বিগত কয়েক বাংলাদেশে তামাক চাষ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সা¤প্রতি বান্দরবন জেলাজজ কোর্টে একটি রায়ে অত্র এলাকায় তামাক চাষ ১০০০ একরের মাঝে রাখার নির্দেশনা প্রদান করেছে, যা একটি মাইল ফলক। সীমিত ভুখন্ডের জনবহুল এদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে, না কি তামাককের মতো তিকর দ্রব্যের বৃদ্ধি করতে দেয়া হবে এক বিষয়ে নীতিনির্ধারকদের দ্রুত পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে দূর্বল নীতি বা অবস্থান দেশের কৃষি জমি ধ্বংশ, খাদ্য নিরাপত্তা সংকট, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সমস্যার মতো বিষয়গুলো প্রকট করে তুলবে।
আমাদের আবাদী জমির পরিমান খুবই সীমিত।
তথাপিও সড়কনির্মাণ, শিল্পস্থাপন, ঘরবাড়ী নির্মাণ, নদীভাঙ্গনসহ বিভিন্ন কারণে প্রতিবছর বাংলাদেশে কৃষিজমি ১ শতাংশ হারে হ্রাস পাচ্ছে। এদেশে ১৯৭১ সালে আবাদী জমির পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১৭ হেক্টর। ১৯৮৬ সালে কমে দাড়ায় ৮১ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর এবং ২০০৩ সালে কমে দাড়ায় ৭০ লাখ ৮৭ হাজার হেক্টরে। এমত অবস্থায়ত্র্র তামাক কোম্পানিগুলোর প্ররোচনার কারনে তামাক চাষ অগ্রাসীভাবে বিভিন্ন খাদ্য ভান্ডারের জমি দখল করে নিচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৭৪০০০ হেক্টর জমিতে তামাক হচ্ছে।
বিগত ২ বছরে তামাকচাষ প্রায় ৬৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। উত্তরাঞ্চলের খাদ্যভান্ডার বলে পরিচিত চলনবিল এখন দখল করে নিচ্ছে তামাক চাষ। পাবর্ত্য এলাকায় এ বিষের ছোয়া রন্ধে রন্ধে।
তামাকের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫৭০০০ হাজার লোক মারা যাচ্ছে এবং ৩৮২০০০ লোক পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এছাড়াও তামাকজনিত রোগের চিকিৎসা খরচ বরাদ্ধ রাষ্ট্রের আর্থিক তির পরিমান ১১,০০০ কোটি টাকা।
এছাড়া বাংলাদেশে ২৫ভাগ পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে, সারাদেশের অতিদরিদ্র মানুষ প্রধান খাদ্য চাল ক্রয়ে তাদের আয়ের ৭৬ভাগ ব্যয় করে এবং শতাকরা ৫৮ভাগ পরিবার পর্যাপ্ত খাদ্য ক্রয় করতে পারে না । অপুষ্ঠিতে শিশু মৃত্যুর পরিমাণ প্রতিদিন ৯০০ জন। আর এ সকল অবস্থাগুলো বিবেচনা করে সরকারের তামাক চাষ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা প্রয়োজন। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এ বাস্তবতার পরও খাদ্য নিরাপত্তা কথা বিবেচনা না করে কিছু ব্যক্তিবর্গ তামাক কোম্পানির সাথে সুরমিলিয়ে তামাক চাষের স্বপে বক্তব্য তুলে ধরে থাকেন।
তামাক চাষ শুধুমাত্র খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয়, এই বিষবৃ চাষ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপনন সকল েেত্র তিগ্রস্ত করছে জনসাধারণকে।
তামাক এমন একটি ফসল যা চাষের কারণে জমির উর্ব্বরতা হ্রাস পায় এবং এই জমিতে একসময় কোন ফসল ফলানো যায় না। তামাকের কারণে ৩টি মৌসুমের ফসলের তি হয়। কারণ জমি তৈরি, বীজ বপন, পরিচর্যা, পাতা তোলা, গোড়া তোলা ইত্যাদি কারণে তামাক চাষের সময়কাল আগষ্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ৯ মাস। উবিনীগ এর এক গবেষণায় দেখা যায়, বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় ৫৩৯৯ একর জমিতে তামাক চাষ হচ্ছে। এসব জমিতে ২১ ধরনের খাদ্যশস্য চাষ করা যেত এবং তার মূল্য দাড়াত ১১ কোটি টাকা।
চাষীদের বক্তব্য অনুসারে তামাক চাষ করলে অন্য কিছু করার সুযোগ পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু প্রতিবছর নানা অর্থ ও নানা প্রলোভনের কারণে চাষীরা তামাক চাষে নিয়োজিত হয়ে পড়ে।
