------
আমার নেত্রকোনা
-হাসান ইকবাল
ছোটোবেলায় আমরা শুনেছি-‘নেত্র’ মানে চোখ, কোনা মানে
কোনা। তাই নেত্রকোনা মানে "চোখের কোনা"।
সঠিক অর্থ এখনত্ত আমার জানা হয়ে উঠেনি। নেত্রকোনার প্রতি ভালোবাসার টানেই বড় হয়ে অর্থ েখাঁজার প্রয়োজন বোধ করেছি কখনো সখনো। নাটরোকোনা থেকেই নেত্রকোনা শব্দের উত্পত্তি।
তবে এটিও সঠিক কিনা আমি বলতে পারছিনা।
নেত্রকোনা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীটির নাম ‘মগড়া'’। এই মগড়া নদীটি যেখানে সেখানে ইচ্ছা মতো যত খুশি বাঁক নিয়ে বয়ে চলেছে। যার বাঁকগুলো দেখলে মনে হবে চোখের কোনা। আঁকাবাঁকা মগড়া নদীর বাঁকগুলো চোখের আকৃতি নিয়েছে বলেই হয়তোবা এ জেলার নাম নেত্রকোনা।
নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, গাছ-ফুল, পাহাড়-বনানী, উর্বর জমি, সহজ-সরল মানুষ; এসবই বাংলার বৈশিষ্ট্য। আর এসব বৈশিষ্ট্যের সবটুকুই পাওয়া যায় যে জেলাটিতে তার নাম নেত্রকোনা।
বাংলাদেশের উত্তর সীমান্তে গারো পাহাড়ের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জেলা নেত্রকোনা। ঢাকা বিভাগের আওতাধীন এ জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ, পূর্বে সুনামগঞ্জ এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ। ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী নেত্রকোনা জেলার লোকসংখ্যা প্রায় ২০ লাখ।
ব্রিটিশ আমলের আগে এ অঞ্চলে পাল, গুপ্ত, বর্মণ, সেন রাজাদের রাজত্ব ছিল। স্থানীয় বিভিন্ন আদিবাসী জনগোষ্ঠীরাও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা শাসন করত। ১৪৯১ সালে এ অঞ্চলে ফিরোজ শাহ মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা করেন এবং মোগল সম্রাট আকবর তার পরিধি বৃদ্ধি করে। পরবর্তীতে বারো ভূঁইয়াদের প্রধান ঈশাখাঁর আমলে রোয়াইলবাড়িসহ এ অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা হয়। ব্রিটিশ আমলে ১৮৭৪ সালে নেত্রকোনা থানা প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৮৮২ সালে হয় মহকুমা। প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের ফলে ১৯৮৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি নেত্রকোনা জেলায় উন্নীত হয়। এ জেলায় রয়েছে ১০টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা, ৮৪টি ইউনিয়ন এবং ২ হাজার ২শ ৮২টি গ্রাম।
নেত্রকোনা সরকারি কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫৯ সালে। এটিই নেত্রকোনার প্রথম কলেজ।
কবি নির্মলেন্দু গুণ, হেলাল হাফিজ, রফিক আজাদের মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা এই কলেজের ছাত্র ছিলেন। নেত্রকোনার প্রথম স্কুলের নাম কেন্দুয়া জয়হরি স্কুল। ১৮৩২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বিদ্যালয়টি। বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ কেন্দুয়া জয়হরি স্কুলের ছাত্র ছিলেন। এ জেলায় মোট ১৯টি কলেজ, ১শ ৫৫টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১ হাজার ১শ ১২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৭৭টি মাদ্রাসা রয়েছে।
এ জেলার শিক্ষিতের হার ৫০ শতাংশের ওপর।
বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিতে পালাগান, যাত্রাগানের চল সেই আদিকালের। এ অঞ্চলের ময়মনসিংহ গীতিকার পালাগানগুলো তিনশ বছরেরও বেশি পুরনো। তাছাড়া গারো, হাজংসহ অন্যান্য আদিবাসীর নিজস্ব নাচগান তো ছিলই। তবে ইংরেজরা তাদের অবসন বিনোদন ও ব্যবসায়িক সাফল্যের স্বার্থে এদেশে থিয়েটারের প্রচলন করে ১৭৬৩ সালের দিকে।
