শ্রদ্ধেয় সিনিয়র ব্লগার এস. এম. রায়হান ভাইয়ের প্রকৃতির বৈচিত্র্য: ডারউইনবাদীদের নাইটমেয়ার সিরিজটি ফলো করছিলাম। সিরিজের দ্বিতীয় ও তৃতীয় পোস্টে দুটো মন্তব্যও করেছিলাম। বিবর্তনবাদ সম্পর্কে একটু লেখাপড়া করা আছে। তার আলোচনা থেকে আমার দুটি ধারণা হয়েছে:
১. তিনি বিবর্তনবাদকে ঈশ্বরবিরোধী তত্ত্ব হিসেবে দেখছেন, এবং তার বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় বিবর্তনবাদকে একটি ফালতু ষড়যন্ত্র/ভুল হিসেবে দেখছেন।
২. বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব কিভাবে বিকাশ লাভ করে সে বিষয়ে তার এবং তার সাথে সহমত পোষনকারী ব্লগারদের ধারণার অভাব রয়েছে (আমার পর্যবেক্ষণে তাই মনে হয়েছে)।
একারণেই, যে প্রাকৃতিক ফেনোমেনা ব্যাখ্যা করার জন্য বিবর্তনবাদের জন্ম হলো, অর্থাৎ প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য, সেটাকেই তার কাছে বিবর্তনবাদের নাইটমেয়ার মনে হচ্ছে।
এই পোস্টকে তার সেই সিরিজের প্রতিক্রিয়া পোস্ট হিসেবে দেখতে পারেন। সিনিয়র ব্লগার রায়হান ভাইয়ের প্রতি যথাযত সম্মান রেখে পোস্টটি তাকে উৎসর্গ করলাম। পোস্টে আমার আলোচনা এই চারটি বিষয়ের মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে:
১. সায়েন্টিফিক মেথড: কি করে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সমূহের জন্ম হয় সে সম্পর্কে আলোচনা।
২. বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
৩. বিবর্তনবাদের সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাস কি সাংঘর্ষিক?
৪. বিবর্তনবাদ এবং শোশ্যাল ডারউইনিজমের মধ্যে সম্পর্ক কতটুকু?
সায়েন্টিফিক মেথড:
প্রাচীন যুগে বিজ্ঞান ছিল জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতই দর্শন নির্ভর।
মূলত বিজ্ঞান ছিল দর্শন শাস্ত্রের একটি শাখা। প্রাচীন মনীষীদের ধারণা ছিল, কেবল মনে মনে যুক্তি তর্ক প্রয়োগ করেই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়। তারা যে পরীক্ষা নিরীক্ষা নির্ভর গবেষণা করতো না তা নয়, তবে জোড় ছিল যুক্তি-চিন্তার ওপর। বিজ্ঞানকে জ্ঞানের অন্যান্য বিষয় থেকে মূলত আলাদা করেছে সায়েন্টিফিক মেথড। সায়েন্টিফিক মেথড শুধু তাত্ত্বিক প্রমাণের ওপর জোড় না দিয়ে পরীক্ষণকে তার চেয়েও বেশি জোড় দেয়।
মধ্যযুগের আরব বিজ্ঞানীরা সায়েন্টিফিক মেথডের জন্ম দিলেও তা পূর্ণতা লাভ করে নিউটনের হাতে। সায়েন্টিফিক মেথডের ফ্লো অনেকটা এরকম:
পর্যবেক্ষণ(observation)--->তত্ত্ব(theory)--->তত্ত্বনির্ভর অনুমান (prediction based on theory)--------->পরীক্ষণ (experimentation)
পরীক্ষণের ফলাফল যদি অনুমানের সাথে মিলে যায় তবে পূর্বের তত্ত্বই বহাল থাকে, আর না মিললে নতুন তত্ত্বের জন্ম হয়। আর সকল তত্ত্বই পুন: পুন: পরিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। নিউটনের গতি তত্ত্বগুলো আজও হাজার হাজার স্কুল/কলেজ শিক্ষার্থী বিশ্বজুড়ে পরীক্ষা করে চলছে।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিজ্ঞানের সকল তত্ত্বই হাইপোথিসিস।
