মুছে যাক গ্লানি,মুছে যাক জরা....
আমি যখন ক্লাস এইটের ছাত্র,তখন বাবার চাকরীর সূত্রে গিয়েছিলাম নড়াইলে। সময়টা ছিল ২০০৩ । নড়াইলে যাওয়ার পরপরই জানতে পারলাম,বাংলাদেশের নবীন পেশ বলার মাশরফি বিন মূ্র্তজার বাড়ি এই নড়াইলেই। এমনি আমার ভাগ্য,এক বছর পর সেই মাশরাফিদের বাসাই ভাড়া নিলাম আমরা । মাশরাফি ভাইয়ার ডাক নাম, “কৌশিক”।
কৌশিক নামেই এলাকায় পরিচিত তিনি । কৌশিক ভাইদের পরিবারের সাথে দারূণ সম্পর্ক ছিল আমাদের;এটাকে নিছক বাড়িওয়ালা ভাড়াটিয়া সম্পর্ক ভাব্লে ভুল হবে। । কৌশিক ভায়ের মা, বলাকা আন্টি প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায় । জাতীয় দলের ব্যস্ত কর্মসূচির ফাঁকে সুযোগ পেলেই বাড়ি চলে আসত কৌশিক ভাই ।
কৌশিক ভাইদের বাসার সামনে শীত কালে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সে খেলায় কৌশিক ভায়ের বাবা স্বপন কাকুও অংশ নিতেন মাঝে মাঝে । অনেকেই হয়তো জানেন না, কৌশিক ভায়ের বাবা স্বপন কাকুও কিন্তু ভালো ব্যাডমিন্টন খেলোয়ার । আসলে,খেলাধূলায় যে নড়াইল এত উন্নত, নড়াইলে না গেলে সেটা বুঝতে পারতেম না। শুধু ক্রিকেট খেলায় নয়, টেবিল টেনিসসহ বিভিন্ন খেলায় নড়াইলের ছেলেমেয়ারা খুবই খুবই।
এই নড়াইলেই কেটেছে আমার স্কুল জীবনের শেষ অধ্যায় । কয়েকটি মজার ঘটনা শেয়ার করছি।
একদিন মাঠে খেলতে গিয়ে সিজার নামে একটা ছেলের বলে বেশ ভাল রান করলাম। (খেলাধূলায় আমি খুব একটা ভালো নই। ). খেলা শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে জানতে পারলাম যার বলে এত পেটালাম সে বাংলাদেশ দলের সেরা পেশ বোলার মাশরাফি বিন মূর্তজার ছোট ভাই,সিজার ।
ব্যাপরটা আমার জন্য ছিল রিতীমত রোমানঞ্চকর।
মাঠে একদিন হঠাৎ দেখলাম কৌশিক ভাইকে। ফুটবল খেলছিলেন তিনি । আমার মনে হচ্ছিল যেন কোনো দানবকে দেখছি মাঠে । আসলে বাংলাদেশের মানুষের গর উচ্চতার চেয়ে ওনার উচ্চতা এতই বেশি যে হঠাৎ দেখলে তা চমকে উঠার মতই।
আমাদের স্কুলের তৃ্তীয়তলা থেকে একবার পড়ে গিয়েছিলেন কৌশিক ভাই । সেই জায়গাটাও দেখলাম । আসলে,যে স্কুলে পড়েছি সেই স্কুলের প্রতিটা বিন্দুতে মিশে আছে,কৌশিক ভায়ের স্মৃতি।
কৌশিক ভাই নড়াইলে আসলে সবসময়ই দেখতাম ওনার নিজের ক্লাবের ছেলেদের প্র্যক্টিস করানোর দ্বায়িত্ব নিতে। স্বাভাবিকভাবেই নিজের এলাকায় ওনার কোন স্টার সুলভ আচরণ আমি দেখিনি।
কেউ কেউ বলত উনি নাকি নিজের এলাকার ছেলেমেয়েদেরকে কখোন অটগ্রাফ দেননা। অনেকে অনেক নেতিবাচক কথা বলত উনার সম্পর্কে। সেগুলো এখানে উল্লেখ করছি না। আসলে উনি ছিলেন "দুষ্টু ছেলে" !!উনার সাথে খেলার সৌভাগ্য অবশ্য নড়াইলের অনেকের মত আমারো হয়েছে।
মনে হলে হাসিই পায়,কৌশিক ভায়ের বাবা একবার মিষ্টি নিয়ে আসলেন আমাদের বাসায়।
উপলক্ষ জানতে চাইলে বললেন,"ছেলে দার্শনিক হবে। " "মানে?" মানে কৌশিক ভাই,জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলোয়ার কোঠায় দর্শনে চাঞ্চ পেয়েছে। খুবই খুশির খবর!এখন অবশ্য উনি ওখানে পড়ছেন না।