১৯০৪ সালের দিকে নেত্রকোনা সদরে প্রথম নূপুর যাত্রাদল প্রতিষ্ঠা লাভ করে। জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় এ অঞ্চলে নাটক এবং যাত্রাপালা দ্রুত বিকাশ লাভ করে।
১৯২৯ সালে ময়মনসিংহ থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে একটা রেললাইন মোহনগঞ্জতে এবং আরেকটি জারিয়া ঝানঝানইল পর্যন্ত বসানো হয়। সে সময় নেত্রকোনা রেলস্টেশনটি তৈরি হয়। ১৯৭০-এর ৯ সেপ্টেম্বর নির্বাচনী প্রচারণায় বঙ্গবন্ধু এই স্টেশনে যাত্রা বিরতি করে জনগণের উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন।
বর্তমানে এই রুটের ট্রেন লাইনের অবস্থা খুব খারাপ। একটি জরিপে ২০০৮-২০০৯ সালে ১শ বারের বেশি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে এ লাইনে।
আজ নেত্রকোনায় মুক্তিযুদ্ধের কথা দিয়ে এ জেলার শহীদদের স্মরণ করে শেষ করি। নেত্রকোনা শহরের মুক্তারপাড়ায় মগড়া নদীর ওপর নির্মিত সেতুটির নাম মুক্তিযোদ্ধা সেতু। ১৯৭১-এ এই সেতুতে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন এ্যাডভোকেট অকিল সেন, নিখিল সেন, হেম সেন, বদিউর রহমান মুক্তাসহ নেত্রকোনা শহর এবং তার আশপাশের শতাধিক মানুষ।
১৯৭১-এর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয়েছিল।
মহান মুক্তিযুদ্ধে নেত্রকোনা ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন ছিল। নেত্রকোনায় বর্বর পাকিস্তানী বাহিনীর ক্যাম্প ছিল ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে, আর টর্চার সেল ছিল বড়বাজারের সর্বমোহন বণিকের গদিঘরটি। নেত্রকোনার স্বাধীনচেতা মানুষদের ধরে এনে এসব জায়গায় অত্যাচার করে পরে বিভিন্নভাবে হত্যা করা হতো। নেত্রকোনায় মুক্তিযুদ্ধে ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন।
তাদের স্মৃতিতে শহরের সাতপাই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর নেত্রকোনা শত্রুমুক্ত হয়। নেত্রকোনার সকল শহীদের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিবেদন করা সকল মহাত্মাকে অন্তরের গভীর থেকে জানাই সশ্রদ্ধ ভালোবাসা।
নেত্রকোনা জেলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্নর নাম বালিশ মিষ্টি নেত্রাকনার প্রায় সব মিষ্টির দোকানে পাওয়া গেলেও গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভান্ডার এর বালিশই সেরা এবং আসল বালিশ মিষ্টি।
আটপাড়া উপজেলা নেত্রকোনার অন্তর্গত।
এটি সুন্দর সুজলা, সুফলা, শষ্যপূর্ণ একটি উপজেলার নাম। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ঐতিহ্যকে ধরে রেখেছে এ উপজেলা। আটপাড়া উপজেলার বুক চিড়ে চলে গেছে মগড়া, কংশ, ধলাই, বিশনাই নামের নদী। বিশনাই-র তীরেই বেড়ে উঠেছে আমার শৈশব ও কৈশোর। আর নেত্রকোনার বুক চিরে বয়ে গেছে "মগড়া"।
ঢাকা থেকে সড়ক পথে ১৫৯ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ জেলার সােথ লেগে আেছ জেলা নেত্রকোনা। এর উত্তরে মেঘালয়ের গারো পাহাড়, দক্ষিণে কিশোরগঞ্জ জেলা, পূর্বে সুনামগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা। কংস, সোমেশ্বরী, মগরা, ধলা প্রভৃতি এ জেলার প্রধান নদী। নেত্রকোনার বিভিন্ন জয়গায় ভ্রমণ নিয়ে কড়চার এবারের বেড়ানো।