অর্থাৎ এগুলোকে সত্য বলে প্রমাণ করা যায় না, মিথ্যা বলে প্রমাণ করতে ব্যার্থ হওয়া যায় মাত্র। "পৃথিবীতে সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে" এটা পুরোপুরি (১০০%) প্রমাণ করতে কাউকে পৃথিবী সৃষ্টি হতে ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত সবগুলো সুর্যোদয় পর্যবেক্ষণ করে তারপর ঘোষনা করতে হবে, যেটা আদতে সম্ভব নয়। কিন্তু যেহেতু পূর্ববর্তী পর্যবেক্ষণ সমূহ থেকে এই সিদ্ধান্তে পৌছানো গেছে এবং এখনো কেউ এই হাইপোথিসিস এর বিকল্প হাইপোথিসিস "সূর্য পূর্ব দিকে ওঠে না" পর্যবেক্ষণ করতে সমর্থ হয়নি, তাই বলা যায় যে, এই হাইপোথিসিস মিথ্যা প্রমাণ করা এখনো সম্ভব হয় নি। যেদিন কেউ অল্টারনেট হাইপোথিসিস পর্যবেক্ষণ করতে সম্ভব হবে, সেদিন থেকে আর এই তত্ত্ব কার্যকর থাকবে না, নতুন তত্ত্বের জন্ম হবে।
বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে তাই ফ্যাক্ট বলে কিছু নেই।
ফ্যাক্ট বলতে সেসকল তত্ত্বকেই বোঝায় যেগুলো ভুল প্রমাণ হওয়ার সম্ভাবণা অত্যন্ত ক্ষীণ।
বিবর্তনবাদ বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
বিবর্তনবাদের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে প্রজাতিগুলো বিবর্তিত হয়ে নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে পারে। চার্লস ডারউইন প্রকৃতিতে প্রজাতি সমূহের বৈচিত্র্য এবং মিল অমিল পর্যবেক্ষণ করে এই তত্ত্ব দেন। তার জীবদ্দশায় এই তত্ত্বের পক্ষে কোন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সেটা তিনি তার চিঠিপত্রে অনায়াসেই উল্লেখ করেছেন।
কিন্তু আধুনিক জিবাশ্মবিদ্যার উন্নতিতে একের পর এক জীবাশ্ম আবিস্কার ও বিশ্লেষন থেকে দেখা যায় কিভাবে একের পর এক প্রজাতি কিভাবে এই পৃথিবীতে এসেছে এবং বিলুপ্ত হয়েছে। প্রকৃতিতে এত এত প্রজাতির বিলুপ্তির পরও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে প্রকৃতিতে এখনো নতুন নতুন প্রজাতির জন্ম হয়ে চলেছে, যদিও তা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হতে কয়েক লক্ষ জেনারেশনের প্রয়োজন হয়। ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার জীবনচক্র অত্যন্ত স্বল্প বিধায় এদের বিবর্তনও হয় দ্রুত। একারণেই আমরা প্রতিনিয়ত পরিচিত হচ্ছি নতুন নতুন সব ভাইরাসবাহিত রোগের সাথে, যেগুলোর অস্তিত্ব আগে কোন কালেই ছিল না।
যেহেতু বিবর্তনের ফলে নতুন প্রজাতির উৎপত্তি একটি স্বীকৃত বিষয়, যেহেতু নতুন নতুন প্রজাতির সৃষ্টি এই তত্ত্বের চেয়ে ভালোভাবে আর কোন তত্ত্ব ব্যাখ্যা করতে পারে না, সেহেতু এটাই গ্রহণযোগ্য হাইপোথিসিস। এর অল্টারনেট হাইপোথিসিস, অর্থাৎ বিবর্তন ছাড়াও প্রকৃতিতে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হয়েছে, এটা প্রমাণ না হওয়া পর্যন্ত বিবর্তনই বিজ্ঞানিদের কাছে গ্রহণযোগ্য থাকবে।