কৌশিক ভাই যখন ইনজুরিতে পড়লেন তখন বলাকা আন্টির মনের অবস্থা কেমন হয়েছিল সে ভাষায় বর্ণণা করা সম্ভব না । মানষিকভাবে যতটুকু স্বান্তনা জানানো সম্ভব আমরা জানিয়েছিলাম।
খুব খারাপ লেগেছিল যেদিন আন্টিকে কাঁদতে দেখেছিলাম।
সকালে আমি প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় দেখতাম কৌশিক ভাই মাঠে দৌড়াচ্ছেন,নিজেকে তৈরী করছেন। অসম্ভব মনের জোর ছিল ওনার। সেই মনের জোর দিয়েই জয় করেছিলেন সকল বাধা । বলাকা আন্টি যেদিন আমাদের বাসায় এসে অতি আনন্দের সাথে জানালেন যে,কৌশিক ভাই এখন খেলার জন্য পুরপুরি ফিট, সেদিন তার আনন্দে আমরাও সামিল হয়েছিলাম ।
দূর্ভাগ্য আমার, কৌশিক ভায়ের বিয়েতে থাকতে পারিনি, কারণ তার মাত্র কয়েকদিন আগেই বাবার বদলির কারণে আমরা পাড়ি জমালাম পাবনায়। ২০০৬সালে অনেক ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল কৌশিক ভায়ের । যোগাযগ প্রায় ছিলইনা বলতেগেলে ওনাদের সাথে । এর মাঝে অনেক বড় স্টার হয়েছেন তিনি। আইসিএল বিতর্কে না জড়ান তাকে আরো সম্মানিত করেছে।
ইঞ্জুরি সমস্যাও আর অতটা ভোগায় না তাকে। পেয়েছেন বাংলাদেশের সহ অধিনায়ক হওয়ার সম্মান ।
২০০৯ এর জানুয়ারি মাসে বেড়াতে গিয়েছিলাম নড়াইলে। বন্ধুদের সাথে দেখা করাই ছিল উদ্দেশ্য । কৌশিক ভাইদের বাড়ি “ছোট্ট কুঠি”-র পাশ দিয়ে যাওয়ার মনে হলো একবার বলাকা আন্টির সাথে দেখা করা উচিত।
কিন্তু কিছুটা দ্বিধান্বিতও হলাম;নড়াইলে থাকতে যা মনে কখনো মনে হয় নি তাই তখন মনে হলো। মনে হলো,এত বড় একজন স্টারের বাড়িতে ঢুকব?আন্টি আমাকে চিনবেনতো!
আন্টিকে দেখে ছালাম দিলাম । অবাক হলাম,আন্টি আমাকে চিনতে একটুও সময় নিলেন না। অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কথা বললেন । আমার আরো দুইজন বন্ধু ছিল সেখানে।
আমাদের তিনজনকেই নিমত্রন জানালেন রাতে খাওয়ার জন্য। খুব অস্বস্তি হচ্ছিল,কিন্তু এতটাই আন্তরিকতার সাথে তিনি বললেন,"না বললে হবে না,খেতেই হবে ",যে আমি রাজি না হয়ে পারলাম না। তিন বন্ধু মিলে এক সাথে খেলাম। খেতে বসে অনেক গল্প করলাম। কৌশিক ভায়ের সাথে যুবরাজ,এরফান পাঠান, শ্রীসান্থ এর ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা বললেন বলাকা আন্টি।
বাংলাদেশ দলের বিরল অনেক তথ্যও জানলাম যেসব তথ্য বাংলাদেশের সাংবাদিকদের কাছে নেই। (গোপনীয়তার কারনে সেগুলো উল্লেখ করলাম না)।
মাঝখানে কেটে গেছে চার বছর কিন্তু তিনি ঠিকই মনে রেখেছেন,যে আমি খাওয়ার ব্যপারে খুব সিম্পল । ডিম বেশি খাই না,চিংরি মাছ পছন্দ করি,ইত্যাদি কনো কিছুই তিনি ভলেননি। ব্যপারটা আমার কাছে রিতীমত বিষ্ময়কর মনে হয়েছে।
এলাকায় কৌশিক ভাইদের ইমেজ খুবই ভাল। সবাইকে তাদেরকে জানে পরোপকারি হিসেবে। পণ্ডিত রবি শংকর,উদয় শংকর,এস.এম.সুলতানের দেশে মাশরাফি আর নড়াইলের কৌশিক এক নতুন বিষ্ময়। ইঞ্জুরির সাথে এত লড়াই করতে না হলে,তার ক্যারিয়ার এর চেয়ে অনেক ভাল হতে পারত,এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যাহোক,খুব ভাল এক স্মৃতি নিয়ে ফিরলাম সেখান থেকে।
খুব সাধারণ হলেও আমার কাছে তা সম্পদের মতই ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।