আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলতি পথে আড্ডাঃ চুক্তিবাস্তবায়ন ও রাজনীতির টুকিটাকি প্রসঙ্গ

নীরব বয়ান

২ ডিসেম্বর ২০১০ পার্বত্য চুক্তির ১৩ বছর পূরণ হয়ে গেলো। তার পরের দিন অর্থাৎ গত ৩ নভেম্বর ছুটির দিন ছিল বলে ঐ দিন গ্রামে ঘুরতে যাচ্ছিলাম। যাবার পথে চুক্তিদিবস উদযাপন সম্পর্কে খবর জানার জন্যে খাগড়াছড়ি বাজার থেকে একটা ‘প্রথম আলো’ কিনে নিলাম। আমার গন্তব্য ছিল বাউমোছড়া। অনেক দূরে।

সেখানে যাওয়ার মূল উদ্দেশ্য হলো কিছু ঔষধি চারা সংগ্রহ করা। আর চলতি পথে যতদূর পারা যায় একটু আধটু ঘুরে বেড়ানো। মোটরবাইক নিলাম। মোটরবাইক নিলেও সেখানে মোটরবাইক নিয়ে পৌঁছানো যায় না। সেখানে মোটরগাড়ী চলার উপযোগী কোন রাস্তা নেই।

দুধুক ছড়াতে মোটরবাইকটা রেখে হেঁটে যেতে হয়। তবে সেদিন খাগড়াছড়িতে ফিরতে হবে এমন কোন তাড়া ছিল না। গ্রামে থাকবো এরকম প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছিলাম। চলতি পথে জোরমরমের শিবমন্দির এলাকায় চা পানের জন্যে একটি চা দোকানে থামলাম। সেই চা-এর আসরে সাধারণ মানুষের চুক্তিকেন্দ্রিক অসাধারণ ভাবনা ও রসবোধে সমৃদ্ধ কথাবার্তা উপভোগ করার সুযোগ হলো।

এ সুযোগটা পাওয়ার অন্যতম উপলক্ষ্য হলো আমার হাতে করে নেওয়া সেদিনের ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাটা। সে কথায় পরে আসছি। আমার চলতি পথে আমার সহযাত্রী হলো হাল্যাপেদা। প্রত্যেক নামের পেছনে এক একটা ইতিহাস থাকে। হাল্যাপেদা’র(বাংলায় মানে হলো ‘খালিপেটওয়ালা’)নামের পেছনের ইতিহাসটাও একটু বলে নিই।

সে ছোটবেলায় নাকি খুব বেশি পেটুক ছিল। সবসময় নাকি বলতো, “আমার পেট খালি, আমি কিছু খাবো”। খাবার নিয়ে মা-বাবাকে প্রায়ই জ্বালাতন করতো। বিরক্ত হয়ে তার মা-বাবা নাম দিয়েছিলো হাল্যাপেদা। এখন সেটাই হয়ে গেছে তার আসল পরিচিতি।

এনজিওতে চাকরী করার সুবাদে খাগড়াছড়ি জেলার অনেক দুর্গম জায়গায় ঘুরার অভিজ্ঞতা আছে। বিভিন্ন মানুষের সাথে চেনা-জানা আছে। তাই সেদিনের চলতি পথে সে ছিলো আমার মূল পথপ্রদর্শক। আমি মোটরবাইক চালাচ্ছিলাম। ৫০-৫৫ কি.মি. বেগে।

পাহাড়ী রাস্তায় বেশি বেগে চালানো ঝুঁকিপূর্ণ । ৩০-৩৫ মিনিটের মধ্যে জোড়মরমের শিবমন্দির দোকানে পৌঁছে গেলাম। পানছড়ি থেকে আসা-যাওয়ার পথে সেখানে চা পান না করলে হাল্যাপেদার পেটের ভাত হজম হয় না। সেখানে পৌঁছামাত্র সে বলে উঠলো, “অডঙ, থাম, থাম, চা খেয়ে নিই। এখানে খাঁটি গরু দুধের চা পাওয়া যায়”।

‘না’ করতে পারলাম না। একপাশে মোটরবাইকটা দাঁড় করিয়ে রাখলাম। হেলমেটটা মোটরবাইকের হাতলে ঝুলিয়ে দিলাম। হাল্যাপেদা নেমে ধপ্ ধপ্ করে একটা চা দোকানে প্রবেশ করলো। তার পিছু পিছু আমিও গেলাম।

শিবমন্দির এলাকাটা আমার অপরিচিত নয়। তবে আগের মত এ পথে আনাগোনা হয় না। আগে এতগুলো দোকান ছিল না। মন্দিরের কারণে এলাকাটা সাধারণ মানুষের কাছে সুপরিচিত ছিল। একসময় ঘটা করে শিবমেলা বসতো।

দোকানে ঢুকে দেখলাম, কেবল চা নয়, চা-এর সাথে অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীও বিক্রি করা হয়। তবে চা খাইয়েদের জন্যে দোকানের একপাশে আলাদা করে বেঞ্চ বসানো হয়েছে। হাল্যাপেদা চা-এর অর্ডার দিচ্ছিলো, আর আমি একপাশে খালি বেঞ্চে বসে গেলাম। বেশ কিছু লোক বসে বসে চা খাচ্ছিলো। আর বিড়ি টানছিলো।

