আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঈশ্বর, বিবর্তনবাদ ও এর অধিবিদ্যার নির্ভরতা!

গ্রীক দর্শনের প্রভাবে পুনঃজাগরিত ইউরোপিয়ান সভ্যতা মূলত বস্তুকেন্দ্রিক। ফলে বস্তুকেন্দ্রিক দর্শন ও চিন্তাধারাই বিস্তার লাভ করেছে। সবচেয়ে প্রসারিত পুঁজিবাদী বস্তুবাদের সাথে পরবর্তীতে যে অধিকতর মানবতাবাদী সাম্যবাদী দর্শন বিকশিত হয়েছিল সেটিও বস্তুবাদী। বস্তুবাদের প্রসারে এর বোদ্ধারা নৈতিকতার প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে রীতিমত কলম চালিয়েছিলেন। জার্মান দার্শনিক ফ্রেড্রিক নিটশে তো (অক্টোবর ১৫, ১৮৪৪-আগস্ট ২৫, ১৯০০) স্রষ্টাকে মৃত বলেই ঘোষণা করেছিলেন (তার একটি জনপ্রিয় উক্তি ছিল: God is Dead)।

নিটশের মানবতায় স্রষ্টার কোন স্থান ছিল না। তবে গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত নীটশে’র প্রতিবাদ ছিল মূলত ক্রিষ্টিয়ানিটি ও এর প্রচলিত শিক্ষার বিরুদ্ধে। ডারউইনের বিবর্তনবাদ সেই একই বস্তুবাদী চেতনা থেকে উদ্ভূত। বিবর্তনবাদে স্রষ্টা বাহুল্য। তবে এর স্রষ্টা নির্ভরতা আছে।

স্রষ্টাকে নাকচ করতে হলে তার অস্তিত্বকে প্রথমে ধরে নিয়েই তা করতে হয়। একটা দ্বৈত ভূমিকা নিয়ে বিবর্তনবাদীরা তা স্বীকার করতে চায় না, যদিও শেষ পর্যন্ত বিবর্তনবাদের দোহাই দিয়েই তারা স্রষ্টাকে নাকচ করতে চায়। বিজ্ঞানের আর কোন বিষয়ের সাথে স্রষ্টা এভাবে জড়িত না যেভাবে জড়িত বিবর্তনবাদ এর সাথে। বিবর্তনবাদ বিপ্লবাত্নক কিছু ছিল না, ডারউইন নিজেও বিপ্লবী কিছু করেননি। তিনি বাতাসে ভেসে বেড়ানো তৎকালীন দূরকল্পী একটি দর্শনকে বৈজ্ঞনিক রূপ দিয়েছিলেন।

ডারউইনের সময়ে যে কয়েকটি ধারণা প্রভাব বিস্তারকারী ছিল তার একটি হল: Gnosticism. এই মতবাদ ইউরোপে আঠারো শতক ও এর পরবর্তী সময়ে পুনর্জন্ম হয়েছে কিন্তু নতুন নয়। দ্বিতীয় শতকে রোমান শাসনামলেও এটি শক্তিশালী ভিত্তি হিসেবে গড়ে উঠেছিল। তবে আধুনিক Gnosticism দ্বিতীয় শতকের মতবাদকে কিছুটা ভিন্নভাবে গ্রহণ করলেও আসলে সেটি পূর্বের গ্রীক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত। Gnosticism-এ স্রষ্টার ভূমিকা প্রাকৃতিক আইনগুলোর জন্য গৌণ। তিনি প্রথমে প্রাকৃতিক আইনগুলোকে যদি তৈরী করেনও পরবর্তীতে সেই আইনগুলোকে নিয়ন্ত্রণের জন্য তার আর প্রয়োজন নেই বা সে সেগুলোতে তিনি কোন প্রভাব বিস্তার করেন না, প্রাকৃতিক আইনগুলো স্বাধীন।