বিবর্তনের মাধ্যমে কিভাবে নতুন প্রজাতি সৃষ্টি হয় তা আরেকটি পোস্টের মাধ্যমে বর্ননা করবো।
বিবর্তনবাদের সাথে ঈশ্বরে বিশ্বাস কি সাংঘর্ষিক
লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে, কোন বায়োলজিস্ট কিন্তু বিবর্তনবাদের সপক্ষে বা বিপক্ষে প্রচারণা চালায় না। সাধারণ পাব্লিক বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলো কি করলো না তার ওপর জীববিজ্ঞানী ও তাদের ছাত্রদের কিছুই যায় আসে না।
এটা নিয়ে যুদ্ধ চলে মূলত ঈশ্বরের অস্তিত্ব ভুল প্রমাণ করতে চাওয়া একশ্রেণীর লোক এবং ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে চাওয়ানো আরেক ধরণের লোকের মাঝে। যেন বা বিবর্তনবাদ সত্য হলেই ঈশ্বর মিথ্যা হয়ে যাবেন, আর বিবর্তনবাদ মিথ্যা হলেই ঈশ্বর সত্য হয়ে যাবেন।
ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার দায়িত্ব বিজ্ঞানের নয়। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কাজ প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করা। একজন আস্তিক হিসেবে বিশ্বাস করি মহাবিশ্বের সব কিছু, (প্রকৃতিতে প্রজাতির বৈচিত্র্য সহ সবকিছু) ঈশ্বর নিজ হাতে গড়েছেন।
আবার ঈশ্বর নিরাকার বলে তার হাত থাকাও সম্ভব নয়। এর মানে হচ্ছে সবকিছুই তার নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে। প্রকৃতি যেহেতু ঈশ্বরের সৃষ্টি, তাই প্রকৃতির সব আইনও ঈশ্বরের সৃষ্টি (গতিবিদ্যা থেকে শুরু করে বিবর্তনবাদ সবকিছু)। বিবর্তনবাদ তাই আমার ঈশ্বরে বিশ্বাসের ওপর কোন হুমকি নয়। ঈশ্বর যেটা যেভাবে খুশি তৈরী করেছেন, আমার কোন অধিকার নেই তার ক্রিয়েশন মেথড নিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে প্রশ্ন তোলার।
পর্যবেক্ষণ থেকে যা পাওয়া যায় তা খোলা মনে মেনে নেয়াই প্রকৃত আস্তিকের কাজ। ঈশ্বর সবার চেয়ে নি:সন্দেহে জ্ঞানী। তিনি যদি মনে করেন বিবর্তনের মাধ্যমেই সব প্রজাতি সৃষ্টি করবেন, আমার তাতে কোন আপত্তি নাই।
৪. বিবর্তনবাদ এবং শোশ্যাল ডারউইনিজমের মধ্যে সম্পর্ক কতটুকু?
কোনই সম্পর্ক নাই। প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের কোন সুত্র যদি কেউ সামাজিক বিজ্ঞানে প্রয়োগ করতে চায় বা সামাজিক মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায় তবে সে দায় তারই, মূল তত্ত্বের নয়।
এক্ষেত্রেও তাকে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে (সায়েন্টিফিক মেথড) পরীক্ষিত হয়ে আসতে হবে।
[যারা বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন না, তাদের প্রতি এত এত প্রজাতির বিলুপ্তির পরও প্রকৃতিতে প্রজাতির বৈচিত্র্যের কারণ জানার চেষ্টা করার আহ্বান রইল]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।