আহত যোদ্ধা। ছেলে যুদ্ধে গেছে কিংবা স্বামী গেছে যুদ্ধে। মনে শংকা। ভয়। হতাশা।
নিয়মিত খাওয়া নাই। পানি নাই। আবার মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের মাঝেও দরকার এক টুকরো হাসি। ক্লান্ত যোদ্ধাদের ক্লান্তি দূর করা দরকার। বেতার বাংলা থেকে জাগরণীর গান চলছে।
গান শুনে আর কতদিন? দরকার ভিন্ন স্বাদের কিছু। যা এনে দিবে নতুনত্ব কিছু। এমনই নতুনত্ব কিছু করতে গিয়ে বাংলার ইতিহাসে যোগ হলো যুদ্ধের নতুন এক ধারা। পাপেট শো এবং চরমপত্র।
বুকের মধ্যে মুক্তি থাকে
একদিন তারেক মাসুদ জোর করে একজন মানুষকে নিয়ে গেলেন তার এডিটিং ষ্টুডিওতে।
সেখানে মুক্তির গান নামে একটি চলচ্চিত্রের কাজ চলছে। তারেক মাসুদ বললেন- তিনি যাতে এর কিছু দৃশ্য দেখেন। দেখলেন- একাত্তরের কৃষক-রাজাকার এবং ইয়াহিয়া। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পুতুল দিয়ে তৈরী হয়েছে এই চরিত্রগুলো। যেখানে কৃষক ইয়াহিয়াকে বলছে- ‘তোমার হস্তরেখায় মরণরেখা স্পষ্ট দেখা যাইতাছে।
’ মুক্তিযোদ্ধা পুতুলটি বলছে, “বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধারা জন্ম নেয়। তারা থাকেন বাঙালীর বুকের মধ্যে। ”
এই দৃশ্যগুলো দেখেই কেদে দেন মানুষটি। জড়িয়ে ধরেন তারেক মাসুদকে। তার এই যুদ্ধের গল্প হারিয়ে গেছে ইতিহাস থেকে।
ধুলোপড়া স্মৃতি থেকে তারেক মাসুদ বের করে আনলেন অন্যরকম একটি যুদ্ধের গল্প এবং একজন যোদ্ধাকে।
হ্যা। তিনি অত্যন্ত পরিচিত একজন মানুষ। তিনি আমাদের পরিচিতজন মুস্তফা মনোয়ার। পুতুল দিয়ে এক অদ্ভুত যুদ্ধ করেন তিনি।
তার যুদ্ধের সময়টা হয় ২৫শে মার্চের আগে। ২৩ মার্চ তিনি যুদ্ধ শুরু করেন। তিনি তখন পাকিস্তান টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করতেন। অনেক চালাকী ও সাহসের সাথে তিনি সেদিন থেকে টেলিভিশনের সমস্ত অনুষ্ঠান বন্ধ ঘোষনা করেন। তারপর যুদ্ধের সময়কার পুতুল নিয়ে যুদ্ধ।
তিনি যখন শরণার্থী শিবির ঘুরলেন তখণ তার চোখ অশ্রুতে ভিজে গেলো। তিনি অনুধাবন করলেন মানুষ যেন হাসতেই ভুলে গেছে। এই মানুষগুলোকে তো হাসানো দরকার। তিনি অবশ্য ষাটের দশকেই পাপেট শোর জন্য জনপ্রিয়তা পেয়ে গেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।
মুস্তফা মনোয়ারের হাতে ছিল পুতুল। তাই তিনি চাইলেন পাপেট শো করেই মানুষের মুখে হাসি ফোটাবেন। কিন্তু পাপেট বানাতে তো অনেক কিছুর প্রয়োজন! তার তো কিছুই নেই। এরই মধ্যেই অনেকেই তার সঙ্গে যোগ দিলেন। তারেক আলী, সাইদুল আনাম টুটুলসহ আরও অনেকে।
তারাও খুব উত্তেজিত। আঠা, কাঠের গুড়া, সুতা, কাপড়, লেইস, রডসহ পুতুল বানানোর সব সরঞ্জাম জোগাড় হলো। এরপর জামা বানানো দরকার। জামাও এক দর্জি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা শুনে সানন্দে বানিয়ে দিলেন। সে সময় সেই দর্জি বলছিল- সারা জীবন বলতে পারবো আমি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধার সহযোগিতা করেছিলাম।
পুতুল তৈরী হলো, জামা-কাপড় তৈরী হলো। এই নিয়ে বারাকপুরে চলে গেলেন তারা। সেখানে শরণার্থী শিবিরে হাজির হলো মুস্তফা মনোয়ার এবং তার দল। কালো পর্দা উঠে গেলো। শরণার্থী শিবিরের অতংক মাখা মুখগুলোতে তখন অবাক হওয়ার ছাপ।
এর আগে তারা অস্ত্রের ডামাডোল দেখে অবাক হয়েছিল। এখন দেখছে অন্যরকম কিছু। এগুলোতো পুতুল!! এবং পুতুলগুলো তো কথাও বলছে!! এগুলো কি হচ্ছে!!!! রাজাকার এসে কৃষককে ভয় দেখালো। রাজাকারের পক্ষ নিয়ে খোদ ইয়াহিয়া চলে এলো। তাকে তাড়া করতে মুক্তিযোদ্ধা এলো।
মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে ইয়াহিয়া আর তার রাজাকার সঙ্গী ভয়ে জড়োসড়। শেষে সবাই মিলে ইয়াহিয়া আর রাজাকারকে ধরে পিটুনী। ঘোষক তখন বলে উঠত- ইয়াহিরে আর কে কে মারতে চায়? উপস্থিত জনতার চিৎকার আর হাসিতে মুখরিত হয়ে উঠত প্রান্তর। শুরু হলো হাসি, প্রাণ খুলে হাসি। চারিদিকে শুধু হাসির শব্দ।
হতাশা-আতংক-আহত মুক্তিযোদ্ধা সকলের মুখে তখন হাসি।
মুস্তফা মনোয়ার তখন চোখ বন্ধ করতেন। বুক ভরে নিশ্বাস নিতেন। এই তো চেয়েছিলেন তিনি।
কখনও কখনও গভীর আবেগেও ভাসাতেন তিনি।
যেমন-
রাজাকার: কইয়া দাও, মুক্তি কোথায়?
