আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেত্রকোনা রোড, অথবা শেষ সকালের বিলাস -(১/২)

মরে বসে আছি, আর কিছু নাই...

(একমাত্র একজনই জানে এই গল্পটা কতটা সত্যি, আর বাকি সবার জন্য গল্প। জানি না সে এটা পড়বে কিনা। যদি পড়ো, কেকা,-তোমার সেদিনের সেই প্রশ্নটার উত্তর এই গল্পটার মধ্যে আছে। )
----------------------------------------------------------------
বাথরুম থেকে তোয়ালে জড়িয়ে প্রায় ভেজা গায়ে বেড়িয়ে এলো কেকা। এসিতে বেডরুমটা অনেক ঠান্ডা হয়ে আছে।

একটু শিউরে উঠে তোয়ালেটা বুকের কাছে আরেকটু চেপে ধরলো। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে টিপে টিপে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। আয়নাতে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকে ভ্রু কুঁচকে, চোখের কোনের দিকে তাকায়, তারপর নিজের দিকে তাকায়। তোয়ালেটা একটু ছেড়ে দিয়েই ভ্রুটা আবার কুঁচকে উঠে, তারপর লজ্জা পেয়ে বুকের কাছে তোয়ালেটা আরেকটু তুলে দাগটা ঢেকে দেয়। জামিলটা এখনও দুরন্ত।

বিয়ের প্রায় আট বছর হয়ে গেলো কিন্তু ওর দস্যুতা এখনও কমেনি। একটু হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে যেতে যেতে ঠোঁটের কোনটা ছুঁয়ে থাকে।

আবার নিজেকে আয়নায় দেখে কেকা। জাবিরের জন্মের পরে শরীরটা একটু ভারী হয়েছে, কিন্তু এখনও অনেকটা ছিপছিপে, খুব বেশী পরিবর্তন হয় নি। মাথার চুলে বাঁধা তোয়ালের ফাঁক দিয়ে কপালের কাছে ভেজা চুলগুলো লেপ্টে আছে, নাকের পাশে গালের পাশ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়তে পড়তে থেমে আছে।

তোয়ালেটা তুলে মুখের পানিগুলো মুছে নেয় কেকা, তারপর মাথার তোয়ালেটা খুলে চুলগুলো মেলে দেয়, মুছতে থাকে।

সকালের এই সময়টা কেকার একেবারে নিজের। জামিল অফিসে চলে গিয়েছে সেই সকালে। এরপর ছেলেকে রেডি করে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে বুয়া আসার আগে পর্যন্ত আর কিছুই করার থাকে না কেকার। মাঝে মাঝে এসময় বাজারে যায় কেকা, কাঁচা বাজার, সব্জী নিজ হাতে কেনে।

কখনো পার্লারে যায় বা ফোনে কথা বলে। আজ কোথাও যেতে ইচ্ছে করছিল না, সকাল থেকে অনেক আলসেমী করেছে। গুনগুন করে সুর ভাঁজতে ভাঁজতে আঙ্গুলের ডগায় একটু ক্রীম নেয়, তারপর খুব যত্ন করে চোখের নীচে, নাকের পাশে, গালে ঘষতে থাকে। সাজগোজ তেমন একটা করে না সে। এজন্য অবশ্য জামিলের বকা খেতে হয় মাঝে মাঝে।

কেকা এমনিতেই যথেষ্ট সুন্দরী, খুব বেশী সাজতেও হয় না। জামিলের প্রশংসা তো আছেই, মাঝে মাঝে অন্যদের চোখেও নিজেকে যাচাই করে নেয় সে নিজেকে।

আধাভেজা চুলগুলো পিঠের উপর ছড়িয়ে দিয়ে ট্রাউজারের সাথে একটা নীল টপ্‌স্‌ পরে নেয়, তারপর ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে বারান্দায় মেলে দিতে যায়। এদিকটাতে কিছুটা রোদ আসে, কিন্তু পাশের বিল্ডিংটা কয়েক ফুট দুরেই পৃথিবীটাকে সীমিত করে দিয়েছে। ফ্লাটটা কেনার সময় পাশের এই বিল্ডিংটা ছিলো না।

