করছে। '
'হাঁসের শীত? ও আচ্ছা, দাড়া। '
'অনন্তর মা খাটের নিচ থেকে একটা চটের বস্তা বের করলেন। '
'চল হাঁসকে ঢেকে দিয়ে আসি। '
'এটা দিয়ে হবে? একটা পুরনো কম্বল দিলে হতো না?'
'এটা দিয়েই হবে।
হাঁসদের কম্বল লাগে না। '
মা ভালো করে পলোটার চারিদিকে চটের বস্তাটা দিয়ে দিলেন।
তিন-চারদিন কেটে গেলো ওদের হাঁস নিয়ে। একদিন বিকেলে নদী খবর নিয়ে এলো, 'আমন ভাইয়া, আমন ভাইয়া , মা বলেছে পরশুদিন মেহমান আসবে বাসায়। ঐদিন হাঁসটা কেটে মেহমানদের খাওয়াবে।
'
'বলিস কি, তুই ঠিকমতো শুনেছিস?'
'আমিও সাথে ছিলাম। নদী ঠিকই বলেছে। ' ইলিন বললো।
ওরা সবাই ভাবনায় পড়লো। হাঁসটিকে কিভাবে বাঁচানো যায়।
হাঁসটিকে কেটে ফেলতে হবে কেন এটাই ওরা বুঝতে পারছে না।
ইলিন বললো, 'আমন ভাইয়া, তুমি গিয়ে নিশি ফুপির কাছে বলো । যাতে হাঁসটাকে না কাঁটে। '
'মাকে বলে কাজ হবে না। বলতে হবে বড় মামীকে।
আর আমি একা বললে কাজ হবে না। সবাই একসাথে গিয়ে বলতে হবে। '
'আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা সবাই একসাথে যাবো। ' অনন্ত বললো।
'চলো এখনই যাই। ' বৈশাখি বললো।
গবাই একসাথে গিয়ে ধরলো অনন্তর মাকে। অন্তর বাবা হচ্ছেন বড় মামা। পরিবারে সবার বড়।
তাই বড় মামীর কথা সবাই শোনে। তিনি যদি হাঁসটাকে কাঁটতে না বলেন তাহলে কেউ কাঁটবে না।
সব শুনে বড় মামী বললেন,'হাঁস কাঁটতে হবে। মেহমান আসছে। তোমরা অন্য কিছু নিয়ে খেলো।
যাও। '
সবাই মন খারাপ করে ফিরে এলো।
সবার মন অ-নে-ক খারাপ হয়ে গেলো। আর ভালো হতে চা-য়-ই না।
শেষে অনন্তর মাথায় একটা বুদ্ধি এলো।
সে বুদ্ধিটা কাউকে বললো না। আমন ভাইয়াকে ডেকে আলাদা করে বললো।
আমন ভাইয়া শুধু ইলিনকে ডেকে কিজানি বললেন।
পরদিন সকালে যখন সবাই ঘুমে তখন আমন আর অনন্ত ঘুম থেকে জেগে উঠলো। দরজা খুলে হাঁস নিয়ে বের হয়ে পড়লো দু'জন।
দরজা লাগালো ইলিন।
ওদের গলির মোড়টা পার হলেই মহল্লার বড় রাস্তা। বড় রাস্তা দিয়ে একটু গেলেই আবার একটা গলি। গলির শেষে পোষ্টাল কলোনীর পুকুর। আমন ব্যাডমিন্টন খেলতে বের হয়ে প্রায়ই এদিকে চলে আসে।
বিশাল পুুকুর। কুয়াশায় পুকুরের পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। পুকুরের বিভিন্ন দিকে গাছপালার জঙ্গল। এত সকালেই অতিথি পাখিরা এসে পুকুরকে মাতিয়ে তুলেছে। আমন হাঁসটাকে ছেড়ে দিলো পুকুরের পানিতে।
ছাড়া পেয়ে হাঁসটা কিছুক্ষন ওদের কাছাকাছি সাঁতাড় কাঁটলো। তারপর অল্প একটু দূরে গেলো সাঁতাড় কেঁটে। কোত্থেকে আরো বেশ কিছু হাঁস এসে জুড়লো ওর সাথে। এরপর হাঁসগুলি সবাই মিলে আরো দূরে গেলো। এরপর আরো দূরে।
আরো দূরে। কোথায় হাড়িয়ে গেলো হাঁসের ঝাঁকটা। আর দেখাই যাচ্ছে না।
হাঁসটাকে ছেড়ে দিয়ে ওদের মন আনন্দে নাচছে। কিন্তু বাসার রাস্তা ধরতেই আমনের ভয় করতে লাগলো।
এতক্ষনে নিশ্চই বড়মামী ঘুম থেকে উঠে গেছেন। অনন্তকে না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করেছেন। আজ আমনের কপালে নিশ্চিত রামধোলাই আছে। অনন্তরও পিটুনি খেতে হবে।
দু'ভাই ভয়ে ভয়ে বাসার দরজায় নক করলো।
ইলিন দরজা খুলে দিলো। ও না ঘুমিয়ে অপেক্ষায় ছিলো কখন ভাইয়ারা আসবে। তখনও বাসার কেউ জেগে ওঠেনি। ওরা দু'জন যার যার বিছানায় শুয়ে পড়লো।
সকাল দশটার দিকে সবার চোখে পড়লো হাঁস নেই।
ঘরে খোঁজাখুঁজির পর বাড়ির পিচ্চিদের জিজ্ঞেস করা হলো। আমন,অনন্ত সোজাসুজি বলে দিলো ওরা কি করেছে। নিশি ফুঁপি প্রচন্ড রাগ করলেন। তিনি পিটুনি দিতে যাচ্ছিলেন আমনকে। কিন্তু বড়মামী বাঁচিয়ে দিলেন।
বললেন,'না,ওরা আর এরকম করবে না। ছেড়ে দাও। '
এরপর অবশ্য ওরা আর এরকম করেনি। তবে কোথাও কোন হাঁস দেখলেই ওদের ঐ হাঁসটার কথা মনে পড়ে। মনে হয় ওদের হাঁসটা এই পৃথিবীতেই আছে।
কোথাও না কোথাও হয়ত খাবার খুঁজছে। কিংবা অন্যদের সাথে ঝাঁক বেঁধে কাঁটছে সাঁতাড়। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।