ইয়াহিয়া: কিধার মুক্তি হায়?
যে কৃষককে তারা এই প্রশ্ন করছিল। সেই কৃষক একটু এগিয়ে আসে। নিজের বুক চাপড়ে বলল, ‘এইখানে, এইখানে থাকে মুক্তি। বুকের মধ্যেই মুক্তি থাকে। ’
এ যেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি মুস্তফা মনোয়ারের একটি বার্তা।
আজীবনের বার্তা। তোমার থাকবে আমাদের অন্তরে। সারাজীবন। চিরকাল। যতকাল বাংলাদেশ থাকবে।
ততদিন মুক্তি থাকবে বাংলার প্রতিটি মানুষের বুকের মধ্যখানে।
বান্দার নাম এম আর মুকুল:
যুদ্ধের সময় যার কাছে একটি রেডিও ছিল সেই সেটি নিয়ে বসে থাকতেন। কারণ একটাই, চরমপত্র শুনবেন। চরমপত্র সারা মুক্তিযুদ্ধের মাসে ছিল জনপ্রিয় একটি অনুষ্ঠান।
অথচ চরমপত্র যেন একটি রূপকথার মতো হয়ে গেছে।
সকলের মুখে বলতে শুনি- একাত্তরের চরমপত্র ছিল সাধারণ মানুষের আশার বর্তিকা। ৮-১০ মিনিটের টেপ নিয়মিতভাবে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের ট্রান্সমিটার থেকে প্রচারিত হয়েছে। চরমপত্রের জনপ্রিয়তার কারণ একটাই- যিনি পাঠ করতে তার কন্ঠস্বর। এই অনুষ্ঠানে যিনি পাঠ করেছেন তিনি তার স্বাভাবিক কন্ঠ ব্যবহার করেন নাই।
চরমপত্র প্রথম পাঠ হয় ২৫ মে ১৯৭১।
সেদিন ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকী।
প্রথমদিনই বলে ওঠেন-
ঢাকা শহর ও নারায়ণগঞ্জ থেকে ভয়ানক দুঃসংবাদ এসে পৌছেছে। গত ১৭ এবং ১৮ মে তারিখে খোদ ঢাকা শহরের ছ’জায়গায় হ্যান্ড গ্রেনেড ছোড়া হইছে। ……….পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের দখলকৃত ঢাকা নগরীতে মুক্তিফৌজদের এধরনের গেরিলা তৎপরতা সামরিক জান্তার কাছে নিঃসন্দেহে এক ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদ বৈকি।
প্রথমদিন শেষ করেছিলেন এইভাবে-
না, না, তোমাকে ভয় দেখাবো না।
একবার যখন হানাদারের ভূমিকায় বাংলাদেশের কাদায় পা ডুবিয়েছো- তখন এ পা আর তোমাদের তুলতে হবে না। গাজুরিয়া মাইর চেনো? সেই গাজুরিয়া মাইরের চোটে তোমাগো হগ্গলেরেই কিন্তুক এই ক্যাদার মাইধ্যে হুইত্যা থাকোন লাগবো।
রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যরকম প্রাণ দিতো এই চরমপত্র। যিনি পাঠ করতে তিনি খুব ব্যাঙ্গাত্বক স্বরে এবং রণাঙ্গনের সর্বশেষ খবর পৌছে দিতেন সকলের কাছে।
আজকে বাংলাদেশের ৪০তম বিজয় দিবস।
অর্থাৎ বাংলাদেশের বয়স হয়েছে ৪০ বছর। ৪০ বছর আগে এই দিনে কি বলা হয়েছিল চরমপত্রে? চলুন দেখে নেই কিছু অংশ।
কি পোলারে বাঘে খাইল? শ্যাষ। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ। ঠাস্ কইয়্যা একটা আওয়াজ হইল।
কি হইলো? কি হইলো? ঢাকা ক্যান্টনম্যান্টে পিয়াজী সা’বে চেয়ার থনে চিত্তর হইয়া পইড়া গেছিল। আট হাজার আষ্টশ’ চুরাশি দিন আগে ১৯৪৭ সালে ১৪ই আগষ্ট তারিখে মুছলমান-মুছলমান ভাই-ভাই কইয়া, করাচী-লাহুর-পিন্ডির মছুয়া মহারাজরা বাঙ্গাল মুলুকে যে রাজত্ব কায়েম করছিল, আইজ তার খতম্ তারাবি হইয়া গেল।