হঠাৎ একদিন ভুঁইফোড়ের মতো পতিত জলা যায়গাটাতে কালো কালো রড ঘিরে নিজের কঙ্ক্রিটের শরীরটা নিয়ে সশব্দে গজিয়ে উঠতে শুরু করলো। সশব্দে বাড়তে বাড়তে এই ফ্লাটটার ছোট্ট বারান্দাটার আলো বাতাস আটকে দিয়ে এখন কেমন সুনসান দাঁড়িয়ে আছে।
কাপড় মেলে দিয়ে ঘরে এসেই হঠাৎ যেন কিছুই করার থাকে না কেকার। বিছানার মাথার পাশ থেকে পানির গ্লাস নিয়ে চুমুক দেয়, বিছানার দিকে তাকায়, একটু নিচু হয়ে বেডশিটটা নিচের দিকে টানে। সোজা হয়, একটু হেঁটে পায়ের দিকের জানালাটার কাছে আসে।

ভারী পর্দায় হাত রাখে। টানতে গিয়ে আবার থেমে যায়। এই দিকটাতে এখনো বিল্ডিং তৈরী হয়নি, কিন্তু একটু পরেই একটা বস্তি। তিনতলার উপর থেকে বস্তির অনেকটা দেখা যায়। তারপর একটা কাঁচা রাস্তা, রাস্তার ওপাড়েই নীচু একটুকু একটা মাঠ, শুকনো সময়ে জেগে থেকে বস্তির শিশুদের চিৎকার করে খেলায় ভরে থাকে, আর তারপরেই আবার জলা।

জলার বুকে একটা হাউজিং কোম্পানির কতগুলো সাইনবোর্ড দূরে দূরে দাঁড়িয়ে জলের বুকে কচুরিপানার ফাঁকে ফাঁকে সুযোগ পেলেই ছায়া ফেলে। তারপর আরো দূরে ধুসর গাছপালার আড়াল নিয়ে একটা চওড়া পাকা রোড। রাস্তাটা কোথা থেকে কোথায় যেন গিয়েছে, অনেকটা অনেক আগে ফেলে আসা নেত্রকোনা রোডের মতো ফাঁকা, মাঝে মাঝে বড় বড় কতগুলো বাস চলে যায়। কাঁচের এপাশ থেকে শুধু যাওয়াটাই দেখা যায়, শব্দ শোনা যায় না। জামিল এই জানালাটা খোলা একেবারেই পছন্দ করে না, ও থাকলে কখনো খোলাও হয় না।

ওর নাকি বস্তির আর জলার গন্ধ নাকে লাগে।

বিছানার দিকে ফিরে হেঁটে আসে কেকা। মাথার কাছের টেবিলটায় গ্লাসটা রাখতে গিয়ে ল্যাপটপটার দিকে তাকায়। মাঝে মাঝেই নেটে বসে কেকা। কিছুক্ষন ফেসবুক, মেইল ঘাটাঘাটি করে।

ফেসবুকে অস্ট্রেলিয়ায় থাকা বোনের, তার বাচ্চাদের ছবি দেখে। দু’একজন বন্ধুও যে নেই, তাও নয়। তাদের ছবি দেখে, ষ্ট্যাটাস পড়ে, নিজে তেমন কিছু লিখে না। এসিটা অফ করে বিছানায় আধো-শোয়া হয়ে হাত বাড়িয়ে ল্যাপটপটা নেয় কেকা। অন করে নেট-এ গিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ ভাবে।

শুনশান বাসাটায় এসময়টায় তার দিকে তাকিয়ে থাকার কেউ নেই। আবার ল্যাপটপের মনিটরের দিকে তাকায়, আবার একটু ভাবে। তারপর মেইলটা ওপেন করে। এই মেইল আইডিটা তার একান্ত নিজস্ব, জামিল এটা জানে না। স্বামীর নামের সাথে নিজের নাম জুড়ে তৈরী করা নিস্পাপ ছোট্ট আইডিটার জানালা খুলে ওপাশে তাকায়।

ও জানে ওপাশে একটা পাগল সবসময়ে অনলাইন। ইনবক্সের মেইলগুলো দেখে। হুম্‌ম্‌, পাগলটা মেইল করেছে, দুটো মেইল। কেকার কাছে দুর্বোধ্য লাগে ওই মানুষটা এত ব্যস্ত থেকেও কিভাবে নক করার সাথে সাথেই সাড়া দেয়। নক করবে কি? -একটু ভাবে আবার, তারপরে একটা মেইলে ক্লিক করে।

ছোট্ট মেইল, কেমন আছো, খবর নেই কেন –দুটো প্রশ্ন। উত্তর না দিয়ে দ্বিতীয় মেইলটা খোলে। এটাও ছোট্ট, কিন্তু কথাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কেকা। আঙ্গুল দিয়ে ছুঁয়ে দেয় শব্দগুলো, “তোমাকে খুব মনে পড়ছে। কেমন আছো?”।

