>>>বৈশাখের ঐ রুদ্র ঝড়ে আকাশ যখন ভেঙ্গে পড়ে, ছেঁড়া পাল আরও ছিঁড়ে যায়...<<<
দৈনিক প্রথম আলো, গত ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ "বর্ষশেষ ২০১০" নামে একটি বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করে সেখান থেকে নিয়মিত হুবহু কিছু লেখা ব্লগের সকল সদস্যদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য এই আয়োজন। আজ থাকছে জনাব আনিসুল হক-এর "এভারেস্ট লাল-সবুজ পতাকা"। এভাবে ইনশাল্লাহ্ ক্রমাগত অন্যান্য লেখাগুলো শেয়ার করা হবে,,,,,
এভারেস্ট লাল-সবুজ পতাকা
আনিসুল হক
ওই ভোরটি, ২৩ মে, ২০১০-এর প্রভাতটি, অন্য যেকোনো দিনের মতোই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে। কিন্তু ওই ভোরের আলো যে বাংলাদেশকে আরেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে, তা জানতে জানতে দুপুর হয়ে গিয়েছিল। মুসা ইব্রাহীম নামের এক তরুণ, বাংলাদেশ থেকে একা এবং সর্বপ্রথম, ভোরের আলো গায়ে মাখছিলেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়াটিতে দাঁড়িয়ে, তাঁর পায়ের নিচে তখন এভারেস্ট।
তখনই সেই খবর পৌঁছায় অগ্রবর্তী বেস ক্যাম্পে, সেখান থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুতে, সেখান থেকে বাংলাদেশে, তা ছড়িয়ে পড়তে পড়তে দুপুর। সেই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদের মাথা উঁচু হয়ে গিয়েছিল, বুক ফুলে উঠেছিল গর্বে, তারা কী করবে বুঝেও উঠতে পারছিল না, সাংবাদিকেরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন খবরের নিশ্চয়তা বিষয়ে নিঃসন্দেহ হতে।
মুসা ইব্রাহীম, নর্থ আলপাইন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক, তাঁর বিচারক স্ত্রী উম্মে সরাবন তহুরা, শিশুপুত্র ওয়াসী ইব্রাহীমকে ফেলে রেখে ৮ এপ্রিল চলে গিয়েছিলেন প্রথমে নেপালে, সেখান থেকে তিব্বতে। ৪০ লাখ টাকার বেশি তহবিল জোগাড় করার জন্য তার আগের কয়েক মাস তিনি ঘুরেছেন দ্বার থেকে দ্বারে, লাখ ১২ জোগাড় হয়েছিল কতিপয় সজ্জন নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তায়, কিন্তু সিংহ ভাগ অর্থ জোগাড় না হওয়ার বেদনা তাঁকে দমাতে পারেনি, প্রবাসী বোনের টাকা ব্যাংক থেকে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন তাঁর পূর্বঘোষিত লক্ষ্য অর্জন করবেন বলে। ফেসবুকে ছিল নর্থ আলপাইন ক্লাবের ঘোষণা, ‘মিশন ২০১০, ভিশন এভারেস্ট’।
তিনি আরও লিখে রেখেছিলেন, ‘আমি যদি কোনো লক্ষ্য স্থির করি, তবে জেনে রেখো, আমি তা অর্জন করেই ছাড়ব। ’
লক্ষ্যটা তিনি স্থির করেছিলেন ২০০৭-এ। তার আগের কয়েকটা বছর তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, অনেক দিন কাটিয়েছেন দার্জিলিংয়ের পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণকেন্দ্রে, আর একটার পর একটা পর্বত অভিযানে অংশ নিয়ে নিজের শরীরটাকে ধাতস্থ করেছেন উচ্চতার সঙ্গে, অক্সিজেন-স্বল্পতার সঙ্গে। পর্বত আরোহণের কঠিন কৌশলগুলো রপ্ত করেছেন।