সবাই পুরুষ। মনে মনে ভাবছিলাম, এটা কী ইতিবাচক পরিবর্তন নাকি নেতিবাচক পরিবর্তন? গ্রামের চাকমারাও এখন চা পানে আসক্ত হয়ে পড়েছে! দোকান দেখাশুনা করছিলেন একজন মধ্যবয়সী মহিলা। একদিকে টাকা গুণে নিচ্ছিলেন, অন্যদিকে চা-এর অর্ডার এলে কর্মঠ হাতে তৎক্ষণাত চা বানিয়ে দিচ্ছিলেন। বেশ দক্ষতার সাথে দোকানটা চালিয়ে নিচ্ছেন বলে মনে হলো। চা-এর অর্ডার দেওয়া শেষ হলে হাল্যাপেদা পাশে এসে বসলো।

চা-এর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। এর ফাঁকে হাতে করে নেওয়া ‘প্রথম আলো’ পত্রিকাটা বের করলাম একটু পড়ার জন্যে। পত্রিকা খুলতেই আরো দু’তিন জন লোক আমার কাছে এসে গা ঘেঁষে বসলো। কেউ কেউ উঁকি মেরে পড়ার চেষ্টা করছিলো। প্রথমে সম্পাদকীয় পড়ে নেওয়া আমার অভ্যাস।

তাই ভেতরের পাতাগুলো হাতে রেখে প্রথম পাতাটা একজনকে দিয়ে দিলাম। পত্রিকা হাতে নিয়ে সে পড়তে লাগলো। :চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনের ঘোষণা দিলেন সন্তু লারমা। ঐ লোকটা সংবাদ শিরোনামটা পড়েই বলে উঠলো, “দেখো, দেখো, সন্তুবাবু আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন”। বেঞ্চের শেষ মাথায় বসে থাকা মধ্যবয়সী লুঙ্গিপড়া একলোক বিড়ি টানতে টানতে বললো, :গুদুঙ্যা, একটু জোরে জোরে পড় তো।

আমরাও শুনি। সন্তুবাবু কী বলেছেন। গুদুঙ্যা পড়তে লাগলো, :পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সভাপতি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় (সন্তু) লারমা। ‘স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এ চুক্তি বাস্তবায়িত হবে না’ - এ মন্তব্য করে গতকাল তিনি বলেছেন, আন্দোলনের মাধ্যমে চুক্তিবাস্তবায়নে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। গুদুঙ্যা সংবাদটা পুরো পড়ে শেষ করতে পারেনি।

লোকটা বলে উঠলো, :সন্তুবাবু তো অনেক দিন ধরে আন্দোলনের হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছেন। কই এতদিন কী ‘ফেদা’(কাজের কাজ) করতে পেরেছেন? ঐ লোকটার মুখে কয়েকটা কাঁচাপাকা মোস আর দাঁড়ি। পরনে কাদায় গাব ধরা ময়লা জামা। চাকমা ভাষায় ‘ফেদা’ শব্দটা খুব অবজ্ঞা অর্থে ব্যবহার করা হয়। ঐ লোকটার মুখ থেকে কেন ‘ফেদা’ শব্দটা বের হলো জানতে খুব ইচ্ছে হলো।

না, কোন কথা জিজ্ঞেস করলাম না। নীরবে শুনে যাচ্ছিলাম কে কী বলছিল। টেবিলের অন্যপাশে আরো একজন বলে উঠলো, :ঝুঙঙো, তুমি কী বলো? সন্তুবাবু, ফাদাবাজত বিজে বাজেইয়্যা, চাট্টেই ন পারেল” (সন্তুবাবুর অন্ডকোষ ফাঁটাবাঁশের দুই চিলতের ফাকেঁর মধ্যে আটকে গেছে। এখন নড়াচড়া করতে পারছেন না)। এই কথার সঙ্গে সঙ্গে অন্যারা হো হো করে হেসে উঠলো।

কথা শুনে বুঝা গেলো ঐ লোকটা চাকমাদের কুরোকুট্যা গোজার। অবশ্য জোড়মরম এলাকায় অনেক কুরোকুট্যা গোজার লোক বসবাস করে। হাল্যাপেদা একসময় এ এলাকায় চাকরী করেছিল। তাই তাকে জিজ্ঞেস করলাম ঐ লোকটার নাম জানে কি না। বললো, ওর নাম হলো ভুদা।

ভুদার কথাটা বড্ড বেশি অমার্জিত শোনালেও সেখানে এক রুঢ় সত্য লুকিয়ে আছে। মুখ না খুলে পারলাম না। ভুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, : বা’জি, চাকমা প্রবাদ “ফাদাবাজত বিজে বাজনা” (ফাঁটা বাঁশে অন্ডকোষ আটকে যাওয়া)মানে কী? ভুদা হে হে করে হাসি দিয়ে বললো, :বাবু, চাকমারা কেন যে এ কথাটা বলে আমিও বুঝিনা। ফাঁটা বাঁশে কীভাবে মানুষের অন্ডকোষ আটকে যায় সেটা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়। তবে কোন মানুষ যখন এদিকেও যেতে পারে না, ওদিকেও যেতে পারে না, তখন সেই অর্থে চাকমারা এ কথাটা প্রয়োগ করে থাকে।