ডারউইনের দাদা এরাসমাস ডারউইনও সেই Gnosticism দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। চার্লস ডারউইন আধুনিক Gnosticism ধারণা থেকেই আশা গ্রে’কে জিজ্ঞেস করেছেন, স্রষ্টা যদি প্রথম দিকে খুব গভীরভাবে সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ না করে থাকেন তাহলে তিনি কি আসলেই সংযুক্ত ছিলেন? প্রজাতির বিস্তারের জন্য প্রাকৃতিক আইনের দরকার ছিল। ডারউইনের উপর প্রভাব বিস্তারকারী হার্শেল (১৭৯২ – ১৮৭১ খৃস্টাব্দ) সেদিকেই ঈঙ্গিত করেছিলেন, আর ডারউইন সেটিই উপহার দিয়েছিলেন। এর বাইরে ছিল খ্রিষ্টীয় চার্চ এর বাড়াবাড়ির ফলে ফরাসী বিপ্লবের হাত ধরে মানবতাবাদীদের খ্রিষ্টীয় ধর্মের বিরুদ্ধ অবস্থান। ইউরোপ তার প্রাচীন ঐতিহ্য গ্রীক ও রোমান দর্শন ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

মুসলিমদের হাত ধরে এগুলো তাদের কাছে আসতে থাকে বহু আগে থেকেই। গ্রীক ও রোমান সভ্যতা প্যাগান হলেও তা নতুন ইউরোপিয়ান সভ্যতায় সহজেই জায়গা করে নেয়। গ্রীক দার্শনিক এরিস্টটল মনে করতেন ভাল থেকে খারাপ এর পরিমাণ বেশী। এরিস্টটলের এই ধারণাটি সেসময়কার প্রেক্ষাপটে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। কারণ প্রাচীন গ্রীক দেবতাদের মধ্যে খারাপ দেবতাদের ছড়াছড়ি ছিল।

প্লেটো অবশ্য সব ভালোর জন্য ঈশ্বরকেই অলঙ্কৃত করেছিলেন, কিন্তু মন্দগুলোকে অস্বীকার করেননি। তবে ধরে নিয়েছিলেন মন্দ জিনিষগুলো ঈশ্বরের গুণের বাইরে। ডারউইনের চোখেও মন্দগুলোই অতিমাত্রায় প্রতিভাত হয়েছে। আশা গ্রে’কে লিখা চিঠিতে ডারউইন তার সেই অনুভূতি ব্যাখ্যাও করেছিলেন। একজন প্রচণ্ড প্রভাবশালী ও সাহায্যকারী ঈশ্বরকে তিনি ভাবতে পারেননি।

প্রাকৃতিক আইনে ঈশ্বর বেমানান। অতএব, প্রাকৃতিক আইনকে ব্যাখ্যা করার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজন নেই; একে ব্যাখ্যা করতে হবে প্রাকৃতিক আইন দ্বারাই। এর জন্য দরকার একটি বাস্তব (বস্তুবাদী) সমাধান, ঐশ্বরিক নয়। এতে দৃশ্যপট থেকে ঈশ্বর হারিয়ে যায়। তবে সাথে সাথে নৈতিক আইন দেবার অথরিটিও হারিয়ে যায়।

অবশ্য ডারউইন ও তার সমমনাদের দৃষ্টিতে নৈতিক আইনের স্থানও নেই। তাদের কাছে নৈতিকতা গুরুত্বহীন ছিল, যা এখনও বর্তমান। বর্তমানের বহুল আলোচিত বিবর্তনবাদী রিচার্ড ডকিন্স বিবর্তনবাদের সেই অবস্থানকেই স্পষ্ট করেছেন তার এথিইস্ট বাস ক্যাম্পেইনে: “সম্ভবত ঈশ্বর বলতে কিছু নেই, অতএব দুঃশ্চিন্তা বাদ দাও ও জীবণকে উপভোগ কর। ” জিওলজিস্ট সেজউইক (১৭৮৫ – ১৮৭৩ খৃস্টাব্দ) ডারউইনের তত্ত্বের কিছুটা মেনে নিলেও অধিকাংশের ব্যাপারে তার মত ছিল “খুবই ক্ষতিকর”। ডারউইনের সময়ে শক্তিশালী Natural Theology বা প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বও বেশ প্রভাব বিস্তারকারী ছিল।