বাঙালী পোলাপান বিচ্চুরা দুইশ পয়ষট্টি দিন ধইর্যাে বাঙাল মুলুকের ক্যাদো আর প্যাকের মাইদ্দে world-এর Best পাইটিং ফোর্সগো পাইয়া, আরে বাড়িরে বাড়ি। ভোমা ভোমা সাইজের মছুয়াগুলা ঘঁৎ ঘঁৎ কইরা দম ফ্যালাইলো। “ইরাবতীতে জনম যার ইছামতীতে মরণ”।
আতকা আমাগো চক বাজারের ছক্কু মিয়া ফাল্ পাইড়্যা উডলো, ‘ভাইসা’ব’, আমাগো চক বাজারের চৌ-রাস্তার মাইদ্দে পাথর দিয়া একটা সাইনবোর্ড বানামু। হেইডার মাইদ্দে কাউলারে দিয়া লেখাইয়া লমু, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গাল মুলুকে মছুয়া নামে এক কিছিমের মাল আছিল। হেগো চোটপাট বাইড়া যাওনের গতিকে হাজারে হাজারে বাঙালী বিচ্চু হেগো চুটিয়া-মানে কিনা পিপড়ার মতো ডইল্যা শেষ করছিল। এই কিছিমের গেনজামরেই কেতাবের মাইদ্দে লিইখ্যা থুইছে ‘পিপিলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে। ’ টিক্কা-মালেক্যা গেল তল, পিয়াজ বলে কত জল?
এইভাবে পাঠ করে চলতেন অসাধরণভাবে।
মানুষ তখন হাসতো। বলা হয় যুদ্ধের পর দুজন মানুষ বিখ্যাত ছিল। এক ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর দ্বিতীয় জন হলেন, এই চরমপত্র পাঠকারী।
মজার বিষয় হলো- ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বরই তিনি তার পরিচয় প্রকাশ করেন। সেটাও রস্বাত্বক করে করে।
এলায় কেমন বুঝতাছেন? বিচ্চুগো বাড়ির চোটে হেই পাকিস্তান কেমতে কইর্যার ফাকিস্তান হইয়া গেল? হেইর লাইগ্যা কইছিলাম, কি পোলারে বাঘে খাইল? শ্যাষে। আইজ থাইক্যা বঙ্গাল মুলুকে মছুয়াগো রাজত্ব শ্যাষ।
আইজ ১৬ ডিসেম্বর। চরমপত্রের শ্যাষের দিন আপনাগো বান্দার নামটা কইয়া যাই। বান্দার নাম এম আর আখতার মুকুল।
সত্যি কথা বলতে কি, আজ পর্যন্ত রেডিও কিংবা টেলিভিশনে এমন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়নি। প্রতিদিন গল্পের ছলে দুরূহ রাজনীতি ও রণনীতির ব্যাখ্যা করা ছাড়াও রণাঙ্গনের সর্বশেষ খবরাখবর অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে উপস্থাপন করতেন। এই অনুষ্ঠানে সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেছিলেন। তাই ভাষায় ছিল ঢাকাইয়া তথা বাঙ্গাল ভাষার ব্যবহার। এছাড়াও যথেচ্ছভাবে ব্যবহার হয়েছে বিভিন্ন আঞ্চলিকভাষা।
ইতিহাসে এই দুই যোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য করা হয়? এম আর আখতার মুকুল তো চলেই গেছেন পৃথিবী ছেড়ে। কিন্তু রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মুখে হাসি ফোটানো কাজে নিয়োজিত এই যোদ্ধাদের ভুলবে এ জাতি। কেউ না কেউ তো মশাল নিয়ে দৌড়াবে। যেই আলোতে দেখা যাবে মুস্তফা মনোয়ার এবং এম আর আখতার মুকুলকে। মুস্তফা মুনোয়ারের সেই পুতুল চরিত্রের মতো আমরা বলব- মুক্তি আমার বুকের মধ্যে।
বাংলার ভিন্নরমক এই যোদ্ধাদের প্রতি আমার সালাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।