দেখো না, সন্তুবাবুর অবস্থা। চুক্তি করে কী বিপদে আছে। সরকার তা বাস্তবায়ন করছে না। সন্তুবাবু এখন না পারছেন চুক্তিটা বাদ দিতে, না পারছেন বাস্তবায়ন করতে। এর চেয়ে মনোকষ্ট কী আর হতে পারে বলো? ভুদা কী বলতে চাচ্ছিলো তা বুঝতে অসুবিধা হলো না।

কিন্তু চুক্তির ব্যাপারটা কী কেবল সন্তু লারমার একার বিষয়। সরকার ও জনগণের কী কোন করণীয় নেই? ভুদার অভিমত জানতে জিজ্ঞেস করলাম, :আচ্ছা বা’জি, বলেন তো, চুক্তি কী কেবল সন্তু লারমার একার বিষয়? চুক্তি বাস্তবায়ন বিষয়ে আমাদের জনগণের কী কোন দায়িত্ব নেই? :বাবু, তোমরা শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতারা যা মনে করো সেটার বাইরে আমাদের বলার কী আছে, করার বা কী আছে? আমরা তো রাজনীতি বুঝি না। ভুদা এখন কথাটা একটু ইতস্তত: করে বললো। প্যান্ট-শার্ট ও জুতা পরা ভদ্রলোক দেখে ভুদা বোধয় আমাকে কোন রাজনৈতিক দলের কর্মী ভেবেছিল। তাকে অভয় দিয়ে বললাম, :বা’জি, আমি কোন নেতা নয়, কোন রাজনৈতিক দলের সাথেও জড়িত নেই।

আপনার মত আমিও খেটে খাওয়া মানুষ। রাজনীতি করি না। যা আলাপ করছেন তা শুনতে বেশ ভাল লাগছে। কেবল রাজনৈতিক নেতাদের উপর রাজনীতি ছেড়ে দিলে তো হবে না। আমাদেরও আমাদের মত করে রাজনীতি সম্পর্কে ভাবতে হবে।

আর আলোচনা করতে তো কোন অসুবিধা নেই। নির্ভয়ে কথা বলে যান। ভুদা মাথায় হাত বুলিয়ে চা-এর কাপে এক চুমুক দিলো। বললো, :বাবু, যা দিনকাল পড়েছে, মেপে মেপে কথা বলতে হয়। চর্মমুখে জিহবাটা নাড়ালেই অনেক কথা বের হয়ে যায়।

কিন্তু জিহবা নাড়াতে গেলে অনেক সময় বিপদে পড়তে হয়। আমার বদ অভ্যাসটা এখনো ছাড়তে পারিনি। অনেক সময় বেফাঁস কথাবার্তা বলে ফেলি। ভুদার কথা শুনে হাল্যাপেদাও আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সে বললো, :ভুদা কাকু, আপনিও কী যে বলেন!আপনি হলেন এ এলাকার মুরুব্বি।

আপনার ভয় কিসের? :আরে ভাইপুত, তুমি কী বলো? রাজনৈতিক নেতারা তো এখন মুরুব্বিদের মাথার উপর চিদোল (এক ধরনের শুটকি)পুড়ে খাচ্ছে। আমরা মুরুব্বি নয়, ওরাই এখন আমাদের মুরুব্বি। :ভুদা কাকু, আপনার কথা একদিক থেকে ঠিক। গায়ে মানে না আপনি মোড়ল। জনগণ না মানলেও আমাদের নেতারা মনে করে জাতির সব ভালোমন্দ কেবল ওরাই বুঝে।

এই বলে হ্যাল্যাপেদা আমাকে ভুদা কাকুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললো :ভুদা কাকু, এ হলো অডঙ বাবু। আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু। অত্যন্ত নিরিবিলি মানুষ। সে আপনার মাথার উপর ‘চিদোল’ পুড়ে খাবে না। একটু আধটু কলম চালায়।

ভয় নেই, নির্ভয়ে তার সাথে আলাপ চালিয়ে যেতে পারেন। :ওহ তাই?ঠিক আছে। এই বলে ভুদা কাকু চা কাপে এক চুমুক দিলো। ওদিকে দোকানের কার্নিসের নীচে দাঁড়ানো আরো এক লোক চুপচাপ করে বিড়ি টানছিলো। আর আমাদের কথাবার্তা শুনছিলো।

দা হাতে কোথাও যাচ্ছিলো বোধয়। চলে যাওয়ার সময় স্বগতোক্তির মত করে বলে উঠলো, :দূর! ‘মান্যা’ ‘ন-মান্যা’ (চুক্তির পক্ষ-বিপক্ষ)নেতাদের কথা বললে তো আফসোসের সীমা নেই। নিজেরাই মারামারি করতে করতে জাতিকে ধ্বংস করে ফেললো। চাকমা ভাষার একটা প্রবাদ আওড়িয়ে সে আরো বললো, :বান্দর কবাল টারেঙত, গুইয়ো কবাল সুরুঙত (বানরের বসবাস বন বাদাড়ে, গো-সাপের বসবাস সরু গর্তে)। ওই নেতাদের দিয়ে আমাদের মত খেটে খাওয়া মানুষদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে না।