ডারউইন নিজেও দার্শনিক উইলিয়াম প্যালের (১৭৪৩ – ১৮০৫ খৃস্টাব্দ) প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের উপর বই পড়েছিলেন ও প্রথমদিকে প্রভাবিতও ছিলেন। প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব স্রষ্টাকে কারণ ও অভিজ্ঞতার আলোকে দেখে থাকে। এর সাথে মিল পাওয়া যায় মুসলিমদের মুতাজিলা সম্প্রদায়ের। ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান সমাজে এটা এতো প্রভাব বিস্তারকারী ছিল যে এমনকি তা ডারউইনের অরিজিন অব স্পেসিস-কেও পিছনে ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে সেজউইক ও ডেভিড হিউম প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বেকে সমর্থন করেছিলেন।

কিন্তু প্রচলিত ক্রিষ্টিয়ান বিশ্বাসের ভাল ঈশ্বর প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখা সত্ত্বেও প্রকৃতিতে বিরাজমান মন্দকে (ধ্বংস ও বিশৃঙ্খলা) ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। ফলে প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্বের শেষরক্ষা হয়নি। কারণ বিবর্তনবাদ সৃষ্টি থেকে স্রষ্টাকে প্রথক করতে সক্ষম হয় সাথে সাথে প্রকৃতিতে বিরাজমান মন্দকেও ব্যাখ্যা করতে পারছিল। ডারউইনের বৈশ্বিক ধারণা নতুন কিছু নয়। ডারউইন চলমান একটি দূরকল্পী দর্শনকে বৈজ্ঞনিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন।

অপরদিকে টেনে দিয়েছিলেন স্রষ্টা ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য বিস্তারকারী একটি লাইন। এতে স্রষ্টা একেবারে দূরীভূত হয়নি, তবে অনেক দূরে সরে গেছে। একে নিউটনের ল’এর সাথে মিলিয়ে ফেলাটা সঙ্গত নয়। নিউটনের ল অব মোশান এবং গ্রাভিটি যেখানে খুব নির্দিষ্ট সেখানে ডারউইন অনুমানের উপরই বেশীরভাগ জিনিষ ছেড়ে দিয়েছিলেন। নিউটনের ল’তে কোন দূরকল্পী দর্শন বা অধিবিদ্যার নির্ভরতা নেই।

যে মন্দ (Evil) এর ধারণা থেকে বিবর্তনবাদ এর অবতারণা, বিবর্তনবাদ শেষপর্যন্ত সেই মন্দকেও নাই করে দেয়। কারণ স্রষ্টা না থাকলে সেখানে মন্দও থাকতে পারে না। অবশ্য ডারউইন সেই মন্দকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও সম্ভব হয়ে উঠেনি। কারণ বিবর্তনবাদ অনুযায়ী বড় মাছের ছোট মাছকে ধরে খাওয়া বা প্রকৃতির বিদ্যমান হিংস্রতার মধ্যে মন্দের কিছু নেই, নেই নৈতিকতার বালাইও।

এগুলো টিকে থাকার সংগ্রামের অংশ। উন্নত প্রজাতির পশু মানুষের জন্যও এর ব্যতিক্রম নেই! বিবর্তনবাদ সর্বেসর্বা স্রষ্টাকে বর্জন করলেও নিজেই সর্বেসর্বা হয়ে যায়। এটা প্রথাগত ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব বর্জন করলেও নিজেই সৃষ্টিতত্ত্ব দিতে পারে। এটা ডিভাইন স্রষ্টাকে বর্জন করলেও নিজেই অথরিটি সেজে বসে আছে। উনিশ ও বিশ শতকের পুরোটা জুরে এর বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে ও এর প্রতি সংশয় তৈরী হয়েছে, কিন্তু তারপরও বিবর্তনবাদ আঠারো ও ঊনিশ শতকের গজিয়ে উঠা অন্তর্নিহিত অধিবিদ্যা বা দূরকল্পী দর্শনকে এখনও বহন করে চলছে।

সুত্র: ১. Darwin’s God, Cornelius G. Hunter, Evolution and the Problem of Evil ২. Friedrich Nietzsche ৩. Natural theology [নোটঃ এ লেখাটি ইতিপূর্বে সদালাপে] প্রকাশিত হয়েছে। আমি সদালাপে শামস নামে লিখে থাকি  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।