"বাঙ্গালী জাতির গৌরবময় ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় সংস্কৃতির জন্য অপমানজনক কোনকিছু এই ব্লগে লেখা যাবে না। "শিহরণে সত্তায় তুমি, হে আমার জন্মভূমি"
কিছু দেখব না, কোন চুপচাপ জায়গায় গিয়ে বসে থাকব, খাবো, গল্প করব, আড্ডা দেব। অবশ্যই জায়গাটা কাছে ধারে এবং সবুজে ভরা হতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই ”অরুণিমা গলফ রিসোর্ট” এর সন্ধান নিয়ে এলো আমার সঙ্গী। এদিকে বন্ধু বান্ধব ও একমত-দু’তিনদিনের জন্যে ঢাকার বাইরে গিয়ে এ জায়গা সে জায়গা দেখার নামে ছোটাছুটি করে আদতে আরো ক্লান্ত হয়ে ফেরা হয়, সুতরাং এবার যেখানে যাব একদম গ্যাঁট হয়ে বসে থাকব।
একে তাকে বলতে বলতে শেষ পর্যন্ত মানুষ হলাম সাকুল্যে চারজন। ঠিক হলো আমরা বৌদ্ধ পূর্ণিমার ছুটিটা কাজে লাগাবো। ঢাকা থেকে মোটামুটি ১৫০ কিলোমিটারের বেশি নড়াইলের যে জায়গায় আমরা যাব। গ্রামের ভেতর। আমাদের নেই নিজস্ব গাড়ি।
কিভাবে যাওয়া হবে? রিসোর্টের হয়ে ঢাকা থেকে বুকিং যাতায়াত সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে অরুণিমার ঢাকাতেই নিজস্ব অফিস আছে। তারাই আমাদের তাদের ই মাইক্রো ঠিক করে দিলো। আট সিটের মাইক্রো। তাদের ঐ ছুটিতে আরো গেস্ট আছে। আমাদের আপত্তি না থাকলে সাথে তাদের আরো চারজন গেস্ট যাবে।
এতে করে যাতায়াতের খরচটা আমাদের স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। ঠিক হলো সাতাশে মে সকাল সাতটায় মাইক্রো প্রথমে আমাদেরকে তুলবে। সে অনুযায়ী আমরা তৈরী হয়ে নিলাম।
এদিকে সাতটা বাজে সাড়ে সাতটা বাজে, আটটা বাজে মাইক্রো আর আসে না।
ধুর, এই যাত্রা বোধহয় আর যাওয়া হলো না! সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আটটার একটু পরে মাইক্রো এসে হাজির হলো। শুরু হলো আমাদের যাত্রা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার উদ্দেশ্যে। এখান থেকে তাদের আরো দুজন গেস্ট উঠবেন। তাদের নিলাম। ওমা, সাথে একটা ফুটফুটে চার বছরের বাচ্চা।
আমরা খুব খুশি হয়ে গেলাম। জার্নিতে বাচ্চা থাকলে অন্যরকম মজা হয়। বনানী থেকে আরেক যুগল। ইউনাইটেড হসপিটালের সামনে থেকে আমার বন্ধুকে তুলে যখন আসাদ গেট যাচ্ছি ঘড়ির কাঁটা তখন সাড়ে নয়টা ক্রস করেছে এবং পাল্লা দিয়ে গরম বাড়ছে। আসাদ গেট থেকে আমাদের সর্বশেষ সঙ্গী আমার বান্ধবী উঠলো।
এবার মাইক্রো ফুল, আমাদের আসল যাত্রা শুরু।
আমার বন্ধু-বান্ধবী এবং আমার হাজব্যান্ড ও আমি পরস্পরের পরিচিত, বাকী চারজন আমাদের অপরিচিত। একটু পরেই দেখা গেল ঢাকা শহর আদতে খুব ছোট। আমার বান্ধবী টুশীর সাথে দুই যুগলের পুরুষদের পরিচয় আছে। বহু বছর পরে একজন আরেকজনের সাথে দেখা হওয়াতে মাইক্রোতে আমাদের আড্ডা বেশ জমে উঠলো।