চুক্তি বাস্তবায়ন হলে কী, আর পূর্ণস্বায়ত্তশাসন হলে কী?চুক্তি পূর্ণ বাস্তবায়ন হলেও সন্তুবাবুরা বিনাপয়সায় একবেলা ভাত খাওয়াবে না। আর পূর্ণস্বায়ত্তশাসন হলেও প্রসিতবাবুরা এসে আমার ধানক্ষেতে একবেলা আগাছা পরিস্কার করে দেবে না। যাই, আমার কাজে আমি যাই। কথা শেষ করতে না করতেই লোকটা বিড়িতে বড় একটা টান দিলো আর বিড়ির শেষ মাথাটা টুপ্ করে তিন আঙুলের মাথা দিয়ে ছুঁড়ে মারলো। তারপর ধোঁয়াটা মুখে কয়েক সেকেন্ড আটকে রেখে নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করতে করতে চলে গেলো।

লোকটার নাম কী জানা হলো না। ভাবছিলাম, গ্রামের সাধারণ মানুষ যাদেরকে আমরা অশিক্ষিত বলে মনে করি তারা কত স্বচ্ছন্দ্যে প্রবাদবাক্যগুলো ব্যবহার করে থাকে। আর সেগুলোতে লুকিয়ে আছে যুগ যুগ ধরে সঞ্চিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা। ঐ লোকটা কত স্বচ্ছন্দ্যে বানর আর গুই সাপের ভাগ্যের সাথে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ভাগ্যের তুলনা দিয়ে চলে গেল। লোকটার কথা একেবারে ফেলনা নয়।

একদিক থেকে চিন্তা করলে জেএসএস-এর চুক্তিবাস্তবায়নের সংগ্রাম কিংবা ইউপিডিএফ-এর পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের আহবান দু’টোই ঐ লোকটার মত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন। যাদের দৈনন্দিন জীবনের সিংহভাগ সময় কেটে যায় খাবার সংগ্রহ আর পরিবার পরিজন ভরনপোষণের চিন্তায়, তাদের কাছে চুক্তিবাস্তবায়ন কিংবা পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের কথা নিতান্তই পরিহাস শোনায়। চুক্তিবাস্তবায়ন, পূর্ণস্বায়ত্তশাসন এসব দুর্বোধ্য রাজনৈতিক শব্দ নিয়ে তাদের বোধয় মাথা ঘামানোর ফুরসত নেই। চুক্তিবাস্তবায়ন আর পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের নামে যারা মারামারি করে, পরস্পরের জীবন হরণ করে তাদের দিয়ে সাধারণ মানুষের সুখ আসবে, ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হবে এমন বিশ্বাস তারা মনের মধ্যে রাখতে পারে না। অন্তত ঐ লোকটার কথাতে তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রতিধ্বনি কী চুক্তিপন্থী কিংবা পূর্ণস্বায়ত্তশাসনপন্থী নেতাদের কানে পৌঁছায়? ঐ লোকটার কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চা কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম।

পত্রিকার পাতায় এদিক ওদিক চোখ বুলাচ্ছিলাম। এমন সময় গুদুঙ্যা একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো ভুদাকে, :ভুদা কাকু, সন্তুবাবু তো বলেই ফেললেন, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চুক্তি আর বাস্তবায়িত হবে না। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কী? প্রশ্ন শুনে ভুদা একটু নড়েচড়ে উঠলো। কী বলবে চিন্তা করছিলো বোধয়। ডানহাত দিয়ে বাম হাতের আঙুলগুলো ভাঙতে ভাঙতে বললো, :ভাইপুত, আমরা তো সাধারণ মানুষ।

অভিমত দেওয়ার কোন যোগ্যতা আমাদের নেই। মাঝে মাঝে যা বলি সেটা হলো স্রেফ ছোটমুখে বড় কথা। সন্তু বাবু নিজে বুঝেন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় না হলে অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াটা কী হবে। :সেটা কী আবার জঙ্গলে যাওয়া? মানে আবার অস্ত্র হাতে নেওয়া? ভুদা আর কোন উত্তর দিলো না। এক হাতে দুই আঙুলের ফাঁকে সানমুন সিগারেট জ্বলছে, অন্যহাতে চা কাপ।

মাঝে মাঝে চা কাপে চুমুক দিচ্ছে, আর সিগারেটে টান মারছে। সিগারেটের ধোঁয়াটা মুখে কুলিকুলি করার মত করে কিছুক্ষণ ধরে রেখে ফু করে উপর দিকে ছুঁড়ে দিচ্ছে। কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। :ভুদার কথার স্টক শেষ হয়ে গেলো না কী? ভুদার পাশে বসা আরো এক বয়স্ক লোক বলে উঠলো। :আরে না, ভেজালিবাপ।

সন্তুবাবু আর প্রসিতবাবুদের কথা উঠলে একটু চিন্তা করতে হয় বৈকি। এতক্ষণ চুপ করে চা পান করছিল ভেজালিবাপ। বয়স ষাটের উপরে হবে বলে মনে হলো। হাল্যাপেদার কাছে জানা গেল, ভেজালিবাপ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিল। একসময় জেএসএস-এর পক্ষে গ্রাম পঞ্চায়েতে কাজ করতো।