গ্রামীণ কৃষক সমাজ ও দরিদ্রতা অনেকক্ষেত্রেই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এই দরিদ্রতাকে পুঁজি করে তামাক চাষ ভয়াবহভাবে বিস্তার লাভ করেছে। তামাকের মূল্য অন্য যেকোন ফসলের চাইতে অনেক বেশী।
তামাক কোম্পানি এ ধরনের বাহারী বিজ্ঞাপনের আড়ালে হারিয়ে যায় তামাক চাষের সমস্যাগুলো। প্রতিটি চাষীই প্রতিবছর তামাক কোম্পানি হতে ঋণ নিয়ে তামাক চাষ করে, অথচ কোম্পানিগুলো প্রচারণা চালায় তামাক চাষ লাভজনক। তামাক যদি লাভজনক হয় তবে চাষী কেন প্রতিবছর ঋণ নেবেন? এই প্রশ্নটি কেহই করে না। অধিকমূল্য বিষয়টি কৃষকদের তামাক চাষে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। অনেক কৃষক তাদের ভাগ্য ফেরাতে, ধনী হবার আশায় কোন কিছু না ভেবেই তামাক চাষে আগ্রহী হয়ে উঠে।
কারণ কৃষকদের বর্তমান অর্থনৈতিক দুরাবস্থার পাশাপাশি, তারা প্রতিনিয়ত স্থানীয় মহাজনদের দ্বারা অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহিত হয়।
তামাক চাষ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমাজ কাঠামো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। গ্রাম এবং শহর দুই স্থানেই, ধনী ব্যক্তি দরিদ্র ব্যক্তির চেয়ে অধিক সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা পায়। গ্রামীণ সমাজে এই বিষয়টির বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। গ্রামাঞ্চলে এক গোষ্ঠীর মানুষ অন্য গোষ্ঠীর মানুষের সাথে অধিক পরিচিত।
তাই একজন ধনী কৃষকের সামাজিক অবস্থান একজন দরিদ্র কৃষককে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। এই সমস্ত বিষয়গুলি দরিদ্র কৃষককে এমনভাবে প্রভাবিত করে যে, অধিক লাভ আসে ঐরকম ফসল চাষ করে সে দ্রুত তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চায়। কিন্তু এ লাভের অংক যোগাতে গিয়ে সে তামাক চাষের চক্রে পড়ে যায়।
তামাক চাষে যে কৃষকের সামর্থ থাকে তারা শ্রমিক ভাড়া করে। কিন্তু অধিকাংশ চাষীর এ সামর্থ থাকে না।
ফলে তামাক পাতা উঠানোর মৌসুমে বাড়ীর নারী, পুরুষ শিশু সকলে একসাথে মাঠে কাজ করতে হয়। এসময় শিশুরা স্কুল কামাই করে তাদের অবিভাবকদের সাথে মাঠে কাজ করে। এছাড়াও তামাক পাতা পোড়ানোর সময় আগুনের পাশে দিনরাত সর্তকভাবে বসে থাকতে হয়। ফলে তামাক চাষীদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। এভাবে তাদের শিাজীবনে ব্যাঘাত সৃষ্টি হওয়ায় তারা শিার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
এক গবেষনায় দেখা যায়, তামাক চাষ থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ পযর্ন্ত সময়কালে বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে বিদ্যালয়ে ছাত্রদের উপস্থিতির হার কমে যায়। শিক্ষা জীবনে সমস্যার পাশাপাশি শিশুরা স্বাস্থ্যগত দিক থেকেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে । বিনামূল্যে শ্রম প্রাপ্তির লক্ষে তামাক চাষী তার পরিবারের সদস্যদেরকে তামাক চাষ থেকে প্রক্রিয়াজাত করণ পর্যন্ত সকল কাজে সম্পৃক্ত করে। ফলে পারিবারিক জীবনযাত্রায় বিঘ্ঘন টে। তামাক পোড়ানোর সময় পরিবারের সদস্যরা নির্ঘুম রাত কাটায় এতে করে পারিবারিক জীবনে প্রচন্ড অশান্তির সৃষ্টি হয়।
জমি কৃষকের জন্য একটি মূল্যবান সম্পদ। প্রচুর রাসায়নিক ও কীটনাশকের ব্যবহার তামাক চাষের একটি বড় তিকর দিক। নানাবিধ কারণে বিগত ১০ বছরে কীটনাশক ব্যবহারের পরিমান ৩২৮ভাগ বেড়েছে । এ রাসায়নিক ও কীটনাশক মাটির উর্ব্বরতা হ্রাস, পানি ধারণ মতা নষ্ট এবং য় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এছাড়া রাসায়নিকের প্রভাবে জনস্বাস্থ্য, বনভূমি, পানি, জলজ প্রাণী, পরিবেশ মারাত্মকভাবে তিগ্রস্ত হচ্ছে।