ড্রাইভার সাহেব আমাদের জানালেন আমরা মাওয়া ফেরী ঘাট হয়ে যাব। মাওয়া ফেরী ঘাট আমরা বেলা বারোটার মধ্যে পৌঁছে গেলাম। সেখানে ব্যাপক লাইন। গরম একদম চরমে। তবু মাইক্রোতে এসি থাকাতে কোনরকমে বাঁচোয়া।
ফেরী ঘাটে পৌঁছে আমরা প্রথমে যেটাতে উঠতে গেলাম সেটাতে আমাদের নেয়ার মতো জায়গা আর নেই।
পুরো বাংলাদেশে পাবলিক টয়লেটের যে সমস্যা মাওয়া ফেরী ঘাটও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এখানে দুঘণ্টা অপেক্ষা করতে হবে পরবর্তী ফেরী আসার জন্যে। ফেরীতে দু প্রান্তে দুটা টয়লেট। একটার কাছে ধারে যাবার কোন জো নেই।
দূর থেকে তার দুর্গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। আরেকটা তালা চাবি দেয়া। আমার করিৎকর্মা বন্ধু নিমেষে আমাকে বিদেশী বানিয়ে তালা খুলতে বাধ্য করলো ফেরী কর্তৃপক্ষকে। আমার দেশ না কি হল্যান্ড! আমি বিনা বাক্যব্যয়ে হল্যান্ডের বিদেশিনী হয়ে নিজেকে হালকা করে এলাম। প্যাঁচানো ইংলিশে যে তালা খুলে দিয়েছে তাকে ধন্যবাদও জানালাম।
অরুণিমা গলফ রিসোর্ট পৌঁছতে আমাদের বেলা চারটা বাজলো। সবুজ, একদম গ্রামের ভেতর দিয়ে সুন্দর রাস্তা চলে গেছে। হাতে সময় থাকলে আমরা বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়া দেখে আসতে পারতাম। কিন্তু বেলা অনেক হয়ে গেছে। মধুমতি নদী পেরুলাম আমরা রিসোর্টের প্রাইভেট ফেরীতে।
তারপর ভ্যান গাড়ি। মাইক্রো জোয়ার এলে এপারে আসবে। কটেজে জাস্ট ব্যাগ রেখেই আমরা লাঞ্চের জন্যে ছুটলাম। উরিব্বাপস, খেলাম আমরা সেই রকম। এত্ত বড় বড় মাছ, মাছের ভর্তা, মুরগি, সব্জি, ডাল।
সবই না কি তাদের নিজস্ব জমিতে ফলানো। খাওয়ার পরে আমের জুস্, জাম। আমে চারিদিক একেবারে আম্রময়। গাছে গাছে আম। খেয়ে আমরা ডাইনিং হলের সামনের লনে ঘাসের উপর শুয়ে পড়লাম।
বিকেলটা হচ্ছে। আলো আস্তে আস্তে অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। দুপুরের সেই খর চেহারা আর নেই।
একটু ঘুরতেই বুঝতে পারলাম এটা প্রথমে মাছ চাষের জন্যে করা হয়েছিলো। পরে দু পুকুরের মাঝের আইলে একেবারে এসি দিয়ে কটেজ করা এবং প্রচুর গাছ লাগানোতে জায়গাটার চেহারা বদলে গেছে।
আছে গলফ খেলার ব্যবস্থা। আজকের দিনটা রেস্ট। আগামীদিন সব ঘুরে দেখব ভেবে আমরা কটেজের দিকে রওনা করলাম। গাছে গাছে প্রচুর আম, পেয়ারাও আছে।
দেখতে দেখতে সন্ধ্যা নেমে গেল।
কটেজের বারান্দায় দাঁড়ালে সামনে পানি। আকাশে চাঁদ। পরের দিনই পূর্ণিমা। আমরা খুব খুশি হলাম রুমে টিভি নেই দেখে। রাতের খাবার খেয়ে আড্ডা দিতে দিতে হঠাৎ দেখি রাত তিনটা বেজে গেছে।
চারিদিকে আমাদের চারজনের কথা, হাসি আর প্রবল ঝড়ো বাতাস ছাড়া আর কোনকিছুর কোন আওয়াজ নেই। শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি এবং ঝড়ো হাওয়া। কারেন্ট চলে গেল। ঘরের চালা ছুঁইয়ে শুরু হলো পানি পড়া। একদম পড়বি তো পড়্ বিছানার মাঝখানে।