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের একজনও বটে। সে বললো, :এখন আমাদের পাহাড়ীদের রাজনীতি নিয়ে আলাপ করতে স্বস্তি পাই না। একসময় আমাদের পার্টির (মানে জেএসএস) নেতারা যখন পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক ইতিহাস, পাহাড়ীদের অধিকার নিয়ে আলাপ করতো তখন খুব মজা লাগতো। মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। গা শিহরণ দিয়ে উঠতো।

আর এখন শুনি, অমুক জায়গায় জেএসএস-র সমর্থকরা ইউপিডিএফ-এর সমর্থককে অপহরণ করেছে, খুন করেছে। ঠিক একই ভাবে, ইউপিডিএফ-র সমর্থকরা তমুক জায়গায় জেএসএস-এর সমর্থককে খুন করেছে, অপহরণ করেছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম ভ্রাতৃঘাতী হানাহানি, মারামারির কারণে পাহাড়ের রাজনীতির মজাটাই শেষ হয়ে গেছে। যা হোক, ঝুঙঙো আর ভুদা যেহেতু রাজনীতি নিয়ে আলাপটা ফেনিয়ে তুলেছে, সেহেতু গলায় সুড়সুড়ি লাগছে। দু-একটা কথা তো বলা যায়, তাই না? :হ্যাঁ, হ্যাঁ, জ্যাঠাবাবু।

আপনার মন্তব্য শুনতে পেলে সেটা হবে বোনাস। বললো গুদুঙ্যা। ভেজালিবাপ একটু বিনয়ের সঙ্গে বললো, :বাইরের দুনিয়া থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকি। কোথায়, কখন, কী ঘটছে আমিও বা কী জানি। সাধারণ জ্ঞানে যা দেয় তা বলতে পারি।

:নিশ্চয়ই। গুদুঙ্যা সমর্থন জানালো। হাল্যাপেদার দিকে তাকিয়ে ভেজালিবাপ আরো বললো, :আমার মনে হয় ঐ বাবুটা (অডঙ)বোধয় নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়ে। টাউনের লোক। অনেক খবরাখবর রাখতে পারে।

আগে তার মতামত শুনতে পেলে খুব ভালো হতো মনে হয়। মনে হলো ভেজালিবাপ আমাকে খোঁচা মেরে কিছু কথা বের করতে চাচ্ছিলো। আমি বললাম, :বা’জি, রাজনীতি সম্পর্কে আমি বোকা। আমাদের জুম্মদের হানাহানির রাজনীতি সম্পর্কে আরো বেশি বোকা। জেএসএস-ইউপিডিএফ-এর রাজনীতি আমিও বুঝি না।

বয়সে আপনারা অভিজ্ঞ। জীবনে অনেক কিছু দেখে আসছেন। আপনাদের থেকেই বরং আমরা অনেককিছুই জানতে পারবো। আপনারা কথা বলেন আর আমি যা বুঝি আপনাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে কিছু যোগ করবো। :তাই হোক।

এই বলে ভেজালিবাপ সন্তুবাবুর বক্তব্যের ব্যাপারে তার মন্তব্য জানালো, :সন্তু বাবুকে কাছে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাই তিনি ব্যক্তি হিসেবে কেমন জানিনা। তবে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তার কথা বার্তায় আরো আত্মপ্রত্যয়ী, বাকসংযমী এবং কৌশলী হওয়া উচিত। যে কথার দাম নেই সেই কথা বলে নিজের তথা তার পার্টির গুরুত্বকে হালকা করা কোনভাবে ঠিক নয়। হাল্যাপেদা আর গুদুঙ্যা ভেজালিবাপের কাছে সন্তুবাবুর ‘আত্মপ্রত্যয়ী, বাকসংযমী এবং কৌশলী’ হওয়া মানে কী তার ব্যাখ্যা চাইলো।

ভেজালিবাপের বিশ্লেষণটা ছিল এরকম, : সন্তুবাবুর আত্মপ্রত্যয়ী ও বাক সংযমী হওয়ার মানে হলো, যেটা তার দ্বারা সম্ভব নয়, সেইকথা তার বলা উচিত নয়। কেবল যেটা করতে পারবেন সেটা দৃঢ়তার সাথে বলা উচিত। ঐ যে, গুদুঙ্যা প্রথম আলোর সংবাদটা পড়ে শোনালো - স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চুক্তি বাস্তবায়ন হবে না। সন্তুবাবুর এ বক্তব্যের মানে কী? তিনি কী আবার জঙ্গলে ফিরে যাওয়ার কথা বুঝাচ্ছেন? তিনি তো এর আগেও বেশ অনেকবার অস্ত্র হাতে নেওয়ার হুমকী দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কী সেই বাস্তবতা ও প্রস্তুতি আছে?সন্তুবাবু যেটা করতে পারবেন না সেই কথা বললে তার নিজের ভাবমূর্তি যেমন নষ্ট হবে, তেমনি তার পার্টির গুরুত্বও কমে যাবে।