বিরিশিরি আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি:
বিরিশিরি বাংলাদেশের নেত্রকোনা জেলার সুসং দুর্গাপুর থানার ঐতিহ্যবাহী একটি গ্রাম।
ইংরেজ শাসন আমলে স্থাপিত শত বছরের পুরনো বয়েজ ও গালর্স হাই স্কুল, সরকারী কালচারাল একাডেমী, সুমেশ্বরী নদী, সাগর দিঘী, দূর্গাপুর রাজবাড়ী, পুরাকীর্তি নিদর্শন মঠগড়, মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ আর দর্শনীয় স্খানগুলোর কারনে পর্যটকদের কাছে এটির যেথষ্ট সুনাম আছে। স্থানীয় অধিবাসীদের ৬০ ভাগ গারো আদিবাসী ৩০ ভাগ মুসলিম, বাকি ১০ ভাগ হিন্দু ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির।
জেলার দুর্গাপুর থানার বিরিসিরি ইউনিয়নে অবস্থিত আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার নানান নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এখানে। এখানে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয় ক্ষুদে জনগোষ্ঠীগুলোর বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
টংক আন্দোলনের স্মৃতিসৌধ:
১৯৪৬-৫০ সালে কমরেড মনি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত টঙ্ক আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। আদিবাসী সাংস্কৃতিক একাডেমি থেকে কিছুটা সামনে শোমেশ্বরী নদী পার হয়ে কিছু দূর এগুলেই চোখে পড়বে এ স্মৃতিসৌধটি। বর্ষা মৌসুমে শোমেশ্বরী জলে পূর্ণ থাকলেও শীত মৌসুমে নদীটি পায়ে হেঁটে পার হওয়া যায়। প্রতিবছর ৩১ ডিসেম্বর কমরেড মনি সিংহের মৃত্যু দিবসে এখানে তিন দিন ব্যাপী মনি মেলা নামে লোকজ মেলা বসে।
সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি:
জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় অবস্থিত সুসং দুর্গাপুরের জমিদার বাড়ি।
সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বর পঠকের বংশধররা এ বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। বাংলা ১৩০৪ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে জমিদার বাড়িটি একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলে তাদের বংশধররা এটি পুনর্নির্মাণ করেন। এ জমিদার বাড়িটি চারটি অংশে বিভক্ত। বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, আবু বাড়ি ও দুই আনি বাড়ি। জানা যায় ১২৮০ মতান্তরে ১৫৯৪ খ্রীস্টাব্দের কোনো এক সময়ে কামরূপ কামাখ্যা থেকে শোমেশ্বর পাঠক নামে এক ব্রাহ্মণ এ অঞ্চলে ভ্রমণে আসেন।
এখানকার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে এখানে থেকে যাবার পরিকল্পনা করেন। শোমেশ্বর পাঠক গারো রাজা বৈশ্যকে পরাজিত ও নিহত করে রাজ্য দখল করে নেন। সে সময়ে সুসং রাজ্যের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী ছিল আদিবাসী, যাদের অধিকাংশই আবার গারো। জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পূর্ব পর্যন্ত প্রায় তিনশ বছর তার বংশধররা এ অঞ্চলে জমিদারি করে।
সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি:
বিরিসিরি থেকে শোমেশ্বরী নদী পার হয়ে রিকশায় রানীখং গ্রাম।
এখানে আছে সাধু যোসেফের ধর্মপল্লি। রানীখং গ্রামের এ ক্যাথলিক গির্জাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯১২ সালে।
রাশমণি স্মৃতিসৌধ:
রানীখং থেকে বিজয়পুর পাহাড়ে যাবার পথে বহেরাতলীতে আছে হাজং মাতা রাশমনি স্মৃতিসৌধ। ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারি সংঘটিত কৃষক ও টঙ্ক আন্দোলনের প্রথম শহীদ ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেত্রী হাজং মাতা রাশমণির স্মৃতিকে স্মরণীয় করে রাখতে রাশমণি মেমোরিয়াল ট্রাস্ট এখানে নির্মাণ করেছে রাশমণি স্মৃতিসৌধ।
বিজয়পুর পাহাড়:
রাশমণি স্মৃতিসৌধ থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে বিজয়পুরে আছে চীনা মাটির পাহাড়।
এখান থেকে চীনা মাটি সংগ্রহের ফলে পাহাড়ের গায়ে সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট পুকুরের মতো গভীর জলাধার। পাহাড়ের গায়ে স্বচ্ছ জলাধারগুলো দেখতে চমৎকার। বিজয়পুরের সাদামাটির (চিনামাটি নামে পরিচিত) পাহাড়। কুয়াশার ভোরের সোমেশ্বরীর বিস্তীর্ণ লালচে চর আর টলটলে পানি মুগ্ধ করে সবাইকে। অপার্থিব এক সৌন্দর্য।
নেত্রকোনার হাওর:
জেলার মোহনগঞ্জ, মদন, খালিয়াজুড়ি, কলমাকান্দায় কম বেশি ৫৬ টি হাওর ও বিল আছে। শুস্ক মৌসুমে হাওরে চাষাবাদ হলেও বর্ষা মৌসুমে পানিতে পরিপূর্ণ থাকে। তখন এসব এলাকার একমাত্র বাহন হয় নৌকা। মোহনগঞ্জ শহর থেকে রিকশায় দিকলাকোনা গিয়ে এখানকার ডিঙ্গাপোতা হাওরে প্রবেশ করা যায়। এখান থেকে ইঞ্জিন নৌকায় করে হাওরের বিভিন্ন গ্রামে যাওয়া যায়।
বর্ষাকালে হাওরের গ্রামগুলো একেকটি ছোট দ্বীপের মতো মনে হয়।
কীভাবে যাবেন:
ঢাকা মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সরাসরি দুর্গাপুর যাবার বাস ছাড়ে। ভাড়া ১৮০-২০০ টাকা। নেত্রকোনা সদর থেকে দুর্গাপুর যাবার বাস সার্ভিস আছে। ঢাকা থেকে সরাসরি মোহনগঞ্জ যায় ঢাকার কমলাপুর থেকে বিআরটিসি ও মহাখালী থেকে নেত্র পরিবহন, রফ রফ পরিবহন, ইকোনো পরিবহনের বাস।
ভাড়া ১৭০-১৮০ টাকা। ময়মনসিংহ থেকে মোহনগঞ্জ লোকাল ট্রেন থাকলেও তা সঠিক সময়ে চলাচল করে না।
কোথায় থাকবেন:
দুর্গাপুরে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা হলো ইয়ূথ মেন খৃষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইএমসিএ-এর রেস্ট হাউস। এছাড়া এখানে ইয়ূথ ওমেন খৃষ্টান অ্যাসোসিয়েশন বা ওয়াইডব্লিউসিএ পরিচালিত আরেকটি রেস্ট হাউস আছে। এছাড়া দুর্গাপুরে থাকার জন্য সাধারণ মানের কিছু হোটেল আছে।
উল্লেখযোগ্য দু-একটি হলো- স্বর্ণা গেস্ট হাউস, হোটেল সুসং, হোটেল গুলশান, এসব হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আছে। হাওর অঞ্চলে থাকার কোনো ভালো ব্যবস্থা নেই। তাই হাওর ভ্রমণে গেলে মোহনগঞ্জ থানা শহরে থাকতে হবে। এ শহরে থাকার জন্য নিম্নমানের কিছু হোটেল আছে। এরকম দু-একটি হোটেল হলো স্টেশন রোডে হোটেল শাপলা।
আর একটি উল্লেখযোগ্য জায়গা হলো -
হজরত শাহ সুলতান রুমী (রহ.)-র মাজার শরীফ:
আল্লাহপাকের সানি্নধ্য লাভকারী আধ্যাত্দিক জগতের এক মহাশক্তির অধিকারী ছিলেন হজরত শাহ সুলতান কমরুদ্দীন রুমী (রহ.)। তিনি ইংরেজি ১০৫৩ সালে ইসলাম প্রচারের জন্য ১২০ জন সুফি-সাধক সহচর নিয়ে বাংলাদেশে আসেন। এর ১১৬ বছর পর ভারতের আজমিরে সুলতানুল হিন্দ হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রহ.) এবং ২৫০ বছর পর বাংলাদেশে হজরত শাহজালাল মুজাররদ ইয়েমেনি (রহ.) আগমন করেছিলেন। যে কারণে তিনি এই বাংলাদেশ তথা গোটা উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারকারী ব্যক্তি হিসেবে খ্যাত। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ভাগ ভাগ করে ইসলাম প্রচার করতে সুফি-দরবেশদের দাওয়াতি কাফেলা পাঠাতে লাগলেন।