“ভালো আছি। তুমি কেমন আছো সাদমান?”-অস্ফুটে নিজে নিজে বলে কেকা। ঠোঁট নড়ে কি নড়ে না।

সাদমানের সাথে তার পরিচয় কবে থেকে? না পরিচয়ের কোন শুরু ছিলো না। পাশের বাসার পড়ুয়া ভালো ছেলে বড় ভাইয়াটা হঠাৎ করেই একদিন কেমন করে যেন নিজের সাথে কেকার একটা জগত তৈরী নিল।

না, ব্যাপারটা একদিনে হয় নি, কিন্তু তারা বুঝেছে হঠাৎই যখন কেকা ভার্সিটিতে। পড়ুয়া ছেলেটা সেদিন ছুটির সকালে নিজের ভার্সিটি ছেড়ে দেড়শো কিলোমিটার দুরের কেকার হলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থতমত হয়ে গিয়েছিল। নিজের নতুন কেনা বাইক দেখাতে, কেকাকে দেখতে, ঘুরতে? কেন? কেকার প্রশ্নের সামনে ভালো ছেলেটা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে হয়তো উত্তর ভাবছিলো। তখনকার ছটফটে কেকার হঠাৎই খুব মায়া পরে গেলো ছেলেটার উপর। বেচারাকে সেই উদ্ধার করলো।

তারপর সেই শুরু হলো। বাইকের পিছনে বসে নেত্রকোনা রোড ধরে ছুটে যাওয়া, কখনো কিশোরগঞ্জের পথে। সেগুলো ছিলো শুধুই ছুটে যাওয়া, তীব্র গতিতে বাতাস দুজনকে ছুঁয়ে যেত আর গল্প থেকে গল্প, কথা, অভিমান, স্বপ্ন দুজনকে জড়িয়ে ধরতো। কি যে দুরন্ত নিস্পাপ সেই ভালোবাসার দিনগুলো ছিল। অনেক স্বপ্ন দেখতে দেখতে তারা ব্রম্মপুত্র পার হতো ছোট নৌকায় করে।

ওপাশের কাশবনে হাত ধরে পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে সেই স্বপ্নের গাছে পাতা-ফুল বসাতো। বাসার ফার্নিচার কি রঙের হবে, ছেলে-মেয়ে কটা হবে, আগে ছেলে নাকি মেয়ে- তর্ক করতে করতে হেসে কেকা সাদমানের গায়ে ভেঙ্গে পড়তো। বিস্মিত মুগ্ধ চোখে সাদমান তাকিয়ে থাকতো অনর্গল কথা বলে যাওয়া কেকার দিকে। আবার বকা খেয়ে চোখ নামাতো, তারপর আবার তাকাতো, তারপর দুজনই হেসে ফেলতো। হ্যাঁ, তাদের সেইসব এডভেঞ্চারগুলোর কথাও ভাবে কেকা।

সেসময়ের তুলনায় সেগুলোতো এডভেঞ্চারই ছিলো। সারারাত সাদমানের বুকে মাথা রেখে লঞ্চের ছাদে একই চাদর দুজনে জড়িয়ে বসে চাঁদ দেখতো আর টুকটুক করে গল্প করত। মাঝে মাঝে হল ছুটি হলে বাসায় মিথ্যে বলে সাদমানের সাথে এভাবে লুকিয়ে বাড়ীতে ফিরতো কেকা। তারপর চাঁদ হেলে পড়ত, গুটিশুটি মেরে কেকাও কখন যে ঢলে যেত, ঘুম ভাংতো সেই সকালে পরম মমতায় জড়ানো দুটো হাতের মধ্যে সাদমানের রাতজাগা চোখের সামনে। ঘাট থেকে রিকসায় হুড তুলে অপরিচিত গন্ডিটুকু এগিয়ে দিত সাদমান, তারপর নিজ শহরের পরিচিত চোখ তাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই আবার সে ঢাকায় ফিরে যেত চুপি চুপি।

যতক্ষন না সে হলে পৌঁছে ফোন করতো, ততক্ষন বুকটা টিপটিপ করতো কেকার।

(চলবে...)

*************************************
আমার লেখা জীবনের প্রথম গল্প। কেমন হয়েছে জানি না। প্রকাশের দুঃসাহস দেখিয়েই ফেললাম। পাঠক যে কোন মতামত, সমালোচনা করতে পারেন।

পরেরবার সেগুলো মাথায় রাখবো।

(গল্পটা একটু বড় হয়ে যাওয়ায় দুই কিস্তিতে দিতে হচ্ছে)



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.