সেটা কখনো কাম্য হতে পারে না। আমার সাফ কথা হলো, কড়া কড়া কিছু বলতে হলে তিনি নিজে বলবেন না, দলের অন্য কাউকে দিয়ে সেটা বলাবেন। অন্যদিকে “কৌশলী” হওয়ার অর্থ হলো কঠিন ও অপ্রিয় সত্য কথা বলার সময় দেশের সার্বিক রাজনৈতিক অবস্থা, যেটাকে উনারা বলেন বুর্জোয়ারাজনীতি, এবং আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। এমনভাবে কথা বলা উচিত, যাতে “সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে”। সন্তুবাবুরা তো ভালো বুঝেন, বুর্জোয়া রাজনীতিবিদ, বুর্জোয়া আমলা ও বুর্জোয়া মিলিটারিদের যতই গালি দেওয়া হয়, ততই তারা জেদ ধরে।

বাংলাদেশের বুর্জোয়া আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র চুক্তিবাস্তবায়নে সহযোগিতা করছে না এটা তো বাস্তব সত্য। কিন্তু তাই বলে লাগামহীনভাবে বাগাড়ম্বর কথা বলে তাদের সাথে বিদ্যমান সম্পর্ক নষ্ট করে কী লাভ? সন্তুবাবুর বুঝতে হবে, একচেটিয়া রাষ্ট্র ক্ষমতা তার হাতে নেই, দেশে পরমত সহিষ্ণু গণতন্ত্র নেই। তাকে এ চরম সত্যটাও অনুধাবন করতে হবে, আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের সহযোগিতা ছাড়া কেবল সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা দিয়ে চুক্তিবাস্তবায়ন হবে না। তাঁকে বুঝতে হবে কীভাবে ঐ দুই তন্ত্র কাজ করে। ঐ দুই তন্ত্রের সহযোগিতা পেতে হলে তাকে অনেক অনেক কৌশলী হতে হবে।

আস্থার পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। ভেজালিবাপের কথাগুলো শুনছিলাম। মনে হলো তার যুক্তিগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মত নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কীভাবে দুই তন্ত্র কাজ করবে? ভেজালিবাপকে এ প্রশ্ন রাখলাম। সে বললো, :ভাইপুত, তোমার প্রশ্নটা যৌক্তিক।

কিন্তু এ প্রশ্নের কোন সহজ সরল উত্তর নেই। তবে প্রয়োজন বিভিন্ন দিক থেকে এ সমস্যার যথাযথ বিশ্লেষণ ও কার্যপদক্ষেপ। আঞ্চলিক পরিষদের নেতা হিসেবে সন্তুবাবু কীভাবে সমস্যাকে বিশ্লেষণ করেন জানিনা। তবে তার কথাবার্তা থেকে আমার যেটুকু মনে হয় সেটা হলো, তিনি রাজনৈতিক বিষয়ের উপর বেশি জোর দিচ্ছেন, আর সব সমস্যা সমাধানের জন্যে কেবল সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন। অন্যদিকে আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রকে পক্ষে আনার জন্যে, নিদেনপক্ষে তাদেরকে নিরপেক্ষ রাখার জন্যে তিনি কোন কার্যপদক্ষেপ নেননি।

অন্তত আমার চোখে তা ধরা পড়েনি। আমার মনে হয় এখানেই তার কৌশলগত সমস্যা। আমার সহজ বিশ্লেষণ হলো, সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও যদি আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র সহায়তা না করে তাহলে সেখানে চুক্তিবাস্তবায়ন হওয়া এত সহজ নয়। আর আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র যদি সহায়তা দেয় তাহলে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অর্জন সহজতর হবে। ভেজালিবাপের অংশগ্রহণে আলাপটা বেশ জমে উঠেছে।

গুদুঙ্যাকেও রাজনৈতিক আলাপে বেশ আগ্রহী বলে মনে হলো। ভেজালিবাপের কথার প্রেক্ষিতে সে বললো, :কিন্তু সন্তু বাবু তো বারবার অভিযোগ করে আসছেন আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র চুক্তিবাস্তবায়নে বাধা সৃষ্টি করছে। সরকার নির্দেশ না দিলে কীভাবে ওদের থেকে সহায়তা পাওয়া সম্ভব? ভেজালিবাপ এর মধ্যে একটা সিগারেট জ্বালালো। গোল্ডলিফ। সিগারেটে ছোট একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে বললো, :আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র বাধা সৃষ্টি করছেই বলে তো ওদের সহায়তার প্রশ্ন আসছে।

কিন্তু সরকার ওদের নির্দেশ দেবে মানে কী? সরকার বলতে কী কেবল প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রী-এমপিদের বুঝায়? আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রও সরকারের অংশ। সন্তু বাবুও তো এখন সরকারের অংশ। তাঁকে বুঝতে হবে, কেবল মন্ত্রী-এমপিদের নির্দেশে আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্র কাজ করে না। গতিশীল আমলাতন্ত্র ছাড়া মন্ত্রী-এমপিরাও অচল। বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রে একজন কেরানীর কেরামতিও অনেক।