আমাদের আনন্দ আর দেখে কে! বৃষ্টিতে নেমে গেলাম। যেন নবধারা জলে স্নান। তারপর ভেজা বিছানাতেই গুটিশুটি মেরে ঘণ্টা খানেকের ঘুম। সকাল বেলা রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ ব্যাপক আক্ষেপ করলেন আমাদের অসুবিধার জন্য। আমরা তো মনে মনে বললাম আমাদের কোনই অসুবিধা হয়নি।
সকাল থেকে শুরু হলো আমাদের জায়গাটা দেখা। বড়শি ফেলে চাইলে মাছ ধরা যাবে। নদীতে ঘুরতে যাওয়া যাবে। আছে ইয়া বড় এক পদ্মপুকুর। গলফ মাঠের কথা আগেই বলেছি।
আছে ঘোড়ার গাড়ি, চরকি। গাছের ফাঁকে ফাঁকে দোলনা। ওমা, পুকুর না বলে দীঘি বলি সেখানে আবার বোট হাউজও আছে। একটা দীঘি আরেকটা দীঘির সাথে কাঠ বাঁশের সেতু দিয়ে যুক্ত। শুনশান চারিদিক।
মধুমতি একদিকে, আরেকদিকে নবগঙ্গা, চিত্রা ও না কি কাছেই। নদীদের বৃত্তান্ত শুনে আমরা যে যার মতো প্রকৃতির সাথে মিশে যাবার জন্যে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম।
দুপুরের খাবারে আমাদের প্রমাণ সাইজের মাছের মাথা খেতে দেয়া হলো। সন্ধ্যায় হবে বারবিকিউ। অনেক বোর্ডার কাছের মন্দির দেখবার জন্যে হোন্ডার পেছনে করে রওনা হয়েছেন।
আমরা বিকেলে রিসোর্টের ফেরী করে নদী ভ্রমণে বেরোতেই আবার বৃষ্টি। মনের সুখে ভিজলাম আবার। বারবিকিউ করে,রাতের খাবার সেরে, সারারাত জোসনা দেখে একটুও না ঘুমিয়ে অদ্ভূত একটা সকাল হওয়া দেখতে দেখতে আমরা আবার ফিরে আসবার প্রস্তুতি নিতে থাকলাম, হয়তো একটু মন খারাপ করেই। তবে কেউ কাউকে সেটা বুঝতে দিলাম না।
পুরো নাম : Arunima Countryside & Golf Resort
স্থান : পানিপাড়া, নড়াগতি, নড়াইল
কাছাকাছি নদী : মধুমতি ও নবগঙ্গা
ঢাকা থেকে সড়কপথে দূরত্ব : ১৫০ কিলোমিটারের একটু বেশি বা কম
যেভাবে যাওয়া যাবে : রিসোর্ট কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করলে এবং বুকিং কনফার্ম করলে তারাই মাইক্রো ঠিক করে দেবেন অথবা Shabaz Tourism Ltd., Ph – ৯৮৯৬৯৪৫, ০১৭১১৪২২২০৩ যোগাযোগ করলে তারাও যানবাহনের সুব্যবস্থা করে দিবেন।
মাওয়া ফেরী ঘাট থেকে চাইলে আপনি ফেরী না ধরে স্পিডবোটে করেও নদী পেরিয়ে যেতে পারেন। এ ব্যাপারে আগেই আলাপ করে নিতে হবে।
সম্ভাব্য খরচ : থাকা খাওয়া আসা যাওয়া, সব মিলিয়ে ২দিনে আমাদের মাথাপিছু চার হাজার টাকা মাত্র খরচ হয়েছে। আপনি যদি নিজের গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন তাহলে খরচ আরো কমে যাবে।
যা যা করতে পারেন : বার্ড ওয়াচিং, রিভার ক্রুজ, ফিশিং, গলফ খেলা, টেবল টেনিস খেলা।
এখানে একদিনের জন্যে পিকনিকও করতে পারেন। চাইলে অফিশিয়াল কনফারেন্স ও করতে পারেন অনায়াসেই।
যেখানে যেখানে যেতে পারেন : টুঙ্গিপাড়া, এস এম সুলতানের শিশুস্বর্গ, বিখ্যাত সেতার বাদক রবি শংকর ও নাট্যশিল্পী উদয় শংকরের বাড়ি, বড়দিয়া মন্দির। যদি বেশি সময় নিয়ে যান তাহলে সুন্দরবনের কাছাকাছি ও ঘুরে আসতে পারেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।