২২ মে সারা রাত তাঁরা পাহাড় বেয়েছেন।
শেষ ধাপ ছিল সেটা। মাথায় জ্বলছে টর্চবাতি। মুখে অক্সিজেন মুখোশ। পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডারসমেত নানা বোঝা। চলতে চলতে ওই আলোতেই চোখে পড়ল মানুষের নিস্পন্দ শরীর, পড়ে আছে তুষারের ওপরে।
বুকটা কি একবার কেঁপে উঠেছিল। না, তিনি থামেননি। অক্সিজেন সিলিন্ডারের নলটা ফুটো হয়ে গিয়েছিল একবার। মৃত্যুকে তিনি তার চোখের সামনে দেখেছিলেন বাহু বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলিঙ্গন করবে বলে। সঙ্গী শেরপারা মেরামত করে দিয়েছেন সেই অক্সিজেনের নল।
তারপর একদিকে পাহাড়ের গায়ে পড়ছে ভোরের প্রথম আলো, আর মুসা ইব্রাহীম ও তাঁর সহযোগী শেরপারা আরও বেশ কয়েকজন বিদেশি পর্বতারোহীর সঙ্গে উঠে পড়লেন এভারেস্টের চূড়ায়। ব্যাগে রাখা সবুজের মধ্যে লাল সূর্যখচিত পতাকাটা মেলে ধরলেন তিনি, পতাকায় আঁকা সূর্যের গায়ে পড়ল প্রকৃত সূর্যের আলো।
তারপর তিনি নামছেন। বাংলাদেশে খুশির লহর বয়ে যাচ্ছে। তিনি তখনো যুঝছেন মৃত্যুর সঙ্গে।
অক্সিজেন সিলিন্ডারে সমস্যা। এবার তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন অস্ট্রেলিয়া আর স্কটল্যান্ড থেকে আসা দুই পর্বতারোহী। আর দিনের আলোয় দেখা যাচ্ছে অনেক মৃতদেহ। বরফে পড়ে আছে পচনবিহীন। শেরপারা বলছেন, ‘মুসা, ফেরার পথেই মানুষ মারা যায়।
কারণ, তারা ভাবে লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, তারা শরীর ছেড়ে দেয়, ক্লান্তির কাছে পরাজিত হয় আরোহীরা। থেমো না। চলো। ’ মুসার শরীর যে চলছে না। তিনি যে উঠতে পারছেন না।
রাতের বেলা বোঝেননি কতটা খাড়া পাহাড় বাইতে হয়েছে, দিনের বেলায় বড় খাড়া খাদ দেখে তাঁর আত্মাপাখি খাঁচাছাড়া। কিন্তু তাঁকে যে নামতেই হবে। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষের শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন তখন তাঁর সঙ্গে। দেশ টিভিতে স্ক্রলে খবর দেখানো হচ্ছে তাঁর এভারেস্ট জয়ের। খানিক পরে রেডিও ডয়েচে ভেলে আর বিবিসিও তরঙ্গায়িত করবে এই খবর।
লালমনিরহাটের মুসা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র মুসা, ডেইলি স্টার-এর সাংবাদিক মুসা, নর্থ আলপাইন ক্লাবের মুসা, প্রথম আলোর নিয়মিত লেখক মুসা তখন তো কোনো একক সংগঠনের নন, সারা বাংলাদেশের।
না, মুসা ইব্রাহীমের বোনের অ্যাকাউন্ট থেকে তোলা সেই টাকা আজও পরিশোধিত হয়নি পুরোটা। কিন্তু জাতিরও কিছু ঋণ রয়ে গেছে মুসা ইব্রাহীমের কাছে। তিনি আমাদের অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।
[বি. দ্র. "এভারেস্ট লাল-সবুজ পতাকা" শিরোনামের লেখাটি ৩১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখের "দৈনিক প্রথম আলো" থেকে হুবহু সংগৃহীত।
]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।