কেরানীর কেরামতিতে অনেক ফাইল উপরে উঠে আর নীচে নামে, আর কখনো গায়েব হয়ে যায়। :সবই তো বুঝলাম। প্রশ্ন হলো, সন্তুবাবু কীভাবে আমলাতন্ত্র ও সামরিকতন্ত্রের সহায়তা পেতে পারে? গুদুঙ্যার প্রশ্ন। ভেজালিবাপের উত্তর, :এ প্রশ্নের এককথায় কোন উত্তর নেই। সে আরো বললো, :চাকমা ভাষায় একটা কথা আছে, গাছকে গাছ দিয়ে ধরতে হয়, বাঁশকে বাঁশ দিয়ে বাঁধতে হয়।

চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও তাই। নেতা হিসেবে এবং সরকারের অংশ হিসেবে সন্তুবাবুকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে চুক্তিবাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট যারা আছেন তাদের মধ্যে কাকে দিয়ে কাকে ধরবেন আর কাকে দিয়ে কাকে বাঁধবেন। এজন্যে তো তার কৌশলী হওয়ার প্রশ্নটা আসছে। জানিনা, তাদের পার্টির মধ্যে যথাযথ ফোরামে এ ব্যাপারে বিস্তারিতভাবে আলাপ-আলোচনা ও পর্যালোচনা হয় কি না; কখনো কোন কর্মকৌশল ও কর্মসূচী গৃহীত হয়েছিলো কী না। ভেজালিবাপের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ বেশ ভালো লাগছিলো।

এদিকে হাল্যাপেদা আমাকে মাঝে মাঝে খোঁচা মারছিলো কখন উঠবো। তাকে বললাম, আরো কিছুক্ষণ সময় নিলেও কোন ক্ষতি নেই। ভুদা কাকু এর মধ্যে উঠে চলে গেছে। “স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চুক্তি আর বাস্তবায়িত হবে না” সন্তুবাবুর এ বক্তব্যের ব্যাপারে গুদুঙ্যা ভুদা কাকুর কাছে তার মন্তব্য জানতে চেয়েছিলো। অথচ এতক্ষণ আলাপের পরেও সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্টভাবে আলাপ হয়নি।

তাই ভেজালিবাপের কাছে একই প্রশ্ন রাখলাম - চুক্তিবাস্তবায়ন সম্পর্কে সন্তুবাবুর বক্তব্যের ব্যাপারে তার মন্তব্য কী? ভেজালিবাপ একটু ভেবেচিন্তে প্রশ্নের উত্তর দিলো। তার উত্তরটা অনেকটা এরকম, :“স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় চুক্তিবাস্তবায়ন হবে না” বলতে সন্তুবাবু কী বুঝিয়েছেন জানিনা। তবে আমার মতে, অস্বাভাবিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে একটা হতে পারে আবার সশস্ত্র আন্দোলনে যাওয়া। কিন্তু এই বাস্তবতা তার হাতে নেই। আরো একটা বিকল্প প্রক্রিয়া আছে বলে মনে হয়।

সেটা হলো চুক্তিবাস্তবায়নে সরকারের কাছে আর দেন দরবার না করে ‘একলা চলো’ নীতি গ্রহণ করা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিকল্প জুম্ম সরকার গঠন করা। কিন্তু সন্তুবাবু দ্বিতীয় প্রক্রিয়াটার কথা বুঝাচ্ছেন কী না? :বিকল্প জুম্ম সরকার মানে কী? ভেজালিবাপকে একটু বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করলাম। সে বললো, : ব্যাপারটা একটু অদ্ভুদ শোনায় বটে। তবে আমি মনে করি সম্ভব। :কীভাবে? :জুম্মদের তো বিকল্প সরকার ব্যবস্থা ছিলো।

এখনো আছে কোন না কোনভাবে। এটাতে একটু পরিবর্তন আনলেই হবে। :রাজাদের নেতৃত্বে প্রথাগত শাসনব্যবস্থার কথা বলছেন? জিজ্ঞেস করলাম ভেজালিবাপকে। :অনেকটা তাই। তবে পরিবর্তিত একটি গণতান্ত্রিক হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থার কথা বলছি।

হাইব্রিড এই অর্থে প্রথাগত শাসনব্যবস্থারও ভূমিকা থাকবে, আর গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও ভূমিকা থাকবে। :একটু ব্যাখ্যা দেবেন কী? আবার প্রশ্ন করলাম ভেজালিবাপকে। ভেজালিবাপ তার ভাবনাটা বিশ্লেষণ করলো, :আমাদের জুম্মজনগণ সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আশায় সরকারি অফিসের বারান্দায় বারান্দায় গিয়ে খুব একটা ঘোরাঘুরি করে না। আগেকার দিনে করতোই না বললে চলে। অর্থাৎ বর্তমানের তথাকথিত সরকারের সাহায্য ছাড়া আদিবাসীদের জীবন চলতো, এখনো চলে।