একপর্যায়ে তিনি ৪১ জন অলি-দরবেশ নিয়ে চলে এলেন কোচরাজ বোকাই কোচের রাজধানী 'বোকাইনগর' হয়ে বর্তমান নেত্রকোনা জেলার মদনপুরে। এই মদনপুরে তখন হিন্দু সামন্তরাজ মদন কোচের শাসন কায়েম ছিল। এ সময় মদন কোচের শাসনাধীনে উল্লেখযোগ্য না হলেও যেসব মুসলমানের মদনপুরে বসবাস ছিল, তাঁদের খুব তুচ্ছতাচ্ছিল্য হয়েই থাকতে হতো সেখানকার হিন্দুদের অত্যাচারে।
রাজা মদন কোচ তাঁকে অবাধে ইসলাম প্রচারের সুযোগ দিলেন। আর এ সুযোগ গ্রহণ করেই হজরত শাহ সুলতান রুমী (রহ.) এবং তাঁর ভক্ত-মুরিদান ইসলাম প্রচার করতে লাগলেন।
তুরস্ক সাম্রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন শাহ সুলতান রুমী (রহ.)। সম্রাটের ছোট ভাই এবং সে দেশের একটি প্রদেশের গভর্নর হয়েও রাজ্য শাসন ও রাজকীয় ভোগবিলাস প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহপাকের সানি্নধ্যলাভের আশায় ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে জন্মভূমি তুরস্ক থেকে এসেছিলেন সুদূর বাংলা নামের এই ভূখণ্ডে_বর্তমান বাংলাদেশের এক প্রান্তসীমা নেত্রকোনা জেলার মদনপুর নামক গ্রামে। আজ এ গ্রামসহ সারা দেশেই বাঙালি জাতির শতকরা পাঁচজন ছাড়া অন্য সবাই সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলমান। মুসলমানদের এ সংখ্যাধিক্যের মূল কারণ কিন্তু তিনিই_হজরত শাহ সুলতান রুমী (রহ.)।
সুতরাং মনে করতে হবে, শাহ সুলতান রুমী (রহ.) ইসলামপ্রচারক হিসেবে এ দেশে পুরোধা।
এ নামের মর্যাদা ও সম্মান দেওয়া আজও পুরোপুরি শেষ হয়নি আমাদের। এই মহাপুরুষের জীবন ও কর্মের ওপর বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা হওয়া উচিত ।
তবে সৈয়দ মমিন উদ্দিন আহম্মেদ, মো. মতিয়ুর রহমান ফকির, মো. জালাল উদ্দিন ফকির, খন্দকার নুরুল হক, সাজ্জাদুর রহমান ফকির ও মাওলানা তাহের উদ্দিন আলাদাভাবে পর পর শাহ সুলতান রুমী (রহ.)-এর জীবনদর্শনের ওপর তথ্যসমৃদ্ধ লেখা ও বই প্রকাশ করেন। পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও গবেষক আলী আহমেদ আইয়ুব, ইসলামী চিন্তাবিদ-গবেষক মো. আবদুল করিম ও মাওলানা মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ খানও পৃথকভাবে নেত্রকোনা জেলা তথা বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলকে ঘিরে এই মহামনীষী শাহ সুলতান রুমী (রহ.)-এর জীবনীর ওপর মহামূল্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
আজ পৃথিবীর সর্বত্রই মুসলমানসমাজের সীমাহীন কল্যাণ সাধনকারী এসব পীর-অলির মাজার বলতেই তীর্থস্থান বা এক বিরাট দর্শনীয় জায়গা।
এসব মাজারে গিয়ে মানুষ জিয়ারত করে মনে সুখ পান এবং আনন্দ লাভ করেন। বিশেষ করে মুসলমান জিয়ারতকারীরা সেখানে মাজার জিয়ারত করে বিশেষ ফায়েজ ও বরকতপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন। তদ্রূপ হজরত শাহ সুলতান রুমী (রহ.)-এর মাজারে গিয়েও আজ প্রত্যহ শত শত মুসলমান তাঁর পবিত্র মাজার জিয়ারত করে সীমাহীন ফায়েজ ও বরকত লাভ করে আসছেন। কিন্তু আপত্তি শুধু এক জায়গায়_সেখানে শরিয়ত পরিপন্থী নামধারী কয়েকজন পাগল ও ফকির জমায়েত হয় এবং তারা মাজার প্রাঙ্গণে গাঁজার আসর বসিয়ে সাধারণ জিয়ারতকারীদের জিয়ারতের পরিবেশ বিনষ্ট করছে। দোয়া করি, মহান আল্লাহপাক জিয়ারতের এ রকম বিঘ্ন ঘটনা থেকে আমাদের জিয়ারতকারীদের উত্তরণের ব্যবস্থা করুন এবং মাজারকেও পবিত্র রাখুন।
....চলবে
রচনাকাল: ২০/১২/২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।