পার্বত্য এলাকার মানুষ প্রাকৃতিক পানিনির্ভর। অথচ সাঙ্গু, মাতামুহুরীসহ পার্বত্য জেলা বান্দরবান এর নদী ও জলাশয়ের ঢালু উর্বর জমিতে ক্ষতিকর তামাক চাষ করায় এ জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক ও তামাকের রাসায়নিক গিয়ে নদী-জলাশয়ের পানিতে মেশায় সে পানি দূষিত হয়ে পড়ছে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকগুলো পানি সাথে মিশে গিয়ে সুপেয় পানির উৎস নষ্ট করছে। যা পানি বাহিত রোগের সম্ভবনা বৃদ্ধি করছে। বিশেষ করে মাছে ডিম পাড়ার সময়ে তামাকের কীটনাশক পানির সঙ্গে মেশার ফলে মাছের বংশ বিস্তার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ক্রমশ মাছের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তামাক পাতার কারণে এমন সব পোকার আগমন ঘটে যা আশেপাশের ফসলী জমির ফসলকে আক্রমণ করে।
তামাক পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য কাঠ, তুষ বা খড় ব্যবহার করা হয়। পার্বত্য এলাকায় তামাক পাতা শুকানোর জন্য ব্যাপকভাবে বনাঞ্চলের গাছ কাটা হয়, বনভূমিকে ধ্বংশ করছে। একর প্রতি তামাক উৎপাদন হয় ১০০০-১২০০ কেজি। প্রতি কেজি তামাক পোড়াতে ৫ কেজি জ্বালানী কাঠ লাগে। প্রতি একর তামাক পাতার জন্য ৫ টন জ্বালানি কাঠের প্রয়োজন হয়।
একসময় কুষ্টিয়া মেহেরপুর অঞ্চলের অনেক চুল্লিতে কাঠ ব্যবহার করা হতো। কিন্তু গাছ কমে যাওয়ার কারণে এ সকল এলাকায় তুষ বা খড় ব্যবহার করা হয়। তামাক কোম্পানিগুলো তাদের কারণে সৃষ্টি সমস্যা আড়াল করতে বৃরোপন অভিযান এর নামে নিজেদের স্বার্থে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এ ধরনের বিদেশী গাছ লাগাচ্ছে বনাঞ্চলে,যা আমাদের জীববৈচিত্রের জন্য হুমকি স্বরূপ।
তামাক পাতা শুকানোর সময় উক্ত এলাকায় ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কাঠ, তুষ বা খড় পোড়ানোর ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্টসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়।
তামাক চাষ করার ফলে কৃষক এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হবার আশংকা থাকে। গবেষনায় দেখা গেছে, তামাক চাষী ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বার্জার্স এবং গ্রীণ টোব্যাকো সিকনেস (এঞঝ) ব্যাপকভাবে লনীয়। এক গবেষনায় দেখা গেছে যে, টানা কয়েকদিন তামাক পোড়ানোর পর অনেক কৃষক এত বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তারা শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। তামাক পোড়ানো শেষে কৃষককের বমি ভাব, শ্বাসকষ্ট, শারীরিক দূর্বলতা দেখা যায় ।
তামাক এর সাথে দরিদ্রতার একটি সম্পর্ক রয়েছে।
পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই দরিদ্ররা বেশী তামাক ব্যবহার করে, ফলে তাদের আয়ের একটি বড় অংশ তামাক ক্রয়ের পিছনে ব্যয় হয়। তামাক ক্রয়ের ল্েয অর্থ ব্যয় করার ফলে দরিদ্র জনগণ অনেক েেত্র মৌলিক প্রয়োজনে অর্থ ব্যয় করতে পারে না। এছাড়া তামাক উৎপাদনের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের খুবই দরিদ্র এবং খুবই অল্প টাকায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করতে হয়। বাংলাদেশে দরিদ্রতা এবং অপুষ্টি একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে জনসংখ্যার অতিরিক্ত বৃদ্ধির কারণে জমির উপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
জনসংখ্যার অনুপাতে জমির পরিমাণ কম থাকায় খাদ্য ঘাটতি পুরণ করা কষ্টকর হয়ে পড়ছে। যেখানে সব আবাদী জমিতে খাদ্য উৎপাদন করা দরকার সেখানে তামাক কোম্পানিগুলোর প্রলুব্ধকর প্রচারণায় দরিদ্র অনেক কৃষক তামাক চাষে অভ্য¯ত হয়ে পড়ছে। তা দারিদ্রতাকে ত্বরান্বিত করছে, পুষ্টি ঘাটতি ও খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি করছে। তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়ন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন -২০০৫ সংশোধনের মাধ্যমে আইনভাবে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণে বিষয়টি নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।