এখনো এমন এমন এলাকা আছে, গ্রাম আছে সে জায়গাগুলোতে যারা বসবাস করে তাদের জীবনে কখনো বাংলা সরকারের সাহায্য বা সুবিধা যায় নি। তাদের কাছে ‘বাংলা সরকার’ একটি অর্থহীন শব্দ। তাদের কাছে এখনো আমাদের রাজা-হেডম্যান-কার্বারীরাই হলো সরকার। স্থানীয়ভাবে হেডম্যান কার্বারীরাই সামাজিক বিচার আচার ও সামাজিক শৃংখলা বজায় রাখেন। প্রথাগত শাসন ব্যবস্থার গুরুত্ব এবং ঐতিহাসিক ভিত্তি আছেই বলেই তো রাজা-হেডম্যান-কার্বারীদের ভূমিকা পার্বত্যচুক্তিতে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে।

এখন শুধু প্রয়োজন এই প্রথাগত শাসন ব্যবস্থার সাথে আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মধ্যে সমন্বয় সাধন করে আদিবাসী বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে সংগতি রেখে একটা হাইব্রিড শাসন ব্যবস্থা কায়েম করা। এ রকম আদিবাসী সরকার/শাসন ব্যবস্থা দেশের ভৌগলিক সীমারেখার মধ্যেই সম্ভব। কেননা, দেশের সংবিধান বলে দিয়েছে, যে কোন সংগঠনে একত্রিত হওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। আদিবাসীদের অধিকার আছে নিজেদের সরকার ব্যবস্থা নিজেদের নির্ধারণ করার। :জ্যাঠাবাবু, আপনার বিকল্প সরকারের ধারনাটা ঠিক ধরতে পারছি না।

গুদুঙ্যা বললো। :আরে না বুঝার কী আছে?যেমন জেএসএস-র উদাহরণটা দেখো। জেএসএস যখন জঙ্গলে ছিলো তখন তো ওরা নিজেরাই একটা সমান্তরাল সরকার পরিচালনা করেছিলো। গ্রামপঞ্চায়েত ছিলো, সেক্টর ছিলো, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগ ছিলো। গ্রামের লোকজন গ্রামপঞ্চায়েতের মাধ্যমে জেএসএস সরকারকে রাজস্ব দিতো।

ভূমি সংক্রান্ত বিরোধ কিংবা কোন গুরুতর সমস্যা দেখা দিলে যেগুলো গ্রামের কার্বারী বা হেডম্যানরা সমাধান দিতে পারতেন না সেগুলো জেএসএস-এর কাছে পাঠানো হতো। তখন তো ওরা এসব সমস্যার সমাধান করতো। তখন তারা একটা বিকল্প সরকার পরিচালনা করতে পারলে, এখন চুক্তি বাস্তবায়নের জন্যে সন্তুবাবু কিংবা জেএসএস কেন শুধু সরকারের দিকে তাকিয়ে আছেন? নিজেদের পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কেন নিজেরাই নিজেদের জুম্ম সরকার গঠন করতে উদ্যোগী হচ্ছেন না? যখন ওরা জঙ্গলে ছিল তখন তো আর্মি-বিডিআরের ভয় ছিল। এখন তো সে ভয় নেই। গণতান্ত্রিক পন্থায় শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনগণকে সংগঠিত করতে পারবেন।

ভেজালিবাপ আরো স্বগতোক্তির মতো বলে গেলো, :সরকার সন্তুবাবুকে বিশ্বাস করে না। সন্তুবাবুও সরকারকে বিশ্বাস করেন না। চুক্তিবাস্তবায়ন হবে কীভাবে? আমি ভেজালিবাপকে প্রশ্ন করলাম, :তাহলে এই বিশ্বাসহীনতার মধ্যে করণীয় কী? ভেজালিবাপ তৎক্ষণাত উত্তর দিলো :কবিগুরু রবি ঠাকুর বলেছেন, মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। এই পাপ হতে রক্ষা পেতে হলে অন্তত নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে সন্তুবাবুকে, আর জেএসএসকে। বেঈমান সরকারের সাথে গলাবাজি না করে নিজেদের জুম্ম সরকার গঠন করতে সন্তুবাবু আর জেএসএসকে গণমানুষের কাছে এখন ফিরে যেতে হবে।

গুদুঙ্যার প্রশ্ন করলো, :সন্তুবাবু কী গণমানুষের কাছে ফিরে যেতে পারবেন? ভেজালিবাপ শুধু মুচকি হাসি দিলো। সেই হাসির অর্থ বুঝা গেলো না। এর অর্থ ‘হ্যাঁ’ও হতে পারে, ‘না’ও হতে পারে। মনে মনে আমারও প্রশ্ন জাগলো, পার্বত্য রাজনীতিতে চুক্তিকে ঘিরে জেএসএস-ইউপিডিএফ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কেউ কাউকে ছাড় দেয় না।

তাদের নাছোড়বান্দা মারামারিতে পার্বত্য জনপদের গণমানুষের বিশ্বাস প্রতিনিয়ত ধর্ষিত হচ্ছে। এ পাপের প্রায়শ্চিত্ত কে করবে? হ্যাল্যাপেদা তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠলো, : কোন উত্তর নেই, কোন উত্তর নেই। কথারও শেষ নেই। চলো চলো। সময় চলে যায়।

বুঝলাম না, হাল্যাপেদা কার প্রশ্নের উত্তর দিলো। গুদুঙ্যার নাকি আমার মনের প্রশ্নের? চললাম দূর পাহাড়ের গন্তব্যে ঔষধি চারার সন্ধানে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।